[পার্ব-৩৯]
আবৃত্তির গ্রুপও ছেড়েছি বাড়িতে অশান্তির কারণে। ভাইজানের বড় মেয়ে হৃদিতা হওয়ার পর ছোট বাচ্চাটির টানেও সকাল সকাল বাড়ি আসতাম। খুব লোভাতুর হৃদয় আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের শিশুটির জন্য। কিন্তু বেডরুমের দরজা বন্ধ। ওই শিশু মুখটিকে দেখতে পাই না। হঠাৎ কখনো দরজা খুললে খুব উৎসুক চেয়ে থাকি। কিন্তু জোর করে ঢুকে পড়ার অভ্যেস নেই কোথাও কখনো আমার। বুয়া চা-নাস্তা সব ওই বন্ধ দরজার ওদিকে রেখে আসতো। আমি কখনো একা একা বই পড়ি, কোনো কোনো সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে পথচারী দেখি। এভাবেই উদাস বেলা পার হয়। এক ছাদের নিচে চারটি মানুষ আমরা, তবু নিঃসঙ্গে একা আমার সন্ধ্যা আর রাতগুলো। মলিন বাতি জ্বেলে আধারের রঙ তাড়ানোর চেষ্টায় বিভোর। সেদিন আমি সন্ধ্যায় বাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন রাত প্রায় আটটা বাজে। ড্রইং রূমে এসে দেখি আলমগীর রশীদ আর রাজু কোনো একটা দরকারে ভাইজানের বাসায় এসেছে। আমি অবাক।
—তোরা? কখন এলি?
আলমগীর কথা বলে।
—তুই বাসায়?
—হ্যাঁ, কেন? ঘুমাচ্ছিলাম। কেউ তো ডাকেনি আমাকে। ডাকতে বলিসনি?
—তুই যে বাড়িতে ভাবি তো জানেই না মনে হলো।
—কী বলিস? আমি তো অফিস শেষ করেই বাড়ি ফিরেছি সন্ধ্যা ছটা বাজে তখন।
—ভাবি যে বললো তুই বাড়ি নেই। ফিরতে প্রায়ই তোর রাত ১২ টা বাজে?
—বুয়া বলেনি বোধ করি ভাবিকে।
আমি লুকানোর চেষ্টা করি ওদের কাছে। ভাইজান ক্রীড়া লেখক সমিতির সঙ্গে যুক্ত তখন থেকেই। স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে আমার প্লেয়ার বন্ধুরা তাকে ভালোই চেনে। তাছাড়া নিজেরও মানসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ঘটনাটা। ডিপার্টমেন্টে আমার সিনিয়র আর হলে রুমমেটের সঙ্গে বড় ভাইয়ের বিয়েটা তখন খুব একটা বিষয় হয়েছিল সবার কাছে। খেলাটা কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছে, এবার আমি বুঝতে পারি। তারপর একের পর এক ঘটতে থাকে মারাত্মক বিধ্বংসী মানবতার চূড়ান্ত অবমাননাকর সব ঘটনা। কাজের দিনগুলো কাজে কাজে বেশ চলে যায়। কিন্তু শুক্রবার—ছুটির দিনগুলো ছিল অসহ্য। ছায়ানটে ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমার আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। কী করবো? কোথায় যাব? কোথায় খাব? সেদিন আবৃত্তির ক্লাস শেষ হলে কিছুক্ষণ মাসুদ ভাই মাসুমদের সঙ্গে আড্ডা হয়। ওরা প্রায় জোর করে হোটেল নিরবে নিয়ে গেলো দুপুরের খাবার খেতে। ভাত মুখে তুলতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলি। আমার সমস্ত নীরব বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে আজও সেই দুঃসময়ের পরম বন্ধুরা আমার। কারও আর কিছু বোঝার বাকি থাকে না। এভাবেই আমার দিনাতিপাত চলতে থাকে। সে নেই ঢাকায়। তাকে অত কিছু বলা যায় না। তবু আমি নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজি। মমতার আশ্বাস খুঁজি। দুজন মানুষ আমার জীবনকে ত্যক্ত-বিরক্ত বিষণ্ন আর বিষাক্ত করে তোলে ক্রমাগত। আমি পালানোর পথ খুঁজি। কোন সে পথ। পরদিন সকালে আবার না খেয়ে অফিসে যাই। দুপুরের পর তার কল আসে অফিসের ফোনে। কথা হয়। নানা কথা। আমি বগুড়া যেতে চাই। সে অবাক হয়। কিন্তু কেন জানতে চায় না। ভীষণ স্থিতধী তার চরিত্র। খুব সহজে কৌতূহল প্রকাশ করা তার স্বভাবে নেই।
—ঠিক আছে। মন বেশি খারাপ হলে চলে এসো।
আমি বগুড়া যাওয়ার রাস্তা জেনে নেই। অফিস ছুটি হলে সোজা গাবতলী এসে উঠে বসি এস আলমের গাড়িতে। সে রাতে আমি আর বাড়ি ফিরি না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা লাগো লাগো। গাড়ি ছেড়েছে। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মোশন সিকনেসে ভোগা মানুষ আমি। তবু একা একা এই উদাস উদ্দেশ্যহীন অজানার পথে কোন্ এক প্রচণ্ড অভিমানে কী এক অদ্ভুত নির্বাণের লক্ষ্যে উঠে বসি। জানি না কিছুই। তবু মনে হয় ওই মুখগুলো আর যেন না দেখি। ওই নারকীয় যন্ত্রণা আর যেন আমাকে ছুঁতে না পারে। আমি কি পালাচ্ছি। জীবন থেকে! কেনই বা এভাবে! আমি তো আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারতাম। আমি তো আবার হলে ফিরে আসতে পারতাম! অত অত যাতনার পথ আমি পার হয়ে চলেছি যখন, যুদ্ধে যুদ্ধে পার হয় বেলা, তখন ওদিকে একা একা লুবনা আত্মহত্যার প্ল্যান করছে। ছোটবেলার খেলার সাথী শামীম ভাইয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে ততদিনে। কে জানতো সেদিন! আহা! লুবনার হাহাকার! বুকের ব্যথা। আমি কিছু কিছু জেনেছিলাম তার ব্যথা। কিন্তু ওই বিধ্বংসী পরিকল্পনার কথা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারিনি। তারপর ভাইয়ের বাসায় এসে ওর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে আরও। তবু, কোথায় যেন ওর যাতনা আর আমার যাতনা মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। আমার প্রাণের ঠাকুর কী তবে এ কথাই লিখেছিলেন–‘মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে।’
তবু আমি পরান্মুখী। আমি একজন মানুষের মায়ায় ছুটে বের হয়েছিলাম। সে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। আমার মনে হয়েছিল ওই আমার একমাত্র নির্দিষ্ট আর শেষ ডেসটিনেশন। গভীর ছিল তার ভালোবাসা। দারুণ মায়া ছিল সেখানে। দায়িত্ববোধ ছিল। বোঝাপড়া ছিল। বেদনাও ছিল অসীম। বেদনার রঙে ভালোবাসার রঙ বুঝি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারই পরশ লেগেছিল আমারও মনে আর শরীরে। রাত বাড়ছে। গাড়ি ছুটে চলেছে। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ির গতি বাড়ছে ক্রমশ। আমি দুরুদুরু বুকে একা বসে আছি। জীবনে প্রথম এভাবে একা অস্থির অসংলগ্ন উদভ্রান্ত আজানার পথে। পথে ঘটতে পারে নানা অঘটন। তখন আজকালের মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়। যখন তখন কোনো বিপদে আপদে যে কাউকে কল করারও অবকাশ নেই। তবু আমি চলি। তবু আমি অজানার পথে বা বাড়িয়ে দেই। কোথায় যাব, কেন যাব, কেন যাচ্ছি কিছুই জানি না। হঠাৎ গাড়ির চাকা নষ্ট হয়ে বিকট শব্দে গাড়িটা বন্ধ হয়ে যায় প্রায় বগুড়ার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় এসে। অনেক চেষ্টার পরও গাড়ি ঠিক হয় না। উৎসুক ভয়ার্ত অস্থির আমি মুখ বার করে দেখছি কী ঘটতে চলেছে। ততক্ষণে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে সবাই নেমে পড়ুন। আর একটা গাড়ি আসছে। ওটাতে উঠে পড়ুন দ্রুত। এ গাড়ি আপাতত আর যেতে পারছে না। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। সবাই দ্রুত বেগে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেমে পড়ে। আমার সঙ্গে কিছু নেই। একটা হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া।
আমি কোথাও চলে যাব করে গুছিয়ে আসিনি। সারাদিন অফিসে কাজের ছলে সব বেদনার অবসান। কিন্তু সন্ধ্যায় অফিস ছুটি হতেই প্রতিদিনের মতো যখন ছুটে আসতে থাকে বর্ষা বল্লম নিয়ে যত সব যাতনার ক্লেদাক্ত মুখগুলো, তখনই তার ফোনটা এসেছিল। আর আমি এক মুহূর্তেই ডিসিশন নেই আজ আর সংসার নয়, নোংরা আবর্জনায় নয়, আজ আমি দিনশেষে ফিরে যাব অন্য আলোয়। অন্য পৃথিবীতে। চোখের জল আমার বরাবরই অসহ্য। খুব অসহায় লাগতে থাকে নিজেকে কাঁদতে লাগলে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করা টাফ হয়ে পড়ে। ততক্ষণে বুঝতে শিখে গেছি আমার অসুস্থতায় আমাকে দেখার কেউ নেই। অতএব অসুস্থ হওয়া চলবে না।। চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের আঙন দুহাতে সরাই। আর তখনই ভেবে বের হয়ে পড়ি পথে। বয়স ২৪। দিকভ্রান্ত। পেছনে নারী। পেছনে নর। পেছনে সমাজ। পেছনে সংসার। পেছনে মানুষের নাকি পশুর মুখ। আমাকে তাড়া করতে থাকে। আমি সামনে ছুটতে থাকি। ছুটতে থাকি। ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে এই শেষ রাতের প্রান্তে এসে গাড়ির সঙ্গে আমিও থামি। সবাই যে যার মতো নেমে গেছে। গাড়ির শেষ যাত্রিটি নামার সময় আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার সাথে কেউ নেই?
—না
—আপনি নামবেন না?
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। কী বলবো, বুঝতে পারি না। তবু কেবল মাথা নাড়ি।
—হুম।
লোকটি হাত বাড়িয়ে বলে, আসুন।
—আপনি চলুন। আমি নামছি।
এই ঘন অন্ধকার রাতে অচেনা জায়গায় এই প্রথম আমি মানুষকে অবিশ্বাস করতে শুরু করি। কে তিনি, কেন আমাকে অত যত্নে নামতে বলছেন, কেনই বা আমি নামবো তার সঙ্গে, নেমে কী বিশ্বাসে আমি এগোবো তার সঙ্গে—এইসব শত দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের মাঝখানে এ জীবনে প্রথমবারের মতো উপনীত হয়ে মারাত্মক রকম অসহায় বোধ করতে থাকি আমি। লোকটি চলে যায়। সামনের সিটের ওপর দিয়ে মাথা বের করি। আর বসে থাকা যাবে না। এবার যাই ঘটুক আমাকে নামতে হবে। খুব ধীর গতি চিন্তার। পৃথিবীর সমস্ত ভার যেন এসে জড়ো হয়েছে এই ক্ষণে আমার পায়ে শরীরে আর মাথায়। এমন শূন্য শূন্য আর কখনো কি লেগেছিল জীবনের কোনো অধ্যায়ে! মনে করার চেষ্টা করি। তবু কিসের যে আশায় আমি দৃষ্টি প্রসারিত করি গাড়ির ভেতর আধো অন্ধকার থেকে বাইরের আধো আলো হয়ে ফুটতে থাকা ভোরের দিকে। কেউ নেই। কিছু নেই সামনে। এতটা ধূসর অতলান্ত গভীর পৃথিবী দেখতে পাই দুচোখ মেলে যা এতটুকু জীবনে আর কখনোই দেখিনি আমি। মনে পড়ে এপার ওপার করা পুকুর। মনে পড়ে ভোরের শিউলি আর লালমাই পাহাড়ের উঁচু টিলার ওপর ছো্ট্ট কুঁড়েঘর। বনপেয়ারা। মনে পড়ে ঝুল বারান্দায় দাঁড়াতেই ঘনসবুজ ধানের ক্ষেত আর চোখের সামনে দিগন্তের প্রসার, নীলের গভীরতা। আর ঠিক তখনই চোখে ভেসে ওঠে প্রিয় মুখ, সেই মুখ। না না একেবারেই স্বপ্ন নয়। কোনো হ্যালুসিনেশন নেই এখানে। মানুষের বিশ্বাসের মাঝে বিধাতা বাস করেন। আমি জানি। মানুষের প্রবলতর ইচ্ছের কাছে ঈশ্বর সমর্পিত হন। এ আমার জানা। দুজন মানুষের ভালোবাসার মাঝখানে আল্লাহ খোদা ভগবান বাস করেন। এ আমার চিরকালের বিশ্বাস। সে বিশ্বাসটুকু আজই নীরবে এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিবিড় অন্ধকারেও আমি চিনতে পারি তার গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ। গাড়ির প্রথম সিঁড়িটাতে উঠেই সে খুঁজছে আমাকে। একা ছিলাম বলে খুব সহজে পেয়েও যায় আমাকে। একা এভাবে গাড়িতে বসে থাকতে দেখে দ্রুত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।
—একা বসে আছ?
—কী করবো?
-ওঠো ওঠো। চলো
আমি আর চোখে জল ধরে রাখতে পারি না। উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণ শক্তিতে তাকে আঁকড়ে ধরি।
—গাড়ি তো আরও পরে আসার কথা। আমি যদি আগে আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ভেবে এখানে না চলে আসতাম তাহলে তো আজ কী হতো কে জানে?
বুঝতে পারি বগুড়া শহর থেকে খুব একটা দূরে নই তাহলে আমরা। তবু কিছুক্ষণ আগের ভীষণ অস্তিরতার ভয়াবহ শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারি না আমি। তবু তার হাত ধরে নেমে আসি। একটা রিকশায় উঠে বসি দুজনে। চলেছি কোথায় অন্য কোনো এক স্বপনের দেশে। তখনো জানি না কিছু।
চলবে…
আ হান্ড্রেড ফেসেস অব উইমেন-৩৮॥ শাপলা সপর্যিতা