কোথায় যেন পড়েছিলাম, পৃথিবীর সব শিল্পীই আসলে কবি। কেউ তার কবিতা লেখেন অক্ষরে, কেউ ছবিতে, কেউবা নট-গীতের মাধ্যমে। মূলত এই সৃষ্টি জগতের মহাসত্যও দাঁড়িয়ে স্রষ্টার শিল্পিত ভাবনার ওপর। সৃষ্টির এই অলৌকিক আনন্দের ভার বহনকারী কবি সত্তা তার বক্ষে অপার বেদনা নিয়ে নিরন্তর আরাধনা করে যান সত্য সুন্দরের। আবার বিপরীত ভাষ্যও বর্তমান। কখনো কখনো স্রষ্টারও স্খলন ঘটে। অর্ঘ্য না পেয়ে কিংবা আরাধনার খামতিতে তিনি অভিশাপের বান মারেন ভক্তের হৃদয়ে। তবে এ কথা সবাই একবাক্যে মেনে নেন যে, কবির স্খলন ঘটলে তার প্রভাব পড়ে কবিতাতেও। আর নষ্ট কবিতা থেকে স্বার্থের যে গন্ধ ম ম করে, তাতে মধুমক্ষিকা নয় বরং উচ্ছিষ্টভোজীরা এসে ভিড় জমায়।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে সারা পৃথিবীতেই এমন নৈতিকভাবে স্খলিত বহু কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, দার্শনিকদের এখন রমরমা বেশাতি। অতিসম্প্রতি মঞ্চে আসা থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নাটক ‘অনুদ্ধারণীয়’-এর কবি চরিত্রটি যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধদেব বসুর গল্প অবলম্বনে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ড. মোহম্মদ বারী। শুধু অন্তঃসারশূন্য সৃষ্টি আর ভাবালুতা নিয়ে শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় ক্রমেই নষ্ট হতে চলা এক কবির গল্প এটি নয়, এর বিরুদ্ধে আছে কবিতাকে ভাবিকালে উত্তীর্ণ করার দায় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো তারুণ্যের দুর্দমণীয় স্পর্ধাও।
নাসির মজুমদার নামে এক স্বনামধন্য কবিকে তার একসময়কার পাড় ভক্ত অমিত অপহরণ করে নিয়ে আসে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকার এক গুহায়। নাটকের বিভিন্ন ডায়লগেই বোঝা যায় শিক্ষিত, রূচিবান অমিত নামের এই তরুণ কিভাবে তার চোখের সামনে দেখেছে, একসময় নিজের আইডল হিসেবে ভাবা নাসির মজুমদারের স্খলন। দেখেছে কবিতার ওপর ভর করে কিভাবে কবি নিজের মাথাটাকে ভাগা দিয়েছেন দেশি-বিদেশি বাজারে। বিনিময়ে কবির মিলেছে রাষ্ট্রীয় সম্মান, বিলাসী জীবনযাপন, অগাধ ধনসম্পত্তি। অথচ একসময় সত্য-সুন্দরের পক্ষে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো এই কবিই চেয়েছিলেন মুক্তি। তাই অন্ধকার গুহায় যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির অস্ত্র নিয়ে নাসির মজুমদারের মুখোমুখি হয় সে। তার লক্ষ্য মানবতাকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া পৃথিবীর সব প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস। তার বিপরীতে এমন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মুক্ত, স্বাধীন। আর চাই অযাচিত ভাবালুতায় মানুষকে আক্রান্ত করে কক্ষচ্যুত করা কবিতার মৃত্যু। চীরন্তন ও বহমান হওয়ায় কবিতাকে যেহেতু ধ্বংস করা এত সহজ নয়, তাই প্রতিক হিসেবে নাসির মজুমদারকেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় অমিত।
আরও পড়ুন: মাঝে-মাঝে জীবনদর্শনও বদলে যায় ॥ চাণক্য বাড়ৈ
বুদ্ধদেব বসুর মূল গল্পটি না পড়লেও নাটকটির ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়নি। নাসির মজুমদারের মতো এমন অসংখ্য চরিত্র আর মনে আগুন নিয়ে জ্বলতে থাকা অমিতদের যেন খুব পরিচিত ঠেকেছে। এরজন্য নির্দেশক ও কলাকুশলীদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। নাসির মজুমদারকে দেখে মনে পড়ে গেছে গ্রিক মিথলজির সিসিফাসের কথা। নশ্বরদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ সিসিফাস দেবতা তথা শাসকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর অবজ্ঞার ফল স্বরূপ অভিশাপপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তবু সেই অভিশাপকে অলৌকিক আনন্দ ভেবে বিশালাকার একটি পাথরকে সিসিফাস গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যেত পর্বতচূড়ায়। পরক্ষণেই যা আবার পর্বতের ঢাল বেয়ে আবার নেমে আসতো নিচে। এভাবে অনন্তকাল ধরে সিসিফাস অর্থহীন আর হতাশাজনক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। নাসির মজুমদারও যেন তাই। কাব্য ভাবনার বিশাল পাথরকে তিনিও ঠেলতে ঠেলতে তিনি কখনো চূড়ায় উঠছেন, আবার ভারসাম্যহীনতায় হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ছেন পরক্ষণেই।
অনুদ্ধারণীয় নাটকটির সবচেয়ে দুর্দান্ত দিক এর ব্যাকড্রপে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী ভিডিও প্রক্ষেপণ। দৃশ্য ও ডায়লগের সঙ্গে মিল রেখে গুহার আলো আঁধারিতে একে একে এস এম সুলতান থেকে শুরু করে ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, সালভ্যাদর দালির চিত্রকর্মগুলোর উপস্থাপন মঞ্চ পরিকল্পক শাহীনুর রহমানের নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাজ। যা নাটকের ডায়লগের শিল্পিত মানকে অনন্য নান্দনিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। তবে প্রসারতার কারণে কি না জানি না, টুকরো টুকরো সেটের সাজেশন থাকারে পরও মূল মঞ্চটাকে খানিকটা ফাঁকা লেগেছে। এছাড়া আলোর কাজে তেমন কোনো নতুনত্ব পাইনি। নাটকে নাসির মজুমদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন নির্দেশক ড. মোহাম্মদ বারী নিজেই। তিনি সুঅভিনেতা প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু একাধারে নির্দেশনা ও অভিনয়ের কারণে কিনা জানি না চরিত্র নিয়ে তিনি হয়তো গভীরভাবে ভাবার সুযোগ পাননি। এমনিতে চলনসই হলেও নাসির মজুমদার চরিত্রটি আরও জীবন্ত করে তোলার ক্ষমতা তার আছে। মূল অমিত চরিত্রটি করা মেহমুদ সিদ্দিক লেলিনও চমৎকার করেছেন। তবে উচ্চারণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি আর ডায়লগের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তিনি আরও ভালো করবেন। এছাড়া যারা ছায়া অমিতের চরিত্র করেছেন তাদের কারও কারও মধ্যেও উচ্চারণগত সমস্যা আছে। আগাগোড়া প্রমিত ভাষার প্রয়োগের মধ্যে যা মারাত্মক কানে লাগে।
নাটকটিতে আরেকটি চরিত্র নির্দেশক নিয়ে এসেছেন, যা কবির মনের সত্তা মনময়ূরী। কিন্তু পুরো নাটকটিতে দেখতে দেখতে মনে হয়েছে নিজের সঙ্গে কথপোকথনরত কবির মনময়ূরী নামক এই নারী সত্ত্বাটি না এলেও হতো। মনময়ূরী চরিত্রটিকে যেভাবে মঞ্চে নিয়ে আসা হয় বা যেভাবে সে চলাচল করছে তাতে এক ধরনের নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু অভিনয়ের খামতির কারণে কিনা জানি না তা আলাদা গিমিক তৈরি করে না। মনে হয় যেন একজন নারী চরিত্র আনতে হয় বলেই মনময়ূরীর আবির্ভাব। বরং অমিত কিংবা ছায়া অমিতদের সঙ্গে কবির লড়াই বেশি উপভোগ্য। তবে মনময়ূরী চরিত্রটির যথাযথ রূপ দিতে ফৌজিয়া করিম অনু যথাসাধ্যই চেষ্টা করেছেন। নাটকের কোরিওগ্রাফি নিয়েও হয়তো আরও ভাবা যেত। বিশেষ করে কবির ছোটবেলায় আকাশে গ্রহ নক্ষত্র দেখার স্মৃতির কোরিওগ্রাফিটি নিয়ে আরও আশা ছিল। হয়তো আরেকটু অন্যরকম করে ভাবা যেত নাটকের শেষ অংশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুহা ঘিরে ফেলার দৃশ্য। কারণ যে ঘোষণাটি দেওয়া হয় তা বড্ড মেকি লাগে।
আরও পড়ুন: মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা: সময়ের ভিন্ন সুর ॥ মামুন রশীদ
তবে মুগ্ধ করার মতো নাটকের প্রতিটি সংলাপ। যা গুঢ় হলেও দুর্বোধ্য হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে না। এ ক্ষেত্রে পুরো প্রশংসাই প্রাপ্য ড. মোহাম্মদ বারীর। নাট্যরূপ দেওয়ার সময় তিনি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য অনুসরণের পাশাপাশি নিজের মননও কাজে লাগিয়েছেন। নাটকটি দেখার পর অনেকেই বলছিলেন, এর ভাষা নাকি কঠিন। তবে ড. মোহাম্মদ বারীকে ধন্যবাদ যে তিনি অন্যের কথা শুনে ভাষাকে সহজ করতে যাননি। বরং এই গুঢ় ভাষাই নাটকটির বিষয়বস্তুকে একধরনের ইন্টেলেকচুয়াল ভারত্ব দিয়েছে। আর থিয়েটার আর্ট ইউনিট কিংবা নির্দেশক নিশ্চই অস্বীকার করবেন না যে, সচেতনভাবেই ‘অনুদ্ধারণীয়’ নামে তারা একটি ইন্টেলেকটুয়াল থিয়েটারই বানাতে চেয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে? আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য বলে গেছে’। তার এই কথাগুলোর পরিস্থিতি আজও পাল্টায়নি বরং খারাপ হয়েছে বহু গুণে। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। কিন্তু তারপরও নিজেদের মেধাবী সমাজের প্রতিভূ বলে দাবি করা কিছু মানুষ মুখে আঙুল পুড়ে বসে আছেন কোন কারণে তা জানতে কারও বাকি নেই। ‘অনুদ্ধারণীয়’ সেসব অর্ধসত্য আর আপসকামিতার বিরুদ্ধে সময়োপযোগী জরুরি উচ্চারণ। এরজন্য থিয়েটার আর্ট ইউনিট ও ড. মোহম্মদ বারী ধন্যবাদ পেতেই পারেন।