মোজাম্মেল হক নিয়োগী—মূলত কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুতোষ ছোটগল্প। রয়েছে প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ে একাধিক গবেষণাগ্রন্থ। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ বিষয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক-গবেষক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: দৈনিকের সাহিত্যপাতায় স্থান পেলেও কথাসাহিত্যিকের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য দৈনিকের পাতা যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। এর কারণ, প্রতিটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায় নির্দিষ্ট স্পেস, অনেক লেখার ভিড়, তদবির, কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ, স্বজনপ্রীতির কারণে শব্দসংখ্যা গুনে কথাসাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়। গল্প বা প্রবন্ধের জন্য লেখার প্রতিপাদ্যের চেয়ে নজর দিতে হয় লেখার আকার ও শব্দের দিকে। এছাড়া সংবাদপত্রের বিধিবিধানও সাহিত্যের উৎকর্ষের অন্তরায়। এ কারণে লিটলম্যাগই লেখক ও সাহিত্যসৃষ্টির উত্তম মাধ্যম। জীবনানন্দ দাশ, জয় গোস্বামীর মতো অনেক কবিই কিন্তু লিটলম্যাগের মাধ্যমে উঠে এসেছেন। আরও আসবেন। তাদের লেখক হওয়ার ক্ষেত্রে দৈনিকের ভূমিকা ছিল খুব কম। একটি কথা এখানে বলা জরুরি যে, শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে দৈনিকের গুরুত্ব অনেক বেশি।
লিটলম্যাগ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে ইন্টারনেটের প্রসার, ইন্টারনেটের ব্যবহার ও খরচ কমে যাওয়া একটি কারণ। আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, এদেশের মানুষ চায় শর্টকাট পথে সবকিছু অর্জন করতে। পরিশ্রম করে বা সাধনা করে কিছু অর্জন করতে চায় না। যারা লিখছেন, তাদের অনেকের সাধনার অভাব, অনেক নবীন লেখক হয়তো বিশ্বাসই করেন না যে, ভালো পাঠক না হওয়া পর্যন্ত ভালো লেখক হওয়া যায় না। ফলে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে গেছে মারাত্মকভাবে। তরুণরাও এখন কাগজের পড়া বাদ দিয়েছে এবং ফেসবুক, ইন্টারনেট নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ বেড়েছে এ কথা সত্যি, পাশাপাশি অনেক ঝামেলাও কমেছে। যেমন, সম্পাদকের যাতায়াত খরচ, কাগজের মূল্য ইত্যাদির কারণেও ওয়েবম্যাগের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। আমাদের বিশ্বাস, লিটলম্যাগের জায়গা অনলাইন এখনও দখল করতে পারেনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে দখল করবে, তা জোর দিয়েই বলা যায়।
চিন্তাসূত্র: কদিন আগেও লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: এর উত্তর আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। খরচের ব্যাপারটা অবশ্যই বিবেচ্য। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কাগুজের পৃষ্ঠা পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনযাপনে খরচের তুলনায় লিটলম্যাগের উৎপাদন খরচ খুব বেশি নয়। কিন্তু পাঠক যদি লিটলম্যাগের দিকে ফিরেই না তাকায়, তাহলে কে যাবে খরচের ঝুঁকি নিতে? এতে শুধু খরচের ঝুঁকি যে রয়েছে, তা নয়। একজন লিটলম্যাগ সম্পাদক অনেকে দায়িত্ব নিয়ে, অনেক সময় ব্যয় করে এবং অনেক পরিশ্রম করে একটি পত্রিকা বের করেন। কিন্তু যখন তিনি দেখেন ম্যাগাজিনটা কেউ পড়লো না, তখন তার উৎসাহে ভাটা না পড়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত আমরা মনে করি, লিটলম্যাগের পাঠকের অভাবেই সাহিত্যকর্মীরা ওয়েবের দিকে ঝুঁকেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় আলোকপাত করা যেতে পারে, আগে লেখকরা কলমে লিখতেন। এগুলো আবার কম্পোজ করতে হতো, দেখতে হতো কয়েকটি প্রুফ। বর্তমানে অনেক লেখক কম্পিউটারে লেখেন। ফলে কম সময়ে অধিক লেখা যাচ্ছে। সম্পাদকও কম্পোজের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাচ্ছেন, তিনি শুধু একবার বা দুবার পড়েই পেস্ট করে দেন। ঝামেলা শেষ। পরিশ্রম কমে যাওয়ার কারণেও অনেকেই লিখছেন এবং ওয়েবম্যাগ এসব লেখা প্রচারের জন্য একটি ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়াল।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: এ অভিযোগকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আগের কথায় আবার ফিরে যেতে হচ্ছে। আমরা সবাই শর্টকাট পথে অধিক সাফল্য অর্জন করতে চাই। অধিক উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু মানসম্মত হচ্ছে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ করে দেখুন—পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, লেখালেখির ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে। রাজনীতি যিনি করছেন, তিনি রাজনীতিবিষয়ক লেখাপড়া করছেন না, ছড়া-কবিতা যিনি লিখছেন, তিনি ছন্দ সম্পর্কে জানতে চান না, কথাসাহিত্য যিনি পড়ছেন তারও পড়ার প্রতি অনীহা। আপনি যদি কাউকে বলেন পড়ার জন্য, দেখবেন অনেকেই রাগ করেন। যিনি গান করছেন, তিনি রাগ শিখছেন না। প্রতিটা ক্ষেত্রেই এমন শর্টকাট পদ্ধতি চলছে। ফলে পেশাদারিত্বের বড় অভাব দেখা দিয়েছে সর্বত্র। সাধনা ছাড়া ভালো কিছু কি অর্জন করা যায়? আপনিই বলুন। এ-কারণেই ওয়েবভিত্তিক সাহিত্যপত্রিকাগুলোর অনেক ক্ষেত্রে মানসম্মত হচ্ছে না, বানানরীতি মানছে না, লেখক যেভাবে লেখা পাঠিয়ে দেন, সেভাবেই ছাপা হয়—সম্পাদনার কাজটিও করেন না। (আমি বলব, এখানে লেখকদেরও দোষ আছে। অনেক লেখকই চান, তার লেখা তিনি যেভাবে পাঠান, সেভাবেই যেন প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা জিনিসটা কী, এই শ্রেণীর লেখক-সম্পাদক কেউ জানেন না।) এটি বড় দুঃখজনক ব্যাপার। আবার অনেককে দেখা যায় সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ কবিতা ঘোষণা করে কবিকে পুরস্কারও দেন। এমন পুরস্কার পাওয়া দুয়েকটি কবিতা পাঠ করে দেখেছি, যা কবিমহলে হয়তো কেউ গ্রহণই করবেন না। শর্টকাট পথে চলতে গেলে যা হয়, তাই হচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনে পয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: প্রশ্নটির শেষ দিকে উত্তর দেওয়া যাক। সাহিত্যপ্রেম কিনা বলা খুব কঠিন। যদি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে, তাহলে তার সর্বস্ব দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে। প্রেমের জন্য কত সময় দেয় একবার ভেবে দেখুন। কিন্তু সাহিত্যপ্রেমের বেলায় কি আমরা তা দেখি? যদি নিখাদ সাহিত্যপ্রেম হতো, তাহলে সাহিত্যকে ভালোভাবে না বুঝে, সাহিত্যের গভীরে না গিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি থেকে বিরত থাকত। আমার লেখালেখির সুবাদেই অনেকেই আমার কাছে লেখা পাঠান মন্তব্য করার জন্য। যদি লেখা সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা বলা হয়, তাহলে তিনি বা তারা মনে করেন আমি মূর্খ এবং তার চরম শত্রু। যদি বলা হয়, এই বইটা পড়ুন এ বিষয়ে জানতে পারবেন,তাহলে তিনি বা তারা বলবেন, এসব পড়ার সময় কই। যা লিখছি তাই লিখে যাবো। এ ধরনের আচরণকে কি সাহিত্যের প্রেম বলে? অথচ আমাকে (আমিত্ব প্রকাশ করছি না) যেকোনো লেখক যদি বলেন, ওই বইটা পড়ুন, তখন সেটা আগে কিনে পড়া শুরু করি। তার মানে এই নয় যে, আমি সাহিত্যপণ্ডিত হয়ে গেছি। বলতে চাচ্ছি, কিছুটা প্রেম আছে বলেই পড়ে শিখতে চাই, জানতে চাই।
কর্তৃত্বও সর্বাংশে ঠিক নয়। আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থাকেও দেখতে হবে। যদি চাকরির করার সুযোগ থাকত বা বেকার না থাকতে হতো, তাহলে এই কাজে মানুষ কমে যেত অনেক। কারও কারও হয়তো এধরনের মানসিকতা থাকতেও পারে। আমার লেখা ওরা ছাপায় না, ঠিক আছে আমিও দেখিয়ে দেব। কিন্তু দেখিয়ে দেওয়ার যে যোগ্যতার প্রয়োজন, সেটা হয়তো ভেবে দেখেন না। এ কারণেই ওয়েবজিন বা ব্লগজিন খুলে নিজেও লিখছেন, সম্পাদক হচ্ছেন। এ থেকে কিছু রোজগারেরও চেষ্টা হচ্ছে, পাশাপাশি করপোরেট বিশ্বে প্রবেশের চেষ্টাও করছেন।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: পাঠবিমুখতার জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক ম্যাগাজিনকে পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। পড়া কেন প্রয়োজন, এই বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার। একশ’ বছর বা পঞ্চাশ বছর আগে মানুষ কেন পড়ত? জ্ঞানতাপস পড়তেন জ্ঞানের জন্য, জানার জন্য। আর অধিকাংশ পাঠকই সাহিত্য পড়তেন বিনোদনের জন্য। এখন বিনোদনের মাধ্যম বইপত্র ছাড়িয়ে চলে গেছে আকাশ-নেট সংস্কৃতিতে, মানুষ দেখছে টেলিভিশন, ঘাঁটাঘাঁটি করছে ইন্টারনেট। বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম বর্তমানে ফেসবুক। ফেসবুকই মানুষের পড়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওয়েবম্যাগজিনের সাহিত্যও মানুষ পড়ে না, শিরোনামটা দেখেই অন্যদিকে চলে যায়। তার মানে বাংলাদেশের মানুষ পড়ার প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলছে। ফেসবুকে একটা সিরিয়াস লেখা দেন, দেখবেন পাঠক নেই। একটু হালকামানের লেখা দেন, দেখেন আপনি কত জনপ্রিয়। আবার বড় লেখা দেন, কেউ পড়বে না। চার-পাঁচ লাইন পড়তে পারে বড় জোর। তার মানে এখানেও শর্টকাট আর বিনোদন। আমরা মনে করি, যারা সত্যিকারের পাঠক, তারা সব জায়গাতেই পড়েন। কাগুজেসাহিত্যও পড়েন, ইন্টারনেটও পড়েন।
এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিদানযোগ্য, বাংলাদেশের মানুষ পাঠবিমুখ। ইউনেস্কোর একটি গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নাগরিকদের গড়ে প্রতি সপ্তাহে পড়ার সময় দশ ঘণ্টার ওপরে। এই তালিকায় কিন্তু বাংলাদেশের নামগন্ধও নেই। ভারতের বইপাঠকের সংখ্যাও অনেক বেশি। ফলে সেখানে ম্যাগাজিন বা বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম। তাদের এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে মেধা বিকাশের মূলমন্ত্র ভেবে, দুশ’ বছর আগে থেকে। তারা পরিশ্রম করে অর্জন করতে চায়। বাংলাদেশে কিন্তু বিপরীত। আবার বলতে হচ্ছে, শর্টকাট। এখানেও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে দায়ী করা যায়। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা অনেক কিছুই পেয়ে আসছি অল্প বা বিনা পরিশ্রমে। বিদেশি সাহায্য, দানদক্ষিণা ইত্যাদি পেয়ে আমাদের মেধা বিকাশের জন্য আমরা তৎপর হইনি। মনোভাবটি এমন যে, পাচ্ছিই তো।
আরেকটি প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেও পাঠক কমে যাচ্ছে। আগে ছাত্রছাত্রীরা ভাষা শেখার জন্য বেশি বেশি পড়ত, যেন পরীক্ষার খাতায় ভালোভাবে লিখে নাম্বার পাওয়া যায়। অজানা শব্দ শিখত, ভাষার ব্যবহার শিখত। বর্তমানে এখানেও শর্টকাট। এমসিকিউ নামের এক ধরনের প্রশ্ন থাকে, যা না পড়লেও পঞ্চাশ নম্বর পাওয়া সম্ভব। কী আজব, ভাবা যায়? সব জায়গায় যদি শর্টকাট পথ থাকে, তাহলে কে যায় লেখাপড়া করতে? কার এত ঠেকা পড়েছে?
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে পছন্দ করেন?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: আমি একসময় ব্লগে লিখেছি। কিন্তু পরে মনে হলো, সময় নষ্ট হচ্ছে। ব্লগে অনেক মানুষের উপস্থিতি থাকে বটে, তবে ভালো পাঠকের সেখানেও অভাব। শুধু শিরোনাম দেখে। ব্লগের আসক্তিতে আমার সাহিত্যকর্মে যথেষ্ট ব্যাঘাতও ঘটেছে। কিছু কিছু ওয়েবম্যাগে আমি লিখতে পছন্দ করি তখনই, যখন দেখি ওয়েবম্যাগটি ভালো মানের লেখায় সমৃদ্ধ। সব ওয়েবম্যাগে লেখার ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই। লিটলম্যাগে আমি লিখতে পছন্দ করি। কারণ, এখনও যে কয়টি লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো অনেক খাটনির ফসল। যারা সম্পাদনার কাজ করছেন, তারা অনেক পরিশ্রম করছেন, নিজের গাঁটের টাকা খরচ করছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করছেন, যথাযথ সম্পাদনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করছেন। তাদের প্রতি আমার আগ্রহ বেশি। এ ছাড়া লেখকসমাজের একটি বড় অংশের হাতে লিটলম্যাগ পৌঁছায়।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিত-সংখ্যক পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: এর উত্তর আগে দেওয়া হয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কাগুজেসাহিত্য থাকবে না। তাই এখন থেকেই যারা অনলাইনে সাহিত্যপত্রিকা বের করছেন, তারা অগ্রসর চিন্তক। সাহিত্যচর্চার জন্য বা প্রসারের জন্য লাখ লাখ না কোটি কোটি মানুষের কাছে গেলেও কোনো লাভ নেই। অনেকেরই শিরোনাম দেখা পর্যন্তই পড়া শেষ। সত্যিকার পাঠকের সংখ্যা খুব কম। সত্যিকারের পাঠক অনলাইনে যেমন পড়েন আবার কাগজেও তেমন পড়েন। এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে, বেশি মানুষের কাছে গেলেই মানুষ সাহিত্যচর্চা করবে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: ভালোমানের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে দৈনিকের পাতার গুরুত্ব কতটুকু আমার বোধগম্য নয়। আমার মনে হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতা লেখক বা লেখার তথ্য দিয়ে থাকে বেশি। বিষয়টি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। সেখানে নতুন লেখকের লেখা ভালো হলেও ছাপার সুযোগ কম বাণিজ্যিক কারণে। খ্যাতিমান লেখকের লেখা থাকলে পত্রিকার ইজ্জত ও কাটতি বাড়ে, বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, ইত্যাদি বিষয়গুলোও লক্ষণীয়। ক্ল্যাসিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য (বিশেষ করে কথাসাহিত্য) দৈনিকের সাহিত্যপাতার সুযোগ সীমিত। সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যসৃষ্টি, সাহিত্যকে লালন করার জন্য সাহিত্যপত্রিকার বিকল্প দৈনিক হতে পারে না।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
মোজাম্মেল হক নিয়োগী: বিষয়বস্তুর দিক থেকে ওয়েবম্যাগ ও কাগুজেম্যাগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো মিডিয়ার বা মাধ্যমের। তাই একটি কাগুজে লিটলম্যাগ যে ধরনের বৈশিষ্ট্যাবলিতে মানুষের নজর কাড়ে ওয়েবম্যাগকেও আমি সে ধরনের দেখতে চাই। একটি বিষয় আশা করি সেটি হলো, সম্পাদকের নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠা। সম্পাদক কাগুজেম্যাগের জন্য যতটুকু খাটাখাটি করেন, ঠিক ততটুকুই খাটেন। সম্পাদনার ব্যাপারে যেন শর্টকাট পদ্ধতিতে ‘লেখা পেলাম আর পোস্ট করলাম’ তেমন না হয়। নিরপেক্ষতার ব্যাপারে বলছি, সম্পাদক যেন লেখকের নাম দেখেই লেখা না ছাপান বরং লেখার মান দেখে লেখা ছাপান। ওয়েবম্যাগ যেন আবর্জনা না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
সত্যিকার অর্থেই আমি পাঠক হিসেবে সর্বভুক। আমি সব পড়ি। ভালো মানের সাহিত্যের প্রতিটি বিষয়ই মনোযোগ দিয়ে পড়ি আর বোঝার চেষ্টা করি। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তবু চেষ্টা করি পড়ার। অনেক পড়তে হয় আমার পেশাগত বিষয়ও। কারণ, প্রকল্পভিত্তিক চাকরি করার জন্য একটি চাকরি শেষ হলে অন্য চাকরিতে ঢুকলে সেখানে চাকরি বাঁচানোর জন্য অনেক পড়তে হয়। তবে সাহিত্যপাঠের ব্যাপারে আমার বেশি আগ্রহ ক্ল্যাসিকের প্রতি।