ফারুক সুমন—কবি ও শিক্ষক। প্রথম প্রকাশিত বই গবেষণা-কেন্দ্রিক—‘শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ’। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে’ ও ‘আঙুলের ডগায় সূর্যোদয়’ । সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েব বিষয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই কবি-শিক্ষক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
ফারুক সুমন: তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিস্ময়কর ভাবে বদলে যাচ্ছে চার পাশ। কবি-সাহিত্যিকদের স্বহস্তে লেখা কাগুজে পাণ্ডুলিপি ক্রমশ কমে আসছে। কারণ প্রযুক্তি সে জায়গাটি দখল করেছে। মুঠোফোনে কিংবা ল্যাপটপে লেখক সেরে নিচ্ছেন লেখালেখির কাজ। বর্তমানে নবীন কিংবা প্রবীণ লেখকের লেখা প্রকাশের অবারিত সুযোগ ফেসবুক। অনেক প্রবীণ লেখক প্রথম দিকে ‘ফেসবুক সাহিত্য’ বলে নাকসিঁটকালেও সময়ের অভিঘাত থেকে তারা বেশি দিন দূরে থাকতে পারেননি। এখন তারাও ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি কিংবা নিজস্ব পেজ/গ্রুপে থেকে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকছেন। লাইভে এসে কবিতা পড়ছেন। আমি বলব, এটা এ যুগের লেখকদের জন্যে আশীর্বাদ!
ফেসবুক কিংবা ব্লগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সম্ভবত ওয়েবম্যাগ বা অনলাইন সাহিত্যপত্রিকার পরিকল্পনা এসেছে। সিরিয়াস পাঠকের পাশাপাশি ওয়েবম্যাগ-পাঠকের একটা বড় অংশ ফেসবুকসংশ্লিষ্ট। যদি শেয়ার দেওয়া না হয়, তবে দৈনিকের সাহিত্যপাতা কিংবা লিটলম্যাগ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ওয়েবম্যাগের ভার্চুয়াল পরিধি ও পাঠকের বিবেচনায় দৈনিক সাহিত্যপাতা এবং লিটলম্যাগ কিছুটা হলেও নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। অনেকটা ডাকযোগে চিঠি প্রেরণের মতো অবস্থা আর কি! বর্তমানে হাতেগোনা কিছু দৈনিকের সাহিত্যপাতা ছাড়া বাকি সব সাহিত্যপাতাই ঘুরেফিরে মুষ্টিমেয় কিছু লেখকের লেখা প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে ওয়েবম্যাগের স্বাতন্ত্র্য ও সুবিধা রয়েছে। পুঁজিপতি পত্রিকা মালিকের চাপ নেই বলে ওয়েবম্যাগ সম্পাদক স্বাধীনভাবে লেখা বাছাইয়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে ‘তারকা লেখক’-এর পাশাপাশি নবীন লেখকের লেখা স্থান পায় বেশি। যদিও কিছুটা রূঢ় শোনাবে, নতুন লেখক তৈরিতে দৈনিক সাহিত্যপাতার ভূমিকা আমি বলব ‘তলানিতে’। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী মনোভঙ্গি কর্তৃপক্ষের ইচ্ছের কাছে সাহিত্যপাতার সম্পাদক অসহায়। স্বাধীনতাহীন সাহিত্য সম্পাদক চাকরির কারণে হুকুম তালিম করবেন, এই তো স্বাভাবিক।
দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই না পাওয়ার আক্ষেপ থেকে লেখকেরা লিটলম্যাগ প্রকাশ করেছেন—এমনটি আমি মনে করি না। কারণ, লিটলম্যাগে লেখেন, এমন অগণিত লেখক দৈনিকের সাহিত্যপাতায়ও নিয়মিত লেখেন।
অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা লিটলম্যাগের স্থান দখল করেছে কি না, এমন মন্তব্য এখনই করা ঠিক হবে না। তবে হ্যাঁ, ওয়েবম্যাগের এখন জয়জয়কার। দ্রুত প্রাপ্তি এবং সুলভ বলেই ওয়েবম্যাগের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তুলনায়, লিটলম্যাগ প্রকাশের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
ফারুক সুমন: আপনার এই প্রশ্নটির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। লিটলম্যাগের আবির্ভাব মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লেখক নিজেই লিটলম্যাগ প্রকাশ করেন। লেখকের আবেগ ও অনুভূতির নিবিড় পরিচর্যায় প্রকাশিত হয় ‘লিটলম্যাগ’। কোনো কোনো লিটলম্যাগ সম্পাদক নিজস্ব অর্থায়নে পত্রিকা প্রকাশ করেন। পুঁজিপতিদের বিজ্ঞাপন গ্রহণে তিনি আগ্রহী নন। পক্ষান্তরে লিটলম্যাগের জন্যে বিজ্ঞাপন জোগাড় করাও কষ্টের। ফলে লিটলম্যাগ প্রকাশের ধারাবাহিকতা থাকে না। এভাবে আর্থিক দৈন্যের শিকার হয়ে নামকরা কত লিটলম্যাগ বন্ধ হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ওয়েবম্যাগ বর্তমানে লিটলম্যাগের সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে। ফলে, সাহিত্যকর্মীরা ওয়েবম্যাগকে আশ্রয় করে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হচ্ছেন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফারুক সুমন: বেশিরভাগ ওয়েবম্যাগ সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে এমনটি নয়। আগে দেখা দরকার, তথাকথিত ওয়েবম্যাগগুলো কারা সম্পাদনা করছেন। কিংবা সেই ওয়েবম্যাগগুলো ওয়েবম্যাগের চরিত্র ধারণ করেছে কি না। কিছুটা সহজলভ্য বিধায় হুজুগে ওয়েবম্যাগের সংখ্যা কিন্তু কম নয় বাজারে। মূলত তাদের ওয়েবগুলোই ভুলে ভরা। কিন্তু মানসম্মত ওয়েবম্যাগ অবশ্যই আছে।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে আসলে বানান ও সাহিত্যমান দু’টি ভিন্ন ব্যাপার। বানান দেখা প্রুফ রিডারের কাজ। একজন লেখক তার লেখা যখন পত্রিকায় পাঠান, তখন সেই লেখায় বানান ভুল থাকা অস্বাভাবিক নয়। সম্পাদক নিজে সেই ব্যাপারগুলো সম্পাদনা করবেন। প্রয়োজন বোধে লেখকের সঙ্গেও পরামর্শ করতে পারেনন। লেখার মান ভালো কিন্তু বানান ও ভাষাবুননে ত্রুটি থাকলে তার দায়ভার অবশ্যই সম্পাদকের।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
ফারুক সুমন: আগেই বলেছি, হুজুগে ওয়েবম্যাগ কিংবা ওয়েবজিন বাজারে আছে। এর পেছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের কারণ বিদ্যমান। এটা যেমন সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা থেকে হতে পারে, তেমনি লেখকেরও সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রচারের প্রবল বাসনা থেকেও হতে পারে। তবে, মান বজায় রেখে ওয়েবম্যাগ বা অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশে দোষের কিছু নেই। এতে বরং পরস্পরের মধ্যে ভালো কাজের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
ফারুক সুমন: না, তা মনে করি না। বরং পাঠক তৈরিতে সহায়তা করছে। ফেসবুকে অভ্যস্তদের সামনে যখন লেখাটির লিংক আসে, তখন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় লেখাটি পড়া হয়ে যায়। লেখা ভালো লাগলে ও লেখকের আরও লেখা পড়ার তাড়না তৈরি হয় পাঠকের মনে। তখন ওই পাঠক বইয়ের খোঁজ করেন। ফলে, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে—এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়।
কোনো বিশেষ লেখার পাঠক তৈরিতে লেখকদেরও দায়বদ্ধতা আছে। বর্তমানে লেখকের বইয়ের পাঠক অন্য লেখকবন্ধুদে হাতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। পাঠকদের হাতে হাতে যাচ্ছে না। তার মানে, আমরা লেখকরা যা লিখছি, তা পাঠকের কাছে যাচ্ছে না।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
ফারুক সুমন: আমি পড়তে চাই। লিখতে চাই। এটা আমার একধরনের অন্তর্গত তাড়না। তা যে মাধ্যমেই হোক। তবে আরও সুনির্দিষ্ট করে জানতে চাইলে বলব, প্রথমত লিটলম্যাগ, দ্বিতীয়ত ওয়েবম্যাগ ও তৃতীয়ত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা। কারণ, লিটলম্যাগ ও ওয়েবম্যাগে লেখকের অবাধ স্বাধীনতা থাকে। শব্দসীমাবদ্ধতাসহ নানাবিধ অপ্রয়োজনীয় শর্তারোপ করা হয় না।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফারুক সুমন: পাঠকের বিবেচনায় নিঃসন্দেহে ওয়েবম্যাগ এগিয়ে থাকার কথা। তবে এটা নির্ভর করে ওয়েবম্যাগের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ওপর। দেখুন, একটি দৈনিক পত্রিকার শেষ গন্তব্য বিশেষ কোনো লাইব্রেরি কিংবা সংগ্রহশালায়। এর বাইরে দিন ফুরালে পত্রিকাটি চলে যায় বাজারের দ্রব্যসামগ্রীর ঠোঙা হিসেবে। চাইলেও সংগ্রেহে রাখা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের আবেদন সর্বাধিক। পড়া ও সংগ্রহে রাখা উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক। অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা লাখ লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছে সত্য, পড়াও হয়। কিন্তু সংগ্রহের বিবেচনায় দৈনিক সাহিত্যপাতার মতোই অবস্থা হয়। তবে সাহিত্যচর্চা, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ওয়েবম্যাগ ব্যাপক প্রভাববিস্তারী।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
ফারুক সুমন: দৈনিক পত্রিকার অনেকগুলো বিভাগ থাকে। তবে, সংবাদ পরিবেশন করাই বোধহয় তার প্রধান লক্ষ্য। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বিনোদন পাতা কিংবা খেলাধুলার পাতা’র মতো সাহিত্যপাতাও দৈনিক পত্রিকার শোভাবর্ধনকারী বিভাগ মাত্র। গুরুত্ব হারালেও সাহিত্যপাতা থাকবে, না হারালেও থাকবে। প্রকাশিত হবে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
ফারুক সুমন: ওয়েবম্যাগের কাছে প্রত্যাশা থাকে বেশি। কারণ অবারিত লেখার উঠান। শুধু কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা ছড়া না ছাপিয়ে সমালোচনা সাহিত্যের ওপর জোর দেওয়া উচিত। ওয়েবম্যাগের উচিত—একজন সৃজনশীল লেখককে সাহিত্য সমালোচনায় উদ্বুদ্ধ করা। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, পৃথিবীতে স্বনামধন্য কবি সাহিত্যিকরাই ছিলেন যথার্থ সাহিত্য সমালোক। এক্ষেত্রে সম্পাদক মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। অর্থাৎ একজন লেখককে দিয়ে অন্য লেখকের গ্রন্থালোচনা করতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
এছাড়া, অনুবাদ একটা জরুরি ব্যাপার। লেখার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি বাড়ে অনুবাদের মাধ্যমে। অনুবাদ শাখা আলাদা করে বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ নিয়মিত করা উচিত বলে বোধ করি।
একটি বিশেষ প্রত্যাশা, বছরান্তে সংশ্লিষ্ট ওয়েবম্যাগের মানসম্মত বাছাই লেখাগুলো নিয়ে একটি লিটলম্যাগ প্রকাশ করা যেতে পারে। এই সেরা সংখ্যাটি পাঠকের সংগ্রহে থাকবে দীর্ঘদিন।