মৃণাল বসুচৌধুরী, কবি। জন্ম ১৩ই জানুয়ারি ১৯৪৪। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন বেলাভুমি (১৯৬৫)। ৬০-এর দশকে শ্রুতি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ৩৪। এরমধ্যে কাব্যগ্রন্থ ২৬। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কবি। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
মৃণাল বসুচৌধুরী: দৈনিক বা সাপ্তাহিকের সাহিত্যপাতায় জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ লিটলম্যাগ বের কতেন—এ মন্তব্যটি অতি সরলীকরণ হয়ে গেলো, মনে হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ আলোক সরকারের ‘শতভিষা’, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘বিভাব’, পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিপত্র’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল বলেই আমার মনে হয়। যারা গতানুগতিক ধারায় লিখতে চান না, স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তার কেউ-ই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজের ওপর ভরসা না করে কষ্ট করে নিজেরা কাগজ করেন, নিজেদের মতো করে লেখার জন্য। ছয়ের দশকে বা পরবর্তীকালে কবিতা নিয়ে যারা আন্দোলন করেছেন, তারা সবাই নিজেদের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য নিজের পত্রিকা বের করেছেন। যেমন, শ্রুতি, হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রত্যেকেরই নিজস্ব পত্রিকা ছিল।
এপারে লিটলম্যাগের সংখ্যা কিন্তু কমছে না। প্রতি বছরই কিছু নতুন পত্রিকা বের হচ্ছে। কলকাতার লিটলম্যাগ মেলা বা জেলার মেলাগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি এটাও ঠিক বেশ কিছু ওয়েবম্যাগও প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু তারা এখনো লিটলম্যাগের জায়গা নিতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। আদর্শগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো কিন্তু থাকবেই। অন্তত ততদিন, যতদিন না এই অনলাইন পত্রিকাগুলো তাদের নিজস্ব চরিত্র তৈরি করতে পারছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
মৃণাল বসুচৌধুরী: আর্থিক দায় ও পরিশ্রম অনেক কম তো বটেই, এছাড়া চটজলদি অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার তাগিদ থেকেও ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন লেখক বন্ধুরা। তবে যারা সাহিত্যজগতের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চান, তারা এখনো বোধ হয় ছাপা কাগজের ওপর ভরসা রাখেন বেশি।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
মৃণাল বসুচৌধুরী: অভিযোগটি অনেকটাই সত্যি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পাদকরা সংকলকের ভূমিকা নিচ্ছেন। যা পান, তা-ই ছাপেন। অনেক লিটলম্যাগও এই দলে পড়ে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
মৃণাল বসুচৌধুরী: নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের জন্য অনেকেই ওয়েবজিন প্রকাশ করেন, এমন কিছু মানুষ হয়তো আছেন। তবু এটাই বিশ্বাস করি, সাহিত্যের প্রতি প্রেম থেকেই বেশিরভাগ বন্ধু ওয়েবজিন করেন।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
মৃণাল বসুচৌধুরী: যান্ত্রিক সভ্যতায় এমনিতেই অবসরের সময় কমে গেছে আমাদের। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই। সাহিত্যপাঠে অনাসক্তিও বেড়েছে। লেখক বন্ধুরাও অন্যের লেখা পড়ার থেকে নিজের প্রচারে সময় দেন বেশি। তা সত্ত্বেও তন্নিষ্ঠ পাঠকরা এখনও বইপাঠবিমুখ হয়েছেন বলে মনে করি না। হওয়ার আশঙ্কাও কম।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
মৃণাল বসুচৌধুরী: এমনিতে আমি খুব কম লিখি। ভালোবেসে কেউ লেখার জন্য অনুরোধ কলে, আমি সর্বত্র লেখা দেই, যদি লেখা থাকে। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যাস প্রিন্ট মিডিয়ার দিকেই টানে।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মৃণাল বসুচৌধুরী: অনলাইন সাহিত্য পত্রিকার প্রচার নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। অসংখ্য ইউজারের কাছে তা পৌঁছে যায়। কেউ কেউ পড়েন, কেউ কেউ শুধু দেখেন, সেটাই বা কম কী? এই জন্য সব দৈনিক পত্রিকা ই-পেপার করছে, এই বিরাট পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছানোর জন্য।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
মৃণাল বসুচৌধুরী: এখনো মনে করি না। ওয়েবম্যাগের গুণগত চরিত্র বদল না হলে তা সম্ভব নয়।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
মৃণাল বসুচৌধুরী: আমাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি বিষয়ে পাঠককে সম্যকভাবে অবহিত করা যায়, এমন লেখা প্রকাশ করলে সত্যিকারের সাহিত্যসেবা হবে। পাঠকরাও উপকৃত হবেন।