॥ফারুক সুমন॥
বহুগুণে গুণান্বিত, দেশের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে যিনি সদা আপসহীন-সংগ্রামী, যিনি বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞে সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে সুদীর্ঘ জীবন অতিক্রম করে ৭৬ বছরে পা দিয়েছেন, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদার। গত ২১ অক্টোবর এই গুণী নাট্যজনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ ‘পাতাদের সংসার’। শাহবাগের ‘পাঠক সমাবেশ’ কেন্দ্রে বৃষ্টিবিঘ্নিত বৈরী আবহাওয়ায় এক এক করে এসে পৌঁছেন রামেন্দু মজুমদারের ভক্ত-অনুরাগী, বন্ধু ও শিল্প-সাহিত্-যসংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষজন।
অনুষ্ঠানের মধ্যমণি রামেন্দু মজুমদারকে ঘিরে অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষাবধি ছিল সরব ও স্পন্দিত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মারুফ কবিরের সুন্দর সঞ্চালনায় প্রথমেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের আয়োজক, ‘পাতাদের সংসার’ পত্রিকার সম্পাদক হারুন পাশা। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের শুরুতেই তিনি ‘পাতাদের সংসার রামেন্দু মজুমদার সংখ্যা’ নিয়ে নিজের কৈফিয়ত পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গুণীজন ও বরেণ্য ব্যক্তিদের কর্মমুখর জীবনের অবদান নিয়ে জীবদ্দশায় খুব একটা আলোচনা হতে দেখা যায় না। আমরা এই প্রথা ভাঙতে চাই। মৃত্যুর পর বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে স্তাবকতাপূর্ণ স্মরণ সভা হতে পারলে জীবদ্দশায় কেন নয়? ‘পাতাদের সংসার’ ইতোপূর্বে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যার ধারবাহিকতায় আজকের এই রামেন্দু মজুমদার সংখ্যা।
প্রথমেই আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাশরিক-ই-হাবিব। তিনি বলেন, ‘যে মানুষটিকে ঘিরে হারুনের এ আয়োজন, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ নাট্যব্যক্তিত্ব, থিয়েটার জগতের কাণ্ডারি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রাণপুরুষ রামেন্দু মজুমদার। তার ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘পাতাদের সংসার’ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। অবাক লাগে, এতদিনে এ ধরনের কাজ হচ্ছে ভেবে। সান্ত্বনা পাই এই ভেবে, কখনো না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হলেও তা ভালো! রামেন্দু মজুমদারের ব্যক্তিত্ব আর সতেজ মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারবেন, এ বয়সেও তিনি কতটা প্রাণবন্ত, মার্জিত আর বলিষ্ঠ মনোভঙ্গি ধারণ করেন।’
নির্দেশক ও অভিনেত্রী ইশরাত নিশাত তার বক্তব্যে কিংবদন্তিতুল্য নাট্য-সংগঠক হিসেবে দেশ ও দেশের বাইরে রামেন্দু মজুমদারের উজ্জ্বল উপস্থিতিকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “নাটক সংশ্লিষ্ট কাজে আমরা যখন দেশের বাইরে গিয়েছি। সেখানে আমাদেরকে ‘রামেন্দু’স পিপল’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সাবলীল বক্তব্যে দেশপ্রেমিক, নির্লোভ ও বিনয়ী রামেন্দু মজুমদারের জীবনের বিচিত্র কর্মপ্রয়াস উঠে এসেছে। রামেন্দু মজুমদারের লেখা ‘প্রথম তিরিশ’ গ্রন্থ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থ কেবল আমার হয়ে ব্যক্তি রামেন্দু মজুমদারের জীবনকথা হয়ে ওঠেনি। এখানে পাওয়া যাবে নিকট-অতীতের ইতিহাসপাঠ। এ ইতিহাস বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের ইতিহাস।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুসের বক্তব্য থেকে ব্যক্তি রামেন্দু মজুমদার যে মানবিক সংবেদি সে বিষয়ে জানা গেল। তাঁর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে জানা গেল দেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ‘সংকটকালে’ রামেন্দু মজুমদারের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার কথা। একজন বলিষ্ঠ সংগঠক, নাট্যনির্দেশক, নাট্যাভিনেতা, নাট্যপত্রিকার সম্পাদক এবং নাট্যান্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে তার অবদান কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।’
অনুষ্ঠানে রামেন্দু মজুমদারকে নিয়ে সর্বশেষ বক্তা ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বন্ধু রামেন্দু মজুমদারকে নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি নানা আন্দোলন সংগ্রামে তার যে অবদান। তিনি কি সেভাবে মূল্যায়ন পেয়েছেন? তাঁকে ঘিরে অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে হতে পারতো! অবশ্য আমি এবং আমরা অপরাধী। যখন বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াটাও ছিল অপরাধ। ঠিক সেই প্রতিকূল পরিবেশেও রামেন্দু মজুমদার সঠিক কথা বলতে দ্বিধা করেননি।’ তার আবেগতাড়িত বক্তব্য উপস্থিত শ্রোতাদের অন্তর ছুঁয়ে যায়।
পরিশেষে রামেন্দু মজুমদার অত্যন্ত বিনয়ী বক্তব্যে নিজের কৃতজ্ঞতার কথা উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘’আমি সারাজীবন কাজ করে গেছি আপন গতিতে। কোনো প্রত্যাশা নয় বরং দেশমাতৃকার আহ্বানে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আমার কাছে পদক পুরস্কারের চেয়ে সব চেয়ে দামি হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা। আমি সেটা পেয়েছি। স্বপ্ন দেখি একটি ‘স্বতন্ত্র থিয়েটার স্কুল’ প্রতিষ্ঠার। জানি না করে যেতে পারব কি না। ‘থিয়েটার পত্রিকা’ সম্পাদনা করছি বহুবছর। এটা আমার সবচেয়ে স্বস্তির ও অনন্দের কাজ। এভাবেই আমি করে যেতে চাই। আপনারা যারা বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাকে ভালোবেসে অনুষ্ঠানে এসেছেন। সত্যি আমি কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত। ধন্যবাদ সবাইকে।”