পলিয়ার ওয়াহিদ
বইমেলা মানেই লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা। তাই এ মেলাকে ঘিরে বইপ্রেমীদের আবেগ-প্রেম একটু বেশিই থাকে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই মেলায় আসতে থাকে নতুন নতুন বই, নতুন চিন্তার বই, নতুন কল্পনার কল্পনার। আসে উপন্যাস, আসে কবিতার বই, আগে গল্পের বই। প্রবন্ধ-নাটকের বইও আসে। তবে কবিতার বই ও উপন্যাসই সংখ্যায় থাকে বেশি। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবারও মেলায় সর্বাধিক বই এসেছে কবিতার। এরপরেই উপন্যাস। মেলায় যত উপন্যাস এসেছে, এর মধ্যে নানা কারণে পাঁচটি উপন্যাস নিয়ে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মধ্যে রয়েছে উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও আবেগের স্ফূরণ। এই পাঁচটি উপন্যাস হলো আহমাদ মোস্তফা কামালের নিরুদ্দেশ যাত্রা, হামিম কামালের কারখানার বাঁশি, মাসউদুল হকের লস্ট কমরেড, আশান উজ জামানের অন্যচোখে, শামস সাইদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর।
নিরুদ্দেশ যাত্রা
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যারা জন্মভূমি ছেড়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে এখানে এসেছিল, তাদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ। এক ভাগ এখানে জমি কিনে বাড়ি করে থিতু হয়েছে, আরেক ভাগ যেকোনো কারণেই হোক বাড়ি করতে পারেনি। এই দ্বিতীয় ধরনের মানুষেরা সারা জীবন শুধু ভেসে বেড়িয়েছে। এ ধরনের ভাসমান, গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন মানুষের মনোজগৎ কেমন হয়, তা নিয়ে দারুণ কৌতূহল ছিল লেখকের। নিরুদ্দেশ যাত্রা উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে তেমনই একটি পরিবার, এক বড় অংশজুড়ে তাদের জীবনযাপন আর মনোজগতের ছবি এঁকেছেন লেখক। উদ্বাস্তু হলেও এই পরিবারের সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করে যায় এ দেশেরই অংশ হয়ে ওঠার; একজন মুক্তিযুদ্ধে যায়, আরেকজন অংশ নেয় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, আরেকজন এ দেশের নিসর্গের সঙ্গে গড়ে তোলে এক নিবিড় ও আত্মিক সম্পর্ক। তাদের কথা বলতে গিয়েই এসেছে আরও অনেক চরিত্র, এসেছে নানা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, বাস্তুত্যাগী মানুষের হাহাকার, নতুন দেশে টিকে থাকার সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, ফের দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, আবার দুর্ভিক্ষ, সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস এটি না।
এখানে আছে ব্যক্তি-মানুষের গল্প , তাদের বিষাদ ও বিপন্নতা, আনন্দ ও বেদনা, বিষণ্নতা ও নিমগ্নতার ছবি আঁকা হয়েছে নিপুনভাবে।এটা সত্যি যে এই উপন্যাসের এক প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন এবং নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের ছবি। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক নো-ম্যানস ল্যান্ডে, দেশটাও তাই। সবাই গন্তব্যহীন, সব যাত্রাই নিরুদ্দেশ যাত্রা। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন, প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা, বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৫৬০ টাকা।
কারখানার বাঁশি
‘কারখানার বাঁশি’ হামিম কামাল-এর দ্বিতীয় উপন্যাস। লেখক একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার তৈরির কারখানায় কাজ করেছেন কিছুদিন। সেখানে তার যে অভিজ্ঞতা, সেই বাস্তবতা থেকে উপন্যাসটি গত দেড় বছর ধরে লেখা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে চিন্তাসূত্রে।
ছোট্ট বাসটা দেখতে দেখতে পূর্ণ হয়ে উঠলে শেষবার জ্বলে উঠল ভেতরের বাতি। সলিল দেখতে পেল, স্টেশনের পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে থাকা সমবয়েসী তরুণটি তার ঠিক পাশেই এসে বসেছে। আসনে স্থির হতে পারছিল না। যেন শরীরময় মার্চ করে বেড়াচ্ছে এক পল্টন আক্ষেপ। বাসের চলন ক্রমে অবিরত হয়ে উঠলে অশান্ত সেনারা ক্রমে শান্ত হলো। বন্ধ চোখের কাঁপন থেমে গিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে নিয়মিত হয়ে উঠল তার। তখনো সলিলের চোখে ঘুম নেই। জানালার বাইরে কালো অরণ্য গতিময়, শীতল, রহস্যঘন। পরিত্যক্ত কারখানাগুলো প্রেতের চোখ হয়ে তাকিয়ে থাকল আরো দীর্ঘপথ। যন্ত্রের মন্দ্রস্বরে ক্লান্ত কর্টেক্স যখন তন্দ্রা তৈরি করেছে, শোনা গেল ওদের জোটবদ্ধ স্বর: কত শতবার কথা দিলে, কই, এলে না তো তুমি, এলে না তো। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন কাব্য কারিম। বইটির দাম রাখা হয়েছে ৪৫০ টাকা।
লস্ট কমরেড
সত্তর দশকের শেষ ভাগে জনমুক্তি পার্টি নামে একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনকে বাদ দিয়ে তারা বিপ্লবের তরতাজা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কিউবা’কে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে। কোনো রকম সম্মতি ব্যতিত ফিদেল ক্যাস্ট্রো হয়ে ওঠেন তাদের আদর্শিক নেতা। বিপ্লবের রূপরেখা কেমন হবে, তা জানতে দরিদ্র সেই দলটির তিন সদস্যের একটি দল পদব্রজে কিউবা রওয়ানা দেয়। সেই তিন সদস্যের দলটির একজন ছিলেন কমরেড আজফার হোসেন মুকুল। তারা শেষ পর্যন্ত কিউবা পৌঁছতে পেরেছিল কি-না, তার উত্তর কেউ জানে না। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যু উপলক্ষে অনেক বছর পর অন্তরালে থাকা কমরেড মুকুল স্মরণসভায় প্রকাশ্যে হাজির হন। আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে আদর্শ ধরে রাখতে গিয়ে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে থাকা এক কমরেডদের জীবন কাহিনী। এর দ্য লস্ট কমরেড একটি চমৎকার সৃষ্টি। বামপন্থী রাজনীতির কিম্ভুতকিমাকার হঠকারিতা, বাস্তববিবর্জিত হাস্যকর জনবিচ্ছিন্নতা, বিপ্লব, আন্ডারগ্রাউন্ড ইত্যাদি বুলি কপচানো কৌতুকময়তা এবং তথাকথিত ত্যাগীদের পল্টিবাজি-এসব কিছু ছাপিয়ে বইটিতে ফুটে উঠেছে কমরেড মুকুল নামের চরিত্রটির সর্বস্বত্যাগী সদিচ্ছা, সমাজ পাল্টানোর স্বপ্নে বিভোর থেকে ধূপকাঠির মত পুড়তে পুড়তে একসময় নিরূদ্দেশ হয়ে যাওয়ার গল্প।
দ্য লস্ট কমরেড একইসঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি তীব্র স্যাটায়ার এবং নীতির প্রশ্নে চরম আত্মত্যাগের এর অদ্ভুত সংমিশ্রণ। বোনাস হিসেবে বইটিতে আছে লেখকের নিজস্ব জীবনবোধের অসামান্য সব এপিগ্রাম এবং সমসাময়িক বাংলাদেশের নিখুঁত চিত্রায়ণ, যে চিত্রায়ণ শুধু একজন সুদক্ষ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। পাওয়া যাবে মেলার ৬০৪-৬০৫ স্টলে। বইটি মূল্য ৩৩০ টাকা।
অন্যচোখে
অন্যচোখে’র দৃষ্টি বাঙালির গাঢ় রক্তে ধোয়া স্বর্ণশেকড়ে। এর গল্পটি মাথা তুলেছে লাশের স্তূপ থেকে। সেই স্তূপ, পঁচিশের কালরাতে যা ঢেকে ফেলেছিল বাংলার আকাশ। সেই স্তূপ, যার ওপর ভর দিয়ে পরসকালেই উঠে দাঁড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলার সূর্য। সেই সূর্যেও পায়ে পা মিলিয়েই এগিয়ে গেছে আখ্যানগুলো, চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে।
বিশাল ক্যানভাসের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য উপন্যাসের সময়কাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৮ মাস বিশ দিন হলেও, এর অলিতেগলিতে ডুকরে উঠেছে আরও আগের ইতিহাস, উঁকি দিয়েছে আরও পরের শঙ্কা-সম্ভাবনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নানা শ্রেণির বাঙালি নারী ও পুরুষের বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ, প্রবাসী বাঙালিদের অনন্য অবদান আর পাকিস্তানি সেনা ও তাদের পরিবারের চোখে এর অবস্থান ফুটে উঠেছে অন্য আভায়। আর তা করা হয়েছে সজীব সজাগ ভালোবাসার রঙ দিয়ে। সবকিছু তাই জীবন্ত খুব। যেন এই এখনই, চোখের সামনেই, ঘটছে সব। সে সময়ের উদ্বাস্তু বাংলাদেশই যেন উঠে এসেছে তার সকল দুর্দশা নিয়ে, গৌরব আর শৌর্যের ষোলআনা নিয়ে।
অভিনব এ উপন্যাসের প্রতিটি পর্বই একটি করে ছোটগল্প। গল্পগুলো সত্য সুতোয় বোনা। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নতুনতর উপলব্ধি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যচোখে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। মেলায় উপন্যাসটি পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ কথাসাহিত্যিক আশান উজ জামান-এর প্রথম উপন্যাস অন্যচোখে।
শব্দঘর-অন্যপ্রকাশ তরুণ কথাশিল্পী অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাসটি প্রকাশ করছে অন্যপ্রকাশ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর
একটি বাড়ি এবং জাতির পুনরুত্থানের ইতিহাস।বাঙালির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনো কোথাও রচিত বা লিখিত হয়নি, হয়ে ওঠেনি। এই না-হওয়ার কারণ ব্যক্তি জীবনের অস্থিরতা, সামাজিক-মানসিক চাপ সহ্য করার অক্ষমতা কিংবা শাসকের রক্তচক্ষুর ভয়, পক্ষ-বিপক্ষের মন্তব্য। আমরা এখনো কঠিন ও বৈপরীত্যকে সহজভাবে নিতে শিখিনি। এই না-নেওয়াটার কারণও অর্থনৈতিক দৈন্য, হীনমন্যতা, শিক্ষাগত অযোগ্যতা। প্রত্যেক জাতির সামনে প্রত্যেক সেক্টরে একজন আইডল থাকে। তাদের অতিক্রম করার অনুপ্রেরণা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম সামনের দিকে চোখ রাখে।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবন তখন অঘোষিত সরকারি সদর দপ্তরে পরিণত হয়েছিল। বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার ঠিকানা হয়েছিল। হয়ে উঠেছিল নিরাপদ আশ্রয়। আবার শত্রুদের চক্ষুশূল। দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে এই বাড়ি ছাড়েননি বঙ্গবন্ধু। ওঠেননি সরকারি আলিশান বাসভবনে। স্বাধীনতার আগে পরে আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংও হয়েছে এই বাড়িতে। যদিও কংগ্রেসের অনেক মিটিং নেতাজির বাড়িতে হয়েছে। তবে ৩২ নম্বরের মতো সংগ্রামের সদর দপ্তরে পরিণত হয়নি। পরিণত হয়নি একটি জাতির ঠিকানায়। ৩২ নম্বর একটি জাতির ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল। এই ইতিহাসের হাত ধরে কল্পনার পথে হেঁটে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর উপন্যাসটি। উপন্যাসটি পাওয়া যাবে মেলার অন্বেষা প্রকাশন-এর ২২ নং প্যাভিলিয়নে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য রাখা হয়েছে ৪৩৮ টাকা।