সৈয়দ শামসুল হক—জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সব শাখায় সমানভাবে অবদান রেখেছেন তিনি। লেখালেখি শুরু করেন ১২ বছর বয়স থেকে। সাংবাদিক হিসেবে পেশা জীবন শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে লেখালেখিকেই মূল উপজীব্য হিসেবে নিয়েছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এছাড়া একুশে পদক পেয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। তাঁর বিখ্যাত সাহিত্য কর্মগুলো হলো; উপন্যাস: নিষিদ্ধ লোবান, খেলা রাম খেলে যা, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, মৃগয়ার কালক্ষেপ। কাব্যনাটক: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারা জীবন, গণনায়ক। কাব্যগন্থ: পরানের গহীন ভিতর, বেজান শহরের জন্য কোরাস, এক আশ্চর্য সংগ্রামের স্মৃতি, প্রেমের কবিতা। শিশু সাহিত্য: সীমান্তের সিংহাসন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন তরুণ গল্পকার হারুন পাশা।
হারুন পাশা: কেমন আছেন?
সৈয়দ শামসুল হক: ভালো আছি, বেঁচে আছি, নিঃশ্বাস নিচ্ছি, লিখছি।
হারুন পাশা: জীবনের বড় একটি সময় পেরিয়ে এসেছেন। পেছনের সেই সময়, সেই জলেশ্বরীর কথা কি মনে পড়ে?
সৈয়দ শামসুল হক: মনে পড়ে কি? জলেশ্বরী তো নিজের বানানো, তবে এর একটি ভিত্তি আছে। এটি হলো সেই কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রামের কিছু কিছু উপাদান নিয়েছি, ভৌগোলিক উপাদান। কিছু তার সঙ্গে যোগ করেছি। যোগ করে একটা নিজস্ব জায়গা তৈরি করেছি। সে আমার গ্রামভিত্তিক বা যাকে লোকে মফস্বল বলে। সেই মফস্বলভিত্তিক গল্প লিখেছি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কথা বলেছি। আমি একটা জগৎ তৈরি করেছি। তো সেই জগতের ভেতরেই আছি।
হারুন পাশা: জলেশ্বরীর সঙ্গে তো আপনার একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সেখানেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে। আজকের যে আপনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, তার শেকড়টা তো সেখানেই গেঁথে আছে?
সৈয়দ শামসুল হক: হ্যাঁ, মানুষ তো যেখানে জন্মায়, আমি আমার জন্মভূমিতে বারো বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম জন্ম হওয়ার পর। তারপর আমি ঢাকায় চলে আসি। এলেও কখনো কুড়িগ্রামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। শুধু কুড়িগ্রাম কেন, এই তোমার ট্রেনের যাতায়াত তো তখনকার দিনে। ট্রেনে আমরা মনে করো ফুলছড়ি থেকে বনান পাড়া হয়ে, গাইবান্ধা হয়ে কাউনিয়ার ওপর দিয়ে, তিস্তা পার হয়ে কুড়িগ্রামে। এই পুরা এলাকাটাই আমার ভেতরে কাজ করে। কাজ করে এই অর্থে—এর প্রকৃতি, এর ভূগোল, এর মানুষ। আর আমাদের এলাকা তো খুবই দারিদ্র্যপীড়িত জায়গা। খুব অভাব মানুষের। স্বাক্ষরতার হার আমাদের সময় অত্যন্ত কম ছিল। খুব সরল, আদিম জীবনযাপন। ওই মানুষগুলোর ভেতর থেকে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। মানুষ যখন তার মূল জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমরা অনেক সত্যের মুখোমুখি হই। সেই সত্যটাকে আমি আমার লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, সেদিক থেকে তো মনের ভেতর আছেই একটা জায়গা।
হারুন পাশা: আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আপনি প্রচলিত অর্থে নিজের জীবনকথা লেখেন না, যা লিখতে চান, তা হলো সময়ের কথা। আবার কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমি একটি কালের অন্তগর্ত হয়েও চেয়েছি কাল অতিক্রম করে যেতে।’ এই সময় বা কালের কথা জানতে চাই।
সৈয়দ শামসুল হক: (হাসি…) এ কি আর এককথায় বলা যাবে। আর এই কথাটি বলার জন্যই তো এত লেখা। আমি একবাক্যে কী বলব? এই সময়ের কথাটি বলার জন্যই তো কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ যাই লিখি না কেন, সময়ের কথাটাই বলতে চেয়েছি। সময় একটা অনুরণন সৃষ্টি করে আমার ভেতর। আমি যেভাবে সময়কে দেখি, সেভাবে সময়কে তুলে ধরারও চেষ্টা করি। আমার কাছে বর্তমানের চেয়ে আমার…। শুধু আমি নই, আমরা সবাই এভাবেই বেঁচে আছি। আর বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতাই তো মানুষের থাকে। কার্যত আমরা জীবনকে বুঝতে পারি এবং পারি।
হারুন পাশা: ‘পরানের গহীন ভিতর’ তো কালকে জয় করে এখনো টিকে আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে বলা যায়, নিশ্চিত হয়েই। এই কাব্য আঞ্চলিকভাষায় লিখতে হবে—কেন এমন মনে হলো? এটি লেখার সময়, পরিপার্শ্ব ও আপনার অবস্থান জানতে চাই।
সৈয়দ শামসুল হক: এ কথা তো আমি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বা ‘পরানের গহীন ভিতর’ লেখার সময় একাধিকবার বলেছি। ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর প্রথম সংস্করণে একটা ছোট্ট ভূমিকা ছাপানো হয়েছিল, তাতেও বলেছি। এটি হচ্ছে, আমরা যে মান বাংলায় এখন কথা বলছি, মান বাংলায় আমি কথা বলছি। এর বাইরেও তো একটা ভাষারূপ আমরা ব্যবহার করছি। যেমন আমি একসময় ভেবেছি, আমার মায়ের সঙ্গে মনের কথা বলেছি। কত সুখ-দুঃখের কথা বলেছি। মা অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন। আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমরা একসঙ্গে বসে কত সুখ-দুঃখের কথা বলেছি। গভীর কথা বলেছি এবং এগুলো সবই আঞ্চলিক ভাষায়। তা যদি হয়, তাহলে এর ভেতরে কাব্যগুণ আছে কি না? এ থেকে কাব্যকীর্তি সম্ভব কি না? এসব বিবেচনা থেকেই করেছি।
হারুন পাশা: ‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান, /ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়’, কবিতাটি কিভাবে লেখা সম্ভব হলো?
সৈয়দ শাসুল হক: যেকোনো লেখার পেছনে অনেক দিনের একটি ভাবনা থাকে। আর এটি এমন নয় যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি। কিন্তু এটি ঠিক, পর্যবেক্ষণের ভেতর থেকে অনুভবের ভেতর থেকে যেটি মনের মধ্যে আসে সেটুকুই লিখতে পারা। বিশেষ কবিতাটির কথা বললে, সনেট, এটি একটি নারীর জবানিতে লেখা কবিতা। কোনো লেখার ভেতরের কথা কি এত বলা যায়? প্রথম কথায় আমি নারী নই, প্রথমেই আমি বুঝতে পেরেছি—এ আমি অন্য মানুষ। একটি স্থান বদল আছে, বুঝতে পারছ যে, এই যে অভিজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে, এটি ওই ব্যক্তিটির ভেতরে গিয়ে তার দৃষ্টিতে আমাকে দেখা।
হারুন পাশা: আপনি তো দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, এ দেশের সামরিক শাসন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তীকালের সামরিক শাসন। এগুলো তো আপনার চেতনায় গেঁথে আছে, যার প্রতিফলন পাই সাহিত্যে। সেই সময় নিয়ে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?
সৈয়দ শামসুল হক: এ খুব জটিল একটি প্রসঙ্গ তুলেছ; হ্যাঁ আমার জীবন তো অনেকগুলো বাইরের ঘটনার ভেতর দিয়ে গেছে। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর গণহত্যা ও স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা, তখন আবার দেশে সামরিক শাসন। মানে সব ঘটনার কোথাও না কোথাও একটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তো আছেই। আমি মনে করি, আমার জীবনে দু’টি প্রধান ঘটনা আছে, একটি হচ্ছে দেশভাগ আরেকটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। বাকি সবই এটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এটুকু বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন গৌরব আছে, পূর্ণাঙ্গ বিজয় আমাদের আসেনি বলে তেমন বিষণ্নতাও আছে। আর দেশভাগে সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হয়, এ রক্তক্ষরণ হয় এখনো। হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে এটি তো আর আমাদের বদলানোর ক্ষমতা নেই। এই সবই আমার লেখার কোথাও না কোথাও আছে। এমনকি এসব কথাও প্রত্যক্ষভাবে যেখানে নেই, সেখানে মানুষগুলো এই ঘটনাগুলো ছুঁয়েছে, তাদের নির্মাণ করেছে এই ঘটনাগুলো। কাজেই সবদিক থেকে বলা যায়—আমার লেখাটিই ফল। আমি সবসময়ই বলি, আমার যা কিছু বলার আমার লেখাতেই বলেছি। আলাদা করে বাইরে থেকে বলার কিছু নেই।
হারুন পাশা: দেশভাগের সময় রক্তক্ষরণ এটা কেমন?
সৈয়দ শামসুল হক: দেশভাগের সময় একটা রক্তক্ষরণ তো হয়। এটি হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে। এটা ঠেকাতে পারব না। কত মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। কত মানুষ তাদের স্বপ্নকে ভাঙতে দেখেছে।
হারুন পাশা: আপনি বলেছিলেন, ‘যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না।’ ইতিহাসকে স্মরণ করেই তো লেখা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি। যে নাটকে নূরলদীন সমস্ত অন্যায় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। এই নাটকটি রচনার ওই সময় সম্পর্কে জানতে চাই, যে সময়টা আপনি যাপন করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক: আমি ঢাকায় তখন, বোধ হয় ১৯৮০-৮১ সালে ঢাকায় বসবাস করছি এই বাড়িটায়। যেখানে বসবাস করছি (গুলশানের মঞ্জু বাড়ি), যেখানে বসে কথা বলছি এই বাড়িটায়; তখনো ছিল অর্ধ-সমাপ্ত; এখানেই বসে নাটকটি লিখেছি।
হারুন পাশা: ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ তো প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। নূরলদীন চরিত্রটি নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা আছে? যা পাঠকদের জানাতে চান?
সৈয়দ শামসুল হক: না, ব্যক্তিগত নেই; ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এটি একটি বিচ্ছিন্ন বা তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়, এটি একটি…; আমরা বহুবার বলেছি, আমরা বাঙালি, আমরা নানামুখী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়েছি। সেই ধারাবাহিকতাই দেখানোর জন্য এই দিক অবলম্বন; এটিই হচ্ছে কথা।
হারুন পাশা: ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইয়ে তো ধরে ধরে, বলতে গেলে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন কবিতা কী? গল্প কী? জানতে ইচ্ছে হয়—কেন মনে হলো এমন করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা দরকার এই বিষয়গুলো?
সৈয়দ শামসুল হক: আমার যেটি বুঝতে বিশ বছর লেগেছে, সেটি বলে দিলে পরে একজন নবীন লেখকের পক্ষে বিশ দিনের বেশি লাগাবে না। বাকি সময়টা সে তার নিজের লেখার কাজে ব্যয় করতে পারবে। আমি লেখক হিসেবে কাজ করতে করতে যেসব জিনিস দেখেছি, কিছু কিছু জিনিস জেনেছি, সেগুলোই লেখার চেষ্টা করেছি, যেন আমার পরবর্তী সময়ে যারা আছে, তাদের জন্য সময় সাশ্রয়ী হয়; এই তো।
হারুন পাশা: আপনার এই দীর্ঘ সময়ের জীবনে সন্তুষ্ট? না অপূর্ণতা রয়েছে?
সৈয়দ শামসুল হক: (হাসি…) এটি সন্তুষ্টি বা অপূর্ণতার কোনো ব্যাপার নয়, জীবন কিভাবে কাটিয়ে এলাম—এটি হলো সবচেয়ে বড় কথা। আমি যে কাজ করতে চেয়েছি, ঠিক সেই কাজই করছি। অর্থাৎ আমি লিখতে চেয়েছি, আমি লিখছিই; লিখেই চলেছি এবং আমার এই মানুষের কথা ভাবতে চেয়েছি, তাদের কথা ভেবেই চলেছি। মানুষ অনেকেই বা কেউ-কেউ বলেছে আমি এর লেখা পড়েছি, এর লেখা ভালো লাগে। সেটাও আমার কাছে ভালো লাগে। এই সবটাই মিলিয়ে আছি। কিন্তু পূর্ণতা বা অপূর্ণতার কিছু নেই। প্রত্যেকটি জীবনেরই অপূর্ণতা আছে। প্রত্যেকটি জীবনেরই সন্তুষ্টি আছে, অসন্তুষ্টিও আছে। কার নেই, সবারই আছে, এটি কোনো বিষয় নয়। আমি যা করতে চেয়েছি, তা করতে পারছি কি না, হ্যাঁ আমি করেছি এবং শেষ জীবন পর্যন্ত করেই চলেছি।