তুহিন তৌহিদ—এই সময়ের ছন্দ-ভাষা-অলঙ্কার সচেতন কবিদের একজন। তার উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থগুলো হলো:‘অডিসিউস ও অন্যান্য কবিতা’, ‘ফিনিক্স পাখির মতো’, ‘প্রজাপতিঘুড়ি’, ‘ফেলানির ডানা’ ও ‘প্রেমের বয়ান’।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
তুহিন তৌহিদ: অনেকটা তা-ই। এটা ঠিক যে, ওয়েবম্যাগ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। এখন অনেকেই ওয়েবম্যাগগুলোয় লিখছেন। কবিতা, ছড়া, গল্প থেকে শুরু করে উপন্যাসও প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলোতে। প্রকাশিত লেখা ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে অধিক সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে প্রিন্ট ভার্সনের একটা বিশেষ গুরুত্ব এখনো আছে বলে মনে হয়। সংরক্ষণ ও পড়ার সুবিধার কারণে হয়তো। আবার অনেকে ওয়েবম্যাগে লেখা প্রকাশ করছেন; পরে ওই লেখাটাই আবার লিটলম্যাগে ছাপছেন, বা বই আকাশে প্রকাশ করছেন। সুতরাং ওয়েবম্যাগ আর প্রিন্ট ভার্সনের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে। লেখক নিজেই সেটা করে নিচ্ছেন। এটা ভার্চুয়াল টু রিয়্যালিটির সেতু। সম্পাদক এখানে ক্যাটালিস্ট।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
তুহিন তৌহিদ: এটা হয়তো একটা বড় কারণ। ওয়েবম্যাগের ক্ষেত্রে অর্থ খরচের তেমন বালাই নেই। আবার লিটলম্যাগ করতে গেলে খরচ অনেক। তবে শুধু যে অর্থ ব্যয়ের কারণে ঝুঁকছেন, এমনটা মনে হয় না। ওয়েবম্যাগ সহজেই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিলে পাঠকের প্রতিক্রিয়াও জানা যায়। এই কারণেও ঝুঁকতে পারেন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তুহিন তৌহিদ: হ্যাঁ, তা হচ্ছে। অনেক লিটলম্যাগের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। তবে সেক্ষেত্রে বানান শুধরানোর কোনো সুযোগ থাকে না; ওয়েবম্যাগে বানান ঠিক করা যায় সহজেই। অনেক নতুন লেখক শুরু করেন ফেসবুক দিয়ে, পরে লেখা ওয়েবম্যাগ পাঠান। সম্পাদকও প্রকাশ করে দিচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে লেখাগুলো ভুল বানান বা বাক্যে ছাপা হচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে এক হাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শত টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
তুহিন তৌহিদ: অবশ্যই সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের প্রতি প্রেমের জন্য। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আছে দেখেই তারা সময় ও পরিশ্রম দিয়ে এ কাজগুলো করছেন। আমার কাছে এটাকে কখনো কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায় বলে মনে হয়নি।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
তুহিন তৌহিদ: না। আমার তা মনে হয় না। পাঠবিমুখ করবে কেন? বরং বলতে পারেন, নতুন পাঠক সৃষ্টি করছে। বইয়ের পাঠকই এখানে আসছে, আবার ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিনের তৈরি করা নতুন পাঠক বইয়ের দিকে ঝুঁকছে। নিজেকে সমৃদ্ধ করতেই তারা এটা করছে। আমার তো মনে হয়, এতে বইয়েরই পাঠক বাড়ছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
তুহিন তৌহিদ: দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা বলেন, লিটলম্যাগ বলেন, আর ওয়েবম্যাগ বলেন—এগুলো সবই লেখা প্রকাশের মাধ্যম। অনেকে লিটলম্যাগে লেখেন, ওয়েবম্যাগে লেখেন কিন্তু দৈনিকে লেখেন না। অনেকে দৈনিকে লেখলেও লিটলম্যাগে নেই। এক্ষেত্রে আমি সব মাধ্যমে লিখি। তবে সব দৈনিকের সাহিত্য পাতায় লিখি না; সব লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগেও না। কিছু বাছ-বিচারের প্রয়োজন পড়ে—নানা কারণেই।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিনশ’ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
তুহিন তৌহিদ: অবশ্যই ইতিবাচক। ফেসবুকের কল্যাণে তা দ্রুত হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে যায়। এসব লেখা অনেক সম্পাদক সংগ্রহ করেন এবং লিটলম্যাগে প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে মফস্বলে থাকা ওই লিটলম্যাগ সম্পাদকও ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন ও ফেসবুকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
তুহিন তৌহিদ: ইতোমধ্যে অধিকাংশ দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারিয়েছে। ওয়েবম্যাগের সংখ্যা বাড়লে এ সংকট আরও প্রকট হবে। অনেক দৈনিকের সাহিত্যপাতা খুলে দেখাও হয় না। লেখা প্রকাশিত হলেও লেখকরাই সেটা ফেসবুকে দেন। এর মাধ্যমে বাকিরা জানতে পারেন; লাইক দেন, মন্তব্য করেন।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
তুহিন তৌহিদ: ওয়েবম্যাগগুলোরও লিটলম্যাগের মতো বিশেষ কিছু চরিত্র থাকে; বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট থাকে। সে অনুযায়ী সেগুলো আত্মপ্রকাশ করে। কিছু লিটলম্যাগের মতো কিছু ওয়েবম্যাগও আছে সিন্ডিকেটভিত্তিক লেখা প্রকাশ করে। তবে সবগুলো এ রকম নয়। আমার পছন্দের ওয়েবম্যাগ কোনো সিন্ডিকেটে থাকবে না; এটি ভালো লেখা পেলে ছাপাবে। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রত্যেকটি ধারার লেখা থাকবে এতে। থাকবে সাহিত্যিক ও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট খবরও। এসব বিবেচনায় চিন্তাসূত্রকে আমার পছন্দ। লেখকদের জন্মদিনেও দেখি চিন্তাসূত্র স্ট্যাটাস দিয়ে শুভেচ্ছ জানায়, জন্মদিনের সংবাদও প্রকাশ করে। বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করে।