গত পঞ্চাশ বছরে সমালোচকদের কষ্টিপাথরে শুধু একটি সিনেমাই অরসন ওয়েলেসের সিটিজেন কেইন সিনেমাটিকে টেক্কা দিতে পেরেছে, সেটি হলো বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নির্মাতা আলফ্রেড হিচককের ‘ভার্টিগো’। কিন্তু কেনই বা এই সিনেমাটির এত কদর? কী আছে এতে? যার জন্য সমলোচকেরা তাদের মুখ সিটিজেন কেইন থেকে ‘ভার্টিগো’র দিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন!
আসলে সত্যি কথা বলতে, ১৯৫৮ সালে ‘ভার্টিগো’ যখন মুক্তি পায়, তখন কিন্তু ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা পায়নি কিংবা সমালোচকদের দৃষ্টিতে ওভাবে আসেনি। এরচেয়ে বরং হিচককের ‘রেয়ার উইনডো’ এবং ‘সাইকো’ নিয়েই সবাই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হিচককের মৃত্যুর পর ১৯৮৩ সালে যখন ‘ভার্টিগো’ ও ‘রেয়ার উইনডো’-এর রি-রিলিজ হলো, তখন সমালোচকদের দৃষ্টি গেলো ‘‘ভার্টিগো’’র দিকে। এরপর আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে সমালোচকেরা ‘ভার্টিগো’র রূপ-বুনন-কৌশল দেখে অবাক হতে থাকলো। শেষমেশ সিটিজেন কেইনকেও বাদ দিয়ে তারা বেছে নিলেন নতুন এক সিনেমা, যেটিকে এখন বলাই চলে সমালোচকদের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র।
এখন প্রশ্ন হলো, ‘ভার্টিগো’ কোন ধারার ছবি? কিছু কিছু অসাধারণ সিনেমার ধারা/ক্যাটাগরি নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ‘ভার্টিগো’কে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হিসেবেই ধরা হয়। প্রেমের দিকটাই বা এখানে কম কী আছে! আধ্যাত্মিকতা, অতিপ্রাকৃত বিষয়াদি, ঘটনার মারপ্যাঁচ সবকিছুই সন্নিবেশিত হয়ে আছে ‘ভার্টিগো’তে। ধীরগতির চলচ্চিত্র হলেও ‘ভার্টিগো’ দর্শন করা এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
সিনেমার অন্যতম মূল চরিত্র হলো গোয়েন্দা জন স্কটি ফার্গুসন। সে আর্কোফোবিয়া নামের এক রোগে আক্রান্ত। এ রোগের রোগীদের চরম মাত্রার উচ্চতাভীতি থাকে। অধিক উচ্চতায় উঠে নিচের দিকে তাকালে আর্কোফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মাথা ঘুরতে থাকে এবং অদ্ভুত এক অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হয় যেটাকে বলা হয়ে থাকে ‘ভার্টিগো’। এটা অবশ্যই একজন গোয়ান্দার জন্য ভালো কিছু নয়। তার খেসারতও তাকে দিতে হয়। তার সহকর্মীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার এই ‘ভার্টিগো’। তাই তো তাকে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে গোয়েন্দাগিরি ছাড়তে চাইলেও সে ছাড়তে পারে না। গ্যাভিন এলস্টার নামে এক পুরনো বন্ধু তাকে ব্যক্তিগত গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দেয় তার নিজের সুন্দরী স্ত্রী ম্যাডেলিনকে অনুসরণ করার জন্য। তারপরই শুরু হয়ে যায় অবাক হওয়ার পালা। রহস্যময় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ম্যাডেলিন। সেই রহস্যের জালে জড়িয়ে স্কটি প্রেমে পড়ে যায় এলস্টারের স্ত্রীর। তারপর অপরূপা ম্যাডেলিনের মৃত্যু। সে এক করুণ কাহিনী। হৃদয়বিদারক এক প্রেমের ইতি ঘটে গেলো ‘ভার্টিগো’র কারণে।
অন্যকোনো সিনেমা হলে অথবা অন্যকোনো পরিচালক হলে হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতো সিনেমাটির চিত্রনাট্য। কিন্তু হিচকক নারী চরিত্র নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। নারী চরিত্রকে জটিল রূপ দিয়ে পুরুষদের খেলাতে ভালোবাসেন। তাই বলে এতটা? অসুখের ওপরে অসুখের প্রলেপে আর্কোফোবিয়া থেকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয় স্কটি। এরপর সত্যের ওপর মিথ্যের প্রলেপ, ম্যাডেলিনের ওপর জুডির প্রলেপ, মিথ্যের মধ্য থেকে সত্যের আলোকচ্ছটা, এলিস্টারের মাস্টারপ্লান সবই স্পষ্ট হতে থাকে এক অসাধারণ আলোকচিত্রের মাধ্যমে। সঙ্গে হৃদয়স্পর্শী এবং হৃদকম্পন সৃষ্টিকারী সাউন্ডের ব্যবহার। এতকিছু দেখার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, স্কটি আসলে কাকে ভালোবেসেছিল? জুডিকে না কি ম্যাডেলিনকে? তার মানসিক সত্তা ঠিকই একসময় ম্যাডেলিনকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু সে যাকে ভালোবেসেছিল, সে কখনোই জুডি ছাড়া অন্য কেউ নয়।
এই যে সিনেমাটির পরতে পরতে নানা প্রশ্ন, নানা দ্বন্দ্ব, নানা রহস্য—এসব দেখতে দর্শক মন ভালোবাসে। তাই মানুষ বারবার এই সিনেমাটি দেখতে চায়। বারবার মানুষ স্কটিকে ভুল করতে দেখতে চায়, মানুষ চায় জুডি ভুল করুক আবার স্কটির প্রেমেও পড়ুক। এই যে দেখতে চাওয়ার আকুলতা, সেটাই ‘ভার্টিগো’কে তুলে দিয়েছে আরও ওপরে।
তাই একথা বলা যেতেই পারে, দুঃখের স্তম্ভ বাড়িয়ে উচ্চতা ভীতি দূর করে স্কটি যেমন মুক্ত হয়েছিল ‘ভার্টিগো’ থেকে, চলচ্চিত্রটিও সব বাধা অতিক্রম করে আজ শীর্ষস্থানে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ‘ভার্টিগো’ মুক্তভাবেই অবস্থান করছে। চলচ্চিত্রটিতে স্কটি চরিত্রে অভিনয় করছেন সর্বকালের সেরা অভিনয়শিল্পী জেমস স্টেওয়ার্ট ও ম্যাডেলিন/জুডি চরিত্রে বৈচিত্র্য এনেছেন কিম নোভাক।