২৬ জুন, যখন মাঠে নামবেন তিনি, তখন তার বয়স আরও একবছর বেড়ে যাবে।
একটা প্রজন্মের কাছে সুপার হিরো থাকত ব্যাটম্যান, সুপারম্যান। কোনো প্রজন্মের কাছে রোজারিওর এই ছোটখাটো মানুষটিই সুপার হিরো। পর্দার সুপারহিরোদের বয়স বাড়ে না, কিন্তু মর্ত্যলোকের রক্ত-মাংসের মানুষের বয়স থেমে থাকে না। তবে তার এবারের জন্মদিন কি আর বাকি সব জন্মদিনের মতো?
২০০৬ সালে ১৯ বছর বয়সে যখন বিশ্বকাপে আসেন, দেশের হয়ে কনিষ্ঠ বিশ্বকাপের খেলোয়াড় তখন তিনি। সার্বিয়া মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে দারুণ এক গোলে আগমনী বার্তা জানিয়েছিলেন নিজের। সে জন্মদিনের ২ দিন আগে নিজদের গ্রুপের শেষ ম্যাচে যখন নির্ভার মেসিরা নামছিলেন, তখন তার দল ইতোমধ্যে পরের রাউন্ডে। ২০১০ সালে ২৩ বছর বয়সের মেসি দ্বিতীয় পর্বের টিকিট হাতে নিয়ে জন্মদিনের আগের দিন গ্রিসের বিপক্ষে দাপুটে খেলা খেললেন। গোল পেতে পেতে না পেলেও সে জন্মদিনটি তার বিফলে যায়নি। তখনও আর্জেন্টিনা টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট—সব ম্যাচে দাপুটে জয়। এই কিছু দিন আগেই চুরমার করে দিয়েছেন নাইজেরিয়াকে। মাসিয়াহ হয়ে বসনিয়া বাধা পেরিয়েছেন, ইরানি দুর্গকে পরাস্ত করেছেন ট্রেড মার্ক কারিশমায়। নতুন ইতিহাস রচনার পথে তখনও মেসির চোখে স্বপ্ন—ফুটবলের অনেক বিতর্কের অবসান হতে পারত আরও ৪ বছর আগে।
১৩ জুলাই, ২০১৪ তে মারকানায় মেসি যখন ৪৭ মিনিটের মাথায় বিগলিয়ার বাড়ানো বলে ন্যুয়ারের পাশ ঘেঁষে দ্বিতীয় বারকে কোনো রকম যখন বলটা অতিক্রম করলো, সে মুহূর্তটাই হতে পারতো অনেক বিতর্কের অবসানের উপলক্ষ। কিন্তু না হলো না। হয়তো সেটা টিমমেট হিগুয়েইনের কারণে, হয়ত বা প্যালাসিওর কারণেও। এরপর এক এক করে দুই-দুটি উপমহাদেশীয় ট্রফির ফাইনালে গিয়ে একইভাবে পরাস্ত হওয়া, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। মেসির ধৈর্য পরীক্ষা নিতে ভাগ্যদেবতা বরাবরই যেন অনেক অনেক আগ্রহী। স্পেনের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। খেলতে পারতেন অনায়াসে। সব ই ছিল সেখানে। এতদিনে নিজের নামের পাশে নিদেন পক্ষে দুটি ইউরো, একটি বিশ্বকাপ অন্তত থাকতো। কিন্তু অর্জনের হাতছানির থেকে দায়বদ্ধতা আর দেশপ্রেম ছিল মনে বেশি। দেশের হয়ে যুব বিশ্বকাপ জিতেছেন। জিতেছেন অলিম্পিক স্বর্ণ। যেখানে ক্লাবের অনেক নিষেধ, বাধা পেরিয়েও খেলার অনুমতি জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু কোথায় গিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে যাচ্ছেন এ ক্ষুদে জাদুকর? ক্লাবের হয়ে একাধিক চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, লিগ, ব্যালন ডি অর কি, গোল্ডেন বুট কী না জিতেছেন? কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে? সেখানে তিনি যেন এক ট্র্যাজিক হিরোর সমার্থক। বারবার করে কাছে গিয়ে ফিরে আসা ২০০৬ সালে পারেননি, ২০০৭ সালের কোপার ফাইনালে গিয়েও ব্যর্থ, ২০১০ সালে পারেননি, ২০১১ সালে নিজের মাঠে কোপা তে নয়। ২০১৪ সালে মারকানায় এসে সোনার সে কাপের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা তার গোটা জীবনকে প্রতীকায়িত করে যেন। ২০১৫ সালে ও ১৬ সালে একই কাহিনী। অনেকের মতে, তার শেষ বিশ্বকাপে নিজ জন্মভূমিকে নিজেই যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনলেন। আর্জেন্টিনা ফুটবলের যে সূর্য অস্তমিত প্রায়, তার পথে নিজে যেন এসে বাধা হয়ে রইলেন। মরা বাঁচার এক লড়াইতে অনেক সমীকরণকে নিজ হাতে সমাধান করে আনলেন কিয়েটোতে। তার এক অমানবিক পারফরম্যান্সে আর্জেন্টিনা রক্ষা পেলো বাছাই পর্বে।
কোথায় দাঁড়িয়ে তিনি তার ৩১তম জন্মবার্ষিকীতে? আরও বড় গহ্বরের সামনে। যেখান থেকে আজীবনের মতো হড়কে যাওয়া হয়তো আর এক পা দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আইসল্যান্ডের সঙ্গে পেনাল্টি মিসে জয় পাননি। পরের ম্যাচে আরও বিবর্ণ, আরও অচেনা তিনি। গোটা দলের শরীরী ভাষা যেন পরাস্ত এলোমেলো হওয়া সৈন্যদলের। যে দল হতে পারতো অন্য সবার ঈর্ষার কারণ, সে দলই এখন নির্ভর করে আছে গ্রুপের বাকি ৩ দলের ওপর। এ দলের কান্ডারি মেসি, ভাবা যায়?
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রেফারির ভুলে লাল কার্ড দেখে। এরপর যার গোটা ক্যারিয়ারের সার যেন হতে যাচ্ছে ‘ভুল’ হিসেবে। কারণ, জগতের অনেকেরই মতে ইতিহাস কেবল সফল দেরই মনে রাখে। যে মেসির হাতে কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা ওঠেনি, তাকে ইতিহাস কতখানি জায়গাজুড়ে স্থান দেবে? হয়তো না, হয়তো হ্যাঁ। কিন্তু লিওনেল আন্দ্রেস মেসি তার ভক্তদের মনে থাকবেন সবসময়ই একই রকম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। স্পেনে জড়িয়েছিলেন ট্যাক্স ঝামেলায়, জাতীয় দলে তিনি ভোকাল নন, স্বভাবটা নেতাসুলভ নয়। শরীরী ভাষাতেও সবসময় চুপচাপ শান্ত স্বভাবের। দেশের হয়ে তাকে কি কেবল তার সর্বোচ্চ গোল আর এসিস্ট দিয়ে মনে রাখবে মানুষ? দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ফেডারেশন তার ট্রেনারদের বেতন দিতে পারে না, একাধিক হানড্রেড মিলিওন ডলারের খেলোয়াড়কে চড়ার মতো বিমানের টিকিট জোগাড় করে দিতে পারে না, কোচকে থাকতে হয় দিনের পর দিন বেতন ছাড়া তার ইউনিট নিয়ে, সেখানে মেসি তার অর্থ দিয়েও এগিয়ে এসছেন যথাসাধ্য। এরপরও বুয়েন্স আয়ার্সে লোকেরা তার মনুমেন্ট ভাঙে, আর্জেন্টিনার ব্যর্থতা সবখানে শিরোনাম পায় মেসির ব্যর্থতার নামে। তিনি একজন ট্র্যাজিক হিরো নয়ত কী? ২০১৬ সালে অবসর নিয়েছিলেন ক্ষোভ, অভিমান থেকে। ডুবতে যাওয়া আর্জেন্টিনার নৌকাকে অবসর ভেঙে এসে একলা হাতে হাল ধরে উদ্ধার করে এমন একমঞ্চে এসে আবার খাবি খাচ্ছেন—যেখানে তার দ্যুতি ছড়ানোর কথা ছিল—মস্কো কিংবা স্তালিনগ্রাদে তার নামে শোর ওঠার কথা ছিল ১৫ জুলাইয়ে। কিন্তু প্রজন্মের এই সুপারম্যান কি শেষ উদ্ধারটা পাবেন? এই দুশ্চিন্তা নিয়েই নিশ্চয়ই তিনি এবারে কেক কাটবেন।
মেসি একসময় সাবেক হবেন, শোকেসে সব থেকেও কোনো জাতীয় দলের শিরোপা থাকবে না। কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসা থাকবে স্বয়ং এ খেলাটারই, খোদ বিশ্বকাপেরই যেন আপসোস বিলিওন দর্শকের।
শুভ জন্মদিন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।