[মামুন রশীদ—একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক ও সাংবাদিক। কর্মজীবনে দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক আজকের কাগজ ছাড়াও পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন। বর্তমানে দৈনিক মানবকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক পদে কর্মরত।
এ পর্যন্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘কালোপাতা ওড়ো সাদা ছাই’, ‘কুশল তোমার বাঞ্ছা করি’, ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’ ও ‘এই বইটির কোন নাম দিবো না’। প্রবন্ধগ্রন্থ হলো ‘বাংলাদেশের কবিতা, সৃজনে অর্জনে’, ‘ষাটের কবি: স্বাতন্ত্র্য ও বৈভবে’; জীবনীগ্রন্থ ‘ডিরোজিও’, ‘মাদার তেরেসা’, ও ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’; ছোটদের জন্য গল্পগ্রন্থ ‘ডাইনি বুড়ি ও অন্যান্য গল্প’, ‘ভূতের সঙ্গে একদিন’ ও ‘সবুজ বাড়ির ভূত’; উপন্যাস: ‘টিটু মিলনায়তন মুক্তিযুদ্ধ’; ইতিহাস: মুক্তিযুদ্ধের কিশাের ইতিহাস, বগুড়া জেলা। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের কাগজ ‘দ্বিবাচ্য’। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন, মোতাহার হোসেন তালুকদারের আমার রাজনৈতিক জীবনের ৫৫ বছর’। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়।
মোহাম্মদ নূরুল হক—ছোটগল্প, ছড়া ও কবিতার পাশাপাশি লিখে চলেছেন প্রবন্ধ-গদ্য। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় বিচিত্র। সাহিত্যের নানা শাখায় সমান বিচরণ থাকলেও প্রাবন্ধিক ও কবি হিসেবেই পরিচিত তিনি। পেশাগত জীবনে কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকে সাহিত্য পাতায় কাজ করেছেন। ছিলেন দৈনিক আমাদের সময়ের বার্তা সম্পাদক। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপেপার বাংলা ট্রিবিউনের উপ-বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
সম্পাদনা করেছে সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজ, মেঠোপথ (১৯৯৬ থেকে), চিন্তাসূত্র (১৯৯৬ থেকে), প্রাকপর্ব (২০০০ থেকে ২০০৫) ও অনুপ্রাস (২০০১-২০০৫)।
এই পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই: ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’, ‘স্বরচিত চাঁদ’, ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’ ও ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান।’
সম্প্রতি চিন্তাসূত্রের আমন্ত্রণে এই দুই কবি-প্রাবন্ধিক-সংবাদকর্মী বসেছেন দীর্ঘ সংলাপে। তাঁদের সংলাপে উঠে এসেছে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-সমাজ-শিক্ষাসহ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সংলাপ গ্রন্থনা করেছেন তরুণ ছোটগল্প লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। দীর্ঘ এই সংলাপটির প্রথম কিস্তি আজ প্রকাশিত হলো।]
দ্বিতীয় পর্ব
মোহাম্মদ নূরুল হক: না ক্ষেপলেই ভালো। বুক রিভিউ ও সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা তেমন মধুর নয়। প্রায় ক্ষেত্রেই বিরাগভাজন হতে হয়েছে। কেউ কেউ আমার রিভিউ-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ পড়ে বলেছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হলো না। যখন আড্ডায় আলোচনার সময় তাদের লেখার আরও বড় ত্রুটিগুলো শনাক্ত করে বলে, এই ত্রুটিগুলো রিভিউ-প্রবন্ধে আমি এড়িয়ে গেছি। তখন তারা আপত থামে। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে বলে, ব্যর্থ কবিরাই ভালো সমালোচক হয়। প্রতি-উত্তরে আমি যখন বলি, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল মান্নান সৈয়দ একইসঙ্গে কবি ও সমালোচক। এদেশে সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এই কয়জন সেরা সমালোচক, তারা কবি হিসেবে কি ব্যর্থ? তখন আমার নিন্দুকরা ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলে, তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এই কয়জন কবিও না, সমালোচকও না। ভাবখানা এমন যে, এই নিন্দুকরা দয়া করে ওই কবি-সমকালোচকদের লেখা পড়ে বলেই তাঁরা আজও সাহিত্যে টিকে আছেন (হাহহাহাহহাহ)। আচ্ছা, এ সময়ে ঠিক আমাদের সমসাময়িকদের মধ্যে প্রবন্ধে-গল্পে-কবিতায় কাকে কাকে তোমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
মামুন রশীদ: এটা আমার বেলাতেও হয়েছে। বরং লেখার পর, আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে—‘এই এই বিষয়ে লিখতে পারতে,’ ‘এই জায়গাটায় এভাবে না বলে এভাবে বললে আমার লেখার প্রকৃত দিকটা পাঠক বুঝতো’, ‘এই দিকটা আরো একটু বিস্তৃত করতে পারতে’। আরে ভাই, একজন লেখক যদি, আলোচককেই ধরিয়ে দিতে চান যে, ‘তুমি আমার লেখার এই দিকগুলো নিয়ে লেখো। আমার লেখার এই দিকগুলো নিয়ে বলো’, তাহলে ওই সমালোচকের দরকার কী? লেখক নিজেই তো তার সম্পর্কে গদ্য লিখতে পারেন। বলতে পারেন, আমার ওমুক লেখায় আমি এই বলতে চেয়েছি, এই বলেছি। আপনারা জলদি আমার লেখা পড়ুন।’ আসলে যে কথাটা অনেকের মুখেই নানাভাবে বলা হয়েছে—সমালোচনা সাহিত্যের ধারা আমাদের নেই। তা অনেকাংশেই ঠিক। যা আছে তা পিঠ-চুলকানি।
আলোচক বা সমালোচক লিখবেন তার ইচ্ছেতে। তার চোখে যে বিষয়গুলো ধরা পড়বে, তিনি যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবেন, তাই-ই বলবেন। এক্ষেত্রে তাকে দেখিয়ে দেওয়ার কিছু নেই বলেই আমার মনে হয়। আর এসব তথাকথিতের জন্যই আমাদের সমালোচনা সাহিত্য দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। এজন্যই সম্ভবত তরুণরা সমালোচনায় আগ্রহী হচ্ছে না। কাকে নিয়ে লিখবে, কী লিখবে—সেটা নির্ধারণ করবেন যিনি লিখবেন, তিনি। আপনি তাকে পথ দেখানোর কে হে? আপনার দেখানো পথে তো আমি হাঁটব না। আপনার যেমন মেরুদণ্ড আছে, আমিও তো তাই বহন করি। এই বোধ যখনই পুরো জাগ্রত হবে, তখন দেখবে, আমরা ঠিকঠাক পথে হাঁটতে পারছি।
আর আমি আলোচনা করি ব্যক্তিগত মুগ্ধতা, ভালোলাগা থেকে। সাধারণত ত্রুটি খুঁজতে যাই না। আমার যা ভালো লাগে, যেটুকু ভালো লাগে, তাই নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করি। তাও পছন্দ হয় না। আরে আমি তো তাকে খুশি করার জন্য লিখছি না। আমার ভালো লাগাকে জানানোর জন্য লিখছি।
আমার সমসাময়িকদের মধ্যে প্রায় সবাই ভালো লিখছে। গদ্য-পদ্য-গল্প-উপন্যাস-আলাচনা-সমালোচনা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অনেকেই পাঠককের নজর কেড়েছে। আমাদের সময়ের কবিতা-প্রবন্ধ-গল্প পড়ার সময় তোমাকে কাজী মহম্মদ আশরাফ, রঞ্জনা বিশ্বাস, এমরান কবির, ইমতিয়াজ মাহমুদ, মোহাম্মদ নূরুল হক, জাকির জাফরান, চন্দন চৌধুরী, ফেরদৌস মাহমুদ, চাণক্য বাড়ৈ, আপন মাহমুদ, সজল সমুদ্র, শারদুল সজল, চন্দন আনোয়ার, শেখর দেব, মোস্তাফিজ কারিগর, আনিফ রুবেদ, পিন্টু রহমান, আশরাফ জুয়েল, মনিরুল মনির, প্রণব আচার্য্য, মুক্তি মণ্ডল, মাজুল হাসান, জাহানারা পারভীন, রিঙকু অনিমিখ, সোমেশ্বর অলি, রবু শেঠ, তুহিন তৌহিদ, সুমন মজুমদার, শামীম হোসেন, ইলিয়াস বাবর; ছড়ায় আহমেদ জুয়েল, অদ্বৈত মারুত, সুমন মাহমুদ—এই নামগুলো মনে রাখতে হবে। কারণ, এদের প্রত্যেকের লেখাই আলাদা মনোযোগ দাবি করে। এর বাইরেও আরো আরো নাম রয়েছে, যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এই নামগুলোর বাইরে কাদের লেখা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে বলে তুমি মনে করো?
রাজনীতির সংকট মুহূর্তে লেখকরা আগে জোরালো ভূমিকা পালন করতেন
মোহাম্মদ নূরুল হক: তুমি বললে, ‘আসলে যে কথাটা অনেকের মুখেই নানাভাবে বলা হয়েছে—সমালোচনা সাহিত্যের ধারা আমাদের নেই, তা অনেকাংশেই ঠিক। যা আছে তা পিঠ-চুলকানি।’ আমি তোমার এই কথার সঙ্গে একমত নই। তোমাকে দেখতে হবে, কারা বলছে এই কথা। এই বক্তব্য আসলে মিথ্যাচার মাত্র। একথা তারা-ই বলে, যারা আসলে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লিখতে জানে না। পারে না। তারা লিখতে না পারার কারণে, সমালোচকের আলোচনায় তেমন গুরুত্ব পায় না। সৎ-গুণবিচারী-ইতিবাচক সমালোচক নিজের সমালোচনামূলক গদ্যে তাদের নামও হয়তো উল্লেখ করেন না। এই শ্রেণীর সমালোচক আলোচনাকালে কোনো লেখায় ইতিবাচক কিছু না পেলে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেন না। তাই যার লেখা সাহিত্যমানসম্পন্ন হয়ে ওঠেনি, তার নাম উল্লেখ করেন না এই শ্রেণীর সমালোচক। আর তখনই এই বাদপড়া তথাকথিত লেখকরা সমালোচনা সাহিত্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ধরো, কেউ একজন একটি বই প্রকাশ করলো, আর দাবি করলো এটি কবিতার বই। একজন সমালোচক পড়তে গিয়ে দেখলেন, ছন্দের ছ-ও নেই, বাক্য ভুল, বানানের ঠিক নেই, আঙ্গিকের বালাই নেই অথচ কিছু অর্থহীন শব্দ এনে জড়ো করা হয়েছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, আর দাবি করা হয়েছে কবিতা। সমালোচক সমালোচনা করতে গেলে তো একবাক্যেই লিখতে হবে, কিছুই হয়নি। আর এই কিছুই হয়নি বলার জন্য তো কলম ধরারই দরকার নেই। ওই বিষয়ে চুপ থাকাটাই তো শ্রেয়। তেমনি গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও একই কথা।
আর সমালোচনা প্রসঙ্গে আমার সাফ কথা, সৃজনশীল রচনা অনেকটা পণ্যের মতোই। আর সমালোচনা হলো এই পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা। সমালোচক এর মাধ্যম। সমালোচক প্রথমেই মুগ্ধ পাঠক, পরে বিশ্লেষক, গুণবিচারী। এর বাইরে গেলে তিনি হয় পণ্ডিত, না হয় নিন্দুক বা স্তাবক। সমালোচককে এর বাইরে থাকতে হয়। আমাদের সমবয়সীদের মধ্যে তুমি যাদের নাম উল্লেখ করেছ, তাদের বাইরে আরও দুই একজন রয়েছেন। যেমন সিদ্ধার্থ টিপু, ইমরান মাঝী, মুক্তিমণ্ডল, কাজী মোহিনী ইসলাম, মিঠুন রাকসাম, অতনু তিয়াস, অবনি অনার্য—এ রকম আরও কয়েকজন রয়েছেন। যাদের নাম এই মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না।
আচ্ছা, লেখকরা তো সমাজ সতেচতন, রাজনীতি সচেতন। রাজনীতির সংকট মুহূর্তে লেখকরা আগে জোরালো ভূমিকা পালন করতেন। এই ধারা বছর বিশেক আগেও ছিল। কিন্তু এখন জাতির সংকটকালে লেখকদের কোনো জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না। এর কারণ কী বলে মনে করো তুমি?
মামুন রশীদ: কবি, লেখকমাত্রেই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন; কথাটা মনে হয় সবার্থে ঠিক না। ঠিক না—বলছি, তার কারণ রয়েছে। কবি-সাহিত্যিকের লেখায় সমাজ ও রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করে। আবার একইভাবে তাদের লেখনীও সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এটা সবসময়ে সবসমাজেই ঘটেছে। আমাদের প্রাচীন যুগের সাহিত্যের নির্দশন চর্যাপদের দিকে তাকালে যেমন, মধ্যযুগেও ঠিক তেমনি। আবার আধুনিক যুগেও তাই। চর্যাপদে—ঘরে ভাত নেই কিন্তু বাড়িতে নিত্য অতিথি আসার দৃশ্য যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি সমাজিক সমস্যা—যে ব্রাহ্মণ ডোমনী রমণীর ঘরে রাত কাটায়, দিনের আলোতে সেই ব্রাহ্মণই আবার ডোমনীর ছায়া গায়ে পড়লে নিজেকে অশুচি ভাবছে। অথবা দিনের বেলা যে রমণী সামান্য শব্দেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, সেই আবার রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যেতে দ্বিধা করছে না, ভয় পাচ্ছে না। সমাজের এ রকম নানা বিষয় সাহিত্যের রূপ-রসে জারিত হয়েই পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। একইভাবে আমরা মধ্যযুগের সাহিত্যেও এর ছোঁয়া দেখতে পাব। মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলীর যে আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরের সঙ্গে সৃষ্টির মেলবন্ধনের পদ, তাও কিন্তু সমাজ ও রাজনীতির বাইরে যায়নি। নানা-উপমা, রূপকের মধ্য দিয়ে সামাজিক সুবিধা-অসুবিধাকে বর্ণনার মধ্য দিয়েই বৈষ্ণব পদাবলি রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলির বাইরে মধ্যযুগের বড় অংশ মঙ্গলকাব্য। কয়েকভাগে মঙ্গলকাব্যগুলোর যেটিই তুমি পড়ো, দেখতে পা্বে, দেবতার আরাধনার মাঝেও ছড়িয়ে রয়েছে সমাজ, সমকাল, রাজনীতি। সেটি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যই হোক, মনসামঙ্গল কাব্যই হোক বা ধর্মমঙ্গল বা অন্য যে মঙ্গলকাব্যই হোক। কথার সুবিধার্থে আমি দুই-একটি উদাহরণ হাজির করতে পারি। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের দুইটি বিখ্যাত এবং অমর পঙ্ক্তি তো আমাদের সবারই জানা। সবাই কমবেশি—নানাভাবে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ অথবা ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়’ ব্যবহার করি। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর কিন্তু লিখছেন, অন্নদামঙ্গলকাব্য। দেবী অন্নদার আরাধনা করতে গিয়েও তিনি কিন্তু সমাজ, রাজনীতিকে ভুলে যাননি। এই অন্নদামঙ্গলেই রয়েছে মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান। যেখানে দেশপ্রেমের কথাও দেবীর আরাধনা করতে গিয়ে ভুলে যাননি রায়গুণাকর। বাদশার সেনাপতি যখন দুই হাতে পায়ের বেড়ি (শেকল) এবং তরবারি উপস্থাপন করছে, তখন দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে কবিই বেড়ি (শেকল) ফিরিয়ে দিয়ে তরবারি গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলছেন, ‘কহ গিয়ে ওরে বীর মানসিংহ রায়ে বেড়ি দিওক আপনার মনিবের পায়ে।’ এই একই রকমভাবে কবিকঙ্গন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু-ফুল্লরার জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সমকাল, সমাজ এবং রাজনীতি। এর পেছনে রয়েছে তাদের দায়বদ্ধতা। তাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজ-মানুষের সঙ্গে তাদের অবস্থান। এটা কিন্তু শুধু মঙ্গলকাব্যেই নয়, একইভাবে মধ্যযুগে আরবি-ফারসি বা অন্যান্য ভাষা থেকে যে বিশাল অনুবাদ সাহিত্যের ভাণ্ডার আমাদের জমা হয়েছে। সেখানেও মিলবে। আলাওল তার কাব্যে পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনা করলেও সমকাল, সমাজকে কিন্তু ভুলে যাননি। সমকালীন রাজনীতিকে উপেক্ষা করেননি। আর আধুনিকতার লক্ষণের অনুষঙ্গগুলোর মাঝে তো সময়, সমাজ, রাজনীতির উপস্থিতি জরুরি। এটা আমাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে দেখেছি বেশ মোটাদাগে। আমাদের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশক তো সময়, সমাজ এবং রাজনীতির বাইরে আসেনি। বরং এসবের মধ্য থেকেই উৎকৃষ্ট সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। এই ধারা আশির দশকেও রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের পেয়েছি কিছুটা। কিন্তু আমাদের সময় থেকেই এর অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
রাজনীতি বিমুখ হলেও, সমাজ বিচ্ছিন্ন নয় কেউ-ই এটা কিন্তু স্বীকার করতে হবে
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্পর্ক রাজনীতির সঙ্গে। একে অন্যের পৃষ্ঠপোষকও। রাজনীতি আগলে সমাজও এগোয়। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাও বেগবান হয়। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারের পতনের পর, আমাদের রাজনীতি আর এগুতে পারেনি বলেই আমার মনে হয়। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের যে স্পিরিট আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তীকালে আর তা ধরে রাখতে পারেনি। রাজনীতি মানেই কি শুধু ক্ষমতা দখল? মানুষকে আগামীর স্বপ্নদেখানোও তো রাজনৈতিক দল এবং নেতার দায়িত্ব। এখন কোন রাজনৈতিক দল কি তাদের আদর্শ দিয়ে, দিকনির্দেশনা দিয়ে কর্মিবাহিনী বা সমর্থক টানছে? মানুষের সামনে যদি কোনো লক্ষ্য না থাকে, কোনো নির্দেশনা না থাকে, তাহলে মানুষ কেন যাবে? নিছক ব্যক্তিস্বার্থ এবং ব্যক্তির উপকার ছাড়া তো এক্ষেত্রে কিছু ঘটারও কারণ নেই। যে রাজনীতি বিমুখতা সাধারণ মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে, সেই বিমুখতাই কবি-সাহিত্যিকদের মাঝেও।
তুমি খেয়াল করলে দেখতে আমাদের অনেক কবি, সাহিত্যিক সরাসরি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। রাজনীতি তাদের লেখাকে প্রভাবিত করলেও, তাদের লেখা কিন্তু শিল্পের মান বিচারে টিকে গেছে। তারা রাজনীতি করেছেন, কিন্তু লেজুড়বৃত্তি করেননি। আগে রাজনীতির মাঠের, দেয়ালের শ্লোগানের অনেক ভাষাই এসেছে শিল্পী-সাহিত্যিকের হাত ধরে। কিন্তু এখন যেহেতু রাজনীতিতে কবি-সাহিত্যিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই, তাই লেখাতেও রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা নেই। খুব কম সংখ্যক কবি-সাহিত্যিক যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আদর্শকে ধারণ করে আছেন, তাদের লেখায় আবার তুমি শিল্পগুণ খুঁজে পেতে হয়রান হবে। তার কারণও কিন্তু ওই স্বপ্নদেখানোর ব্যর্থতা, গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা।
আমাদের সময়ের কবি-সাহিত্যিকরা যে রাজনীতি বিমুখ, তাদের লেখায় রাজনীতি নেই, সমকাল নেই, মোটা দাগে সমাজ নেই—এর পেছনে আমাদের রাজনীতিহীনতাই দায়ী। জাতির সংকটে কবি-সাহিত্যিকরা এগিয়ে আসতেন, তা এখনো আছে। তবে আগে যা চোখে পড়তো রাজনীতির মাঠে, এখন এটা তুমি খুঁজে পাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাই রাজনীতি বিমুখ হলেও, সমাজ বিচ্ছিন্ন নয় কেউ-ই এটা কিন্তু স্বীকার করতে হবে। আমাদের লেখায় যে রাজনীতি নেই, সমকাল নেই, সমাজের বড় অংশ নেই— এ ব্যাপারে তোমার কী মনে হয়?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আমাদের লেখায় রাজনীতি নেই, সমকাল নেই, সমাজের বড় অংশ নেই— এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নয়; আংশিক সত্য। আমাদের সময়ের মানে তোমার আমার বয়সী লেখকদের কথা যদি বলো, তাহলে আমি বলব মেজর লেখকদের লেখায় সমাজ-রাজনীতি-সমকাল; সবই আছে। তবে এই শ্রেণীর লেখক হাতেগোনা। কিন্তু তাদের বৃহত্তর পাঠক সমাজ কম চেনে। বেশি চেনে তাদের, যাদের লেখায় রাজনীতি নেই, সমকাল নেই, সমাজের বড় অংশ নেই। অথচ তারাই আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মিডিয়াবাজি থেকে শুরু করে মঞ্চবাজি, কোথায় নেই তারা। অবশ্যই আমাদের আগেও এমন লেখকদের দৌরাত্ম্য ছিল। যাদের লেখায় সমাজ-রাজনীতি-সমকাল নেই, তারা তো আমাদের এই সমাজের কানুন, নিয়ম, কিছুই জানে না। অবশ্যই তাদের দাবি, তারা এসব মানে না। এই শ্রেণীর লেখকদের দেখবে, এরা জানে কম, বোঝে বেশি। শেখে কম, প্রকাশ করে বেশি। আর সব রকমের নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে বলে।
গত চল্লিশ বছরের সাহিত্যে বিশেষত কবিতার ধারাবাহিক পাঠে কোনো বাঁকবদল দেখতে পাও তুমি? পেলে সেটা কী রকম, না পেলে কেন কোনো বাঁকের সৃষ্টি হলো না?
চলবে…
পড়ুন প্রথম পর্ব: কথোপকথন: পর্ব-১ ॥ মামুন রশীদ ও মোহাম্মদ নূরুল হক