সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে ক’টি চলচ্চিত্র টিকে থাকতে পারে? যে কয়টি পারে সেগুলোকে মানুষ সম্মান করে, গুণগান গায়। সেই বিচারে যদি ধরা হয়, তবে সিটিজেন কেইন সেই কালোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রগুলোর একটি, যেটি গত ৭৬ বছর ধরে গুণবিচারী দর্শকদের আগ্রহ ধরে রেখেছে। কেন ১৯৪১ সালে মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমা নিয়ে আজো এত আকর্ষণ?
পরিচালক অরসন ওয়েলসের এক অমর সৃষ্টি সিটিজেন কেইন। যুগ পেরিয়ে শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও হিরামণি হয়েই আছে সিটিজেন কেইন। সিনেমাটির নাম হওয়ার কথা ছিল দ্য আমেরিকান। হলেও হতে পারত নামটি রোজবাড কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিটিজেন কেইন হয়েই আমাদের মাঝে আজও বর্তমান।
হ্যালির ধুমকেতু নয়। ৭৬ বছর পর কোনো চলচ্চিত্রপ্রেমী যদি বড় পর্দায় সিটিজেন কেইন দেখে, সে হয়তো মুখ ফসকে বলেই ফেলবে, হ্যালির ধুমকেতু দেখে এলাম।
যুগটা ছিল সাদাকালোর। তাতে কী? পরিচালক অরসন ওয়েলস-এর পরিচালনায় আর অভিনয়ে সিনেমাটি রঙিন—এনিমেটেড যুগের হাজার হাজার সিনেমাকে হার মানিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
সিনেমাটির সবচেয়ে চমকপ্রদ যে দিকটি হচ্ছে, সেটি হলো এর স্ক্রিন প্লে। দৃশ্যপটগুলো এত রহস্যময়ভাবে সাজানো হয়েছে, যেন পুরো সিনেমা জুড়ে দর্শকদের একটা অন্যরকম আকর্ষণ থাকে। আর সেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু শুধু একটি শব্দ ‘রোজবাড’। এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘অপ্রস্ফুটিত গোলাপ’। চার্লস ফস্টার কেইন তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বলে যান এই শব্দটি।
‘রোজবাড’ কী?—এই প্রশ্নের উত্তর ১৯৪১ সাল থেকে খুঁজতে ব্যস্ত সিনেমাটির দর্শক, আলোচক, সমালোচকেরা। তবে এক কথায় এই ‘রোজবাড’-এর অর্থ কেউ বলতে পারেননি। রোজবাড—এমন একটি সিনেমাটিক মেটাফোর, যা অতুলনীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যারা ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া রোমান পোলানস্কির ‘চায়না টাউন’ মুভিটি দেখেছেন, তারা অবশ্য বলতে পারবেন, ‘চায়না টাউন’ শব্দ দিয়ে যে মেটাফোর সৃষ্টি করা হয়েছে. সেটি হয়তো ‘রোজবাড’ থেকেই উৎসাহিত। তবে ‘চায়না টাউন’ মেটাফোরটি কখনো ‘রোজবাড’-এর সমতুল্য নয়।
চার্লস ফস্টার কেইনের মৃত্যুর পর ‘রোজবাড’ কী—এ নিয়ে অন্বেষণ শুরু করেন একজন সাংবাদিক থমসন। কারণ চার্লস ফস্টার কেইন এমন এক ব্যক্তি বা চরিত্র যে কিনা ছিল সংবাদপত্রের মুঘোল, হলেও হয়ে যেতে পারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাকে সব হারাতে হয়, মৃত্যুবরণ করতে হয় ‘জেনেডু’ নামক বিলাসবহুল প্রাসাদে, যে প্রাসাদের অর্থমূল্য কারো জানা নেই।
রোজবাড কী—এর উত্তর সিটিজেন কেইনের ভেতরে বেশ কয়েকবার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হয়তো চার্লস কেইনের কোনো প্রেমিকার নাম রোজবাড, কিংবা এমন কোনো জিনিস বা ব্যক্তি যাকে সে হারিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোজবাড অধরাই থেকে যায় থমসনের কাছে। তাই শেষপর্যন্ত তাকে বলতে হয়, ‘কেইন সেই মানুষটি, যে তার জীবনে সব পেয়েছিল এবং তারপর সে তার সব হারিয়েছে। মনে হয়, রোজবাড এমন কিছু যা সে কোনোদিন পায়নি বা হারায়নি। আমি মনে করি না, একটি শব্দ একটি মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করতে পারে।’
তবু শেষপর্যন্ত একরোখা, সমাজতান্ত্রিক খ্যাত, বিভিন্ন সময়ে আলোচিত বিশিষ্ট ধনী কেইনের শেষ উক্তি ‘রোজবাড’ কী—এর উত্তর পাওয়া যায় সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে। চার্লস ফস্টার কেইনের ছেলেবেলার স্লেজগাড়ি, যেটার গায়ে লেখা সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দ ‘রোজবাড’।
সিনেমাটিক এই উত্তরে তবু কারও মন ভরবে না। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, রোজবাড কী?
সিটিজেন কেইন সিনেমাটি করা হয়েছে মূলত একজন প্রভাবশালী সাংবাদপত্র মুঘোক উইলিয়াম রেনডলফ হার্স্টের জীবনের ছায়া অবলম্বনে। হার্স্ট তার স্ত্রীকে ডাকত ‘রোজবাড’ নামে।
তাহলে কি সিটিজেন কেইনের ‘রোজবাড’ এই রোজবাড হতে পারে? চার্লস কেইনের দ্বিতীয় স্ত্রী সুসান আলেক্সান্ডার কেইন কি তাহলে সেই রোজবাড? যার জন্য চার্লস কেইন ছেড়েছিল তার প্রথম স্ত্রীকে, যে কিনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ভাগ্নী, যার জন্য ৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানিয়েছিল অপেরা হাউজ, যাকে সঙ্গীতশিল্পী বানানোর জন্য এক রকম সংগ্রাম করে গেছে, যার স্বপ্ন পূরণের জন্য গড়েছিল এক রাজপ্রাসাদ ‘জেনেডু’, সেই সুসান আলেক্সান্ডার কি রোজবাড হতে পারে না?
আসলে রোজবাড কী—এর উত্তর দেওয়া আছে সিনেমাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে, যে সময়টায় চার্লস কেইনের হতাশার সময় চলমান। গভর্নরের নির্বাচনে হেরে যাওয়া থেকে শুরু করে নানা বিপর্যয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, তার সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবে। সেই মুহূর্তে তার ব্যাংকার মি. থ্যাচারের সঙ্গে কয়েকটি কথা যেন রোজবাডের রহস্য উন্মোচিত করে দেয়। মি. থ্যাচার সেই ব্যক্তি, যে তার জীবনের শৈশব কেড়ে নিয়েছিল।
সেই সময়, চার্লস কেইন তার ম্যানেজার বার্নস্টিনকে উদ্দেশ করে বলে, যদি আমি ধনী না হতাম, তাহলে হয়তো আমি কোনো বিখ্যাত মানুষ হতাম।
এ সময় মি. থ্যাচার বলে, তুমি কী নিজেকে বিখ্যাত মানুষ মনে করো না?
কেইন, আমি মনে করি আমি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভালো করেছি।
থ্যাচার, তাহলে তুমি কী হতে চেয়েছিলে?
কেইন, তুমি যে বিষয়গুলো ঘৃণা করো, সেগুলো।
এই উক্তিগুলোর গভীরতা এত বেশি যা অনুধাবন করলেই রোজবাড কী, তার খোঁজ পাওয়া যায়।
আসলে রোজবাড বা অপ্রস্ফুটিত গোলাপ হচ্ছে চার্লস ফস্টার কেইনের অপ্রস্ফুটিত জীবন। নয়তো এটা এমন কিছু, যা উদ্ধার করা অসম্ভব।