ফ্রান্সের ৪৪ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট বন্দরনগরী ডানকার্ক। মিত্রবাহিনীর ৪ লাখ সৈন্যকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে হিটলার বাহিনী। চার্চিল আদেশ দিলেন, ফিরিয়ে আনো ওদের। তারপর যা ঘটেছিল, তা শুধু ইতিহাস, তা শুধু ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ডানকার্ক’।
২০১৭ সালের ডানকার্ক সিনেমাটির জন্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে, এটি যেমন সত্য, তেমনি এতে প্রথমবারের মতো আইম্যাক্স হাত দিয়ে চালনা করা হয়েছে এটিও আরেক সত্য। এছাড়া সিনেমাটির শ্যুটিং হলিউডের ইনডোরে হয়নি, হয়েছে ফ্রান্সের সেই বন্দরনগরী ডানকার্কে। সিনেমাটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৪০ সালে ডানকার্কে ব্যবহৃত নৌযান, আকাশযান।
সিনেমার জগতে নোলান যেন এক বিস্ময়। কেননা, তিনি কোনো ফ্লপ সিনেমা বানাতে পারেন না। প্রতিভাবান এই পরিচালকের প্রতিটি সিনেমাই বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। বর্তমানে হলিউডের সবচেয়ে আধুনিক, কৌশলী পরিচালক হিসেবে অনেকে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তিনি বানিয়েছেন মেমেন্টো, ইনসোমনিয়া, দ্য ডার্ক নাইট, দ্য প্রেস্টিজ, ইনসেপশন ও ইন্টারস্টেলারের মতো সিনেমা। কিন্তু এবার? প্রায় ৩ বছর অপেক্ষার পর তিনি নিয়ে এলেন ‘ডানকার্ক’। যে চলচ্চিত্রটিকে হলিউড ইতিহাসের অন্যতম সেরা যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এমনকি এটি ছাড়িয়ে গেছে ১৯৯৮ সালের স্পিলবার্গের ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ ও মেল গিবসনের ‘হ্যাকশ রিজ’-কেও।
‘ডানকার্ক’-এর কাহিনী ও স্ক্রিপ্ট, দুটোই লিখেছেন ক্রিস্টোফার নোলান। কাহিনীতে চমকের কিছু নেই। তিনি শুধু ‘ডানকার্ক ইভ্যাকুয়েশন’ বা ‘অপারেশন ডাইনামো’ দেখানোর জন্য একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনটি গল্প সমান্তরালে পরিচালনা করেছেন তিনি। একটি গল্প ডানকার্কের স্থলভাগে, একটি গল্প আকাশে, একটি গল্প জলে খেলা করে বেড়িয়েছে। তিনি মূলত ডানকার্ক ইভ্যাকুয়েশনের পুরো অবস্থাটা দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এটি দেখাতে গিয়ে বিশেষ কোনো নায়কের প্রভাবশালী রূপ সৃষ্টি করেননি। ‘ডানকার্ক’-এ কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। আসলে সিনেমাটির কেন্দ্রবিন্দু কোনো চরিত্র নয়, সিনেমাটির কেন্দ্রবিন্দু একটি স্থান- ডানকার্ক। বলা চলে, ডানকার্কই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র, ডানকার্কই সিনেমাটির দগ্ধ নায়ক। যুদ্ধভিত্তিক সিনেমার কাহিনী উপস্থাপনার এই যে নতুন ভঙ্গি, তা সিনেমার দর্শকদের মোহিত করবে। যুদ্ধে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে খোশগল্পের সময় থাকে না। তাই স্বল্প উক্তির এই সিনেমাটিকে মেদহীন সফল যুদ্ধভিত্তিক উপস্থাপনা বলা যেতে পারে।
কাহিনী শুরু হয়েছে ডানকার্কে জার্মান সৈন্যদের গোলাবর্ষণের মুখ থেকে কোনো রকমে বেঁচে যাওয়া ব্রিটিশ সৈন্য টমির সমুদ্র সৈকতে আগমন থেকে। সে এসেই দেখতে পায়, ইংল্যান্ড যাওয়ার নৌযানের জন্য সমুদ্র সৈকতে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার মিত্রবাহিনীর সৈন্য। সেখানে সে গিবসন নামে আরেকজন তরুণ সৈন্যের সঙ্গে এমন এক সময় মিলিত হয়, যখন গিবসন তার মৃত বন্ধুকে মাটিচাপা দিচ্ছিল। জার্মান বিমান বাহিনীর মুহুর্মুহু বিমান হামলায় বিপর্যস্ত তারা। তারপর তারা উদ্ধার করে অ্যালেক্স নামে আরেক সৈন্যকে। সেদিন রাতেই তারা একটি জলযানে করে ডানকার্ক থেকে পালানোর চেষ্টা করে। সেটিও ব্যর্থ হয়। বাঁচার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে পরদিন একদল স্কটিশ সৈন্যের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও জার্মান সৈন্যদের হামলা। এ সময় অ্যালেক্স নিশ্চুপ গিবসনকে জার্মান স্পাই হিসেবে সন্দেহ করলে উত্তেজনাকর মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।
এ গেল ডানকার্কের কাহিনী। অন্যদিকে চার্চিলের নির্দেশে ডানকার্কে নৌযান পাঠাতে রয়েল নেভি তোড়জোড় শুরু করে। ১৯৪০ সালের ২৭ মে ডানকার্ক থেকে যে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়, তার কোড নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ডাইনামো। এই অপারেশনে প্রায় ৮০০টি নৌযান ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে বড় নৌযান, ছোট নৌযান, ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত নৌযান, মাছ ধরার নৌযান ছাড়াও লাইফবোট ব্যবহার করা হয়। ১৪২৩ ঘণ্টার এই অপারেশনটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা বলে বিবেচিত। সেই অপারেশনে সমুদ্রের নৌযানের অবস্থা বোঝাতে মিস্টার ডসনের নৌযানকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ডসন দেশপ্রেমী একজন মানুষ। সে তার নৌকায় কোনো নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাকে নেয়নি। তার ছেলে পিটার ও সহযোগী তরুণ জর্জ তার যাত্রাসঙ্গী হয়। যাত্রাপথে নানা দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের মুখোমুখি হয় ডসন। তবু সে তার নৌকার মুখ ফ্রান্সের দিকেই স্থির রাখে।
আকাশপথের উপস্থাপনায় অন্য যেকোনো যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা থেকে কৌশল ধার করা হয়নি। এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যা দেখে মনে হবে, সত্যিই এটা ঘটছে। আকাশে আস্ফালন নেই, উদ্বিগ্নতা আছে, উত্তেজনা আছে। ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের ফেরিয়ার, কলিন্স ও তাদের স্কোয়াড্রন লিডার ডানকার্কের উদ্দেশে যাত্রা করে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের স্কোয়াড্রন লিডারের বিমান বিধ্বস্ত হলে তারা আক্রমণকারী জার্মান যুদ্ধবিমান ‘লাফউয়াফল’ বিধ্বস্ত করে। বেশ কটি বিমানকে তারা বিধ্বস্ত করতে সফল হয়। এরপর বিমানের জ্বালানিকেন্দ্রিক ফেরিয়ারের যে সিদ্ধান্ত, সেটাকে বীরোচিত না বলে উপায় নেই।
একটি যুদ্ধ যে শুধু সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে জয়ী হওয়া যায়, সেটি সফলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ডানকার্ক সিনেমাটিতে। জলপথ, স্থল ও আকাশের এ রকম উচ্চমার্গীয় শৈল্পিক উপস্থাপনা, আর কোনো যুদ্ধভিত্তিক সিনেমায় এত নিখুঁতভাবে করা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিমতাকে বর্জন করে বাস্তবিকতার প্রাধান্য ‘ডানকার্ক’-এর প্রতি সেকেন্ডে প্রতি মুহূর্তে।
চলচ্চিত্রটিতে মিউজিক দিয়েছে হ্যানস জিমার। স্বল্প উক্তির সিনেমায় মিউজিকের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যানস জিমার পুরো সিনেমা মিউজিক দিয়ে মাতিয়েছে। অন্যদিকে হয়িট ভ্যান হয়িটেমা আইম্যাক্স ৬৫ মি.মি. যে খুব দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন, এটিও অনস্বীকার্য।
অভিনয়ের কথা বিশেষ করে বলতে গেলে শেষ করার উপায় নেই। এটি তো কোনো একটি বিশেষ চরিত্রকেন্দ্রিক সিনেমা নয়। ডানকার্ককে শৈল্পিক রূপ দিতে অনেক অভিনেতা কাজ করেছেন। টম হার্ডির মুখোশ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। ‘ডার্ক নাইট রাইসেস’ ও ‘ম্যাড ম্যাক্স ফারি রোড’-এর মুখোশ ফিরে পেয়ে ফেরিয়ার চরিত্রে তার চোখ ও কপালের আবারও ভিন্নধর্মী ব্যবহার করেছে হার্ডি। পুরো সিনেমায় মাত্র কয়েক সেকেন্ড তার পুরো মুখ দেখা গেছে। মিস্টার ডসন চরিত্রে মার্ক রাইল্যান্স তার শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া ফিয়ন হোয়াইটহেড, টম গ্লিন কার্নি, জ্যাক লোডেন, হ্যারি স্টাইলস, অ্যানেরিন বার্নার্ড, জেমস ডারসি, বেরি কেহান, ক্যানিথ ব্রানাগ, সিলিয়ান মার্ফি অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে মমতা মাখিয়ে তাদের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন।
নারী চরিত্রহীন সিনেমাটিকে নতুন মাত্রা দিতে যা যা করা দরকার, তার সবই করেছে ক্রিস্টোফার নোলান। নৌযানে যাত্রা, বিধ্বস্ত নৌযানের যাত্রীদের সংকট, নৌযান বিধ্বস্ত করানোকে নানাভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। আকাশপথে জার্মান বিমান হামলার সময় শঙ্কিত ডানকার্ক বন্দীদের অবস্থা খুবই হৃদয়স্পর্শী। ১৯৪০ সালের ডানকার্কে অবস্থানরত কেউ যদি ২০১৭ সালের সিনেমাটি দেখে, সে হয়তো বলেই বসবে- এটা কী ১৯৪০ সালের ডানকার্কের ভিডিও চিত্র! আসলে ডানকার্কের যে চিত্রগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোকে সফলভাবে জোড়া লাগাতে প্রায় শতভাগ সফল হয়েছে নোলান। এক জটিল সংকটপূর্ণ মুহূর্তের তীব্র স্বাদ সিনেমাজুড়ে বিদ্যমান। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জানা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবস্থা না জানা অনেকের কাছে সিনেমাটি পানসে মনে হতে পারে। কেননা এখানে সচরাচর সিনেমার মতো কোনো দৃশ্য নেই। এটি বাস্তবতার চলচ্চিত্র। যুদ্ধক্ষেত্রের অবাস্তব বাহুল্য উক্তি কিংবা বাহুল্য অ্যাকশনের পরিবর্তে ‘ডানকার্ক’-এ মুখ্য হয়ে উঠেছে চরম বাস্তবতা।