Das Boot শব্দযুগল জার্মান ভাষা থেকে এসেছে। যার ইংরেজি অর্থ The Boat, বাংলায় নৌকা। তবে এই নৌকা কোনো সাধারণ নৌকা নয়, এর নাম ইউ-বোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নৌযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারণা আছে তারা সবাই ইউ বোটের নাম শুনে থাকবে। ইউ-বোট আসলে নৌকা নয়, এটি হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান কর্তৃক ব্যবহৃত একটি বিধ্বংসী ডুবোজাহাজ। হিটলারের ইউ-বোট তখন ছিল মিত্রবাহিনীর নৌশক্তির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউ-বোটের আঘাতে নিমজ্জিত হয়েছিল মিত্রবাহিনীর প্রায় তিন হাজার জাহাজ। তবে মিত্রবাহিনীও বসে ছিল না, তারা ইউ-বোট ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করে ডেস্ট্রয়ার। এই ডেস্ট্রয়ার, ইউ-বোট আর ইউ-বোটের নাবিকদের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তুলে ধরতে সত্য ঘটনা অবলম্বনে উলফগ্যাঙ পিটারসেন ১৯৮১ সালে নির্মাণ করেন ডাস বুট।
ডাস বুটের গল্পটা অতি সংক্ষেপে বলা যায়। একটি ইউ-বোট নতুন কিছু নাবিক ও পুরনো কিছু অভিজ্ঞ অফিসারদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ১০ ফিট প্রস্থ ও ১৫০ ফিট দীর্ঘ ইউ-বোটে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। কখনো পানির নিচে, কখনো বা পানির ওপরে তিমির মতো নিশ্বাস নিতে বের হয় ইউ-বোট। এরপর শুরু হয় ইউ-বোট ও ডেস্ট্রয়ারের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। শেষমেশ যুদ্ধের নির্মম পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছায় তারা। তাদের একটি মিশন দেওয়া হয়, যাতে তাদের সবার মৃত্যু নিশ্চিত। জিব্রাল্টার প্রণালী পাড়ি দেবার যাত্রায় তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভাগ্যক্রমে তারা রক্ষা পায়। তবু শেষরক্ষা হয় না। যুদ্ধের নির্মম পরিস্থিতি তাদের বরণ করে নিতে হয়।
চলচ্চিত্রটা অনেকটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম টাইপের। কাহিনী প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিছু চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হই ঠিকই কিন্তু সিনেমার গল্পটা ওসব চরিত্রনির্ভর নয়। বরং সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্র ইউ-বোটের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।
সিনেমার শুরুর কিছু দৃশ্য ইউ-বোটের বাইরে হলেও প্রায় পুরো সিনেমাটির দৃশ্যায়ন করা হয়েছে সংকীর্ণ ইউ-বোটের ভেতর অথবা ইউ-বোটের উপরাংশে। দৃশ্যায়নে সিনেমাটোগ্রাফার জস্ট ভ্যাকানোকে বেশ বেগই পেতে হয়েছে। কেননা, সংকীর্ণ বোটের একপাশ থেকে অন্যপাশে মাঝে মাঝে ক্যামেরাম্যানকে খুব দ্রুত চলে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোর দৃশ্যায়ন ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বোটের ক্যাপ্টেন জার্গেন প্রোচনাউ চরিত্রটি দৃঢ়তার সঙ্গে তার নেতৃত্ব বজায় রাখে ইউ-বোটে। এমনকি বোট যখন ডুবে যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব, তখনো তিনি বলেছেন, ’আমি উপযুক্ত রিপোর্ট চাই!’ মূলত ডুবোজাহাজের কী অবস্থা সেই রিপোর্টই তিনি চেয়েছেন। দৃঢ়চেতা হলেও প্রোচনাউ যে নাৎসীপন্থী নয়, সেরকম ইঙ্গিত তিনি দিয়ে গেছেন সিনেমাজুড়ে। তার কাছে তার জাহাজের নাবিকদের জীবনই মুখ্য, যুদ্ধ যেন তার ভাগ্যের পরিহাস। তার দক্ষতা, নেতৃত্ব ও ধৈর্য্যের ফলেই বোটটি বার বার রক্ষা পায়। তার কৌশলী বিবেচনা অবশ্যই দর্শককে অবাক করবে। ইউ-বোট মিশনের শুরুর সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় একজন সাংবাদিক হার্বাট গ্রোয়েনেমায়ার। চরিত্রটির প্রকাশভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, এই চরিত্রটি আসলে লুথার গুন্টার বুচহেইম। মূলত লুথারের উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করেই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে।
সিনেমাটিতে অনেক উত্তেজনাকর মুহূর্ত আছে। তবে সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্তটি আসে তখনই, যখন ইউ বোটটি তার বিধ্বংসী অস্ত্র টর্পেডো দিয়ে তিনটি মিত্রবাহিনীর জাহাজ উড়িয়ে দেয়। এর পরপরই একটি ডেস্ট্রয়ার তাদের আক্রমণ করে। শুরু হয় ডেস্ট্রয়ার আর ইউ-বোটের ইঁদুর-বিড়াল খেলা। একদিকে ডেস্ট্রয়ার আল্ট্রাসনিক সাউন্ড দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে ইউ-বোট খুঁজতে থাকে, অন্যদিকে ইউ-বোট সমুদ্রের তলদেশের দিকে যেতে থাকে। শুরু হয় ধৈর্য ও উত্তেজনার খেলা। ইউ-বোটের বেশ ক্ষতি হলেও এই খেলায় জয়ী হয় ইউ-বোটের ক্যাপ্টেনের ধৈর্য। ইউ-বোট পরেরদিন জেগে ওঠে সমুদ্রের ওপর। একটি অর্ধনিমজ্জিত মিত্রবাহিনীর জাহাজে তখনো আগুল জ্বলছে, বোটের ক্যাপ্টেন আরেকটি টর্পেডো ছুড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তখনি ঘটে ঘটনাটা, যেটি নিয়ে ১৯৮১ সালে সিনেমাটি মুক্তি পেলে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। মিত্রবাহিনীর অনেকেই জীবন বাঁচানোর জন্য সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে। তখন ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ওরা এখনো জাহাজে কী করছে? কেন তাদের এখনো কেউ উদ্ধার করেনি?’ মিত্রবাহিনীর নৌসেনারা জীবন বাঁচাতে ইউ-বোটের দিকে সাঁতরাতে থাকে। তখন ক্যাপ্টেন ইউ-বোটটিকে উল্টো দিকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। সেসময় ক্যাপ্টেনের মনে কী ঘটেছিল সেটা বলা হয়নি, কেন ক্যাপ্টেন তাদের উদ্ধার করলো না সেটা জানা যায়নি, শুধু একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যে কণ্ঠস্বরটি বলে, মনে করো ওই জাহাজে কেউ ছিল না। এটিই মনে হয় যুদ্ধক্ষেত্রের নির্মম ভাষা।
হলিউড কোনো সিনেমাতে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ডুবন্ত মানুষদের ফেলে আমেরিকান কোনো সাবমেরিন কখনোই ফিরে আসে না। কিন্তু ডাস বুট জার্মান সিনেমা। জার্মান চলচ্চিত্র যুদ্ধের নির্মম সত্য প্রকাশে আবেগী হয়নি। এই বাস্তববাদিতা সিনেমাটিকে অন্য মাত্রায় নিয়েছে বলে অনেকে স্বীকার করেন।
চলচ্চিত্রটিতে শব্দের ব্যবহার এটিকে আরও বিশেষিত করেছে। ডেস্ট্রয়ার যখন ইউ-বোটের পেছনে লাগে, তখন বিভিন্ন রকম শব্দ ব্যবহার করা হয় দৃশ্যের উত্তেজনা বৃদ্ধি করার জন্য, যা খুব কার্যকরী ফল দিয়েছে সিনেমাটিতে। এছাড়া জিব্রাল্টার পাড়ি দেওয়ার সময় যখন ইউ-বোট তার সর্বোচ্চ নিম্নসীমা অতিক্রম করে, তখন তার গজালগুলো বুলেটের বেগে বের হয়ে আসে। সমুদ্রের তলদেশে আটকা পড়ে বোটের নাবিকেরা অক্সিজেন সংকটে পড়ে, তাদেরকে অক্সিজেনের মাস্ক পড়ে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এই বিষয়গুলো সিনেমাতে উপস্থাপনের ভঙ্গি ১৯৮১-এর প্রেক্ষাপটে নতুন ছিল।
শেষকথা, ডাস বুট অসাধারণ একটি মাস্টারপিস। সিনেমাটি থেকে নানা তত্ত্ব-উপাত্ত নিয়ে পরবর্তী সময়ে হলিউডের অনেক চলচ্চিত্রে তার প্রয়োগ ঘটেছে। তাই বলা যেতে পারে, ডাস বুট উপভোগ করা একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। চলচ্চিত্রপ্রেমী সবারই জার্মান চলচ্চিত্রের এই অমৃত সুধা পান করা উচিত।