[মামুন রশীদ—একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক ও সাংবাদিক। কর্মজীবনে দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক আজকের কাগজ ছাড়াও পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন। বর্তমানে দৈনিক মানবকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক পদে কর্মরত।
এ পর্যন্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘কালোপাতা ওড়ো সাদা ছাই’, ‘কুশল তোমার বাঞ্ছা করি’, ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’ ও ‘এই বইটির কোন নাম দিবো না’। প্রবন্ধগ্রন্থ হলো ‘বাংলাদেশের কবিতা, সৃজনে অর্জনে’, ‘ষাটের কবি: স্বাতন্ত্র্য ও বৈভবে’; জীবনীগ্রন্থ ‘ডিরোজিও’, ‘মাদার তেরেসা’, ও ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’; ছোটদের জন্য গল্পগ্রন্থ ‘ডাইনি বুড়ি ও অন্যান্য গল্প’, ‘ভূতের সঙ্গে একদিন’ ও ‘সবুজ বাড়ির ভূত’; উপন্যাস: ‘টিটু মিলনায়তন মুক্তিযুদ্ধ’; ইতিহাস: মুক্তিযুদ্ধের কিশাের ইতিহাস, বগুড়া জেলা। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের কাগজ ‘দ্বিবাচ্য’। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন, মোতাহার হোসেন তালুকদারের আমার রাজনৈতিক জীবনের ৫৫ বছর’। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়।
মোহাম্মদ নূরুল হক—ছোটগল্প, ছড়া ও কবিতার পাশাপাশি লিখে চলেছেন প্রবন্ধ-গদ্য। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় বিচিত্র। সাহিত্যের নানা শাখায় সমান বিচরণ থাকলেও প্রাবন্ধিক ও কবি হিসেবেই পরিচিত তিনি। পেশাগত জীবনে কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকে সাহিত্য পাতায় কাজ করেছেন। ছিলেন দৈনিক আমাদের সময়ের বার্তা সম্পাদক। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপেপার বাংলা ট্রিবিউনের উপ-বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
সম্পাদনা করেছে সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজ, মেঠোপথ (১৯৯৬ থেকে), চিন্তাসূত্র (১৯৯৬ থেকে), প্রাকপর্ব (২০০০ থেকে ২০০৫) ও অনুপ্রাস (২০০১-২০০৫)।
এই পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই: ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’, ‘স্বরচিত চাঁদ’, ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’ ও ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান।’
সম্প্রতি চিন্তাসূত্রের আমন্ত্রণে এই দুই কবি-প্রাবন্ধিক-সংবাদকর্মী বসেছেন দীর্ঘ সংলাপে। তাঁদের সংলাপে উঠে এসেছে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-সমাজ-শিক্ষাসহ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সংলাপ গ্রন্থনা করেছেন তরুণ ছোটগল্প লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। দীর্ঘ এই সংলাপটির প্রথম কিস্তি আজ প্রকাশিত হলো।]
প্রথম পর্ব
মোহাম্মদ নূরুল হক: মামুন, তুমি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। তোমার এই তিন পরিচয় পাঠক-গণমাধ্যমকর্মীরা জানেন। তোমার পরিচয় নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হলো, তুমি লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই কলম ধরেছ? না কি নিছক খেয়ালের বশেই লেখালেখি শুরু? না কোনো স্বপ্নকন্যার প্রেমে পড়ে?
মামুন রশীদ: নাহ, নিছক খেয়ালের বশে বলা যাবে না। আমি লিখতে শুরু করেছি বেশ পরে। অনার্স পড়ার সময়। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয়েছে। আর পারিবারিক পরিবেশ আমার ভেতরে বই পড়ার আগ্রহ জাগিয়েছে। এই দুইয়ের মিশেলে আমার ভেতরে লেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাৎক্ষণিক কিছু বিষয়। যখন আমাদের ক্লাস থাকতো না, অবসর। তখন সহপাঠী যারা কবিতাচর্চা করতো, তারা ডায়াসে উঠে নিজেদের লেখা পাঠ করতো। প্রাচীন দরবারি সাহিত্যের মতো, অন্যরা মারহাবা, মারহাবা বলে উঠতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কাঁচা হাতের সে সব লেখা আমাকে খোঁচাতো। তারা একে অন্যকে অস্বীকার করাতো। বিষয়টা আমাকে কষ্ট দিতো। এই সবের যোগফল থেকেই আমার লেখা শুরু।
সত্যিকার অর্থে প্রতিটি মানুষের লেখা শুরুর পেছনেই একটি গল্প থাকে। সেটি কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার। বার তা কখনো উৎসাহেরও। আমার শুরুতে উৎসাহ ছিল না, সহযোগিতা ছিল না। আমি যখন লিখতে শুরু করি, তখন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের এক প্রশিক্ষাণার্থী কবি, আমাদের শহরের বেশ নাম-ডাক ছিল, আছেও, তিনি আমাকে বলেছিলেন, মামুন তুমি যা লেখো, তা কিছুই হয় না। তুমি তো নাম কামাতে চাও, তাই আমি বলি কি, তুমি নিজের নামটা কাগজে লিখে ফটোকপি করে শহরের দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দাও। আমি তাকে কিছু্ই বলিনি। আজো বলতে পারিনি। তবে চেষ্টাটা আমার ভেতরে এখেনা আছে।
এবার তোমাকে বলি, তুমি আজ যেখানে, সেখানে আসতে তোমাকেও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। তোমার কাছ থেকে সে সব কথা শুনতে চাই। তোমার প্রথম পরিচয় কবি, অথচ গদ্যকার হিসেবে তেমার খ্যাতি। কবিতা লিখে তুমি যে আনন্দ-স্বস্তি পাও, গদ্য লিখে সেই তৃপ্তি পাও না—এটা আমাকে ব্যক্তিগত আড্ডায় অনেকবার বলেছ। এই যে তোমার ভালো লাগা-স্বস্তির জায়গা থেকে সরিয়ে অন্যরা তোমাকে অন্য জায়গায় দেখতে চায়, এটা কি তোমাকে পীড়া দেয়? কবি পরিচয়ের চেয়ে প্রাবন্ধিক পরিচয় কি তোমাকে বিব্রত করে? না কি দুটোই উপভোগ করো?
মোহাম্মদ নূরুল হক: তুমি কি কৌশলে প্রেমে পড়ার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলে? তুমি কারও প্রেমে পড়োনি? না পড়লে ভালো। কিন্তু পড়ে থাকলে বললে মনে হয় না তেমন কোনো অসুবিধা আছে। লেখালেখির পেছনে আমারও বড় ও করুণ গল্প আছে। কিন্তু তোমাকে তার পুরোটা বলব না। কারণ, আমার মনে হয়েছে,তুমি তোমার লেখালেখির শুরুর গল্পটা অকৃত্রিভাবে বলছ না। আমি কেবল কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছি বা লিখছি তা নয়। আমার শুরুটা কিন্তু ছড়া ও ছোটগল্প দিয়ে। বেশ কিছু ছোটগল্প জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ লেখার শুরু অনেক পরে। তাও, চিন্তাসূত্র, মেঠোপথ, অনুপ্রাস ও প্রাকপর্ব নামের এই চারটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করতে গিয়ে লিখতে হয়েছে। মানে ওই সময়ে, সেই ১৯৯৬ থেকে শুরু করে ২০০৯ পর্যন্ত ছোটকাগজগুলোর জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে প্রচুর বুকরিভিউ ও প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। এছাড়া দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধেও লিখেছি প্রচুর। কখন যে কিভাবে আমার গল্প ও কবিতা ছাপিয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা-ই বেশি হয়ে গেলো, বুঝতেই পারিনি। তবে আমি বুঝতে পারি, যারা আমাকে কবি না বলে কেবল প্রাবন্ধিক বলে, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বলে। আমি তাদের কিছু বলব না। কারণ আমাদের সমাজের একটি কমন স্বভাব হলো, একই ব্যক্তির একাধিক পরিচয় মেনে নিতে পারে না। বহুমুখী প্রতিভাবানকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তবে, আমি কবিতা-প্রবন্ধ দুটোই মনের আনন্দে লিখি।
তুমি তো দীর্ঘদিন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করেছ। সম্পাদনাকালে এদেশের লেখকদের চারিত্র্য দেখেছো। আমাকে বলবে, আমাদের গড়পড়তা লেখকদের লেখার মান কেমন? আর তুমি সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলে, ঠিক সেভাবে করতে পেরেছ?
__________________________________________________________________________________
দৈনিকের সাহিত্য দিয়ে সামগ্রিক সাহিত্যের মান বিচার করা অসম্ভব
__________________________________________________________________________________
মামুন রশীদ: হাহাহা। প্রতিটি কবিতারই রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। যা শুধু কবিই জানে। এ রকমই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ইতিহাসের বর্ণনা সত্য অথবা ‘অর্ধসত্য’—দুই-ই হতে পারে। বোবার নাকি শত্রু থাকে না। তাই এড়িয়ে যাওয়াই তো ভালো। আর তুমি নিজেও তো এড়িয়ে গেলে। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনাকে আমার জন্য অভিশাপ হিসেবেই দেখি। আমি কখনোই সাহিত্য সম্পাদক হতে চাইনি। চেয়েছি সাংবাদিক হতে। তবে নির্ধারিত কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সাহিত্যপাতা দেখতে হয়েছে। সাহিত্যের জন্য প্রতি সপ্তাহের বরাদ্দ পাতা ভরতে হয়েছে। এটাকে আমি সম্পাদনা বলতে চাই না। বরং এক্ষেত্রে আমি সংকলকের দায়িত্ব পালন করেছি। যদি লেখককে উপযুক্ত সম্মানী দেওয়া না হয়, তাহলে সাহিত্য সম্পাদক চাইলেই কাউকে দিয়ে পছন্দমাফিক লেখা লিখিয়ে নিতে পারেন না। শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে দীর্ঘসময় ভালো কাজ দেখানো সম্ভব নয়। আবার প্রতি সপ্তাহে যেহেতু পাতা ভরানোর চাপ মাথায় থাকে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই লেখার মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এছাড়া নানান অনুরোধ-আবদার-হুমকি তো থাকেই। সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করা মানে সামাজিক শত্রুতা বাড়ানো। তবে পুরোপুরি সংকলকের দায়িত্ব নিয়ে তা অনেকটাই এড়ানো যায়। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যে নামগুলো আমাদের চোখের সামনে ভাসে, যারা নমস্য, তাদের অবস্থান থেকে সম্পাদনা করা যতটা সহজ ছিল, বর্তমানের সঙ্গে তা মেলানো যাবে না বলেই আমার মনে হয়। কারণ, একজন তরুণ, যে সাহিত্যপাতার দায়িত্ব নেয়, সে একটি চাকরি করে। এক্ষেত্রে মূল পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি কী, তাও দেখা জরুরি। পাতার দায়িত্বে থাক ব্যক্তির যদি স্বাধীনতা না থাকে, তার রুচিবোধকে (যদি সত্যিকার অর্থেই তার রুচিবোধ গড়ে উঠে থাকে) প্রাধান্য দেওয়া না হলে আসলে করার তেমন কিছু থাকে না। আর দৈনিকের সাহিত্য দিয়ে সামগ্রিক সাহিত্যের মান বিচার করা অসম্ভব। মানদণ্ড নির্ণয়ের জন্য এটা কখনোই দর্পণ হতে পারে না। তুমি নিজেও তো দীর্ঘদিন ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছ, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও দেখেছ, অনলাইনের সাহিত্য দেখেছ, সবসময় মান ধরে রাখতে পেরেছ? যা চেয়েছ, যেমন চেয়েছ তা পেরেছ? তবে তুমি তো নানামাধ্যমে সম্পাদনার কাজ করেছ, তুমি এই বিষয়গুলো কিভাবে দেখো? সত্যিকার অর্থেই কি আমাদের হাত দিয়ে প্রকাশিত লেখা কোনো সাহিত্যের সামগ্রিক কোনো ছবি ধারণ করে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: দৈনিকের সাহিত্যপাতায় কাজ করতে গিয়ে আমিও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। তবে, আমি কোনো রকম আপস করিনি। হয়তো দীর্ঘদিন থাকতে গেলে আপস করতেই হতো। আপস করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমি সাহিত্য পাতার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। আমি একসময় ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতা ছেড়ে আমাদের সময়ের নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালন করতে চলে যাই। এই তথ্য তোমারও জানা। নিউজ এডিটরকেও অনেক বিষয়ে আপস করতে হয়, সত্য। কিন্তু আমি নিউজ এডিটর হিসেবে নানা বিষয়ে আপস করতে রাজি হলেও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে একচুল ছাড় দিতেও রাজি নই। তবে হ্যাঁ, ছোটকাগজে যেভাবে সাহিত্যমান বজায় রাখা সম্ভব দৈনিকে সেভাবে সম্ভব না। দৈনিকের সাহিত্যপাতাটি হলো, ওই পত্রিকার সবচেয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ পাতা। আর ওই পাতাটি দেখেনও প্রতিটি হাউজের সবচেয়ে কম বেতনভুক্ত সাব এডিটর। বুঝতেই পারছ, একটি পত্রিকার সবচেয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ পাতায় প্রকাশিত লেখার মান আর কত ভালো হবে! দৈনিক বা অনলাইন পত্রিকা যেহেতু গণমাধ্যম, সেহেতু গণরুচির জোগান দেওয়া-ই এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে সাহিত্যমান আশা করা অবান্তর।
আমাদের আগে যারা সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন, তাদের মধ্যে কাকে কাকে তুমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করো। মানে কাকে তোমার মডেল ভেবেছিলে? তুমি যে বললে, আমাদের আগে যারা সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন, তাদের কাজটা আমাদের চেয়ে সহজ ছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলবে?
মামুন রশীদ: সাহিত্যপাতা সম্পাদনার সময়ই অনেকের কথা মনে হয়েছে। তাদের একজন কবি আহসান হাবীব। সবার শ্রদ্ধাভাজন সাহিত্যসম্পাদক ছিলেন। অনেকর স্মৃতিচারণে জেনেছি, তার কাছে লেখা নিয়ে যেতে সবাই তটস্থ থাকতেন। আমি কবি আহসান হাবীবের নাম উল্লেখ করলাম, তার কারণ্- তুমি লক্ষ করলে দেখবে, তিনি যখন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন, তখন তিনি অন্যসবার চেয়ে বড় ছিলেন। প্রজ্ঞার পাশাপাশি আমি বয়সকেও মাথায় রাখছি। চল্লিশের দশকের একজন কবি, সাহিত্য সম্পদকের দায়িত্ব পালন করছেন, যিনি সবার শ্রদ্ধার। তার কাছে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের কবিরা লেখা নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি কারও লেখা ভালো না লাগলে অকপটে বলতে পারছেন, পাল্টে দিতে বলতে পারছেন। আর আমাদের সময়ের দিকে তাকাও। বেশির ভাগ দৈনিকের সাহিত্যপাতা দেখছে কিশোর থেকে শুরু সদ্য যৌবনে পদার্পণকারীরা। এ সময়ে সচল রয়েছেন—পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই ও প্রথম দশকের কবিরা। আবার দ্বিতীয় দশকও দরজায় কড়া নাড়ছে। এক্ষেত্রে প্রথম দশকের একজনের পক্ষে কি পঞ্চাশের দশকের কোনো কবির লেখা পাল্টে দেওয়ার কথা মানায়? অথবা ওপরের কেউ অনুরোধ করলে, তা না রেখে পারা সম্ভব?
আমি তাই সবসময়ই মনে করি, একজন লেখকের জন্য যেমন যোগ্য সম্পাদক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তেমনি সত্যিকার সাহিত্য সম্পাদক তৈরিতেও লেখকদের সহযাগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন। লেখক যদি সমালোচনা সইতে না পারেন, ভুল ধরিয়ে দিলে তা ভালোভাবে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সম্পাদনা করার কাজটাই কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে সাহিত্যপাতা যিনি দেখবেন, তার সামাজিক শত্রুও বাড়বে। তিনি তত বন্ধুহীন হয়ে পড়বেন। অথবা নিজেই একটি গোষ্ঠী তৈরি করে, সেই দলের লেখাই ছাপবেন। বাইরে থেকে আসা ভালো লেখার কদর করবেন না। বা সেগুলো ছাপার সুযোগই থাকবে না।
সম্পাদনায় লেখার জৌলুস বাড়ে। লেখা উজ্জ্বল হয়। এখন অনেকেই সম্পাদনার টেবিলে লেখা পরিবর্তন হোক, তা মানতে চাইবেন না। কোনো যুক্তিই তিনি মানবেন না। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সম্পাদকের দায়িত্ব কী? এক্ষেত্রে তাই সংকলনের ভূমিকাই পালন করতে হয়।
আমার কথার সঙ্গে তোমার দ্বিমত থাকতে পারে। তবে আমার মনে হয় তারপরও তুমি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার কথা অস্বীকার করতে পারবে না। ‘দুইটা ভাতের জন্য এই শহরে এসে এত ফাল পারো কেন?’—এ রকম অসম্মাজনক কথা শোনার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। লেখকের যেমন মেরুদণ্ড থাকতে হয়, তেমনি সম্পাদকেরও। অথচ সত্যিকার অর্থেই চাকরি বাঁচাতে বিশেষত সংবাদপত্র, অনেক কিছুই ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেনে নিতে হয়। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী না হলেও মেরুদণ্ড বাঁকাতে হয়, এটাও নিশ্চয় তুমি অস্বীকার করবে না।
সম্পাদনার তিক্ত কথাবার্তা বাদ দিয়ে চলো আমরা সাহিত্যের অন্য দিকগুলো নিয়ে কথা বলি। তোমার প্রথম বই প্রকাশের কথা বলো। কেমন করে, কিভাবে লেখাগুলো মলাটবন্দি করলে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আচ্ছা ঠিক আছে,। সম্পাদনার বিড়ম্বনা প্রসঙ্গ বাদ। সাহিত্য পাতা সম্পাদনার ক্ষেত্রে তোমার আমার অভিজ্ঞতা প্রায় একই। তুমি বন্ধুকৃত্যও করেছ কিন্তু আমি করিনি। প্রমাণ হিসেবে আমার আর তোমার কথা-ই বলতে পারি। তুমি তোমার পাতায় আমার প্রচুর লেখা ছেপেছ। আমি ছাপিনি তোমার কোনো লেখায়। কী বলো, এ ক্ষেত্রে তোমার চেয়ে আমি বেশি নির্মোহ ছিলাম! (হাহাহাহাহ)। ১৯৯৫/৯৬ থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রচুর কবিতা, প্রবন্ধ ও রিভিউ লিখেছি। ২০০৭ সালের দিকে এসে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। নতুন নতুন কবিবন্ধু বাড়ছে। নতুন কবিবন্ধুদের মধ্যে একজন অগ্রজ কবি আমিনুল ইসলাম। ২০০৮ সালের দিকে তিনি আমাকে বললেন, তোমার তো কবিতার বই করার সময় এসে গেছে। বই করছ না কেন? বললাম, আমার বই কে করবে? প্রকাশক না করলে তো আমি বই করতে পারব না। তিনি বললেন, তুমি পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে আমাকে পাঠাও। আমিও পাঠালাম। এর কিছুদিন পর আমিনুল ভাই বললেন, তোমার বই বেরুচ্ছে মুক্তদেশ থেকে।
________________________________________________________________________________
প্রথম বই ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’ প্রকাশের সমস্ত কৃতিত্ব কবি আমিনুল ইসলামের
________________________________________________________________________________
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির বই মেলা। রজত সিকস্তি নামে আমার এক স্নেহভাজন কবি ঢাবিতে পড়তো। সে একদিন বইমেলায় ঢুকে মুক্তদেশের স্টলে আমার প্রথম কবিতার বই ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’ দেখে এককপি কিনে আমাকে পাঠালো। বইটি দেখে আমার রীতিমতো কান্না এলো। এক কবিতার শেষাংশ নিয়ে অন্য কবিতার প্রথমে, এক কবিতার শিরোনাম আরেক কবিতার শেষ শব্দ হয়ে আছে। পচ্ছদ তো বটতলার চটি বইয়ের চেয়ে খারাপ। আমি আমিনুল ভাইকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি খুব শান্তভাবে আমার কথা শুনলেন আমাকে আর কিছুই বললেন না। আমিও কিছুদিন পর বইটির কথা ভুলে গেলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আমিনুল ভাই ফোন করে জানালেন, আমার বইটি নতুন করে ভাষাচিত্র থেকে বের হচ্ছে। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। এরপর বইটি হাতে পেয়ে আমি আগের যন্ত্রণার কথাই ভুলে গেলাম। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, বইটির প্রকাশের সমস্ত ব্যয়ভার কে বহন করেছেন আমি জানি না। আমার তো তখন বিশ্বাস ছিল, প্রকাশকই তার খরচে সব বই করেছেন। কিন্তু না। কদিন পর আমিনুল ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, আমার বইয়ের সমস্ত কপি তার রিডিংরুমে। বিষয়টি বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। প্রথম বই প্রকাশের সমস্ত কৃতিত্ব কবি আমিনুল ইসলামের। তার কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। এরমধ্যে বই প্রকাশের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার প্রথম বই প্রকাশের কথা বলো।
মামুন রশীদ: নির্মোহ ছিলে আমার লেখা না ছেপে, এর দ্বারা আসলে কি বোঝাতে চাইলে? আমার লেখা কি তোমার বিবেচনায় মানহীন ছিল? ছাপার অযোগ্য ছিল? সময় তো অনেক গড়িয়েছে, এখন দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে পারো। তবে আমি ঠিক বন্ধুকৃত্য করেছি কিনা জানি না। আসলে সাহিত্যপাতায় কবিতা ছাপতে আগ্রহীদের অভাব না থাকলেও গদ্যলেখকের অভাব। দৈনিকের সাহিত্যপাতা যেহেতু ইস্যু নির্ভর, তাই নিয়মিত গদ্যলেখক থাকা জরুরি। তাৎক্ষণিক অনেক বিষয়েও লিখিয়ে নিতে হয়। এছাড়া জন্মদিন, মৃত্যুদিন উপলক্ষে লেখা প্রকাশের রেওয়াজ থেকে তো আমরা বেরিয়ে আসিনি। তাই পাতা বের করার জন্য গদ্যলেখক প্রয়োজন।
সাহিত্যপাতার লেখকদের নিয়মিত সম্মানী দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো কর্তৃপক্ষের অনীহা আছে, আবার অনেকের সাধ আছে সাধ্য নেই। ফলে এই পাতাগুলো ভরানোর প্রয়োজনেই অনেকটা গোষ্ঠীবদ্ধতা তৈরি হয়। আমিও দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এই দিকটা সামনে রেখেছি। ফলে যথাযথ সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও, শুধু আমাকে সহায়তার জন্যই আমার বন্ধুরা লেখা দিয়েছে।
আমার প্রথম বই ছিল কবিতার। বের হয় ২০০৫ সালে। ১৯৯৫/৯৬ সাল থেকে নিয়মিত লেখার চেষ্টা। ছোটকাগজ ঘিরে আমার স্বপ্নরা বাড়তে থাকে। সেই সময় সারাদেশ থেকেই অসংখ্য ছোটকাগজ প্রকাশ হতো। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। বগুড়া থেকেও বেরুতো অনেকগুলো কাগজ। বগুড়ার বাইরে প্রথম লেখা বেরুলো সম্ভবত ক্রম নামের ছোটকাগজে। সম্পাদনা করতে আশির দশকের কবি ওয়ালী কিরণ। তার হাতে আমার লেখা নিয়ে দিয়েছিলেন, ইসলাম রফিক। কিরণ ভাই আমার একগুচ্ছ কবিতা ছাপেন তার কাগজে। এটা মনে হয় ১৯৯৭/৯৮-এর ঘটনা। সম্ভবত সেই একই বছর দৈনিকে আমার কবিতা ছাপা হয়। দৈনিক জনকণ্ঠে। বগুড়া থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় তৌফিক জহুর, আমার কয়েকটি লেখা নিয়ে এসে জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক কবি নাসির আহমদকে দেন। তিনি পাশাপাশি সময়ের মধ্যে দু’টি সংখ্যায় আমার দু’টি লেখা ছাপেন।
বই প্রকাশের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু ২০০৫সালের জানুয়ারিতে হঠাৎ মনে হয়, বই করব। প্রকাশক তো নেই, নিজেই করার, আমার ছোটকাগজ- দ্বিবাচ্য থেকে। পাণ্ডুলিপি তৈরি করলাম। বইয়ের নাম নিয়ে দ্বিধাছিল। মাহমুদ শাওন বইয়ের নাম পছন্দ করে দিল। সম্ভবত ঈশান সামীর কাছে একটা আঁকানো ছবি ছিল, সেটা দিয়েই কাভার করা হলো। বই প্রেসে দেওয়ার আগে-আগে ইসলাম রফিক, বইটার প্রকাশক হিসেবে তার ছোটকাগহ দোআঁশ-এর নাম প্রস্তাব করলেন। বই ছাপা হলো, প্রকাশক দোআঁশ। তিনি শুধু পুস্তানির টাকা দিয়েছিলেন। বাকি টাকা আমার। ছাপার পর বই দেখে মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, বইটা এত তাড়াহুড়োতে না করলেও পারতাম।
‘কালোপাতা, ওড়ো, সাদাছাই’ নামের এই বইটি নিয়ে একটা আলোচনা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লিখেছিল তালাশ তালুকদার। আলোচনাটা ছাপা হয় অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে। এরপর আরও তিনটি কবিতার বই হয়েছে। ‘বাংলাদেশের কবিতা, সৃজনে অর্জনে’নামের গদ্যের বইটির জন্য প্রকাশক জোগাড় করে দিয়েছিলেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান। পরেও তিনি আমার বই প্রকাশে সহযোগিতা করেছেন। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য যাই বলো, কোনো কোনো বইয়ের জন্য কয়েকটি করে টাকা পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার টাকা দেওয়ার কথা বলে পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘোরানো এবং অসম্মানজনক ব্যবহার পাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে আমার।
তবে বই লিখে টাকা পাওয়ার সঙ্গে আমাদের প্রকাশনা বা আমার নিজের মান বাড়ার যোগসূত্র স্থাপন করতে চাই না। সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রকাশনা জগৎ নিজস্বতাই অর্জন করতে পারেনি। আর পারবেই বা কী করে? যেখানে প্রকাশকদের বড় অংশই চায় মুরগি ধরতে। কোনো প্রকাশক কি তার প্রকাশনীর বই বাজারজাত করেন? তারা পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে চান না, তারা লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে লেখকের হাতেই ধরিয়ে দেন। লেখক তখন সেই বইগুলো নিজের পরিচিতজনদের মাঝে বিলি করেন।আমাদের কোনো প্রকাশনা সংস্থার কি সম্পাদনা বিভাগ আছে? বই যে সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে হয়, সেজন্য কোনো প্রকাশকেরই নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদ নেই, নেই বানান সংশোধনের নিজস্বরীতি। আমাদের প্রকাশনা ব্যবস্থাতেই রয়ে গেছে গলদ। তুমি কী বলো?
তোমার তো এরই মধ্যে অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। এই বইগুলো প্রকাশের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রকাশনা জগতের সঙ্গেও তোমার একটা জানাশোনা হয়েছে, তোমার ধারণা ও অভিজ্ঞতার কথা বলো।
মোহাম্মদ নূরুল হক: হাহাহাহা। তুমি ক্ষেপলে নাকি? আরে তোমার কবিতা সত্যিকার অর্থেই কবিতা। কিন্তু আমার সম্পাদিত সাহিত্যপাতায় আমি বন্ধুদের জায়গা কম দিতাম। এছাড়া ওই পাতাটি একলা আমি দেখতাম না। আমার সঙ্গে আরও একজন দেখতেন। ফলে তিনি যেন মনে না করেন, আমি বন্ধুদের লেখা ছাপছি। তাই বন্ধুদের লেখা কম ছাপতাম। আমাদের প্রকাশনা সেক্টরের মান ভালো না। এটা সত্য। প্রায় প্রকাশক লেখকের টাকায় বই করেন। এটাও সত্য। তবে এরজন্য প্রকাশক একা দায়ী নন। নব্বই ভাগ দোষ লেখকদের। তারা যাচ্ছেতাই লিখে বই করতে চান। প্রকাশক তো তাদের যাচ্ছেতাই লেখা ছাপিয়ে লোকসান গুনতে চাইবে না। তখন প্রকাশকপাল্টা শর্ত জুড়ে দেন। আর লেখকরাও তাতে রাজি হয়ে যান। এর ফলে লেখকের টাকায় বই বের হয়। যে বই লেখকের টাকায় বের হয়, সে বইয়ের মার্কেটিং প্রকাশক কেন করবেন? সে বই সম্পাদনাও বা কেন করবেন? তুমি যে বললে আমাদের প্রকাশনীগুলোর সম্পাদনা বোর্ড নেই, কথাটি শতভাগ সত্য না। সম্পাদনা বোর্ড আছে। তবে সীমিত। গননা করার মতো নয়।
আর আমাদের লেখকদের তুমি যদি বলো, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেই প্রকাশ করতে হবে। তখন কিন্তু লেখকরা নিজে নিজেই প্রেসে গিয়ে কন্ট্রাক্ট করে রাতারাতি বই করে দেখিয়ে দেন। প্রকাশক পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার যত শর্তই দিক, লেখক সম্পাদনার কথাও শুনতে চান না। অধিকাংশ লেখকই মনে করেন, তিনি যা লিখেছেন, তা মাস্টারপিস। ফলে তার লেখা সম্পাদনা করা যাবে না। এই লেখকদের সমস্যা দুই দিকে। প্রথমত, তারা জানতে চান না, জানাতে চান। দ্বিতীয়ত, শিখতে চান না, শেখাতে চান। শুনতে চান না, শোনাতে চান। এ কারণে আমাদের সমাজে শিক্ষার্থী কম, পণ্ডপণ্ডিত বেশি, শ্রোতা নেই মাঠভর্তি বক্তা। আর এই বক্তা- পণ্ডপণ্ডিতদের বক্তব্য আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে হতে তাদের কর্ণকুহুরেই বজ্রপাতের মতো আঘাত করে। তারা আবেগ গদগদ হয়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘আহ পাইলাম অমৃতবচন পাইলাম!’ তো তুমি এই ধরনের লেখকের লেখা সম্পাদনা করবে কোন সাহসে? আর প্রকাশকই বা কেন এই সম্পাদনাহীন পাণ্ডুলিপি নিজের টাকায় প্রকাশ করবেন? আর লেখকের টাকায় প্রকাশিত বই প্রকাশ কেন মার্কেটিংয়ের দায়িত্ব নেবেন?
প্রকাশকরা ভালো পাণ্ডুলিপি না পেলে বিনিয়োগ করবেন কেন? ভালো পাণ্ডুলিপির জন্য ভালো সম্পাদক দরকার। ভালো সম্পাদকের জন্য ভালো সম্মানী দরকার। এভাবেই সাহিত্য মানসম্পন্ন হয়ে ওঠে। আর মানসম্পন্ন সাহিত্যের জন্য ভালো সমালোচনাও দরকার। আমাদের এখানে ভালো সমালোচনা যে হয় না, তা নয়। হয়, তবে তা পরিমাণে খুবই কম। কম হওয়ার কারণ ঝুঁকি নেওয়ার অনীহাপ্রবণতা। প্রায় সমালোচকই ঝুঁকি নিতে চান না। কারণ তারা জানেন, তুমি যদি সাহিত্যসমালোচক হিসেবে তুলনামূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণের পথে যাও, আর আঙ্গিক-প্রকরণ ও বিষয়বস্তুর সমন্বিত আলোচনা করো, তাহলে কবি-কথাকাররা তোমাকে অপছন্দ করবে। আর যদি কেবল বিষয় ধরে ধরে আলোচনার পাশাপাশি ‘বিস্ময়কর প্রতিভা’, ‘অসাধারণ কাজ’, ‘মৌলিক স্বর’, ‘নতুন ধারার স্রষ্টা’মার্কা মন্তব্য করো, তাহলে তোমাকে মাথায় তুলে নাচবে। এখন তুমি কোন পথে যাবে?
মামুন রশীদ: আরে না ক্ষেপিনি। প্রচারে প্রসারনীতি সবখানে খাটে না। আমার লেখাই নেই, তাই প্রচারের পেছনে ছুটি না। ফুল ফুটলে সৌরভ এমনিতেই ছড়াবে। আমার লেখা ছাপার জন্য তোমাকে অনুরোধ করেছি, বিরক্ত করেছি, ঘ্যানঘ্যান করেছি, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। অনুরোধের আসর সম্পর্কে আমার নিজেরই বিরক্তি আছে।
আর লেখা কোথাও প্রকাশ হওয়া মানেই আমি বিরাট কিছু হয়ে গেলাম, তা তো না। ২০১২-এর (আমার কর্মরত প্রতিষ্ঠান ছাড়া) অন্য কোনো দৈনিকে আমার লেখা (সাহিত্য বিষয়ক) ছাপা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এমনকি ছোটকাগজে লেখা দেওয়াও আমি কমিয়ে দিয়েছি। আর এখন চিন্তাসূত্র ছাড়া কোথাও লেখা দেইনি। আমার কাছে কেউ লেখা চায়ওনি।
প্রকাশকদের কারো কারা সম্পাদনা বোর্ড আছে, বানান সংশোধনের নিজস্ব রীতি আছে, একথা সত্য হলেও তা কোনো কিন্তু উদাহরণ তৈরি করছে না। কোনো দৃষ্টান্ত কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এর কারণ, যারা এটা করেছেন, তাদের সংখ্যা হাতের আঙুলে গুনে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের প্রকাশনাসংস্থার সংখ্যা হাতের আঙুলে তো দূরের, অনেক কিছু যোগ করেও সঠিক সংখ্যা জানতে পারবে না।
বই প্রকাশের দুই ধরন। এক. প্রকাশকরা লেখকদের কাছে ধরনা দিয়ে পাণ্ডুলিপি নেন। লেখক সম্মানী দেন এবং বই কাশ করেন। দুই. লেখকরা প্রকাশকদের কাছে ধরনা দেন, নিজের টাকা প্রকাশককে দেন এবং প্রকাশকরা বই বের করে লেখকদের হাতে তুলে দেন। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটিই ঘটছে সবচেয়ে বেশি। সারাবছর দূরের, কখনোই যাদের লেখা দেখোনি, কোথাও, দেখবে মেলায় পাঁচটি বই নিয়ে হাজিরা তারা । খবরে লেখা হচ্ছে মেলায় সাতটি বই এলো অমুকের। আমি এই বইগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এই যে অপচয়, এই যে গাছ হত্যা করে তৈরি কাগজের অপব্যবহার, সেই বিষয়টিই দৃষ্টিতে এনেছি। হ্যাঁ, তাদের বই প্রকাশকরা বাজারজাত করেন না। কিন্তু, আমরা যারা, এই দুই পক্ষের কোনোটিতেই ঢুকতে পারিনি, তাদের বইও কি বাজারজাত হয়? আমার বই তেমন বিক্রি হয় না, কিন্তু আমার সমসাময়িক অনেকের বইয়ের প্রতিই আগ্রহ দেখেছি আমি, সেসব বই নিয়ে আমার নিজেরও আগ্রহ আছে। কিন্তু তাদের বইগুলোও বইমেলার বাইরে কোথাও পাওয়া যায় না।
___________________________________________________________________________________
সমালোচনা তো দূরের, আলোচনা করারই তো উপায় নেই
__________________________________________________________________________________
আচ্ছা, যে লেখকের বই টাকা নিয়ে প্রকাশক বের করছেন। ধরে নিলাম তার কোনো পাঠক নেই। কিন্তু প্রকাশক কি তা যাচাই করেছেন? এ ক্ষেত্রে সেই বইগুলো, যা লেখকের টাকা বের হয়েছে, সেগুলোও তো প্রদর্শন করে, প্রকাশক বাজার এবং আগ্রহ যাচাই করতে পারেন। তুমি খেয়াল করে দেখবে, এটাও করা হয় না।
একজন চিকিৎসককে জানি, আমার সঙ্গে ফেসবুকে আছেন, কথা হয়নি কখনো। ফেইসবুকে তার নিজের দেয়ালে দেওয়া তথ্য থেকে জেনেছি, গত বইমেলায় তার চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। অবাক করার মতো বিষয়। বইমেলায় যদিও সেই বইগুলোর যথাযথ প্রদর্শন আমার চোখে পড়েনি, তবু আমার বলার জায়গাটা এই, একজন প্রকাশক যার চার চারটি বই একই মেলায় আনলেন, সেগুলো বিপণনের একটা উদ্যোগ বা ঝুঁকি তিনি নিতে পারতেন। এক্ষেত্রে তার দ্বিগুণ মুনাফার সুযোগ থাকতো। কারণ, বই প্রকাশের টাকা তো লেখক দিয়েই দিয়েছেন। এখন তার থেকে কিছু যদি বিক্রি হয়, তাহলে মুফতে প্রকাশকেরই লাভ। এই টাকাটা তো লেখককে দিতে হতো না। আসলে আমাদের সবক্ষেত্রেই সততা যে ঘাটতি, যা আমার মধ্যে, তা প্রায় সবার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে একই বৃত্তে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। আর সমালোচনার কথা যেটা তুমি বললে, এর সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই। সমালোচনা তো দূরের, আলোচনা করারই তো উপায় নেই। বেশ করেছেন, বেশ হয়েছে, বাহ, বাহ, বাহ- এটা হলো আমাদের আলোচনার মূলমন্ত্র। এর বাইরে গেলেই বিপদ।
কোনো কোনো বই পড়ার পর, অনেক সময়-আমার নিজেরই ইচ্ছে হয় লিখতে। এই লেখাটা আলোচনা-সমালোচনা কোনো পর্বেই আমি ফেলি না। এটা শুধু বইটিকে বা লেখাটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কারণ আমি মনে করি, যে বইটি আমার ভালো লাগলো, যে কবিকে আমার ভালো লাগলো, তার সম্পর্কে অন্যদেরও আগ্রহ তৈরি হোক। এখন এটা করাও কঠিন। বই পরিচিতি লিখে, বা ব্যক্তিগত অভিমত লিখে আমি কাউকে খুশি করতে চাইনি। আবার কেউ বেজার হোক, সামাজিক শত্রুতা তৈরি হোক, তাও চাই না। অথচ দ্বিতীয়টিই হচ্ছে।
যখন কোনো বই বা লেখা ভালো লাগলো, জানানোর পর, লেখক তার লিখিত অভিমত চান, তখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই আমি করতে আগ্রহী। কিন্তু যখন, লেখক জোর করেন, বাধ্য করতে চান, তিন ফর্মা বইয়ের জন্য পাঁচ ফর্মা আলোচনা প্রত্যাশা করেন, আবার যেটুকুই লেখা হোক, তা মনমতো হয়নি বলে মন্তব্য করেন, তখন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আমি দেখি না।
একইভাবে আরও একটি বিষয় এই অবসরে স্পষ্ট করি। এটি অন্যদের বেলায় ঘটেছে কি না, জানি না। তবে আমার ক্ষেত্রে একাধিক বার ঘটেছে। আমার লেখা, আমার অভিমতকে যখন কেউ নাকচ করে দেওয়ার পরও কেউ কেউ আমার কাছে প্রত্যাশা করেন, আমি যেন তাকে নিয়ে লিখি। এখন তুমিই বলো, আমি তাদের নিয়ে লেখা ঠিক হবে?
আমার সময়ে কারা কারা ভালো লিখছে, বা চেষ্টা করছে, বা সচল এরকম প্রশ্নের জবাবে যখন কোনোভাবেই আমি সামনে আসি না। তখন কী করে প্রত্যাশা করা যেতে পারে, তাদের লেখা সম্পর্কে আমার মূল্যায়ণ? আর সেটা যদি আমি করিও, তা কি তার নিজের মনমতো হবে?
তুমি তো নিজে অসংখ্য বই আলোচনা করেছ। অনেক বইকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছ, অনেককে নিয়ে মূল্যায়ন করেছ, এ ক্ষেত্রে তোমার অভিজ্ঞতা কী?
চলবে…