সাফি উল্লাহ্
আজ ২০ জুলাই, আজ খ্যাতিমান অনুবাদক-সাহিত্যিক ফকরুল আলমের জন্মদিন। ১৯৫১ সালের আজকের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজ থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। পরবর্তী সময়ে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
অধ্যাপনার চল্লিশ বছর পার করে বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। এ হলো তার সংক্ষিপ্ত পেশাগত পরিচয়। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে তার আরও একটি বড় পরিচয় রয়েছে। তিনি একজন প্রথিতযশা অনুবাদক। বাংলা সাহিত্যকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি হলেন অধ্যাপক ডক্টর ফকরুল আলম।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দু’টি ইংরেজিতে অনুবাদ করে শুধু খ্যাতিই অর্জন করেননি, বরং বাংলাদেশ ও জাতির জনক ও আমাদের ইতিহাস ও সংগ্রামকে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য সহজলভ্য করেছেন। এটা একটি রাষ্ট্রীয় কাজও বটে। তার মতো ঋদ্ধ অনুবাদকের হাতে এই গ্রন্থ দু’টি অনুবাদ হওয়াই অবাঙালি পাঠক সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও বাংলাদেশকে অধ্যয়ন করতে পারবে।
ড. ফকরুল আলম অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রচুর পরিমাণে দেশি পশুপাশি ও গাছপালার নাম থাকায় অনুবাদে বেশ বেগ পোহাতে হয়। বাংলা শব্দটিই ইংরেজি দিতে হবে নাকি এটার কাছাকছি কোনো শব্দ বসাতে হবে, এমন দ্ব্যর্থবোধক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ইংরেজিতে সিদ্ধহস্ত হ্ওয়ার কারণে এসব ঝক্কিঝামেলা খুব সহজেই উৎরে গিয়েছেন তিনি। বাংলা, মাটি ও সংস্কৃতির যথাসম্ভব ছোঁয়া রেখে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। জীবনানন্দের কবিতা অনেকে অনুবাদ করলেও ফকরুল আলমকে অনেকেই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থ অনুবাদের কারণেই ২০১২ সালে অনুবাদ বিভাগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘দ্য অ্যাসেনশিয়াল ট্যাগর’-এর সম্পাদক ছিলেন ড. ফকরুল আলম এবং রাধা চক্রবর্তী। এই বইটিতে রবীন্দ্রনাথের সেরা সৃষ্টিকর্মের অনুবাদ স্থান পায়। এই গ্রন্থে ফকরুল আলম রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি, দু’টি প্রবন্ধ, একত্রিশটি কবিতা ও একষট্টিটি গান অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদ সম্পর্কে শর্মিলা সেন একটি রিভিউতে মন্তব্য করে লিখেছেন, ‘ফকরুল আলমের অনুবাদ খুবই প্রাণবন্ত এবং ছন্দময়।’
বাংলা সাহিত্যের আরও একজন বিখ্যাত লেখক মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’র ইংরেজি অনুবাদও তিনি করেছেন, যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিষাদ-সিন্ধুর ইংরেজি অনুবাদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ফকরুল আলম লিখেছেন, ‘অনুবাদ মানে তো কেবল শব্দের অনুবাদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দৃষ্টিভঙ্গি, স্বরভঙ্গি, মনোভঙ্গি ইত্যাদি বিস্তর বিষয়। মূলত কৌশলগত দিক ঠিক রেখে বিষাদ-সিন্ধুর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ উপন্যাস অনুবাদ করা সত্যিই দুরূহ। এটুকু বলতে পারি, আমি সেই কঠিন কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেছি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বিষাদ-সিন্ধুর অনুবাদ আমি কেন করলাম? বলব, কাজটি করেছি নিজের দায়িত্ববোধ থেকে। কেননা, এই অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বপাঠক পরিচিত হবেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ একটি ধ্রুপদি গ্রন্থের সঙ্গে।’
তিনি অনুবাদে নিজের নিষ্ঠার চিত্র তুলে ধরেছেন এইভাবে ‘অনুবাদের সময় আমি সচেতনভাবে ঔপন্যাসিকের মূল উদ্দেশ্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি।…বিষাদ-সিন্ধুতে মীর মশাররফ হোসেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভাষাশৈলী নির্মাণ করেছেন। ভাষার কাব্যময়তাকে বজায় রেখেছেন আগাগোড়া। অনুবাদক হিসেবে লেখকের এই সচেতনতাকে শ্রদ্ধা না দেখিয়ে উপায় নেই। স্বীকার করছি, শব্দের ব্যঞ্জনা বোঝাতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।’
ফকরুল আলম শুধু অনুবাদ করেন না, শুধু শব্দের পরে শব্দ বসিয়েই ক্ষান্ত হন না, বরং মূল রচনার ছন্দ, কাব্যময়তা, শব্দের ব্যঞ্জনা, বাক্যগঠন, সাংস্কৃতিক দিক সবকিছুই ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এমনকি ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠক যেন এই রচনা, ভূখণ্ড ও সংষ্কৃতিকে তাদের মতো করে বুঝতে পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন তিনি। এভাবেই তিনি অন্য অনুবাদকের থেকে নিজের আলাদা অবস্থান ও পরিচিতি তৈরি করেছ্নে।
তার হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের আরও অনেকগুলো গ্রন্থ বিশ্বপাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাক, এটাই হোক তার সাতষট্টিতম জন্মদিনের কামনা।