বিচারব্যবস্থায় জুরিসিস্টেম একটি আদি-প্রক্রিয়া। এথেন্সে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও জুরির অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। অবশ্য আধুনিক জুরিসিস্টেমের সূচনা হয় ১২ শতকের মাঝামাঝি, তখন ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় হেনরির রাজত্ব চলছিল। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিচারকার্যে জুরিসিস্টেমের ব্যবহার করা হয়। সিডনি লুমেটের ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’ এমন একটি চলচ্চিত্র, যেটি আপনাকে জুরিসিস্টেম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবে।
একটি জুরি বোর্ডে সাধারণত ১২ জন নির্বাচিত ব্যক্তি থাকেন, যাদের জুরর বলা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা বেশি বা কম হতে পারে। স্কটল্যান্ডে জুরি বোর্ডে ১৫ জন করে থাকত। যাই হোক ১৯৫৭ সালে বিচারকেন্দ্রিক কোর্টরুম ধারার এই চলচ্চিত্রটিতে ১২ জন ব্যক্তিকে নেওয়া হয়েছে আদালতের একটি মামলার ফয়সালা দেওয়ার জন্য। সিনেমাটির ৯৬ মিনিটের পুরো ৯৩ মিনিটই শুধু একটি নির্দিষ্ট কক্ষের ভেতর দৃশ্যায়ন করা।
শুরুটা কোর্টরুমে। একটি ১৮ বছর বয়স্ক ছেলে পিতৃহত্যার দায়ে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে অভিযুক্ত। আদালতে সব সাক্ষ্য-প্রমাণই তার বিপক্ষে। জাজ জুররদের ওপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করেন। ছেলেটির জীবন চলে যায় জুররদের হাতে। এখন জুরররা তিনটি কাজ করতে পারে। এক, ছেলেটিকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে, যার ফল ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তাকে হত্যা করা হবে; দুই, তারা তাকে সর্বসম্মতভাবে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারে; তিন, তারা সর্বসম্মত না হতে পারলে ‘হাঙ জুরি’ করতে পারে, যার ফলে হয়তো পরে আবার অন্য কোনো জুরি বোর্ডকে মামলাটির ফয়সালার দায়িত্ব দেওয়া হবে। খুব সাদামাঠাভাবে শুরু সিনেমাটির দৃশ্যপট যখন একটি নির্দিষ্ট কক্ষে পদার্পণ করে, তখন থেকে এর নাটকীয়তা শুরু হয়।
অনেকে বলবেন, একটি মামলার সুরাহা করার জন্যই সিনেমাটি সৃষ্টি করা হয়েছে। একটু নজর দিলে আরও একটি বিষয় খেয়াল করবেন, আসলে সিনেমাটি ১২ জন ক্রুদ্ধ ব্যক্তির স্বরূপ উন্মোচিত করা হয়েছে। ১২টি ভিন্ন চরিত্রকে ১২ রকম বৈশিষ্ট্যে রূপায়িত করা হয়েছে। এই যে একেকটি চরিত্রের একেক রূপ, এটিই আপনাকে স্ক্রিনের পর্দায় দৃষ্টি নিবন্ধ করতে বাধ্য করবে। আর সিনেমাটির যে বিশেষ দিক সবাইকে মোহিত করবে, সেটা হচ্ছে সংলাপ। হলিউডের পুরনো ধাঁচের ক্ল্যাসিক সিনেমাগুলোর সংলাপ এতটা দুর্দান্ত যে, শুধু সংলাপের মাধুর্যের জন্যই আপনার সিনেমাটি ভালো লেগে যেতে পারে। আজকালকার হলিউড সিনেমাতে এনিমেশনের কারিকুরি আছে, উন্নত ক্যামেরার ব্যবহার আছে, অস্ত্রের ঝনঝনানি আছে কিন্তু ক্ল্যাসিক সিনেমার মতো শক্তিশালী সংলাপ নেই। অথচ, নাটক কিংবা সিনেমার মূল শক্তি হচ্ছে সংলাপ।
চলচ্চিত্র আর সাহিত্যকর্মের ভেতর একটি সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে। সেটি হলো- একজন ব্যক্তির মনের ভেতর বয়ে যাওয়া দ্বন্দ্ব, আনন্দ, শঙ্কা, ঝড় কোনোকিছুই পূর্ণভাবে চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়, যা সাহিত্যে সম্ভব। এজন্য সাহিত্য চলচ্চিত্রের চেয়ে সচল ও সূক্ষ্ণ। চলচ্চিত্রে মানুষের মনের অবস্থা বোঝানোর জন্য সম্বল হচ্ছে প্রকাশভঙ্গি ও সংলাপ। এই দুটি কাজ একদম ঠিকমতো করাটা সহজ নয়, কিন্তু লুমেট ও এর অভিনয়শিল্পীরা এত নিখুঁতভাবে এটা সম্পন্ন করেছেন, যাতে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।
টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যানের গল্পটাও দারুণ। ফ্লাশব্যাকের মাধ্যমে অতীতে যাওয়ার ঘটনা এখানে নেই। শুধু একটি কক্ষের ভেতরেই গল্পটি আবর্তিত। রেজিল্যান্ড রোজ হয়তো জীবনে একটি কারণে সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত ছিলেন, সেটি হচ্ছে, টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যানের গল্পটি তার। গল্পটি এতটা শক্তিশালী যে, দীর্ঘ ৪০ বছর পরে ১৯৯৭ সালে সিনেমাটি আবার রিমেক করা হয়েছে।
১১ বনাম ১ দিয়ে জুরি বোর্ডের কার্যক্রম শুরু, যেখানে ১১ জন মনে করে ছেলেটি দোষী, মাত্র ১ জন মনে করে ছেলেটি দোষী বা নির্দোষ যাই হোক না কেন, বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। নানা নাটকীয়তার মধ্যে সিনেমটি শেষ হয় ১২ বনাম ০ ফলে। কিন্তু এই ১২ সংখ্যাটির গুরুত্বই আলাদা, কেননা তখন ১২ জনই মনে করে হয়তো ছেলেটি নির্দোষ। তারা যখন বদ্ধ কক্ষটি থেকে বের হয়, তখন তাদের সবার মনেই হত্যাটি সম্পর্কে যৌক্তিক সন্দেহ বর্তমান। কী করে ১ জন ব্যক্তি ১১ জনের অভিমত কিছু সময়ের ব্যবধানে পাল্টে দিল, এটিই হচ্ছে সিনেমাটির মূল আকর্ষণ। এটা কি খুবই সহজ? এটা কি দুঃসাধ্য? এটা কি বিরল ঘটনা? এটা আসলে কোনো বিরল ঘটনা নয়। এটি এমন এক ঘটনা, যা উপভোগ করে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যানে যে ১২ জন জুরর অভিনয় করেছেন, তারা সবাই দুর্দান্ত। ১২টি ব্যতিক্রমী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে এবং চরিত্রের ভেতর রসায়ন সৃষ্টিতে সবটুকু উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একজন আরেকজনকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়। কিন্তু এই হত্যার হুমকিই হয়ে ওঠে ছেলেটিকে বাঁচানোর একটি অস্ত্র। অতিশয় বোদ্ধা বা বাচাল মানুষকে মানুষ কিভাবে দেখে, তাও একটি অসাধারণ দৃশ্যে চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক সিডনি লুমেট। এক কথায় একজন ফুটবল কোচ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, স্টক ব্রোকার, বেসবল ভক্ত, ঘর সজ্জাকারক, বিক্রেতা, স্থপতি, বৃদ্ধ, গ্যারেজ মালিক, ঘড়ি প্রস্তুতকারক, বিজ্ঞাপন নির্মাতা যখন একই কক্ষে একটি সিদ্ধান্ত নিতে ব্রত হয়, তখন তারা কে কী রকম আচরণ করতে পারে, তা প্রকাশিত হয়েছে খুব সূক্ষ্ণভাবে।
পরিচালক সিনেমাটিতে কক্ষটিকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। বৈদ্যুতিক ফ্যান, জানালা, টেবিল, চেয়ার, চুরুটদানি সবকিছুই যেন সিনেমাটিতে অভিনয় করেছে। একজন পুত্রহারা বাবার ক্রোধ বার বার ফিরে এসেছে সেই কক্ষে। ব্যক্তিগত ক্রোধ ও অহমিকার পরীক্ষায় শেষপর্যন্ত সবাই উতরে যায়। কিন্তু এই উতরে যাওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। এক্ষেত্রে একটি ছুরি, একটি ম্যাপ এবং বৃদ্ধটির অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
চলচ্চিত্রটি দর্শক জনপ্রিয়তায় ও আলোচনায় সর্বকালের সেরা সিনেমাগুলোর একটি। কোর্টরুম ধারার চলচ্চিত্রের ভেতর এটি অদ্বিতীয়।