আমিনুল ইসলাম—কবি-প্রাবন্ধিক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিকলীচর গ্রামে ১৯৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গদ্য, প্রবন্ধ ও কবিতায় সমানসিদ্ধহস্ত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য ২৬। কাব্যগ্রন্থগুলো:তন্ত্র থেকে দূরে-(২০০২); মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম-(২০০৪); শেষ হেমন্তের জোছনা(২০০৮); কুয়াশার বর্ণমালা (২০০৯); পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি-(২০১০); স্বপ্নের হালখাতা(২০১১); প্রেমসমগ্র-(২০১১); . জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার-(২০১২); শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ-(২০১৩); কবিতাসমগ্র-(২০১৩); জোছনার রাত বেদনার বেহালা : (২০১৪) ; তোমার ভালোবাসা আমার সেভিংস অ্যাকউন্ট ( ২০১৫) প্রণয়ী নদীর কাছে (২০১৬), ভালোবাসার ভূগোলে(২০১৭); নির্বাচিত কবিতা ( ২০১৭); অভিবাসী ভালোবাসা ( ২০১৮) , জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র (২০১৯) ( বাছাই কবিতা ( ২০১৯), প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ ( ২০২০), হিজলের সার্কিট হাউস(২০২১); রমনার কোকিল(২০২২)। প্রকাশিত ছড়ার বই : ১.দাদুর বাড়ি-(২০০৮); ২. ফাগুন এলো শহরে-(২০১২) ৩. রেলের গাড়ি লিচুর দেশ (২০১৫)। প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ: বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ-(২০১০)। প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ: নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব । ইতোমধ্যে তাকে নিয়ে ছোটকাগজ ‘পুনশ্চ’, ‘অদ্রি’, ‘পাতাদের সংসার’ ও ‘দৃষ্টি’ বিশেষ সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। আর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার, নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সম্মাননা , দাগ সাহিত্য পুরস্কার, কবিকুঞ্জ পদক, পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পুরস্কার। তার বর্তমান সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গবেষক-প্রাবন্ধিক-কবি হরিদাস ঠাকুর। ২৯ ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো।]
হরিদাস ঠাকুর: বলা হয়ে থাকে, কবিতার ইতিহাস হচ্ছে, টেকনিকের ইতিহাস। আপনার কবিতায় এই টেকনিকের কতটুকু প্রয়োগ করতে পেরেছেন?
আমিনুল ইসলাম: শুরুতেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার সাক্ষাৎকার আয়োজনের জন্য। একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই যে, কবিতার ইতিহাস টেকনিকের ইতিহাস হলেও শুধুই টেকনিকের ইতিহাস নয়; একইসঙ্গে বিষয়েরও ইতিহাস। বলা যেতে পারে, উৎকৃষ্ট কবিতা চিরকালই বিষয় ও শিল্পের সুসমন্বিত রূপ। সেই অভিজ্ঞান থেকে আমি নিজস্ব একটি কাব্যভাষা নির্মাণের চেষ্টা করে এসেছি। কতটুকু পেরেছি, তা পাঠক ও আলোচকদের দেখার ও রায় দেওয়ার ব্যাপার। আমার কবিতা পড়ে অনেকেই বলেছেন যে শব্দচয়ন, উপমা, চিত্রকল্প দেখে সহজেই বোঝা যায়, এগুলো আমিনুল ইসলামের কবিতা। আমার কবিতা থেকে ৩টি উদ্ধৃতি দিতে চাই, পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন আমি নিজস্ব কাব্যভাষা অর্জনে সক্ষম হয়েছি কি না:
১
যারা বিবেচক—যারা সৎ ও সংসারী
তারা কেনে মেপে কাঁচা মরিচের ঝাল
আমি গাঁজাখোর হাটভাঙ্গা হাটুরিয়া
ঘরে ফিরি চুমে বয়েসী চাঁদের গাল।মাতাল হরফে এঁকে দিয়ে যাই আমি
সাঁঝের উরুতে অবৈধ আলোর উল্কি
মর্নিং শিফ্টের ভিজিটিং প্রফেসর
বলে দেবে এই আলোআঁধারির ভুল কি।সুখের শরীরে বারোয়ারী এঁটো ঘ্রাণ
আমি চুমে যাই বেদনার গোল নাভি
তুমি দেখাওনি ব্যালান্স সীটের ভাঁজ
(এই তো জীবন/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগে)২….হায়, আমাদের
হাছন রাজা কই? তিনি কি ঘুমিয়ে গেছেন ঝাড়েবংশে?
এদিকে কদমতলায় কৃষ্ণের আসনে বসে জগতশেঠের নাতি;
তাকে পীর মেনে খোলাবুকে সারিবদ্ধ নীলক্ষেতের
একঝাঁক রঙিন যুবতী। ও ভাই যুবতী!
তোমরা বুকভরে কি নেবে গো?
এই বুঝি যক্ষযুগ ভক্তিতে ভরে না প্রাণ আর;
গণেশের মূর্তি গিলে গোগ্রাসে শিশুর আহার।
(বেদখল হয়ে যায় পরানের পার্ক/স্বপ্নের হালখাতা)৩.
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়,
দেখুন—
গরীরের ঘামে রোদ লেগে চিকচিক করছে ভ্যাট,
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাগটানা পথ ধরে
দিনদিন বেড়ে চলেছে করের পরিসীমা;
বাড়ুক্! শুধু এটুকু মিনতি—দয়া করে
আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না!
রাতরঙা ব্যাগহাতে এক্সটার্নাল অডিট যাক্ মেগা প্রজেক্টের বাড়ি!
(চুম্বন নিয়ে লেখা যে-কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক / ভালোবাসার ভূগোলে)
হরিদাস ঠাকুর: অনেকে বলে থাকেন, কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় নতুনত্ব ও অভিনবত্বের ছাপ পাওয়া যায়। আপনি এটিকে কিভাবে উপভোগ করেন বা দেখে থাকেন?
আমিনুল ইসলাম: অন্যের কবিতা যতই সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হোক, তাদের অনুকরণ বা অনুসরণ করে তো কবি হওয়া যায় না। যারা রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ-অনুকরণ করেছিলেন, তাদের নাম মুছে গেছে। কাজী নজরুল ইসলাম ভিন্নপথ অবলম্বন করেছিলেন বলেই সাহিত্যে-সংগীতে অমরত্ব লাভ করেছেন। তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব নিজেদের পথ নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন বলে তারা আজও সমিহমায় দীপ্তিমান। এই যে আপনপথ সৃষ্টি করা যাকে বলে প্রাতিস্বিকতা, আমি উপভোগ করি। সেজন্যই সবসময় নতুন সমাসবদ্ধ শব্দ, নতুন উপমা, নতুন চিত্রকল্প, নতুন ভাবনা, পুরাতন মিথ ও প্রচলিত বিশ্বাসকে ভিন্ন অর্থে, বিপরীত অর্থে ব্যবহারকরণ প্রভৃতির চেষ্টা করে থাকি। এটা একটা ইনটেলেকচুয়াল এডভেঞ্চার। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় আমাকে। নতুন বিষয় খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন । তারপরও আমি নতুন করে খুঁজি। প্রচলিত প্রেমভাবনার মাঝে আমি নতুন ভাবনা যোগ করার চেষ্টা করেছি। নদী নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছি। সেগুলো একেকটি একেক ভাবনাকে পরিস্ফুটিত করে তুলতে চেয়েছে। এসবই আমাদের গভীর আনন্দ দেয় এবং আরও আরও কবিতা লেখার প্রেরণা জোগায়।
হরিদাস ঠাকুর: কবির কাব্যচর্চা একটি সুকঠিন সংগ্রাম। আপনার কাব্যচর্চায় কি কোনো সুখানুভূতি এবং দুঃখানুভূতির ঘটনা আছে? থাকলে পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন?
আমিনুল ইসলাম: কবিতা আসে সুখে এবং দুঃখেও। একেবারে গড়পড়তা সময়ে কবিতা আসে না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে সেটা হয় না। জীবনে বহু আনন্দ পেয়েছি। বেদনাও। কবিতা লিখেও অনেক আনন্দ পেয়েছি । প্রতিটি কবিতা লেখা শেষ হওয়ার পর একটা আনন্দ পাই, যেটিকে নজরুলের কথা ধার করে সৃষ্টিসুখের উল্লাস বলা যেতে পারে। আর যখন আমার কবিতাটি পাঠক কর্তৃক গৃহিত হয়, তখন আবার নতুন করে আনন্দ পাই। যখন সাহিত্যবোদ্ধাগণ আমার কবিতা নিয়ে লেখেন, তখন আরও একবার আনন্দ পাই। বেদনা পাই, যখন কেউ কেউ আমার কবিতাকে দাবিয়ে রাখতে চায় পেশাগত কারণে। কেউ কেউ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা বলেন। এসব দেখে কষ্ট পাই। তবে মোটের ওপর আমার কবিতা লেখার অভিজ্ঞতা সুখের। কবিতাই আমাকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে নানাবিধ অপ্রাপ্তি, হতাশা আর ব্যর্থতার চাপের মুখে। সম্প্রতি উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অবিবাহিত একজন মানুষ আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি এবং তার বন্ধুজন আমার কবিতা ব্যবহার করে পরস্পর প্রেম করছেন। তারা এই সেলফোনের যুগে একে অন্যের কাছে প্রেমপত্র প্রেরণ করেন এবং সেসব প্রেমপত্রে তারা দুজনই আমার প্রেমের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। তাদের দাবি অনুযায়ী আমিনুল ইসলাম হচ্ছে আধুনিকতম প্রেমের কবি; তার কবিতা এসময়ের তরুণ-তরুণীদের মনের কথা ও ভাষা নিয়ে রচিত। তারা দুজন বিয়ে করতে চান এবং সেটা হলে আমাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেবেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। এমন আরও অনেক ঘটনা শুনেছি, যা আমাকে অনুপম আনন্দ দেয়।
হরিদাস ঠাকুর: আপনার কাব্যচর্চায় আপনি কোনো কবির দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত বলে মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: আমার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কয়েকজন প্রখ্যাত কবি-সমালোচক আমাকে মৌলিক কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের অভিমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কোনো কবিই বিচ্ছিন্নভাবে একশত ভাগ আপনাতে আপনি ভাস্বর নন। কবিতার একটি হাজার বছরের অথবা তারও বেশি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তি ও পরম্পরা আছে। কত ভাষার কত কবির কবিতা পড়তে হয়। যাদের কবিতা খুব বেশি ভালো লাগে, তাদের কবিতার প্রভাব কোনো না কোনোভাবে এসে যেতেই পারে। এটা সব কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কম অথবা বেশি। শামসুর রাহমানের শুরুর দিকের কবিতায় জীবনানন্দ দাশ-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবির প্রভাব ছিল। আমারও দুচারটে কবিতাতে জীবনানন্দ দাশ-আল মাহমুদের পরোক্ষ প্রভাব আছে বলে দু’একজন আলোচক অভিমত দিয়েছেন। হয়তো তাদের বিচার সঠিক। হয়তো বা নয়। তবে এটাই সত্য যে আমি সজ্ঞানে কোনো কবিকে অনুসরণ করি না। তবু যারা আমার প্রিয় কবি , বিভিন্ন ভাষা মিলিয়ে তাদের সংখ্যাও অনেক, তাদের কোনো কেনো কবিতার একটা পরোক্ষ প্রভাব অথবা তাদের কবিতার সৌরভ আমার কোনো কোনো কবিতার শরীরে এসে লাগতেই পারে। এটা অসম্ভব নয়, দোষেরও কিছু নয়। কিন্তু আমি বিশেষ কোনো কবি দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত নই বলেই আমার বিশ্বাস। আমার কোনো ঘরানা নেই।
হরিদাস ঠাকুর: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘প্রতিটি বাঙালি কিশোর দুটি জিনিস নিয়ে বড় হয়। একটি দাঁড়ি-গোঁফ অপরটি কবিতা। পরবর্তীকালে কবিতা ঝরে পড়ে দাঁড়ি গোফ থেকে যায়।’ আপনি এই ঝরে যাওয়া কবিতাকে কিভাবে ধরে রাখতে পারলেন বলে মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার একজন প্রিয় কবি-কথাকার। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তার কথাটি অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি কিশোরের জন্য প্রযোজ্য হতেও পারে। কিন্তু সব কবির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ ৮২ বছর বেঁচেছিলেন। তার দাড়ি-গোঁফ কালো থেকে দিনদিন শুভ্র হতে শুভ্র হয়ে উঠেছে; তার কবিতা-গানও দিনদিন সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ষাটোর্ধ্ব বয়সে রচিত প্রেমের গানগুলো তরুণ-যুবা শ্রেণির জন্যই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবেও সেসব তাদের মধ্যে আজও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ এবং এমন আরও অনেক কবিই আছেন, যাদের কোনো বয়সেই ছেড়ে যায়নি কবিতা। আমার মনে হয় ও’কথাটি সনীলবাবু বলেছেন, বাঙালির প্রায় সকলেরই একটা বয়সে প্রেমিক এবং কবি হতে চাওয়ার বাসনা ও চেষ্টার দিকে ইঙ্গিৎ করে। তবে এটাও সত্য যে, কোনো কোনো কবি অকালে ফুরিয়ে যান। যেমন শহীদ কাদরী ৩টিকাব্যগ্রন্থ উপহার দেওয়ার পর বহুদিন কবিতা রচনা করতে পারেননি। সেজন্য তার কবিতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে। বস্তুত ঝরে পড়া কবির সংখ্যাই বেশি।
হরিদাস ঠাকুর: কাব্যচর্চায় কাব্যলক্ষ্মী এবং কাব্য সরস্বতীর দ্বন্দ্বকে কিভাবে সমন্বয় করেছেন, আমরা কৌতূহলে জানতে চাই।
আমিনুল ইসলাম: এই সমস্যা এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘পুরস্কার’ কবিতা। আসলে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেও একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে জমিদারি পরিচালনা করেছেন। সে-ও অন্য জমিদারদের তুলনায় অনেক বেশি সফলভাবে এবং অনেক বেশি মানবিক হয়ে। আবার জমিদারের তখতে বসেই তিনি রচনা করেছেন শত কবিতা, গান, কাব্যনাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। লিখেছেন সাহিত্যমূল্যে অমূল্য অনেক অনেক পত্র। আমি একটা সরকারি চাকরি করি। মাস গেলেই বেতন পাই। উৎসব এলে উৎসব ভাতা পাই। অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাই। আমার তো পেটের ভাতের জন্য দৌড়াদোড়ি করতে হয় না। আমার পক্ষে ব্যবসা করা অথবা রাজনীতি করা সম্ভব ছিল না। সেসব যোগ্যতা আমাকে দেননি বিধাতা। আমার জন্য চাকরিটাই পেটের ভাত উপার্জনের সহজ ও নিরাপদ পেশা। অবশ্য চাকরিতে কিছু ঝামেলাও মাঝেমধ্যে পোহাতে হয়, সেগুলো মোকাবিলা করি আর দশজন চাকরিজীবীর মতোই । সেসবকে যাপিত জীবনেরই স্বাভাবিক অংশ হিসেবে আমি মেনে নিতে চেষ্টা করি। বাস্তবে সব পেশাতেই কিছু ঝুঁকি-ঝামেলা থাকে। রাজনীতিতে, ব্যবসায়, কোথায় ঝুঁকিঝামেলা নেই? তবে একটা কথা সত্য যে শুরু থেকেই আমার চাকরির ধরন এমনই যে এখানে ব্যস্ততা বেশি, নানারকমের মানসিক চাপও থাকে। আমার আনন্দ এখানেই যে, আমি সেসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোকেও কবিতা বা কবিতার উপকরণ-অলংকার করে তুলতে পারি। বস্তুত আমার চাকরিটা আমাকে পেটের ভাতের নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং একধরনের নতুন কাব্যভাষা তৈরীতে সহায়তা করেছে। আমি চাকরি ও কবিতা, দুয়ের প্রতিই কৃতজ্ঞ।
হরিদাস ঠাকুর: জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি কি লিখতে পেরেছেন বা কোনো কবি কি তা লিখতে পারেন বলে মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: এর উত্তর স্থির হবে আমার মৃত্যুর পর। অতৃপ্তি থেকেই নতুন নতুন লেখা আসে। কবিতা লেখা একটা নেশার মতো। এখানে পূর্ণতৃপ্তি নেই। তাই জীবদ্দশায় কবিতালেখার চেষ্টার কোনো শেষও নেই। তাছাড়া প্রতিটি কবিতাই কবির কাছে সন্তানতুল্য। আবার পাঠকভেদে একেকটি কবিতার কদর এককজনের কাছে বেশি। সেখানেও ঐকমত্য নেই। ফলে জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি, এটি কবির পক্ষে বলা সম্ভব নয়। হয়তোবা বোঝাও সম্ভব নয়। দুই-একজনের ক্ষেত্রে তা বলা গেছে। কাজী নজরুলের ইসলামের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’, আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘সোনালি কাবিন’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের? বিশ্বভারতী কিংবা শান্তিনিকেতনও এর উত্তর দিতে পারবে না। অথবা জীবনানন্দের? এরও উত্তর কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।
হরিদাস ঠাকুর: বলা হয়ে থাকে, মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ মানুষ হওয়া (The toughest task of a human is to humanize)। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকেই বলেন, ‘কবির জন্য সবচেয়ে কঠিন কবি হওয়া’। বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আমিনুল ইসলাম: জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ তো কবিতা লেখা আর প্রকৃত কবি হতে পারা দুটোর মধ্যেও একটা বিশাল আকারের ফাঁক রয়ে গেছে। চেষ্টা ও সাধনা করলে মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায়; কিন্তু শুধু চেষ্টাই প্রকৃত কবি হওয়া যায় না। যেমন কেবল চেষ্টা দ্বারা কেউ গুণী কণ্ঠশিল্পী হতে পারেন না। আগে দরকার জন্মগত প্রতিভা। তারপর চেষ্টা দ্বারা সেই প্রতিভার উদ্বোধন ও বিকাশ সাধন। আমি হাজারো চেষ্টা করলেও কি মোহাম্মদ রফি, মেহেদি হাসান কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হতে পারবো? ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কিশোরকুমার কারও কাছে তালিম না নিয়েও এবং তেমন কোনো সাধনা না করেও কিশোরকুমার। বিধাতাপ্রদত্ত জন্মগত একটি অতুলনীয় সুরময় কণ্ঠই তাকে বিশ^খ্যাত কণ্ঠশিল্পী বানিয়েছে। সাধনা বা চেষ্টা তো লাগবেই। তবে তার আগে চাই জন্মগত কাব্যশক্তি। জন্মগত প্রতিভার বিকল্প নেই।
হরিদাস ঠাকুর: অনেকেই বলে থাকেন, কবিতা দেওয়ার চেয়ে নেয় বেশি। অথবা কবিতা লিখতে গেলে হাহাকারের বসবাস করতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে কি এটি প্রযোজ্য?
আমিনুল ইসলাম: আমার ধারণা এই যে, কবিরা সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল মানুষ। তাদের অনুভবক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তারা হচ্ছেন সমাজের মুখপাত্র। তারা সব মানুষের মনের ভাব ও কথা প্রকাশের স্বেচ্ছা-অর্পিত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তা পালন করে থাকেন। আর দশজনের মতো তিনি অন্যের সুখে-দুঃখে নির্বিকার থাকতে পারেন না। ‘কবি, সবার কথা কইলে, এবার নিজের কথা কহ/ কেন নিখিল ভুবন অভিমানের আগুন দিয়ে দহ’; কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি আলোচ্য বিষয়টি বোঝার জন্য যথেষ্ট। আবার রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’ কিন্তু যদি সেটা পুরোপুরি না ঘটে? তখন কবির মনে হাহাকার সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই হাহাকারের কথাই ‘ঐকতান’ কবিতায় তুলে ধরেছেন:
অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা।
আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের।
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার–
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।
আর মাটির কাছাকাছি থাকা বিদ্রোহী কবি সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত।
নজরুলের এই কবিতাও একধরনের হাহাকার থেকে লেখা। এখানে স্পষ্ট কবির বেদনা ও তার কারণ। কিন্তু অনেক বেদনা থাকে একেবারে একান্ত, সঙ্গোপন, সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে, যাকে মুখের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এককথায় যাদের বলা হয় ‘অনির্বচনীয়’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক গানে এধরনের বেদনা বা হাহাকারের কথা তুলে ধরেছেন, ‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম/ কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম।।’ জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় তুলে ধরেছেন এমন বেদনা ও হাহাকারের কথা অনেক বেশি সুন্দর করে:
আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়–কোন্ এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়–পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা–প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়!
অভাববোধ, বেদনাবোধ ইত্যাদি থেকে স্ষ্টৃ যে-হাহাকার, তা-ই একজন প্রকৃত কবিকে গভীর কবিতা লেখায়। যারা প্রকৃত কবি, তাদের সবার জন্য একথা কমবেশি প্রযোজ্য। যার ভেতরে অভাববোধ নেই, হাহাকার নেই, তার পক্ষে প্রকৃত কবি হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। আরেক ধরনের হাহাকার হলো, কবির সৃষ্টির যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াজনিত বেদনাজাত অনুভব। অনেক কবিই নিজ জীবদ্দশায় তার প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মান পান না। অনেক সময় কবি নিজেও কবিতা লিখে তৃপ্তি পান না, তার কাছে মনে হয় কিছুই হয়নি, হচ্ছে না। এসব লিখে আর কী হবে? এই বেদনা বোধ, এই অতৃপ্তি, এই হাহাকার তাকে হাহাকার বিষয়ক কবিতা লিখতে প্ররোচিত করে। এটি জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল। তিনি বাধ্য হয়েই ‘ সমারূঢ়’ শিরোনামের ভয়ংকর শ্লেষযুক্ত কবিতা লিখেছিলেন । হাহাকার থেকে লেখা আমার নিজেও কিছু কবিতা আছে। একটি হচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী–আমার’ । কবিতাটি এরকম:
আমার এ জীবনটা বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট
একটা জয়ের আগে অনেকবার হারতে হয়
হারের কথা লুকিয়ে রাখি হার্ড ডিস্কে
কিন্তু জয়ের কথা ফাঁস করে দেয় ফেসবুক!হে হার, হে বেদনা, শুধু তোমাদেরই নয়,
বড় ব্যবধানে হারাবো একদিন মৃত্যুকেও
যেভাবে বীরশ্রেষ্ঠ নুরমোহাম্মদের বুকের কাছে
হেরে গিয়েছিল নিয়াজীবাহিনীর ব্রাশফায়ার!কিন্তু তার আগে আরও অনেকবার হারতে
হবে আমাকে, হারতে হবে, আমি জানি।হে অসাফল্য, আমি ক্রীজ ছেড়ে যাচ্ছি না।
হরিদাস ঠাকুর: কবি আমিনুল ইসলাম কবিতার মাঝে বেঁচে থাকবেন–আমাদের এ প্রত্যাশার বিপরীতে আপনার প্রক্ষেপণ জানতে চাই।
আমিনুল ইসলাম: কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা রচনা করেছেন মানুষের জন্য; মানুষের রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিক ও আত্মিক মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য। ফলে তাঁর কোনো চিন্তা ছিল না মৃত্যুর পর তিনি কবি হিসেবে টিকে থাকবেন কি থাকবেন না। আমরা সবাই জানি এই নিয়ে তাঁর বিখ্যাত কবিতা আছে যার শিরোনাম ‘ আমার কৈফিযত’। ওই কবিতায় তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন,
পরোয়া করি না, বাঁচি না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে।
মাথার ওপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা করো- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল । তিনি জানতেন, যতদিন মানুষ থাকবে পৃথিবীতে, ততদিন টিকে থাকবেন তিনি কবি হিসেবে সমিহমায়। তাই তাঁর কুৎসা রটনাকারী সজনীকান্ত দাস গংদের সমালোচনার কড়া জবাব দিতে গিয়ে তিনি আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন, কবিতাটির নাম ‘ সাবধানী ঘণ্টা’ । ঐ কবিতার শেষ দু’লাইনে তিনি বলেছেন, ‘আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস / ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও উপহাস।’ আমি আমার একটি আত্মজৈবনিক কবিতায় লিখেছি,
নাইবা হলো যাওয়া সমুদ্রের বাড়ি
জলের দৌড়ে নাইবা হলো লেখা
প্রান্তবাসী এই আমার নাম
আমাকে মনে রাখবে
গরীবের বউয়ের মতো এক ভূগোল।
আমার শারীরিক মৃত্যুর পর কী হবে তা তো আমি জানার সুযোগ পাবো না। আমি পরজন্ম নিয়ে সংশয়দীর্ণ; ফলে সিদ্ধান্তহীন। এই নিয়ে আমার ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতা আছে, ‘গন্তব্যহীন’। তারপরও যদি তর্কের খাতিরে মেনে নিই যে পরজন্ম আছে, তাহলেও তো এজীবনে রচিত কবিতার ভাগ্য আমার মৃত্যুর পরে কী হবে, তা পরজন্মের হুরপরীবেষ্টিত স্বর্গীয় উঠোনে বসে জানা সম্ভব নয়; সেই সুযোগ রাখা হয়নি। এখন হোমার-রুমি-শেক্সপিয়ার-টলস্টয়-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কি জানতে পারছেন যে তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে? অথবা যারা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে, তারাও তো জানতে পারছেন না কি ঘটেছে তাদের কবি-ভাগ্যে। তাই ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা মাঝেমধ্যে মাথায় এলেও সেটাকে খুব বেশি পাত্তা দিই না আমি। বরং আমার কবিতা নিয়ে এই যে এখন দশজন দুচারকথা বলছেন, এটাই প্রাপ্তি বলি মানি। আমি ব্যক্তিজীবনে ভোগবাদী নই তবু এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমার মনে বাজছে ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত সেই রুবাইয়াত:
কাল কী হবে সেই ভাবনায় কী ফল এমন থাকিয়া জড়
নগদ যা পাই তাই ভালো মোর হে সাকী পেয়ালা অধরে ধর।
এ চাঁদ-যামিনী মধু লুটো সখি, কাল জীবনের ভরসা কই!
কুসুম ফুটিবে, চাঁদনী হাসিবে, আমরা তো আর রবো না সই।
তো কবিতাই আমার সাকী। কবিতাই আমার মদ। আমার কবিতার ভবিষ্যত আমার জন্য নয়, সেটি আমার পাঠকের জন্য বরাদ্দ। তারাই সেটার অংশীদার। তাই আমার কবিতার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে গেলে সে-ভাবনা ক্ষণিক বাদেই হাওয়া হয়ে যায়।
হরিদাস ঠাকুর: কিশোর কবিরা রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে কবিতা লিখে থাকেন। আপনার কৌশোরের এই রাতজাগা কবিতা পাখিরা কতবার উড়ে এসে আপনাকে আবিষ্ট করেছে?
আমিনুল ইসলাম: এই প্রশ্নটি করা জন্য বিশেষ ধন্যবাদ। আমি নবম দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই কবিতা লেখা শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কবিতা-গান দুই-ই লিখতাম। কিন্তু সেসব প্রকাশের জন্য কোনো চেষ্টাই ছিল না। মূলত একতরফা, কখনোবা দোতোরফা প্রেম ও প্রেমে ব্যর্থতা থেকে সেসব কবিতা-গান লেখা। সেগুলো আমার তখনকার ডায়েরির মধ্যে রয়ে গেছে আজও। আমার বহু কবিতায় কৈশোরের জয়জয়কার আছে। আমার একটি কবিতার নাম, ‘নদীর দেশ কবির কৈশোর’। কৈশোরে পাঙ্গাশমারী নামক একটি নদীতে সাঁতার কাটা ছিল আমার প্রিয় অভ্যাস। নদীটি ছিল আমার কৈশোরের এবং যৌবনের ঊষালগ্নের প্রেয়সী । তাকে নিয়ে লেখা আমার ‘পাঙ্গাশমারী’ নামক কবিতাটি আছে আমার ‘ জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র’ নামক কাব্যগ্রন্থে। আমার শৈশব কৈশোর খুবই ঘটনাবহুল ও ঐশ্বর্যময় বলে তারা আমার কবিতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমার কবিতায় নদী-ঘাট-বাঁশি-সবুজ ফসলের মাঠ-খোলা হাওয়া এসবের যে ব্যাপক ও গভীর উপস্থিতি, তা আমার বাল্যকৈশোরের স্মৃতির ভান্ডার থেকে উঠে আসা । সেই সময়ের প্রেমের মন আজও আমার পাকাচুলে এসে বাসা বেঁধে থাকতে চায়। আমি তাকে তাড়াতে পারি না। হয়তোবা তাড়াতে চাইও না। আর হয়তোবা সেজন্যই এইসব চরম অর্থনৈতিক দিনরাত্রিতেও আমি রাজধানীতে বসে এত এত প্রেমের কবিতা লিখি। আমার মনে এখনও সেই মার্বেল খেলোয়াড়-মাঠের রাখাল-নৌকার মাঝি-নদীর প্রেমিক গ্রামীণ কিশোরের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর।
হরিদাস ঠাকুর: কবি আমি আমিনুল ইসলাম কবিতা সুন্দরীর সাথে বসবাস করেন। এই কবি আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।
আমিনুল ইসলাম: আমার জীবনটা কবিতাময়। কবিতার উদ্ধৃতি না দিয়ে আমি কখনো কোনো বক্তৃতা শেষ করতে পারি না। কবিতা পড়ি না, গান শুনি না , এমন দিন আমার জীবনে নেই বললেই চলে। একটু আগেই জানলাম, কবিতা নাকি কৈশোর-যৌবনের কাজ। কিন্তু আমি তো প্রৌঢ় বয়সেও কবিতার সঙ্গে ঘরগেৃহস্থালি করে চলেছি। মান-অভিমান আছে। মাঝেমধ্যে সাময়িক বিরহ আছে। কিন্তু আমার আর কবিতার মধ্যে কেনো ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ নেই। কবিতাসুন্দরীর সাথে বসবাস নিয়ে, প্রেম নিয়ে আমার একটি কবিতা আছে, নাম ‘ ভীমরতি’। সেই কবিতার শেষের লাইনগুলো দিয়ে এই প্রশ্নের জবাব সম্পন্ন করা যায়:
সেও অবশ্য নেই আর আগের মতো
প্লাস্টিক সার্জারি বদলে দিয়েছে তার মুখের আদল,
বৈশ্বায়নের হাওয়া নিয়ে গেছে তার ঢাকাইশাড়ি,
আর আজানুলম্বিত কেশ–কোনোদিন ছিল কিনা মনেও পড়ে না।
সে এখন উত্তরাধুনিক কবিতা:
রহস্য করে খাপছাড়া কথা বলা তার স্বভাব;তবু তার সাথেই ইয়ে করতে চায় মন;
যুবকদের আড্ডা তো বটেই-
বুড়োঠাকুরের বটতলাতেও বুদ্ধি নিতে যায়;
ফিসফাস ওঠে
তবু তারি জন্য প্রহর কাটে- অসময়ের বটমূলে।’
রুটি ও মদ ফুরিয়ে যাবে; প্রিয়ার কালোচোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে : কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়। — এই কথাগুলো ওমর খৈয়াম হয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর। আামার মতে সেই বইখানা হচ্ছে কবিতার। ‘তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয় শতরূপে শতবার/ জনমে জনমে চলে তাই মোর অনন্ত অভিসার।।’ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কোন্ সুন্দরীকে চেয়ে এমন গান রচনা করেছিলেন, আমি জানি না। তবে আমার সেই সুন্দরী হচ্ছে কবিতা যাকে আমিও চেয়ে আসছি ‘শতরূপে শতবার ’।