মনি হায়দার। কথাসাহিত্যিক। টিভি উপস্থাপক। জন্ম ১৯৬৮ সালে। পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বোথলা গ্রামে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার-২০২১’। তার সাহিত্যচর্চা, পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে শনিবার (৩০ অক্টোবর) চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
চিন্তাসূত্র: কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পাচ্ছেন বগুড়া লেখক চক্র-২০২১ পুরস্কার। কেমন লাগছে আপনার? সাহিত্য পুরস্কার কি লেখককে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে?
মনি হায়দার: ধন্যবাদ। বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পেয়ে ভালো লাগছে। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক আছে। বগুড়া লেখক চক্রের পুরস্কার সেদিক থেকে মুক্ত। কথাসাহিত্য বিশাল অতলান্ত একটা ব্যাপার। আমাকে নির্বাচন করায় আনন্দিত! সাহিত্য যখন রচনা করতে এসেছিলাম, তখন তো এতসব ভাবনায় ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিভ্রমণে ত্রিশ বছরে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মনে হয়, প্রকৃত লেখকের পাঠকের অনুভব ছাড়া কোনো পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। আবার সাহিত্যের নানা সংগঠন যখন পুরস্কারে ভূষিত করে, তখন খারাপ লাগে না। ভেতর থেকে অনুপ্রেরণা অনুভব করি।
চিন্তাসূত্র: বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। এজন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?
মনি হায়দার: গোটা সিস্টেমকে দায়ী করি। কারণ, ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরস্কারে ক্ষমতার একটা নিকৃষ্ট প্রভাব থাকে। থাকে নিজের পছন্দ, স্বার্থের দুর্গন্ধ। আর পুরস্কার সবসময়ই বিতর্ক তৈরি করে। বিতর্ক ছাড়া পুরস্কারের সার্থকতা কোথায়?
চিন্তাসূত্র: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
মনি হায়দার: সার্থক লেখা প্রকৃতপক্ষে কী? কিভাবে নির্ধারিত হয় এই লেখাটি সার্থকতা? আমি যে লেখাকে সার্থক বলবো, আপনি বা অন্যরাও মানবেন? সুতরাং সার্থক লেখা বলে কিছু নেই। লেখা লেখাই। একজন প্রকৃত লেখক যখন লেখেন, তিনি সমস্ত সত্তার আলোকযাত্রায় নিবেদন করে লেখেন। হ্যাঁ, কারও পড়াশোনার ঘাটতি থাকতে পারে, অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে, তারা কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে, যাবে। লেখায় নিরন্তর সাধনা লাগে। আর লেগে থাকার ধৈর্য লাগে। যারা সাধনায় মগ্ন থাকেন না, তারা হারিয়ে যান ঝরা পাতার মতো।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মনি হায়দার: সমকালে অনেক তরুণ চমৎকার লিখছেন। বিচিত্র অনুষঙ্গে তরুণরা লিখছেন গল্প কবিতা প্রবন্ধ। বাংলা একাডেমি থেকে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হযেছে। আমি বিস্মিত, অসাধারণ চিন্তা ও আখ্যানের গল্প আসছে। গল্পকার হিসেবে কয়েকজনের নাম লিখছি, মাসউদ আহমাদ, কামরুল আহসান, হাবীবুল্লাহ ফাহাদ, ইশরাত তানিয়া, নাহিদা নাহিদ, নাহিদা আশরাফী, মৌরী তানিয়া।
চিন্তাসূত্র : বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
মনি হায়দার: যারা চৌর্যবৃত্তি করে, আমি তাদের ঘৃণা করি। যদি সাহিত্য রচনা করার ক্ষমতা না থাকে, আলু-পটলের ব্যবসা করুন কাওরানবাজারে, সাহিত্য চুরি করবেন না।
চিন্তাসূত্র : আপনি কি সাহিত্যে দশক বিভাজনে বিশ্বাস করেন? সাহিত্যে দশক বিভাজন কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? যদি বিশ্বাস করেন, তবে নিজেকে কোন দশকের বলে দাবি করেন?
মনি হায়দার: সাহিত্য সংস্কৃতি প্রবহমান ধারা। চলতে থাকে হাজার বছরের পরিচয় পরিচর্যা আর নির্মাণ প্রকৌশলের স্রোতধারা। সেই স্রোতধারাকে দশকের ক্ষুদ্র জালে আটকানো ঠিক না। একজন লেখকের শুরুর সময় হিসেবে দশক ব্যবহার করা যায়, সাহিত্যের বিচার হিসেবে কোনো যুক্তি নেই!
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
মনি হায়দার: না কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তবে অনেক লেখকের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, হই এখনো। হয়তো অনেকে নামই জানে না, তিনি আবুল কাসেম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছেন। দু বছর আগে অন্যপ্রকাশ থেকে আটশো পৃষ্ঠার উপন্যাস মৌর্য প্রকাশিত হয়েছে। অসাধারণ ঘটনা। দুই হাজার বছর আগের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর সময় কাল নিয়ে এমন উপন্যাস বিরল। মৌর্য ভারতের পত্রভারতী থেকে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে। ওরা ইংরেজিতে অনুবাদও করছে। কতজন খবর রাখি? পাবনার মোখলেস মুকুল চর্যাপদের সময় নিয়ে লিখেছেন ‘বঙ্গালী ভইলী’!
চিন্তাসূত্র: কী নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন?
মনি হায়দার: আমি দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে গতশতকের আশির দশকে ঢাকায় লঞ্চে এসে সদরঘাট নেমেছিলাম। সদরঘাটর সেই যাত্রা আমার এখনো চলছে। দক্ষিণাঞ্চলের হাজার মানুষ এখনো আসে, আসবে ঢাকায়। নামবে, নামে সদরঘাট। নদীপথের যাত্রা যাত্রী স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বিচিত্র উপখ্যান নিয়ে আমি এখন ব্যস্ত দীর্ঘ উপন্যাস মোকাম সদরঘাট লিখতে। আসছে বইমেলায় আসছে দুটি গল্পের বই ‘উজানগাওয়ের অমরনাথ এবং একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক নিয়েও সময় কাটছে। আবার বাড়তি বিতর্ক, উজানগাওয়ে চন্দ্রবিন্দু বসবে কি বসবে না নিয়ে।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাইবো। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা কি সঠিক পথে রয়েছি বলে মনে করেন?
মনি হায়দার: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সংবেদনশীল নান্দনিক চলমান ধারা। বিচিত্র প্রেরণায় আমাদের লেখকেরা লিখে যাচ্ছেন। বর্তমানে দাঁড়িয়ে প্রবহমান ভবিষ্যৎ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন। বাঙালি লেখক হিসেবে আশা রাখি, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি!
আরও পড়ুন : বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পেলেন ৫ জন