ড. রকিবুল হাসান—কবি-গবেষক-কথাকার। এই পর্যন্ত প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো, ‘বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন’, ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন’, ‘আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি’, ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’, ‘পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ’, ‘পথের কথা’, ‘গড়াই নদীর পাড়’, ‘পথে যেতে যেতে’, ‘সাহিত্যের নন্দনচর্যা’, ‘প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর-বাহির’, ও ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’। উপন্যাস: ‘জীবন দিয়ে ভালোবাসি’, ‘এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ’, ‘নবীরন’, ‘ভাঙন’, ‘ছায়াবন্দি’ও ‘অহনাবউ’। গল্পগ্রন্থ: ‘মেয়েটির চোখে শিশির জমেছিলো’, ‘প্রেমের বেলা নেই’।
কাব্যগ্রন্থ: ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত’, ‘ব্যর্থ ভয়ঙ্কর দৌড়ের কাছে’, ‘দেবতীদেউল’, ‘রহস্যস্বাক্ষর’, ‘রকিবুল হাসানের প্রেমের কবিতা’ ও ‘বুলবুলবেদনাকাব্য’।
পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষক। বর্তমানে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও গবেষণা অনুষদের ডিন। একইসঙ্গে বাংলা বিভাগের প্রধানও। সম্পাদনা করছেন ‘এনইউবি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকা’ও সাপ্তাহিক ‘অর্থবিত্ত’।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘লালন সাঁই পুরস্কার’, ‘কবি ওমর আলী স্বর্ণপদক’, ‘শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’, ‘স্যার সলিমুল্লাহ পদক’ ও ‘বাংলা সাহিত্য পদক’। সম্প্রতি ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’ গবেষণাগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন, ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য সম্মাননা’। সর্বশেষ সম্মাননাপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে তিনি চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন। এখানে তার কথোপকথনটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
চিন্তাসূত্র: দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করছেন সাপ্তাহিক ‘অর্থবিত্ত’। এই কাগজের মাধ্যমে আপনি নতুন কোনো ধারা তৈরি করতে পেরেছেন?
রকিবুল হাসান: ‘অর্থবিত্ত’ অর্থনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই বছরেই পত্রিকাটির বয়স দুই দশক অতিক্রম করেছে। অর্থনীতির মতো নিরস বিষয়ে খুব কম জনই লিখতে আগ্রহবোধ করেন। শিল্প-বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদ, ফিচার, বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন পত্রিকাটিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটি বিষয় সবসময় গুরুত্ব দিয়েছি, দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা-চিন্তা-ভাবনা-কর্মপন্থা বিষয়ক প্রতিবেদন তুলে ধরার চেষ্টাটা বেশি থাকে, যেন তরুণেরা তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হন, নিজেরা চাকরির পেছনে চেষ্টা না করে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তরুণ একটা উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হবে। এ চেষ্টাটি পত্রিকার শুরু থেকেই করে আসছি। আর একটা বিষয় বলি, আমি যেহেতু শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লেখালেখি করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়িয়ে থাকি, সে-কারণে পত্রিকাটিতে অর্থনীতির পাশাপাশি সাহিত্য রাখার একটা প্রয়াস থাকে।
চিন্তাসূত্র: আপনার কাগজ থেকে নতুন লেখক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন? না প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রকাশেই আপনি বেশি মনোযোগী?
রকিবুল হাসান: কিছু লেখক তো তৈরি হয়েছেই। অনেকে আছেন, তারা লিখতে চান বা গোপনে লেখেন, প্রকাশ করেন না। এ রকম অনেক লেখককে আমি আবিষ্কার করেছি। তাদের লেখা পত্রিকাতে ছেপেছি। এদের অনেকেই বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত লেখক। কেউ অর্থনীতি বিষয়ক, আবার কেই সাহিত্যে। আমি নতুন লেখকের লেখা ছাপতে বেশি আনন্দবোধ করি। তবে পত্রিকার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা তো ছাপতেই হয়। প্রতিষ্ঠিত ও তরুণ লেখক—সবার লেখাকেই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতে চেষ্টা করি। অনেক তরুণ লেখকেরই প্রথম লেখাটি আমার পত্রিকায় ছেপেছি। এর আনন্দ অন্যরকম।
চিন্তাসূত্র: সম্প্রতি ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি শুরু হয়েছে ওয়েব পোর্টাল। আপনি ছাপা সাহিত্য পত্রিকা বা ছোটকাগজ ও ওয়েবপোর্টালের মধ্যে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য দেখেন?
রকিবুল হাসান: দৈনিক পত্রিকা, ছোটকাগজ ও ওয়েব পোর্টাল—তিনটার ধারা তিন রকমের। সময়ের প্রয়োজনকে তো অস্বীকার করার উপায় থাকে না। ছাপা পত্রিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ছোটকাগজ তো একসময় শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার প্রকৃত জায়গা মনে করা হতো। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত অনেক কবি-সাহিত্যিক তো ছোটকাগজ থেকেই উঠে এসেছেন। ওয়েবপোর্টাল সাহিত্যের নতুন সংযোজন। এটা সময়ের দাবি। শৈল্পিকতায় ওয়েবপোর্টালগুলো প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। গতানুগতিক ধারাটা তারা ভাঙার চেষ্টা করছে। পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করছে। তরুণ লেখকদের সাহিত্যচর্চার অবাধ সুযোগও তৈরি হয়েছে। নতুন যেকোনো কিছুকেই সহজে কেউ গ্রহণ করতে চায় না। সে বিষয়ে কোন ধারণা বা আগ্রহ আগে থেকে থাকে না। সময়কে ধারণ করেই যেকোনো জিনিসকে গ্রহণ করে তুলতে হয়। সে জন্য চেষ্টা শ্রম মেধার প্রয়োজন হয়। ওয়েবপোর্টালও এর বাইরের নয়। ওয়েবপোর্টালগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে পাঠকের আগ্রহের জায়গাটি তৈরি করে নিতে পেরেছে বলে আমার ধারণা।
চিন্তাসূত্র: শিক্ষকতাকে অনেকেই লেখালেখির জন্য সহায়ক পেশা বলে মনে করেন। আপনার কী ধারণা? শিক্ষকতা আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে সহায়ক? না কি কখনো কখনো প্রতিবন্ধকও?
রকিবুল হাসান: শিক্ষকতা ও লেখালেখি দুটোই ব্রত বলে মনে করি। দুটোই সাধনার জায়গা। নিরবচ্ছিন্ন নদীর মতো বহমান। তবে শিক্ষকতা করলেই যে তিনি লেখক হয়ে উঠবেন, বা যিনি লেখক তিনি শিক্ষক হবেন—আমার কাছে ব্যাপারটি তা মনে হয় না। সাংবাদিকতায় থেকেও তো অনেকে বিখ্যাত লেখক হয়েছেন। এখনো অনেক সাংবাদিক আছেন, তারা সাহিত্যের শীর্ষ পর্যায়ের লেখক। ধরুন, এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে কত শত শিক্ষক আছেন, এদের মধ্যে লেখক ক’জন? আপনি নিজেও গুনে বলে দিতে পারবেন। আমাদের দেশে লেখালেখিকে এখনো পেশা হিসেবে গ্রহণ করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। দু একজনের ক্ষেত্রে হয়তো এ কথা প্রযোজ্য নয়। লেখককেও তো খেতে হয়—সংসার করতে হয়—সে কারণে তাকে একটা পেশা গ্রহণ করতে হয়। আমি পেশাগতভাবে জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতা করেছি। এখন শিক্ষকতা করছি। সাংবাদিকতা যে একদম ছেড়ে দিয়েছি, তাও নয়। আমার কাছে শিক্ষকতার চেয়ে সাংবাদিকতাকেই লেখালেখির জন্য বেশি সহায়ক মনে হয়। সাংবাদিকতার মাধ্যমে যে জীবনে যে বহুমাত্রিক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন হয়, তা শিক্ষকতায় সম্ভব নয়। একজন লেখকের জন্য ব্যক্তিক সেসব অভিজ্ঞতা মহামূল্যবান সম্পদ।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো গল্প-উপন্যাস-গবেষণা-কবিতা ও প্রবন্ধ, সমানভাবেই চর্চা করছেন। এরপরও জানতে চাইবো, কোন পরিচয়ে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
রকিবুল হাসান: আমার সবচেয়ে আবেগের জায়গা কবিতা। কবিতা লিখি বলেই হয়তো উপন্যাস গল্প প্রবন্ধ লিখি। কবিতা না লিখলে আমি হয়তো উপন্যাস ছোটগল্প প্রবন্ধ এসব কিছুই লিখতাম না। একটা ছোট কবিতায় যে গভীর জীবনবোধ তুলে ধরা সম্ভব হয়, একটি দীর্ঘ উপন্যাসেও তা সম্ভব নয়। আর প্রবন্ধ তো লিখি দায়বোধ থেকে—নিজস্ব চিন্তা-চেতনা প্রকাশের জন্য।
চিন্তাসূত্র: প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’-এর জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য সম্মাননা। সম্মাননা পেয়ে কেমন লাগছে? আপনি কি মনে করেন পুরস্কার-পদক-সম্মাননা লেখককে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে?
রকিবুল হাসান: প্রথমেই বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’ প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য আমাকে এ সম্মানে সম্মানিত করার জন্য। এ গ্রন্থটি মূলত আমার গ্রাম ‘কয়া’নির্ভর। এ গ্রামে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। এ গ্রামে বিপ্লবী বাঘা যতীন, সাহিত্যিক ললিতকুমার এবং ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের জন্ম। কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতৃভূমি এ গ্রামে। এ গ্রামের চ্যাটার্জি পরিবার ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিল। এ পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। একটি গ্রামের জন্য এটি একটা অসাধারণ ব্যাপার। আমার গ্রন্থটিতে এ ব্যাপারগুলো আছে। আর নিজের গ্রাম নিয়ে লেখা বই যখন পুরস্কার পায়, সে অনুভ’তি প্রকাশের সাধ্য আমার নেই। তবে একটি কথা বলা খুব প্রয়োজন মনে করছি, যাদের সঙ্গে আমাকে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, প্রত্যেকেই দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক। তাদের সঙ্গে আমাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন, আমার কাছে এটা বিরাট আনন্দের ও সম্মানের। পুরস্কারের তালিকায় কবি বিমল গুহ, কবি আসাদ মান্নান, কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ, বহুমাত্রিক লেখক তপন বাগচী, কথাশিল্পী ঝর্ণা রহমান, প্রাবন্ধিক ফরিদ আহমেদ দুলাল, কবি-কথাশিল্পী মজিদ মাহমুদ, কথাশিল্পী ইসহাক খান, অনুবাদক আমিনুর রহমান ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে নিজের নাম দেখে সত্যি বিস্মিত হয়েছি। অভাবনীয় এক আনন্দ ও অনুভূতি নিজের ভেতর অনুভব করেছি। আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই, আমাকে যারা এই সম্মান দিচ্ছেন, তাদের সবাইকে। কাজের স্বীকৃতি পেলে অবশ্যই ভালো লাগে। দায়িত্ববোধ বাড়ে। নিজের ভেতর নতুন করে স্পৃহা তৈরি হয়। আমার ভেতর সেটি এখন অনুভব করছি। তবে, পুরস্কার-পদক-সম্মাননা লেখকের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের মাপকাঠি বলে আমি মনে করি না। সমকালে কোন লেখক মূল্যায়িত নাও হতে পারেন, কোনো পুরস্কার-পদক-সম্মাননা নাও পেতে পারেন, তাই বলে তার সৃষ্টিসম্ভাব অগুরুত্বপূর্ণ বা ভবিষ্যতে মূল্যায়িত হবে না, এটা আমি মনে করি না। একজন লেখক প্রকৃতপক্ষে একজন সাধক, তিনি সাধনাটা করে যাবেন। সময় নিজেই একসময় তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কথা বলবে—সৃষ্টিকর্মে যদি সেই শক্তি তিনি বপন করতে পারেন। আবার পুরস্কার পেলেই যে একজন লেখক পাঠকের মনে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবেন, বা তার সাহিত্যকর্ম অসামান্য সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ—সেটিও বোধ হয় সর্বক্ষেত্রে মানা কঠিন। তবে প্রত্যেকেরই তার জীবদ্দশাতেই কাজের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। এতে তার সাহিত্যসৃষ্টিতে যেমন নব প্রবাহধারা তৈরি হয়, তেমনি সামাজিক সম্মানটাও বাড়ে। একজন লেখকের জন্য এটা খুব প্রয়োজন।