মামুন রশীদ, জন্ম ০২ আগস্ট ১৯৭৭। শৈশব-কৈশোর কেটেছে উত্তরবঙ্গের নানা জেলায়। প্রায় আধ ডজন স্কুল পাল্টিয়ে মাধ্যমিক। বাংলায় স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমবিএ।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বিশের বেশি। উল্লেখযোগ্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘কালোপাতা, ওড়ো, সাদাছাই’; ‘কুশল তোমার বাঞ্ছা করি’; ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’; ‘এই বইটির কোনো নাম দিবো না’; ‘আমি তোর রাফখাতা’; ‘যা কিছু লিখেছি সব সব প্রেমের কবিতা’। এছাড়া প্রবন্ধের বই, ‘ষাটের দশক: স্বাতন্ত্র্য ও বৈভবে’; ‘বাংলাদেশের কবিতা: সৃজনে অর্জনে’। ছোটদের গল্পের বই, ‘সুবজ বাড়ির ভূত’, ‘ভূতের সঙ্গে একদিন’। উপন্যাস, ‘টিটু মিলনায়তন’। অনুবাদ ‘মরক্কোর সমকালীন কবিতা’। জীবনী, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘ডিরোজিও’, ‘বেগম রোকেয়া’, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’, ‘মাদার তেরেসা’। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা, যুদ্ধস্মৃতি’। সম্পাদনা করেন ‘দ্বিবাচ্য’ নামের একটি সাহিত্যের কাগজ। এবার পেয়েছেন অনুবাদের জন্য ‘দোনাগাজী পদক-২০২১’। নিজের লেখালেখি ও পদক প্রাপ্তি নিয়ে মুখোমখি হলেন চিন্তাসূত্রের।
চিন্তাসূত্র: এবার অনুবাদের জন্য দোনাগাজী পদক পেলেন। কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
মামুন রশীদ: যেকোনো প্রাপ্তিই আনন্দের। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি অনুবাদে পুরস্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করেছে। যারা আমাকে মনোনীত করেছেন, তাদের এই ভালোবাসা আমার জন্য সম্মানের। আমি আনন্দিত। মধ্যযুগের কবি দোনাগাজীর নামে প্রবর্তিত এই পুরস্কার আমাকে খুশি করেছে, আনন্দিত করেছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো অনুবাদ ছাড়াও কবিতা, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্যও চর্চা করছেন। কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
মামুন রশীদ: অনুবাদ সখের জায়গা। তবে আমার মূল ক্ষেত্র কবিতা। এর সঙ্গে গদ্য। কবিতার তুলনায় আমার গদ্যের সংখ্যা বেশি। নানা বিষয়ে আমাকে প্রচুর গদ্য লিখতে হয়। পেশাগত কারণেও গদ্যের সঙ্গে আমার সখ্য বেশি। গদ্যে আমি স্বস্তিও পাই। আমার ভালো লাগা কবিতা, বা পছন্দের কবিদের কবিতা বিষয়ে গদ্যে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মত প্রকাশ করি। এটা আমার ভালো লাগে। এছাড়া সমসাময়িক নানা বিষয়ে সংবাদপত্রে উপ-সম্পাদকীয় লিখি। এটাও আমাকে আনন্দ দেয়। কারণ কবিতার বাইরেও আমার বলার আছে, আমি বলতে চাই। সেগুলোই উঠে আসে গদ্যে। আবার এমন অনেক বিষয় আছে, যা আমি বলতে পারি না, তাকে রূপকে ধরে রাখতে কবিতা আমার প্রিয় আশ্রয়। ছোটদের জন্য লিখতেও আনন্দ পাই। তবে সব পরিচয় শেষে আমি কবি পরিচয়েই পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
চিন্তাসূত্র: কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
মামুন রশীদ: প্রশ্নটি কবিতা লেখায় আগ্রহী মানুষের জন্য একটি জটিল। কেন জটিল? কারণ, কবিতা যিনি লেখেন, সে যে বয়স থেকেই লিখতে শুরু করুন না কেন, আমার মনে হয়, তিনি এই তাগিদ, মানে লেখার প্রেরণা ভেতর থেকেই অনুভব করেন। দীর্ঘদিন সেই তাগিদ, সেই প্রেরণা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে। যা থেকে তৈরি হয় একটি ঘোর। সেই ঘোর, সেই মোহগ্রস্ততাই একজন মানুষকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়।
ছেলেবেলা থেকেই কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগতো। সেই কবে, ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে, বা সন্ধ্যায় মায়ের কাছে বসে সুর করে পড়েছিম ‘পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল।/ কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল ॥/ রাখাল গরুর পাল, ল’য়ে যায় মাঠে।/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে ॥ / ফুটিল মালতী ফুল, সৌরভ ছুটিল।/ পরিমল লোভে অলি, আসিয়া জুটিল ॥ / গগনে উঠিল রবি, লোহিত বরণ।/ আলোক পাইয়া লোক, পুলকিত মন ॥ / শীতল বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর।/ পাতায় পাতায় পড়ে, নিশির শিশির ॥/ উঠ শিশু মুখ ধোও, পর নিজ বেশ।/ আপন পাঠেতে মন, করহ নিবেশ’॥ এই সুর, কথার মালা দিয়ে নিজেকে গেঁথে রাখার এই যে প্রবাহমানতা, আমার মনে হয়,এরকম ছোট ছোট নীতিকথামূলক কবিতা, যা আমি শৈশবে পড়ে এসেছি, তাই আমাকে পরবর্তী সময়ে লেখার দিকে এগিয়ে নিয়েছে। প্রতিবছর নতুন ক্লাসে ওঠার পর আমার আগ্রহ একটি বইকে ঘিরেই থাকতো। বাংলা সহজ পাঠ, বইয়ের পাতায় ঝকঝকে ছাপায় ফুটে থাকা কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়তাম। যেগুলো ভালো লাগতো, সেইসব কবিতা বারবার পড়তে থাকতাম। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই। বা ভোর হলো দোর খোল খুকুমনি ওঠোরে, ছিপখান তিন দাড় তিন জন মাল্লা; এরকম অসংখ্য পঙ্ক্তি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। আমি মনে করি, কবিতা লেখার আগ্রহের পেছনে এইসব পঙ্ক্তিমালা আমার পথ নির্মাণ করে দিয়েছে।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন প্রাবন্ধিকদের মধ্যে কার প্রবন্ধ আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
মামুন রশীদ: সমকালীন কথাটিই আমার কাছে স্পষ্ট না। কারণ এক্ষেত্রে যেমন আমার নিজের সময়ে লিখতে শুরু প্রাবন্ধিকের কথা বলা যায়। আবার আমার অনেক আগে লিখতে শুরু করেছেন, সময়ের ধারাবাহিকতা রেখে এখনো লিখছেন, তাদের কথাও বলা যায়। তবে আমি মনে করছি, আমার সময়ে লিখতে শুরু করা প্রাবন্ধিকদের নামের কথাই জানতে চাইছেন। এক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত শব্দটিকেও আমি সরিয়ে রাখতে চাই। কারণ, অনুপ্রেরণার জন্য আমি অগ্রজের কাছেই দ্বারস্থ হই। সমসাময়িকের চিন্তাকে আমি সম্মান করি, তার পথ বোঝার চেষ্টা করি। তার ভাষায় শব্দ প্রয়োগের কৌশল দেখি। আমার সময়ের মোহাম্মদ নূরুল হক, কাজী মুহম্মদ আশরাফ, মিজান রহমান, এমরান কবিরের গদ্য আমি আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি।
চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কবিতার আলোচনা করতে গেলে কোন কোন কবিকে এগিয়ে রাখবেন?
মামুন রশীদ: এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া সহজ। আমার সময়ের কবিদের অনেকেই খুব-খুব ভালো কবিতা লিখছেন। ভাষার ওপর তাদের ঈর্ষণীয় দক্ষতা। বর্ণনা কৌশল, কল্পনাশক্তি; এক কথায় চমৎকার। অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে। তাদের মাঝে ইমতিয়াজ মাহমুদ, জাকির জাফরান, চন্দন চৌধুরী, মোহাম্মদ নূরুল হক, অদ্বৈত মারুত, মাহমুদ শাওন প্রমুখের কবিতাকে এগিয়ে রাখবো।
চিন্তাসূত্র: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?
মামুন রশীদ: আঙ্গুর ফল টক, প্রবাদটি মনে পড়ছে আপনার কথায়। পুরস্কার নিয়ে যত কথাই প্রচলিত থাক, আমার মনে হয়, পুরস্কার পেলে ভালো লাগে। তখন প্রাপ্ত পদক, পুরস্কারকে খুব উঁচু দরের মনে হয়, আর না পেলে তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা সহজ হয়। পুরস্কার মানেই সম্মান, ভালোবাসা। সে যেখান থেকেই আসুক। যারা পুরস্কার দেন, তারা ভালোবেসেই দেন। ভালোবাসার কোনো বিনিময় হয় না।
চিন্তাসূত্র: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, করপোরেট পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সাহিত্যসংগঠনগুলো থেকে দেওয়ার পুরস্কারের মধ্যে আপনি স্পষ্ট কোনো পার্থক্য দেখেন? কোন পুরস্কারকে আপনার নিরপেক্ষ ও বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়?
মামুন রশীদ: নিরপেক্ষতার মানদণ্ড কী? আমি পেলে নিরপেক্ষ? আমি না পেলে অগ্রহণযোগ্য? সত্যিকার অর্থে আমি এভাবে বিচার করতে আগ্রহী না। যে পুরস্কারই হোক, তা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড, একটি নীতিমালা হোক তা অলিখিত, তবু থাকে বলেই মনে করি। করপোরেট পুরস্কারই হোক আর বিভিন্ন সাহিত্যসংগঠনেরই হোক, সবাই নিজেদের পছন্দ ও ভালোলাগাকে প্রাধান্য দেবেন, বা দেন; তেমনটাই হওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে তাদের রুচিবোধও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে বলে মনে করি। নিরপেক্ষ বা গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে নয়, পুরস্কার দিয়েও আমি মাপতে চাই না। আমার কাছে ভালো লাগাই প্রথম কথা। পুরস্কার কাউকে স্থায়ী করে না। কিন্তু ভালোলাগা স্থায়ী আসন তৈরি করে দেয়। পাঠকের ভালো লাগাই নিরপেক্ষ ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পুরস্কার।