সময় বহমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নীল আকাশের নিচে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। সেসব ঘটনাকে উপজীব্য করেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। কখনো কখনো চলচ্চিত্র সময় ও বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে পরাবাস্তবতায় রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘নীল আকাশের নীচে’ চলচ্চিত্রটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। সম্পূর্ণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে একদিকে উঠে এসেছে শহুরে নিম্নবিত্ত একটি পরিবারের সংগ্রাম, অন্যদিকে একটি অসম প্রেম। পরবর্তীকালে বাংলা চলচ্চিত্রে এ দুটি বিষয় এত বেশি চর্চিত হয়েছে যে, চলচ্চিত্রের মান-মহিমা সম্পর্কে বর্ণনা করা কঠিন। ‘নীল আকাশের নীচে’ চলচ্চিত্রটি বাংলা রোমান্টিক ধারার চলচ্চিত্রটির ভেতর অন্যতম সেরা সিনেমা। কিন্তু কেন?
চলচ্চিত্রটির গল্প শুরু মামুন নামে ট্যাক্সিচালকের সূত্র ধরে। একটু পরেই অবশ্য বোঝা যায়, সে আসলে পেশাগতভাবে ট্যাক্সি চালায় না। ভার্সিটিতে এমএ ক্লাসে পড়ে। ট্যাক্সিচালক বড় ভাইয়ের অসুস্থতার জন্য সে পরিবারের হাল ধরেছে। এরপর ট্যাক্সি চালানোর সুবাদেই তৃষ্ণার সঙ্গে পরিচয় হয় মামুনের। ওদিকে জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত মামুনের বড় ভাই তার বোন নাসিমাকে বিয়ে দিতে গিয়ে দু’হাজার টাকা এক সুদখোরের কাছ থেকে ধার করে। এই সামান্য পরিমাণ টাকাই তার গলার কাটা হয়ে বিঁধে। নাসিমার বড় ঘরে সুপাত্রে বিয়ে দেওয়া হয়, তবু কি নাসিমা শান্তিতে থাকে? এ শঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত মামুনের বড় ভাই নিঃশেষিত হতে থাকে। অন্যদিকে মামুনের সঙ্গে তৃষ্ণার অসম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তৃষ্ণা ধনী বাবার একমাত্র মেয়ে, কিন্তু প্রেম করে বসেছে ট্যাক্সিচালক এক শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে। তবে এর পরিণতি কী? মামুনের বড় ভাইয়ের জীবন সংগ্রাম ও মামুনের অসম প্রেম সিনেমাটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। মূলত একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে গল্পটি অগ্রসর হলেও পরবর্তী সময়ে আরও দুটি পরিবার গল্পটিতে জড়িয়ে পড়ে। সব বিষয় বিবেচনায় সিনেমাটিকে ট্র্যাজি-কমেডি ধারার বলা চলে।
সিনেমাটির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ইসমাইল মোহাম্মদ। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল এক দারুণ গল্প। সিনেমাটিতে এখনকার মতো অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যের অবতারণা করা হয়নি। এমনকী লম্পট আরশাদ প্রতিশোধের নেশায় যে কাজটি করে, সেটা চিত্রনাট্যকারের বুদ্ধিদীপ্ততার বহিঃপ্রকাশ।
রোমান্টিক বাংলা চলচ্চিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সিনেমায় গানের ব্যবহার। নীল আকাশের নীচে সিনেমাটির প্রতিটি গান স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং প্রতিটি গানই ক্লাসিক গান হিসেবে গণ্য। একই বাংলা সিনেমাতে এতগুলো ক্ল্যাসিক গানের সমাবেশ আর কোনো চলচ্চিত্রে আছে কিনা, জানা নেই। সিনেমাটিতে গানের সন্নিবেশ এতটা প্রাসঙ্গিকভাবে করা হয়েছে, যেখানে সিনেমার কাহিনীর ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং চলচ্চিত্রটির কাহিনীকে সম্প্রসারিত করেছে। এছাড়া গানের চিত্রগ্রহণ দারুণভাবে করা হয়েছে। সিনেমাটির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্য সাহা ও চিত্রগ্রহণ করেছে বেবী ইসলাম। তারা উভয়েই দক্ষতার সঙ্গে সিনেমাটিতে স্বীয় ভূমিকা রেখেছে।
নারায়ণ ঘোষ মিতার চলচ্চিত্রটিকে অনন্য পর্যায়ে নিয়েছে। প্রতিটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে তার প্রয়াস লক্ষণীয়। চটকদার আবুল ঘটকের চরিত্র, নানীর চরিত্র কিংবা খোকনের চরিত্রকে বাংলার গ্রাম্য সমাজের চরিত্র। ওই সময়ের ঢাকা শহরও যে বর্তমান গ্রাম্য সমাজের মতোই ছিল তা বোধহয় চলচ্চিত্রটিতে নানাভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বিয়ে করার জন্য নাসিমাকে দেখতে এসে খুঁতখুঁতে যুবকের নানা পরীক্ষা গ্রহণ যেমন একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মান সম্মানে আঘাত করেছে, আবার সালামের বড় হৃদয় সবাইকে উল্লাসিত করেছে। এছাড়া অযথা মারপিটের দৃশ্য সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়েছে পরিচালক।
সিনেমাটিতে মামুন চরিত্রে অভিনয় করেছে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলা চলচ্চিত্রে রাজ্জাক-কবরী বিখ্যাত জুটির কথা কারও অজানা নয়। এই সিনেমাটিও রাজ্জাক-কবরী জুটির রসায়ন। ধনীর দুলালী তৃষ্ণা চরিত্রে অভিনয় করেছে কবরী। রাজ্জাক তার অভিনয়ে সাবলীলতা দেখিয়েছে, বিশেষ করে গানের দৃশ্যগুলোতে তার অঙ্গভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ অসাধারণ। এছাড়া করুণ আর্তনাদ কিংবা প্রতিবাদের সময় সে বলিষ্ট অভিনয় করেছে। এক কথায় রাজ্জাক একটি প্রতিবাদী, প্রেমিক ও দায়িত্বশীল যুবকের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে। আরশাদ তৃষ্ণাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে সে প্রতিবাদ করেছে, বোনের বিয়েতে অযাচিত পরীক্ষা নেওয়া হলে সে প্রতিবাদ করেছে এবং তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগলে সে প্রতিবাদ করেছে। আবার তৃষ্ণার সঙ্গে অসম প্রেমে লিপ্ত হয়েছে। কবরী সিনেমাটিতে একজন প্রেমিক ও প্রতিবাদী নারী। লম্পট আরশাদকে একমুহূর্ত প্রশ্রয় দেয়নি সে।
নীল আকাশের নীচের চলচ্চিত্রটি আসলে রোমান্টিক নাকি জীবনধর্মী এই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছে মামুনের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা আনোয়ার হোসেন। অসাধারণ অভিনয়ে আনোয়ার হোসেন একটা শহুরে নিম্নবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। এছাড়া রোজী সামাদ মামুনের ভাবীর চরিত্রে এক মমতাময়ী নারী হিসেবে নিজেকে উন্মেষ করতে সার্থক। সে নিম্নবিত্ত পরিবারের সকলকে মমতাভরে আগলে রেখেছে, কোনো পরিস্থিতিতেই ভেঙে পড়েনি।
একটা সাদা শাড়ি বাঙালি সমাজে কী নির্দেশ করে, তা শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমাটিতে। আবার মামুনের বন্ধু দীদারকে বিপদের বন্ধু হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
নীল আকাশের নীচে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। একটি প্রেমের নাটকীয় পরিণতি হয়েছে, একটি সংগ্রামের জয় হয়েছে; একজন জীবন সংগ্রামীর পতন হয়েছে। অথচ নীল আকাশের নীচের পতন হয়নি। অর্ধশত বছর পরেও নীল আকাশের নিচের মানুষের মুখে তা এখনো কথা হয়ে ভেসে বেড়ায় স্বমহিমায়।