মোহাম্মদ নূরুল হক—কবি, প্রাবন্ধিক, ছোটকাগজকর্মী ও সংবাদকর্মী। ১৯৭৬ সালের ১২ জুন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে তার জন্ম। এই পর্যন্ত তার নয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কবিতা, ছয়টি প্রবন্ধের। কবিতার বইগুলো হলো, ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’, ‘স্বরচিত চাঁদ’ ও ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’। প্রবন্ধের বইগুলো হলো, ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’ ও ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’। আইনে স্নাতক। পেশাগত জীবনে বহুপেশা পরিবর্তন করে বর্তমানে সাংবাদিকতায় থিতু হয়েছেন। কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্যপাতায়, ছিলেন দৈনিক আমাদের সময়ের বার্তা সম্পাদক, ঢাকা টাইমসের বার্তা সম্পাদক। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের উপ-বার্তা সম্পাদক। এছাড়া ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছিলেন, সাহিত্যের ছোটকাগজ চিন্তাসূত্র, মেঠোপথ, প্রাকপর্ব ও অনুপ্রাস। সম্প্রতি এই কবি-প্রাবন্ধিক-সংবাদকর্মীর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাশিল্পী ও সংবাদকর্মী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। ১২জুন, কবির জন্মদিন উপলক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রথমেই কথা বলতে চাই, আপনার লেখালেখি প্রসঙ্গে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিকে আপনার কবিতা ও প্রবন্ধ চোখে পড়তো। কিন্তু ইদানিং দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তেমন কোনো লেখা চোখে পড়ছে না, কেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: ২০০৯ সালের আগ-পর্যন্ত আমি মূলত কবিতা ও ছোটগল্পই লিখতাম। মাঝেমধ্যে বুকরিভিউ করতাম। প্রবন্ধও লিখতাম। তবে তা পরিমাণে খুবই কম। হয়তো বছরে একটি কী দুটি। একবার কবি-সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ার আমার একটি রিভিউ পড়ে বললেন, তোমার মধ্যে প্রাবন্ধিকের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। প্রবন্ধ লিখলে ভালো করবে। তখন মূলত তারই অনুপ্রেরণায় পুরোপুরি প্রবন্ধে মনোনিবেশ। তখন বিভিন্ন দৈনিকে যারা সাহিত্যপাতা দেখতেন, তারা আমার কাছ থেকে লেখা চেয়ে নিতেন। আমার লেখাও তারা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপাতেন। যুগান্তরে আবু হাসান শাহরিয়ার, ইত্তেফাকে রাজীব নূর, জনকণ্ঠে মামুন রশীদ, ভোরের কাগজে রনজু রাইম—মূলত এই চারজন আমার প্রবন্ধ-কবিতা-গল্প বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করতেন। এর মধ্যে আবু হাসান শাহরিয়ার ও রাজীব নূর আমার বেশিরভাগ প্রবন্ধই লিড আইটেম হিসেবে ছাপতেন। একসময় এই দুইজন সাহিত্য পাতার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর আমি নিজেও দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেছি বেশ কিছুদিন। মূলত সাহিত্যপাতা সম্পাদনার সময় থেকেই দৈনিকে লেখা ছেড়ে দিয়েছি।
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার কোনো চিন্তা বা কাজ অ্যাপ্রিশিয়েট করার লোক না থাকলে আপনিও সেই কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। তেমনি দৈনিকে-ছোটকাগজে-সাহিত্য পত্রিকা যদি আপনি সেই সম্মান দিয়ে লেখার আমন্ত্রণ না জানান, তাহলে আপনিও লিখতে চাইবেন না। অর্থাৎ আপনাকে বোঝার বা মূল্যায়নের লোক না থাকলে আপনিও কাজে আগ্রহ বোধ করবেন না। আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমন।
আমরা স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি এখনো পাচ্ছি। তবে তা সংখ্যায় অল্প।
আর ভালো কিছুই সংখ্যায় অল্পই হয়।
অল্প হয় বলেই তার কদর বেশি
এছাড়া, আমি লেখালেখি করলেও পেশাগত জীবনে ইত্তেফাক ছাড়া আর সব জায়গায় নিউজেই কাজ করেছি। নিউজে কাজ করতে করতে রুচি-মেজাজ এমন হয়ে গেছে যে, আর দৈনিকের সাহিত্যপাতা বা লিটলম্যাগে লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আমার মনে হয়েছে, যা কিছুই লিখি না কেন, সরাসরি বই করাই শ্রেয়। এ কারণেই আমার লেখা দৈনিকের সাহিত্যপাতা বা ছোটকাগজে দেখা যায় না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: ২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আপনার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যার ব্যবধানও কম নয়। আমরা কবে নাগাদ আপনার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ পেতে পারি? কিংবা এ সময়ে কি আপনার কবিতাচর্চা হচ্ছে না?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আমি নিয়মিতই কবিতা লিখি। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। হয়তো মাসে একটি কী দু’টি। এরপর দুই তিন বছর শেষে সব কবিতা একত্রিত করে দেখি, কী পরিমাণ লেখা হলো। তাতে দেখি শখানেক কবিতা লেখা হয়ে যায়। সেখান থেকে বাছাই করে মাত্র ৩৮/৩৯টি কবিতা দিয়ে তিন ফর্মার বই করেছি ‘স্বরচিত চাঁদ’ ও ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’। তবে প্রথম কবিতার বই ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহারে’ সম্ভবত ৫৫টি কবিতা রয়েছে। আমার চতুর্থ কবিতার বই হয়তো ২০১৯ সালে আসতে পারে। হয়তো বা না। তবে ২০২০ সালে আসবে, এটা বলতে পারি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, উপমা, আঙ্গিক নিয়ে আপনার অভিমত কী? ইদানিং আমরা স্মরণযোগ্য কবিতা না পাওয়ার কারণ কী বলে মনে হয়? কিংবা কাব্যচর্চার গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: সবকালেই ফসলের সঙ্গে আগাছা ছিল। এখনো আছে। ফসলের ক্ষেতে আগাছা থাকবেই। তাই বলে সে আগাছা উপড়ে ফেলতে হয় না। আগাছাকে মাড়িয়ে দিতে হয়। আগাছা মাড়িয়ে দিলে ফসলের ক্ষেতে সারের কাজ করে। আর উপড় ফেলতে গেলে ফসলের ক্ষতি হয়। মনে রাখবেন, চন্দন কাঠের দাম ধানের চেয়ে বেশি সত্য; কিন্তু ধান ক্ষেতে চন্দনের চারাও আগাছা। ক্ষেত যখন ধানের, তখন ধানের পরিচর্যা করাই কৃষকের প্রধান কাজ। লোভনীয় চন্দনের চারার প্রতি দরদ দেখালে দেশে দুর্ভিক্ষই তেড়ে আসবে, চন্দনে চারা আপনাকে ধান দেবে না। এজন্য চন্দন গাছ যেখানে রোপন করা উচিত, সেখানেই করবেন, ধান ক্ষেতে নয় মোটেও।
আসল কথা বলতে গিয়ে গৌরচন্দ্রিকা বেশি হয়ে গেলো। বলছিলাম, সব যুগেই আগাছা ছিল, এ যুগেও আছে। কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ না জেনে, মানি না মনে গোয়ার্তুমি করার লোক আগেও ছিল, এখনো আছে। আর এই না জানা, না মানাদের সংখ্যা সব সমকালেই বেশি। আপনাকে মনে রাখতে হবে, শিল্পের যে শাখায় আপনি কাজ করবেন, সে শাখার কিছু নির্দিষ্ট বিষয়-আশয় আছে। সেগুলো আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে। কবিতা লিখতে এলে আপনাকে ছন্দ-অলঙ্কার-আঙ্গিক জানতে হবে, এর প্রয়োগ বুঝতে হবে। না হলে আপনি কেবল কাব্যিক বাক্যই লিখতে পারবেন, সেগুলো কবিতার পঙ্ক্তিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না।
আমরা স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি এখনো পাচ্ছি। তবে তা সংখ্যায় অল্প। আর ভালো কিছুই সংখ্যায় অল্পই হয়। অল্প হয় বলেই তার কদর বেশি।
এসময়ের কাব্যচর্চার গতি কোন দিকে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া কঠিন। কারণ এসময় যারা কাব্যচর্চা করতে এসেছেন, তারা মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। একভাগ কিছুই শিখবেন না, কিছুই মানবেন না। মনে যা আসে, যেভাবে আসে, সেভাবেই লেখার পক্ষপাতী। আরেক ভাগ, জেনে-বুঝে লিখতে চান, এদের সংখ্যা কিন্তু কম। আর তৃতীয় ভাগ এই দুয়ের মাঝামাঝি থাকেন। তারা এ দলেও আছেন ও দলেও আছেন। তবে, বর্তমানে অকবিতা-অকবিদের প্রচার বেশি। স্টান্টবাজদের দৌরাত্ম্য আরও বেশি। ফলে প্রকৃত কবি ও কবিতা প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছে আবর্জনার স্তূপে। কিন্তু স্টান্টবাজদের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর দৃশ্যমান চেষ্টা নেই। মনে হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। এ কারণে কবিতার বর্তমান প্রায় অন্ধকার। ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবে, কেউ যদি এসব স্টান্টবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, তবে বাংলা কবিতার সুদিন আবারও ফিরে আসবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: একটি সার্থক কবিতার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে আপনি বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন? বা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন? বর্তমানের কবিতাগুলো ছন্দোবদ্ধ না হয়ে ছন্দহীন হওয়ার বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
মোহাম্মদ নূরুল হক: ছন্দহীন রচনা কখনোই কবিতা নয়। ছন্দহীন রচনাকে কোনো কবি-সমালোচক-কাব্যবোদ্ধা কোনো দিন কবিতার স্বীকৃতি দেননি। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো একটিও ছন্দহীন কবিতা লেখেননি। তিনি ছন্দকেই কাব্যকৃতির একমাত্র মানদণ্ড মানতেন। বলতেন, ‘আমার বিবেচনায় কবি-প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য, এবং মূল্যনির্ণয় যেহেতু মহাকালের ইচ্ছাধীন আর অর্থগৌরবের আবিষ্কর্তা অনাগত সমধর্মী, তাই সমসাময়িক কাব্যজিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদ- ছন্দোবিচার।’ আর ২০১৩ সালে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ তো আমাকে সরাসরিই বলেছেন, ‘ছন্দ ছাড়া কবিতাই হয় না।’ এসব বড় কবির বক্তব্যের পর আমি কোন মুখে ছন্দহীন আবর্জনাকে কবিতা বলি? আচ্ছা বলুন, কেউ যদি কোনো একটি বিষয়ে পিএইচডি করে, তিনি কি বলবেন, মানুষের পড়োশোনার কোনো দরকারই নেই, গণ্ডমূর্খ থাকতেই আরও ভালো বুঝতাম। নিশ্চয় এমনটা কেউ দাবি করবেন না। তেমনি কেউ যদি একটু কষ্ট করে ছন্দের নিয়মকানুন শেখেন তিনি কখনোই ছন্দহীন আবর্জনাকে কবিতা বলে স্বীকার করবেন না। ছন্দহীন আবর্জনাকে কবিতা বলার ধৃষ্টতা দেখাবে কেবল গণ্ডমুর্খরাই। এত কিছুর পরও সত্য, কিছু ‘গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ টাইপের বখাটে নিজেদের ছন্দহীন আবর্জনাকে কবিতা নাম দিয়ে বাজারে ছেড়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আপনার ছয়টি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন করে আর কোনো প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশের সম্ভাবনা আছে? বর্তমানে যত প্রবন্ধ দেখছি, তার বেশির ভাগই স্তুতিমূলক। এছাড়া সমালোচনামূলক প্রবন্ধের তুলনায় মৌলিক বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধ তেমন চোখেই পড়ে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—মৌলিক প্রবন্ধের সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ কী বলে মনে হয়?
মোহাম্মদ নূরুল হক: না। এ বছর আর নতুন করে প্রবন্ধের কী কবিতার কোনো বই-ই প্রকাশিত হবে না। আপনি বলছেন, এখন যত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার বেশিরভাগই স্তুতিমূলক। আসলে ওই রচনাগুলো প্রবন্ধ নয়। প্রবন্ধের কোনো উপরকরণই সেগুলোতে পাবেন না। বেশিরভাগই দেখবেন মূলত স্তুতিসর্বস্ব রিভিও। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শব্দসংখ্যা বাড়িয়ে সেগুলোকে প্রবন্ধ নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই লেখকদেরই বা দোষ কী? তারা যদি যথার্থই সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখে থাকেন, তখন তো কবিযশপ্রার্থী বা কথা সাহিত্যিকরা রে রে করে উঠবেন। এদেশে সমালোচনামূলক গদ্যে যতক্ষণ বলা হয়, বাহ সুন্দর, অসাধারণ, নতুন স্বর, নতুন যুগের স্রষ্টা, ততক্ষণ যথার্থ সমালোচক। আর যখনই কবিযশপ্রার্থী বা কথাশিল্পীর ত্রুটি শনাক্ত করে, তা সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন অভিযোগ আসে, এই সমালোচক সাহিত্য বোঝেন না। তিনি সাহিত্যিকবান্ধব নন, ছিন্দ্রান্বেষী। এর ওপর আরও আছে। কোনো কোনো অপ্রস্তুত সাহিত্যিক যশপ্রার্থী আছেন, যারা বলেন, লেখকরা কখনোই সমালোচকের ধার ধারে না। তারা পাঠকের মুখাপেক্ষী। ভালো কথা। সমালোচকও তো আগে পাঠক, পরে সমালোচক। না কি? তাহলে যে লেখকরা বলেন, সমালোচকের ধার ধারেন না, পাঠকের মূল্যায়ন চান, কেন বলেন? তাহলে কি তারা নীরব পাঠকের মুখাপেক্ষী? এরপর আরও মজার ব্যাপার আছে, যাদের সমকালের সমালোচক গ্রাহ্য করেন না, তারা বলেন, মহাকাল আমাদের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু তারা কি এটা ভেবে দেখেন না যে, সমকালও মহাকালের একটা অংশ। সমকাল যাকে ছুড়ে ফেলে দেয়, মহাকাল তাকে মাটি খুঁড়ে তুলে আনে না।
এবছর পুরস্কারদাতা বা বিচারক প্যানেলে যিনি আছেন,
তিনি পরবর্তী বছর কমিটি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন,
একটা পুরস্কার নিয়ে আবার কমিটিতে ফিরে আসছেন।
এগুলো অহরহই ঘটছে
আরেকটা কথা। সমালোচনামূলক প্রবন্ধের তুলনায় মৌলিক প্রবন্ধ এখন কম। এটা সবকালেই ছিল। মৌলিক প্রবন্ধ লেখার জন্য দরকার লেখকের অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন ও এই দুয়ের সমন্বয়ে নতুন চিন্তা। যদি লেখকের মনে কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা না থাকে, কল্পনা ও মনীষার সম্মিলন ঘটানোর মতো শক্তি না থাকে, তাহলে তার পক্ষে মৌলিক চিন্তা করাই সম্ভব নয়। আর যদি মৌলিক চিন্তাই করতে না পারে, তাহলে মৌলিক চিন্তা সাহিত্য রচনা করবে কিভাবে? শিল্প-সাহিত্য-সমাজতত্ত্ব-আইন-বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শনসহ বিচিত্র বিষয়ে পাঠ না থাকলে, এসব বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু মন না থাকলে মৌলিক প্রবন্ধ লেখা সম্ভব নয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যে দশক বিভাজন, সমালোচকের দায়, সমকালীন সাহিত্য চিন্তা এবং সাহিত্যের রাজনীতি নিয়ে এখনো দ্বিমত রয়েছে। বলতে গেলে—দুইপক্ষে ভাগ হয়ে গেছে লেখকরা। সেক্ষেত্রে আপনার প্রবন্ধগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: সাহিত্যে দশক বিভাজন একটি ভ্রান্তধারণা। দশকে দশকে কি সাহিত্যের গতিপথ বদলায়? বদলায় না। একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হয়, অনেক অনুষঙ্গ ও ঘটনার অভিঘাতে। কখনো কখনো একটি যুগ সৃষ্টি হয়, একজন মাত্র ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, কখনো কখনো একাধিক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। কখনো সাহিত্যিককে কেন্দ্র করে, কখনো অর্থনীতিবিদ কিংবা রাজনীতিবিদকে কেন্দ্র করে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো যুগের ব্যাপ্তি যেমন দশ থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত চলে, তেমনি কোনো কোনো যুগের ব্যাপ্তি আবার শতকও পার হয়ে যায়। সুতরাং প্রতি দশ বছর ধরে ধরে যে দশক বিভাজন, এটা মূলত ব্যর্থ ও অসাহিত্যিক স্টান্টবাজি। যখন সাহিত্যকর্ম দিয়ে টিকে থাকতে পারে না, তখন দশকের কবি হওয়ার স্টান্টবাজিটা এরা করে।
সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে সমালোচকের দায় অনেক। বিষয়টি আমি এই ‘সমালোচকের দায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে সবিস্তারে তুলে ধরেছি। তাই এখানে আর উল্লেখ করব না। এছাড়া ‘সমাকালীন সাহিত্যচিন্তা’ বা ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ দুটিতে আমি যে সব বিষয় ব্যাখ্যা করেছি, তার সঙ্গে সবাই যে একমত হবে, এমনটা আমি ভাবি না। চোর যে চুরি করে, তার কাজ যে গর্হিত কাজ, একথা দুনিয়াসুদ্ধ লোক তাকে বললেও সে মানবে না। সে মনে করবে, তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য লোকে এসব বলছে। তেমনি যারা সাহিত্যের রাজনীতি করে বেড়াচ্ছে, তাদের যতই বলুন, তারা মানবে না। কারণ তারা যদি দোষ স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। সাহিত্যের রাজনীতির মৌলিক প্রবণতাগুলো কী? এগুলো হলো, গ্রুপিং করা, নিজের গ্রুপের অথর্বটাকেও কোনো মহিরুহের চেয়ে বড় করে দেখানো, এর জন্য প্রয়োজনে পুরস্কার-পদকের প্রবর্তন করা। সেগুলো আবার নিজেদের মধ্যে বণ্টন করা। দেখা যাবে, পুরস্কারদাতারাই আবার সেই পুরস্কার নিচ্ছেন। যিনি পুরস্কারের খাতে লগ্নি করছেন, তিনিই পুরস্কার নিচ্ছেন, আবার এবছর পুরস্কারদাতা বা বিচারক প্যানেলে যিনি আছেন, তিনি পরবর্তী বছর কমিটি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন, একটা পুরস্কার নিয়ে আবার কমিটিতে ফিরে আসছেন। এগুলো অহরহই ঘটছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনি ১৯৯৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে চারটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছেন। এরপর আর সেগুলো নিয়মিত করেননি। না করার পেছনের কারণগুলো বলবেন কী? এখনো তো ছোটকাগজ প্রকাশিত হচ্ছে। আপনার সম্পাদিত কাগজের সঙ্গে বর্তমানে প্রকাশিত কাগজের মৌলিক বা আদর্শিক কোনো পার্থক্য রয়েছে কি না? এছাড়া ওয়েবপোর্টালের যুগে ছোটকাগজের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আমি ‘চিন্তাসূত্র’, ‘মেঠোপথ’, ‘প্রাকপর্ব’ ও ‘অনুপ্রাস’ নামে চারটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছি বটে। কিন্তু ওই কাগজগুলো যে উদ্দেশ্যে করেছিলাম, সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। মানে আমি সফল হইনি। ওই চারটি কাগজ দীর্ঘদিন প্রকাশ করেও আমি কোনো নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারিনি। ফলে একসময় মনে হলো, ছোটকাগজের যে চারিত্র্য, সেটা যদি অর্জন করতে না পারি, তাহলে ছোটকাগজ করে লাভ কী? তাই বন্ধ করে দিলাম।
এখনো ছোটকাগজ প্রকাশিত হচ্ছে, সত্য। কিন্তু সব কাগজই প্রায় একই। আলাদা কোনো চরিত্র নেই। ক’য়ের কাগজের লেখক, খ’য়ের কাগজেরও সেই একই লেখক। আবার ক’য়ের কাগজে যে ধরনের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, খ’য়ের কাগজেও তাই। এমনিভাবে গ-ঘ-চ-ছ যাই বলুন, সবারই একই চারিত্র্য। কিন্তু ছোটকাগজ হচ্ছে, এটাই সুখের কথা। আদর্শিক পার্থক্য কতটা, সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না। তাই এই বিষয়ে কথা না বলাই শ্রেয়।
সমাজে যা নাই, তা তো সে আনবে না। মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরে,
পঠন-পাঠনের বাইরে তার কল্পনাশক্তিও যায় না
এখন তো ওয়েবপোর্টালের যুগ। এ যুগে কাগজের পত্রিকা এখনো বের হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আজকের মতো এই ঘ্রাণ, এই অনুভূতি হয়তো থাকবে না। এছাড়া ওয়েবপোর্টালের যোগাযোগের যে বিস্তৃতি, তাতে একদিন কাগজে ছাপানো ছোটকাগজ কিছুটা গুরুত্ব হারাবে। যেমন, গ্রামো ফোনের গুরুত্ব কমেছে ফিতার ক্যাসেটের কাছে, ক্যাসেটের গুরুত্ব কমেছে সিডির কাছে। ইউটিউব এসবে সবাইকে বিদায় করে দিয়েছে, তেমনি। তবে ওয়েবপোর্টাল পড়ার জন্য যেসব ডিভাইস, বিদ্যুৎ, নেট কানেকশন দরকার, সেগুলো এখনো আমাদের জন্য খুব সহজলভ্য নয়। এখনো অনেক জায়গায় পেজ লোডিং হতে অনেক সময় নেই। ফলে আমাদের এখানে এখনো কাগজে ছাপানো ছোটকাগজের গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার কি কখনো ছোটগল্প বা উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে হয়নি? বা লিখেছেন কিনা? লিখলেও প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। একজন প্রাবন্ধিক হিসেবে এ সময়ের ছোটগল্প সম্পর্কে আপনার সমীক্ষা কী বলছে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আমার লেখালেখির শুরুটাই ছোটগল্প দিয়ে। ছোটগল্প লেখার অনেক পরেই কবিতায় এসেছি। ছোটকাগজ করতে এসে বুকরিভিউ শুরু করি। আমার বুক রিভিউ দেখে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছিলেন, তোমার উচিত প্রবন্ধ লেখা। তোমার মধ্যে প্রাবন্ধিকের সব বৈশিষ্ট্য আছে। তখন থেকে, মূলত তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি প্রবন্ধে আসি। প্রায় পাঁচ বছর আগে, শুরু করেছিলাম, দাস নামে একটি উপন্যাস। প্রায় শেষ করে এনেছিলাম। গত বছর আমার কম্প্যুটার নষ্ট হয়ে যায়। তখন তিনটি প্রবন্ধের পাণ্ডুলিপি, একটি গল্পের পাণ্ডুলিপি আর এই দাস উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ধ্বংস হয়ে যায়।
এই সময়ের ছোটগল্প এসময়ের কবিতার চেয়ে ভালো। অনেক তরুণই ভালো গল্প লিখছেন। তাদের কারও কারও গল্প পাঠে আমার মধ্যে রীতিমতো ঈর্ষা জাগে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: উপন্যাসের কথা বলতে গেলে—রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস এখন তেমন চোখে পড়ে না। এখানে কি লেখকের সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করবেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: এখন রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক উপন্যাস চোখে পড়ে না, এটা বোধ হয় সর্বাংশে ঠিক না। হয়তো কেউ লিখছেন, হয়তো না। কিন্তু সবই আলোচনায় আসে না। এখন প্রচারের যুগ। যে যত প্রচারপটু, তার তত খ্যাতি। এখন প্রচারের জন্য দরকার মিডিয়া। মিডিয়া কাকে প্রচার দেবে। যে তার চেতনার দাসত্ব করে, তাকে? না যে তার চেতনার বিরোধিতা করে, তার ভণ্ডামিগুলোর প্রতিবাদ করে, তাকে? তবে, হ্যাঁ, এরপরও কোনো কোনো তরুণ লেখক আছেন, যারা মিডিয়াকে তোয়াক্কা না করেই নিজেরাই হয়ে উঠেছেন প্রতিমিডিয়া। এখনই মিডিয়া-ই তাদের পেছনে ঘুরঘুর করছে। এখন মিডিয়ার স্বভাব হয়ে পড়েছে ঘ্রাণপ্রিয় কুকুরের মতো। যেখানে ঘ্রাণ সেখানেই তার ঘুরঘুর। উদাহরণ হিসেবে আমরা তরুণ কথা সাহিত্যিক সাদাত হোসেনের কথা বলতে পারি। সাদাতের কোনো গল্প-উপন্যাস তো কোনো মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখিনি। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠা বা প্রচার আটকে থাকেনি। আসলে দরকার নিষ্ঠা, বিনয় আর একাগ্রতা। তাহলে তাকে কেউ আটকাতে পারে না।
মূল কথায় ফিরে আসি। রাজনৈতিক উপন্যাস বা ঐতিহাসিক উপন্যাস কারা লিখবেন? প্রবল সুখের ভেতর যেমন মানুষ সুখ অনুভব করতে পারে না, তেমনি দুঃখের ভেতরও না। দেশে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলতে গেলে স্ববির। বিরোধী দলগুলো মিলাদ মাহফিল আর দোয়া আলোচনাসভায় ব্যস্ত। গণসম্পৃক্ত-জনস্বার্থের কোনো কাজে তাদের দেখা যায় না। আর রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গেই তো ইতিহাসের সম্পর্ক। দেশে রাজনীতির চর্চাই তো নেই। ইতিহাসেরও না। আর লেখক তো সমাজের চিত্রই প্রতিফলিত করবে। সমাজে যা নাই, তা তো সে আনবে না। মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরে, পঠন-পাঠনের বাইরে তার কল্পনাশক্তিও যায় না। হয়তো একারণেই রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হচ্ছে না। আর হলেও মিডিয়ার কারসাজিতে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।