রীতিমতো এখন একটি উৎসব। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এমনটি ছিল না। ভোরবেলায় বৈশাখ বন্দনা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করছে নিউিয়র্কের ‘আনন্দ ধ্বনি’। সঙ্গে প্রাতরাশ। আসছে ১৫ এপ্রিলের ভোরে এমন আমন্ত্রণই দেওয়া হয়েছে বৈশাখ বরণে।
গানে, কবিতায় ও কথায় আমরা সম্মিলিতভাবে বরণ করব বাংলা বর্ষ ১৪২৪। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে থাকছে আনন্দধ্বনির অর্ধশতাধিক শিল্পী ও যন্ত্রীশিল্পীদের সমন্বয়ে সন্মেলক গান ও একক পরিবেশনা, পাশাপাশি থাকবে প্রবাসের বিশিষ্ট শিল্পী ও আবৃত্তিকারের পরিবেশনা ও সংস্কৃতিজনের অনভূতি। অনুষ্ঠান শুরু হবে প্রভাত আলোয় সেঁতারের সুরের মূর্ছনায়। অনুষ্ঠানে মূলত পঞ্চকবির গান, লোক গান, গণসংগীত এবং দেশের গান পরিবেশন করা হবে। সঙ্গে থাকবে আমাদের ভালোবাসার উষ্ণতায় মোড়া বৈশাখী প্রাতঃরাশ।
‘আনন্দধ্বনি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—আমরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। তবে এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সহজ নয়, মধ্য এপ্রিলের শীতের ভোরে দর্শকদের অনুষ্ঠান মঞ্চে সমবেত করা একটি প্রায়-অসম্ভব কাজ। তা সত্ত্বেও এই উদ্যোগটি আমরা গ্রহণ করেছি। আপনারা জানেন, বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক সর্বজনীন লোকউৎসব। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। বাংলাদেশে এই দিনটি উদযাপনের জন্য আমরা বরাবর অতি প্রত্যুষে, ভোরের প্রথম আলো সম্ভাষণ জানানোর আগেই, রমনার বটমূলে সমবেত হয়েছি। আমরা সেই ঐতিহ্যটি ফিরিয়ে আনতে চাই প্রবাসেও, প্রত্যুষে নববর্ষ উদযাপনের সেই আনন্দ, আগ্রহ ও প্রত্যাশার অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও প্রবাসী বাঙালির মনে আমরা সঞ্চারিত করতে চাই।’
২০১৩ সালে নিউইয়র্কে গঠিত ‘আনন্দধ্বনি’নামে একটি স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, তিন দশক আগে যার যাত্রা শুরু করে ছিলেন বাংলাদেশে প্রথিত যশা সাংবাদিক ও সংগীতগুরু ওয়াহিদুল হক। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানিকটিকাট ও পেলসিলভিনিয়ায় বসবাসরত আনন্দধ্বনির দুই বাংলার শিল্পীরা শুদ্ধভাবে গান পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও সংস্কৃতিজন প্রবাসের শত পরিশ্রমের মধ্যেও সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আনন্দধ্বনি গড়ে তুলেছে। মূলত এর পেছনে রয়েছে তাদের বাংলা ভাষা, সংগীত ও স্বদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা; সর্বোপরি ত্যাগ ও সংগীতের প্রতি একাগ্রতা।
এপ্রিল মাসের শুরুতেই উত্তর আমেরিকা মেতে ওঠে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপনে।
এখানে ‘শুভ হালখাতা মহরত’ নেই যদিও, তারপরও বাঙালি মালিকানাধীন বিপনি বিতানগুলোতে মিষ্টি মুখের রেওয়াজ চালু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। নতুন একটা পর্ব যোগ করেছে আনন্দ-মাত্রা। আর তা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে ‘পিঠা উৎসব’।
যুক্তরাষ্ট্রে শীত এবার এখনও শেষ হয়নি। শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের রঙে রাঙাতে নানা আয়োজনে নিউইয়র্কে প্রথম পিঠা ও বসন্ত উৎসব পালিত হয়েছে মার্চের শেষ সপ্তাহে।
উইকএন্ডে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় রবিবার চেয়েও অনেক বেশি ক্রেতা-দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এ মেলায়। সকাল থেকেই নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে আসেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশি-আমেরিকান নতুন পুরাতন প্রজন্মের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিটসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রবাসীদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি পিঠা উৎসব। বর্ণিল আয়োজনে ব্রঙ্কসে অনুষ্ঠিত হয় এই পিঠা উৎসব।
অনুষ্ঠানমালায় ছিল আলোচনা সভা, কবিতা, ছড়া, কৌতুক, মনোজ্ঞ পরিবেশনাসহ নানা কর্মসূচি।চমৎকার এই আয়োজনে বাঙালি সংস্কৃতির জয়গান প্রতিধ্বনিত হয়।
পিঠা উৎসবে ছিল মজাদার পাটিসাপটা, ভাপাপিঠা, বুলশা, বিবিখানা, তেলে পিঠা, চিতই পিঠা, ছানার সন্দেশ, গজাগজা, পাকুন পিঠা, মাংসের পিঠা, নারিকেল পুলি, নিমকি, চুপতি পিঠা, ঝাল পিঠা, সাবুদানার, ডালপুরি, ডালপাকনসহ হরেক রকমের পিঠা। ছিল পান-সুপারিও। উৎসব প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন আমেজের।
আয়োজকদের বন্ধুদের হাতে বানানো বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানান আকৃতি, নানা স্বাদ আর রঙের এসব পিঠা অতিথিদের মাঝে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান উপভোগ করেন সবাই। উৎসবে যোগ দেওয়া হলভর্তি অতিথিদের তৃপ্তি মিটিয়েও পিঠার বিপুল ভাণ্ডার থেকে যায় অনুষ্ঠান শেষে। অনেকে বাড়ি নিয়ে যান সেসব পিঠা।
আগামী উইকএন্ডেও দিনব্যাপী বাংলা নববর্ষ উৎসবে থাকবে পিঠা মেলা, নাচ, গান, আবৃত্তিসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। পিঠা ছাড়াও উৎসবে থাকবে বিভিন্ন রকমের খাবার-দাবার, পান্তা-ইলিশ, পোষাক ও অলঙ্কারের স্টল।
বিশেষ করে নিউইয়র্কে, বাংলা নববর্ষ উদযাপনে যে সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে তার নাম—বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস (বিপা)।
গেল বছর বৈশাখ বরণে বিপা প্রবাসে নতুনত্ব এনেছিল তাদের আয়োজনে।
উত্তর আমেরিকার অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস বিপার আয়োজনে গত বছরের বৈশাখী উৎসবের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হিসেবে চিত্রাঙ্কন কর্মশালায় শিশুকিশোরদের মুখোশ বানানোর প্রতিযোগিতা ছিল বেশ নান্দনিক। মনোরম আবহাওয়ায় উম্মুক্ত আকাশের নিচে সেদিনের কর্মশালাটি বাংলাদেশের চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বৈশাখী উৎসবের মতোই মনে হয়েছিল প্রবাসীদের কাছে।
নিউইয়র্কের পিএস ১১২-এর চত্বর ঘেরা লোহার প্রাচীর ঢেকে দেওয়া হয়েছিল বাংলা স্লোগান লেখা বর্ণাঢ্য সব ব্যানারে। এর সামনেই পরিচালক জিল রেইনিয়ার বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ সরবরাহ করেন। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এই কর্মশালায় প্রতিযোগীদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ছিল কে.জি থেকে দ্বিতীয় গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাঘের মুখ, তৃতীয় থেকে পঞ্চম গ্রেডের জন্য পেঁচার মুখ, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম গ্রেডের জন্য সিংহের মুখ ও নবম থেকে বারো গ্রেডের জন্য ছিল ময়ূরের অবয়ব।
পথচারি আমেরিকানরা যখন সেদৃশ্য দেখছিলেন, তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের লোকজ,সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।
নিউইয়র্কে আরেকটি সংগঠন পহেলা বৈশাখ পালনে সাহসী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সেটি হলো ‘উদীচী, যুক্তরাষ্ট্র’। কয়েকবছর আগে উদীচীর এই আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই প্রবাস এবং দেশের সবাইকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এবারই সম্ভবত আমি প্রবাসে নববর্ষ উদযাপন করছি। তিনি সকলের সুখ-শান্তির আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, দেশে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র আজ নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরা বাংলা নববর্ষ পালনকেও মেনে নিতে পারছে না। তারা নানা ধরনের ভ্রান্ত কথা বলে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ম্লান করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, এসব অপশক্তিকে রুখতে প্রজন্মকে সজাগ থাকতে হবে।
অত্যন্ত প্রাণবন্ত সেই অনুষ্ঠানে উদীচী’র সংগীত বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ‘আলো আমার আলো ওগো, আয় তবে সহচরী, আকাশভরা সূর্যতারা‘ অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে, আমার গহীন গাঙের নাইয়া গান গেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রীর। পরিচালনা করেছিলেন সংগীত শিক্ষক শফি চৌধুরী হারুন। জীবন বিশ্বাসের পরিচালনায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশিত করেছিল ‘আবার এসেছে বৈশাখ, ধান নদী ভরা দেশ, ভাসাইয়া দে রে নোঙর তুইলা দে- প্রভৃতি গানের বহর।
বিপা ও উদীচী এবছরও মহাসমারোহে বাংলা নববর্ষ পালন করছে। নিউইয়র্কে এখন বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন, বাংলাদেশ কনস্যুলেট, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউইয়র্ক,জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা, চট্টগ্রাম সমিতিসহ প্রায় প্রতিটি সংগঠনই একক অথবা যৌথভাবে বাংলা নববর্ষ পালন করে।
যে বিষয়টি হালে চোখে পড়ার মতো, তা হলো বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে এখন ছোবল দিতে চাইছে কিছু কর্পোরেট মিডিয়া কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ‘বানিজ্যই নিয়ন্ত্রণ
করবে সংস্কৃতি’—এমন একটি থিম-তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে কেউ কেউ।এদের কারও কারও বিরুদ্ধে বাণিজ্য মেলার নামে ‘আদম আমদানি’র অভিযোগও উঠছে। ফলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কাছে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির কৃষ্টি-সভ্যতা-ঐতিহ্যের আবেদন কিছুটা হলেও ম্লান হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক।
বলা হচ্ছে, শুধু নিউইয়র্ক নগরীতেই প্রায় সোয়া লক্ষ বাংলাদেশির বসবাস। তাই আয়োজন, পার্বণ, উৎসব লেগে থাকে প্রায় প্রতি উইকএন্ডে’ই।ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব হয় পারিবারিক আয়োজনে। অভিবাসী জীবনে এই যে শিকড়ের হালখাতার মহরত, তা শাণিত করছে উত্তর প্রজন্মকে।
বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশখের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতো ব্যাপক তা অনুধাবন করার জন্যই প্রবাসেও চলে না না আয়োজন।প্রায় পাঁচশতাধিক বছর যাবত দিনটি নববর্ষ হিসেবে উদযাপিত হওয়ার ধারাবাহিকতার হাওয়া এখন আটলান্টিকের পারেও।
ধর্ম ও রাজনৈতিক সীমানা নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ, বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসব। তাই যুগ যুগ ধরে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাঙালির সব কার্য সম্পন্ন হলেও বাংলা নববর্ষের প্রতি সকল বাঙালিই গভীরতর এক প্রাণের টান থেকেই যাচ্ছে। পরবাসী প্রজন্মও করছে সেই কৃষ্টির সন্ধান।
নিউইয়র্কের বাঙালি গ্রোসারিগুলো বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করতে শুরু করেছে। যা এক অভিনব আউডিয়া তো বটেই।
যুক্তরাষ্ট্র বহুজাতিক, বহুভাষিক মানুষের দেশ।এখানে চীনা নববর্ষ, জুইশ নববর্ষ, হিজরী নববর্ষ বেশ জোরেশোরেই পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা শুভেচ্ছা বাণী দিতে শুরু করেছেন ইতোমধ্যে। এটা অত্যন্ত আশার কথা। বাংলা নববর্ষ যে সম্প্রীতি মানুষে মানুষে ছড়িয়ে যায়, তা বিশ্বমানবতার একটি উজ্জ্বল সিঁড়ি। অভিবাসী প্রজন্ম সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার পিতা,পিতামহ,মাতামহীর ফেলে আসা বাংলাদেশকে দেখতে চাইছে। এটা তো বিদেশে বাঙালির কম অর্জন নয়।