ডেনিয়েল ডে-লুইস অভিনয় শিল্পীদের ভেতর এক অনন্য নাম। হলিউডে যে ক’জন অভিনেতা অভিনয়ের কারিশমা দিয়ে দর্শকহৃদয় জয় করতে সমর্থ হয়েছেন, তাদের মধ্যে ওপরের সারির একজন ডেনিয়েল। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডেনিয়েল অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়, মাত্র ২০টি; তবু এই অভিনেতা বার বার প্রশংসিত হয়েছেন তার অভিনয় দক্ষতার জন্য।
আপনি যদি ‘লিংকন’, ‘মাই লেফট ফুট’, ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ ও ‘ইন দ্য নেম অব দ্য ফাদার’ এই চারটি সিনেমা দেখেন, তাহলে আপনি অভিভূত হবেন। এরপর যখন কেউ বলবে, চারটি সিনেমাতেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেনিয়েল ডে-লুইস; তখন আপনি যেন আকাশ থেকে পড়বেন।
কেননা, ডেনিয়েল ডে-লুইস যে চরিত্রে অভিনয় করেন, সে সেই চরিত্রকে ধারণ করেন। তাকে সব সিনেমাতে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এ কাজটি করতে ডেনিয়েল নিজের চরিত্রকে বিসর্জন দেন। এটা কতটা কঠিন কাজ, তা অভিনয় শিল্পীরা ভালোভাবেই জানেন।
১৯৬৯ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে হাঙ্গামা শুরু হয়। এই হাঙ্গামার মূল কারিগর আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ)। আইআরএ উত্তর আয়ারল্যান্ডের সশস্ত্র বিদ্রোহী সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে ব্রিটিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বন্দ্ব হয় অনেক বছর ধরে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে আইআরএ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। জিম শ্যারিডানের ‘ইন দ্য নেম অব দ্য ফাদার’ চলচ্চিত্রটি এই হাঙ্গামার সময়কালেরই একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। সিনেমাটির মূল রসদ নেওয়া হয়েছে জেরি কনলনের ‘প্রুভড ইনোসেন্ট’ নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থ থেকে।
জেরি কনলন বেলফাস্টে বসবাসকারী নষ্ট হয়ে যাওয়া এক অস্থির যুবক। ছিঁচকে চুরি করে তার দিন যায়। কিন্তু এই চুরি করতে যেয়েই তাকে ব্রিটিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রোষানলে পড়তে হয়। অন্যদিকে আইআরএ অযথা ঝামেলা সৃষ্টির জন্য তাকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু তার বাবা জ্যুসিপি কনলন তাকে শেষবারের জন্য রক্ষা করে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়। লন্ডনে যেয়েও তার বন্ধু পল হিলের সঙ্গে উচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে থাকে। কিছুদিন পর ইংল্যান্ডে টিকতে পারে না জেরি, সে বেলফাস্টে ফিরে আসে। কিন্তু লন্ডন তার পিছু ছাড়ে না। ৫ অক্টোবর, ১৯৭৪ সালের গিল্ডফোর্ড বোম্বিংয়ের ঘটনায় ফেঁসে যায় জেরি।
কিন্তু কী হবে এরপর? সে সময় ব্রিটেনে একটি নতুন সন্ত্রাস দমন আইন পাস করা হয়, যে আইন কোনো অভিযুক্তকে সাত দিন অবধি আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা দিয়েছিল পুলিশকে। গিল্ডফোর্ডের মতো বড় বোমা হামলার দোষীদের আটক করার চাপ পুলিশের ওপর প্রকট ছিল। তাই জেরি ও পলকে তীব্র শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাদের ফাঁসিয়ে দেয় পুলিশ। তাদের সঙ্গে-সঙ্গে ফাঁসিয়ে দেয় জেরির বাবা ও আন্টের পরিবারের সবাইকে। তারা সবাই নির্দোষ হলেও আদালতে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেন। এরপর নানা নাটকীয়তায় শেষ পর্যন্ত জেরি ও অন্য সবাই মুক্তি পায়। কিন্তু এরই মাঝে সে হারিয়ে ফেলেছে তার বাবাকে, হারিয়ে ফেলেছে তার যৌবনের পনেরো বছর।
পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি ভুলের কারণে একটি পরিবার কিংবা একদল মানুষের জীবন কিভাবে ধ্বংসের দিকে পতিত হতে পারে, তা খুবই বাস্তবিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। কতগুলো শক্ত বার্তা দেওয়া হয়েছে সিনেমাটিতে, যেমন: সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ থাকলেও সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারও বিচার হতে নেই। এটি শুধু একটি উন্নত রাষ্ট্রের দৃশ্যপট নয়, সব রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ধামাচাপা দেওয়ার খেলা চলে।
সিনেমাটিতে জেরি কনলন চরিত্রে ডেনিয়েল ডে-লুইস অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটি করার জন্য তাকে তার শরীরের ওজন কমাতে হয়েছে, তাকে উত্তেজিত এক যুবকরূপে নিজেকে দীক্ষিত করতে হয়েছে। এককথায় ডেনিয়েলের জেরি অভিযানটা সহজ ছিল না। যদিও ‘মাই লেফট ফুট’ কিংবা ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ সিনেমা দুটির মতো নিজেকে অভিনয়ের উচ্চসীমায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এখানে পাননি ডেনিয়েল, তবে তার প্রয়াস ছিল অনবদ্য। বিশেষ করে জেলের ভেতর বাবার সঙ্গে উত্তেজনাময় আবেগী কথাবার্তাগুলো দর্শকদের জানান দেবে, ডেনিয়েল ডে-লুইস একজনই।
জেরি কনলনের বাবা জ্যুসিপি কনলনের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন পিট পাসোফোয়েট। একজন আদর্শ বাবা হিসেবে তার চরিত্রটি ফুটে উঠেছে। এমনকি জেলের ভেতরেও তার ছেলে বিপথে গেলে ফেরানোর চেষ্টা করেছে জ্যুসিপি, সত্যের পথে চলার প্রেরণা দিয়েছে। আসল বোমা হামলাকারীর জেলে আগমন ঘটলে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে জেরিকে উপদেশ দিয়েছে। আবার যেন তারা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে, এ জন্য একা একা ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। অবশ্য বাবা হিসেবে জ্যুসিপি সফল হয়। শেষ পর্যন্ত জেরি তার ভুল বুঝতে পারে। বিশেষ করে জ্যুসিপি অসুস্থ হয়ে পড়লে জেরি ভেঙে পড়ে। জ্যুসিপি মারা গেলে, সেই ক্যাম্পেইনকে চাঙা করে ‘ফ্রি দ্য গিল্ডফোর্ড ফোর’ আন্দোলনে রূপ দিয়েছে জেরি।
সিনেমাটি ৬৬তম অস্কার প্রতিযোগিতায় সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতাসহ ৭টি শাখায় মনোনয়ন পেলেও সে বছরের আরও দুটি বিখ্যাত সিনেমা ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ও ‘ফিলাফেলডিয়া’-র জন্য উপেক্ষিত হয় ‘ইন দ্য নেম অব দ্য ফাদার’। তবে পুরস্কার কোনো কিছুর মাপকাঠি নয়। তাই তো সিনেমাটি আজও দর্শকদের হৃদয়ে বাস্তব এক ঘটনার সাক্ষীস্বরূপ প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় আছে। হয়তো আরও যুগ যুগ ধরে থাকবে। জ্যুসিপির জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও জেলবাসীরা যে ব্যতিক্রমী ও আবেগী শেষ বিদায় জ্যুসিপিকে দিয়েছিল, তা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।