১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসের একটা কালো দিন। এই দিনে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমার ওপর পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করে, যার সাংকেতিক নাম ছিল ‘লিটল বয়’। এর আগে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে বিমান হামলা করে জাপান। দুটি ঘটনা কোন সময়ের, তা কারো অজানা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতা যুদ্ধক্ষেত্রকে ছাড়িয়ে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে ক্যালিফোর্নিয়াতে বসবাসরত একজন আটবছর বয়সী বালকের ওপর, তা আলেজ্যান্দ্রো মন্টিভেদির ‘লিটল বয়’ চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে।
সিনেমাটিতে বয়স্ক পিপার বাসবিকে তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আটবছর বয়সী পিপার বাসবিকে ছেড়ে তার প্রাণপ্রিয় বাবা মোটর মেকানিক জেমস বাসবি যুদ্ধে চলে যায়। কয়েকদিন পরেই খবর আসে, জাপানিজদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পরে আটক হয়েছে জেমস। মুহূর্তেই যুদ্ধের নির্মমতা ভর করে বাসবি পরিবারে। সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতার মাঝে পড়ে পিপার। কেননা, আকারে ছোট হওয়ার কারণে সবাই তাকে ‘লিটল বয়’ বলে খ্যাপায়। তার সঙ্গে সময় কাটানোর কেউ নেই। বেন ঈগল দেখার মতো কেউ নেই।
যুদ্ধকালীন অবস্থায় যুদ্ধরত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের জীবনে একটা ঝড় বয়ে যায়। সেই ঝড়ের মাত্রা কতটুকু, তা বোধ হয় প্রকাশযোগ্য নয়। তবু পিপার বাসবি চরিত্রের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক বালকের গল্পটা বেশ জমে ওঠে একজন জাপানিজ হাশিমতোর আবির্ভাবে। হাশিমতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বজনহারা নিঃসঙ্গ একজন বয়স্ক লোক। প্রথমে পিপার ও তার বড় ভাই লন্ডন হাশিমতোর বাড়িতে হামলা করে, কেননা তাদের বাবাকে জাপানিজরা ধরে নিয়ে গেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে দীর্ঘদিন আমেরিকাতে অবস্থানরত এক বয়স্কলোককে জাপানবিরোধী চিন্তাধারার কারণে সমাজে নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে, সেগুলো তুলে আনা হয়েছে সিনেমাটিতে।
এদিকে বেন ঈগলের সঙ্গে লাইভ শোতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বালক পিপারকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। পিপার ভেবে বসে তার ভেতর বেন ঈগলের মতো একটা ক্ষমতা ভর করেছে। তার এই চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করে গির্জায় এক ধর্মীয় বক্তব্যে।
সেখানে বলা যায়, তোমার বিশ্বাস যদি একটি সরিষা বীজের মতোও হয়, তাহলে তুমি সেটা দিয়ে একটা পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারবে। আর যদি তুমি পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারো, তাহলে তুমি যে কোনো কিছুই করতে পারবে।
এরপর শুরু হয় বালক পিপারের বিশ্বাসের খেলা। অবুঝ বালক পিপারের চিন্তা তখন একটাই কী করে তার বাবাকে ফিরিয়ে আনা যায়। তার মানসিক অবস্থার কথা বুঝতে পেরে ফাদার অলিভার তার হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয়। পিপারের ভাবতে শেখে শুধু বিশ্বাসই পারবে তার বাবা জেমসকে ফিরিয়ে আনতে।
লিস্ট অনুযায়ী জাপানিজ হাশিমতোর সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু করে পিপার। আস্তে আস্তে তাদের ভিতর একটা গুরু-শিষ্য সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যেমনটি দেখা গেছে ‘দ্য কারাতে কিড’ সিনেমাতে। হাশিমতো পিপারকে শিক্ষা দেয়, কিভাবে তাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। কিভাবে সে তার কটাক্ষকারীকে রুখে দিতে পারবে।
বন্ধুর ভূমিকার পাশাপাশি হাশিমতোকে ঘিরে সেই সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। পুত্রহারা স্যাম এবং লন্ডন বাসবি মিলে একসময় হাশিমতোর বাড়িতে হামলা করে। তাদের উদ্দেশ্য হাশিমতোকে শায়েস্তা করা।
তাদের মতিগতি বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাসভরা কন্ঠে হাশিমতো স্যামের উদ্দেশে বলে ওঠে, Doing this won’t bring back your son. অর্থাৎ, এটা করার ফলে তুমি তোমার সন্তানকে ফিরে পাবে না।
স্যাম একথায় আরও রেগে গিয়ে হাশিমতোকে মারাত্মকভাবে আহত করে। অন্যদিকে, হাশিমতো সুস্থ হয়ে লন্ডনকে নির্দোষ ঘোষণা করে, এমনকি স্যামের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনে না।
মন্টিভেদি ও পিপি পোর্টিলোর চিত্রনাট্যটি নিয়ে অনেকের মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে গল্প বলার ধরনটা ঠিক নেই। আসলে কিছু বিষয় প্রকটভাবে ফুটে ওঠার দরকার ছিল। অন্যদিকে সিনেমাটিকে বেশি উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যা যুদ্ধকালীন অবস্থার সঙ্গে কিছুটা দৃষ্টিকটু। আর যুদ্ধক্ষেত্রে জেমস বাসবিকে নায়কোচিত ভূমিকার পরিবর্তে পুরো সিনেমার আকাঙ্ক্ষা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।
সিনেমাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে, বেন ঈগলের ভঙ্গিমায় পিপার বাসবির পর্বত নড়িয়ে ফেলা। পরদিন অবশ্য খবর বেরোয় ভূমিকম্পের ফলে পর্বত নড়েছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিতর একটা বিশ্বাস জেগে ওঠে, জেমস বাসবির ভেতর কোনো একটা অতিপ্রাকৃত শক্তি থাকলেও থাকতে পারে। পিপার বাসবি ফাদার অলিভারের লিস্ট ধরে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করতে থাকে। একসময় সে সমুদ্রের সামনে বেন ঈগলের ভঙ্গিমায় তার বাবাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকে। তার এই বিশ্বাস দেখে সবাই অবাক হয়। তাকে দেখতে মানুষ ভিড় জমায়। এই বিশ্বাস ঠুনকো বিশ্বাস নয়, সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিল এক আবেগী বালকের লড়াই।
তবে সব লড়াই শেষে হিরোশিমায় লিটল বয় আঘাত হানে। তার কিছুদিন পরেই খবর আসে, জেমস বাসবি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে। বেন ঈগলকে নিয়ে নানান কল্পনা, পার্টনারের সঙ্গে অসাধ্য সাধনের চেষ্টা, লিটল বয়ের স্বপ্ন সবকিছু স্থবির হয়ে ওঠে মুহূর্তেই। পিপার যেন তার বিশ্বাসের লড়াই-এ হেরে যায়।
মেক্সিকান পরিচালক আলেজ্যান্দ্রো মন্টিভেদির পরিচালনায় সিনেমাটির প্রধান চরিত্র পিপার বাসবি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেকব সালভাটি। এছাড়া পিপারের মায়ের চরিত্রে এমিলি ওয়াটসন একজন সুন্দরী মমতাময়ী মা হিসেবে এমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যাকে পাওয়ার আশায় সুযোগসন্ধানী ড. ফক্স অতি দুঃখের সময়েও এমার ওপর তার জাল ফেলেছে। হাশিমতো চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসিদ্ধ জাপানিজ-আমেরিকান অভিনেতা কেরি হিরোইয়োকি তাগাওয়া। তার গাম্ভীর্যপূর্ণ, নিষঙ্গ উপস্থাপনা অতিশয় উচ্চমার্গীয়। টম উইলকিনসন অভিনয় করেছেন ফাদার অলিভারের চরিত্রে, যেখানে তিনি ধার্মিক, আশাবাদী ও বাস্তববাদী হাশিমতোর বন্ধু হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। লন্ডন বাসবি চরিত্রটিকে বিকশিত করেছেন ডেভিড হেনরি। মধ্যবয়সী লন্ডন তার বাবার অবর্তমানে পরিবার চালাতে হিমশিম খেয়েছে, জাপানিজ হাশিমতোর ওপর চড়াও হয়েছে আবার মৃত্যুমুখে পতিত হাশিমতোকে বাঁচাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার যুবক বয়সের অস্থিরতা সূক্ষ্ণভাবে ফুটে উঠেছে এখানে। বেন ঈগল চরিত্রে বেন চ্যাপলিন ছোটদের কাছে নায়কতুল্য এক চরিত্র। যাকে নিয়ে অল্পবয়সীরা কল্পনাতে ভেসে যায়। যাকে তারা নিজেদের ভেতর ধারণ করতে চায়।
মাইকেল রাপাপোর্ট পিপারের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। রাপাপোর্ট তার প্রকাশভঙ্গিতে বেশ উজ্জ্বল ছিল সিনেমাটিতে। পিপারের সঙ্গী হিসেবে তার একরূপ, যুদ্ধেক্ষেত্রে তার ভিন্ন রূপ এবং যুদ্ধফেরত অবস্থায় তার আরেক রূপের বহিঃপ্রকাশ পাওয়া গেছে।
ফ্লপ সিনেমা হিসেবে বিবেচিত ‘লিটল বয়’ দেখে অতৃপ্ত হওয়ার কারণ নেই। অল্প কিছুদিনের ভেতরে এই সিনেমাটির আদলে বলিউডে সালমান খান অভিনিত ‘টিউবলাইট’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় টিউবলাইটে ‘লিটল বয়’-এর প্রভাব কতটুকু বর্তমান থাকে।