ক্যানিবাল শব্দের অর্থ নরকখাদক। নরখাদকেরা মানুষ হয়েও মানুষের মাংস কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খায়। একসময় ফিজিকে বলা হতো নরখাদকের দ্বীপ। ক্যানিবালিজম বর্তমান সময়েও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান। এমনকি ২০১২ সালেও পাপুয়ানিউগিনিতে ক্যানিবালিজমের নজির আছে। শুধু বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নয়, দুর্ভিক্ষ কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যানিবালিজমের অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত। বিশ শতকে রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ মানুষকে খাওয়ার কথা যেমন পৃথিবীকে অবাক করে, আবার আধুনিক যুগে বিভিন্ন যুদ্ধে খাদ্যাভাবে ভোগা সৈন্যদের নরমাংস ভক্ষণ মানুষের বিকৃত সত্তার প্রকাশকও হয়ে ওঠে।
ইংরেজিতে একটি বাক্যাংশ আছে ‘হ্যানিবাল দ্য ক্যানিবাল’ অর্থাৎ হ্যানিবালই ক্যানিবাল বা নরখাদক। এই বাক্যংশটির উৎপত্তি হয়েছে আমেরিকান কথাসাহিত্যিক টমাস হ্যারিসের বিখ্যাত চরিত্র ‘হ্যানিবাল লেক্টার’-এর কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে। টমাস হ্যারিস ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনটি হরর উপন্যাস লেখেন হ্যানিবাল লেক্টারকে কেন্দ্র করে। এই তিনটি উপন্যাস এতটা জনপ্রিয় হয় যে, গ্রন্থ প্রকাশের পরপরই এগুলোর ওপর ভিত্তি করে সিনেমা নির্মিত হয়েছে। শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৮ সালের দ্য ‘সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ দিয়ে, দ্বিতীয় উপন্যাস ‘হ্যানিবাল’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রি-সিক্যুয়াল ‘হ্যানিবাল রাইজিং’।
১৯৯১ সালে জোনাথন ডেমের পরিচালনায় ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ নামে যে চলচ্চিত্রটি রহস্য ও হররপ্রিয় দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল, সেটি মূলত টমাস হ্যারিসের হ্যানিবাল লেক্টরকেন্দ্রিক প্রথম উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। হরর থ্রিলারধর্মী সিনেমার মধ্যে এই চলচ্চিত্রটি শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে অনেক বছর ধরে। হ্যানিবাল লেক্টার চরিত্রের মতো সফল চরিত্র হরর সিনেমাতে খুঁজে পাওয়া ভার। শুধু হরর বললেও ভুল হবে চলচ্চিত্রটিতে নানাবিধ স্বাদ বিদ্যমান। একদিকে ধরলে এটি একটি সিরিয়াল কিলারের গল্প, অন্যদিকে এটিকে ক্রাইম থ্রিলার বললেও ভুল হবে না। রহস্য চলচ্চিত্রটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কতগুলো সফল ও শক্তিশালী চরিত্র চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়। হরর কাহিনীর ভেতরেও জীবনবোধের সচেতন সন্নিবেশন এটিকে মহিমান্বিত করেছে। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য হওয়ার পেছনে সংলাপ, মিউজিক ও অভিনয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একথা সবার জানা, একটি ভালো কাহিনী হলেই সেটি ভালো চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারে না। তাই জোনাথন ডেমের প্রচেষ্টা এখানে উজ্জ্বল তারকার সঙ্গে তুলনা করা চলে।
সিনেমার শুরুটা হয় ক্লারিস স্টার্লিং দিয়ে। প্রশিক্ষণরত একজন এফবিআই এজেন্ট স্টার্লিংকে দেওয়া হয় একটা কেসের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব। কিন্তু রহস্যে ভরা ব্যাপারখানা। বাফেলো বিল নামক সিরিয়াল কিলারকে ধরার জন্য তাকে পাঠানো হয় একজন কারাবন্দির কাছে, যে কিনা একইসঙ্গে একজন বিখ্যাত মানসিক রোগের চিকিৎসক, মানসিক রোগী, সিরিয়াল কিলার ও নরখাদক, যার নাম হ্যানিবাল লেক্টার। কারাগারের ভেতরে থেকেই কিভাবে হ্যানিবাল লেক্টার কেসটির সমাধান করে, কিভাবে ধূর্ত হ্যানিবাল লেক্টার সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জেল থেকে পালিয়ে যায়, কিভাবে স্টার্লিং এক দুঃসহ স্মৃতির সম্মুখীন হয় বার বার, সেসব প্রশ্নের উত্তর সিনেমাটিতে দেওয়া আছে। সিনেমাটির কাহিনী অতি সহজে বলা সম্ভব, তবে এর গভীরতা এর কাহিনীকে ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনো ভালো চলচ্চিত্রের প্রতি মুহূর্তের রোমাঞ্চকর অনুভূতি অতি সহজে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
বাফেলো বিল চরিত্রটি সিনেমাটিতে একটি রহস্যময় চরিত্র। চলচ্চিত্রটিতে সবার উদ্দেশ্য বায়বীয় বাফেলো বিলকে অন্বেষণ হলেও হ্যানিবাল লেক্টার চরিত্রের বৈচিত্র্য সবার দৃষ্টি হ্যানিবাল লেক্টারের দিকে নিয়ে যাবে। লেক্টারের আজব কথা বলার ভঙ্গি ও হিংস্রতা তার অতীতের ক্যানিবালিজমের বৈশিষ্ট্য বহন করে। চরিত্রটিকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। আবার হ্যানিবালকে দিয়ে ক্যানিবালিজমের স্বাদ দিতেও ভুলে যাননি জোনাথন ডেম।
এজেন্ট স্টার্লিং ও হ্যানিবালের ভিতরের রসায়ন খুবই গুরুত্ববহ। ঠিক কী কারণে হ্যানিবাল স্টার্লিংকে পছন্দ করে ফেলে, এটা অজানা। স্টার্লিং-হ্যানিবাল রসায়নের ফলেই শেষ পর্যন্ত বাফেলো বিলকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।
চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন টেড টালি, তিনি এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। শক্তিশালী সংলাপ তার চিত্রনাট্যজুড়ে বিদ্যমান, এমনকি চলচ্চিত্রটিতে নাটকীয়তা আনার ক্ষেত্রেও তিনি সফল। অবশ্য এসবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার টমাস হ্যারিস। হরর সিনেমাতে মিউজিকের ব্যবহার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। হাওয়ার্ড শোর প্রতি মুহূর্তে যথাযথভাবে মিউজিকের ব্যবহার করেছেন।
অ্যান্থনি হপকিন্স তার অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন সিনেমাটিতে। হ্যানিবাল চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি এমন কিছু বিষয় রপ্ত করেছিলেন যেগুলো ব্যতিক্রমী ও শৈল্পিক। হ্যানিবালকে ক্যানিবালের প্রতীকে পরিণত করতে তার ভূমিকা অনেক। হপকিন্সের মতোই স্টার্লিং চরিত্রে জোডি ফস্টার দারুণ অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া জ্যাক ক্রফড চরিত্রে স্কট গ্লেন, বাফেলো বিল চরিত্রে টেড লেভাইন, ডা. চিল্টন চরিত্রে অ্যান্থনি হেলড ভালো অভিনয় করেছেন।
আসলে প্রতিটি চলচ্চিত্র তার সময়সীমার মধ্যে মানুষের মন নিয়ে খেলা করে। একটি চলচ্চিত্র তার দুই-তিনঘণ্টার মধ্যে আপনার মনকে আনন্দিত করবে, উৎকণ্ঠিত করবে, আশা জাগাবে কিংবা দুঃখে ভরিয়ে দেবে। আর কোনো কিছু অতি স্বল্প সময়ে আপনার মনকে একইসঙ্গে এত ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা এত গভীরভাবে দেবে না। এই অভিজ্ঞতাগুলো যদি আপনার মনে দাগ কাটতে পারে তবেই আপনি সেই চলচ্চিত্রের কথা ভুলতে পারবেন না। ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ এমন একটি চলচ্চিত্র যেটি স্টার্লিং-এর দুঃস্বপ্নের মতোই। যন্ত্রণা কাতর ভেড়ার মতোই দর্শকদের হৃদয়পটে এটি ঘুরে বেড়াবে। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি ভেড়া শাবককে বাঁচাতে পারলেই কি তবে দুঃস্বপ্ন থেকে রেহায় পাওয়া যাবে? স্টার্লিং কি ক্যাথরিন মার্টিনকে বাঁচানোর পরে তার দুঃস্বপ্ন থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল?