আনিস, আমার বন্ধু
আনিসকে মনে পড়ে। আমার বন্ধু। কত বছর যোগাযোগ নেই। শেষ দেখা হয়েছিল, পথে। আনিস ফিরছে মাদ্রাসার ক্লাস শেষে, আর আমি খেলা শেষে। মাঝপথে দেখা। আমাকে দেখে, হাসিমুখে আনিস হাতে থাকা একটি অদ্ভুত ফুল দেখিয়ে বললো, ‘শুখে দেখ এটার গন্ধ’। ফুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দিলাম। পুরো মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো। মিষ্টি গন্ধ। ফুলের নাম মনে নেই, রঙটা গোলাপির কাছাকাছি। কিন্তু গন্ধটা? আর কখনোই এমন মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে আমার ঘ্রাণান্দ্রীয়র মোকালাত হয়নি। মাঝে পেরিয়ে গেছে প্রায় পঁয়ত্রিশ/ছত্রিশ বছর। কিন্তু গন্ধটা এখনো মাথার ভেতরে ঘাই মারে। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাই। সেদিনও হয়েছিলাম। ফুল থেকে নাক তোলার পর, আনিস বলেছিল, এটা এখানের ফুল না। অবাক চোখে বললাম, কোথায় পেলি? ও হাসিতে রহস্য মেখে বললো, পেয়েছি। বারবার জানতে চাওয়ায় শেষে বললো, ওরা দিয়েছে।
এই ‘ওরা’ মানে আনিসের সঙ্গে থাকা আশরীরী। মাঝে অনেক দিন আনিসের খোঁজ ছিল না। আনিস হঠাৎ করে হারিয়ে গিয়েছিল। স্কুল বন্ধের এক দুপুরে বাড়িতে বসে আছি। জানালার পাশে বসে সামনের রাস্তা দেখছি। হঠাৎ হৈ চৈ। আনিসের বড় ভাই, মা, ভাবি আরও আরও মানুষ দল বেঁধে রাস্তায়। আনিস নেই। পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা দরজা খুলে দৌড়ে এলাম রাস্তায়। চিৎকার, কান্নার শব্দের মাঝে জানা গেলো আনিস নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। কাউকে বলে যায়নি। হঠাৎ করেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সেদিনের সেই মফস্বল শহরে থানায় ডায়েরি করার কথা কেউ হয়তো বলেছিল, কিন্তু আনিসের বাড়ির কারো সেবিষয়ে আগ্রহ ছিল, এমনটি মনে পড়ে না।
আনিসকে পাওয়া গেলো না। অনেক দিন আনিসের খোঁজ নেই। আনিসের মা, তাঁর নাম ছিল পরী। আমরা ডাকতাম ‘পরীয়া দাদি’। তাঁর কান্না থেকে জানা গেলো, আনিসকে পরীরা ধরে নিয়ে গেছে। তারা যখন দৌড়ে বাড়ির বাইরে এসেছিলেন, তখনই নাকি পরীরা আনিসকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এটা টের পেয়েই বাড়ির সবাই হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু পরীদের হাত থেকে আনিসকে ছাড়িয়ে নেওয়া যায়নি। সবাই জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে, তাহলে আনিসের এখন কি হবে? প্রায়ই আনিসকে নিয়ে আলোচনা শুনতাম। বড়রা কথা বলতো। তাদের মুখেই শুনতাম, পরীয়া দাদি বলতেন, আনিসকে ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। তবে আনিসদের বাড়ির কারো প্রতিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে না। শুধু পরীয়া দাদিকে মাঝে মাঝে কাঁদতে দেখতাম।
দুপুরে পুকুরে গোছল করতে নেমে, বিকেলে খেলার মাঠে আমাদের মধ্যে আনিসকে নিয়ে কথা হতো। আনিস নেই। আমরা কল্পনা করতাম, পরীর দেশ কেমন? ওকে কেনো ধরে নিয়ে গেলো পরীরা? আনিস ছিল রোগা-পটকা। লিকলিকে শরীর, কিন্তু শরীরের তুলনায় পেটটা বেশ বড়ো। সেই আনিসকেই ধরে নিয়ে গেলো পরীরা? আমাদের বিস্ময় কাটে না। আমাদের অবাক হওয়ার রেশ কাটে না। পরীর রাজ্যের কত কত গল্প শুনেছি, কত কত ভালো খাবার, বিশেষ করে হরিণের মাংস। আহ, আমরা খুব আফসোস করতাম। আনিস হারিয়ে যাওয়ার জন্য যতটা শোক তার চেয়ে আমাদের মধ্যে ওর পরীর রাজ্যে চলে জন্য বেদনা কাজ করতো। বেশ কিছুদিন পরে, হয়তো এক মাস হবে, বা আরও বেশি, এক সন্ধ্যায় হঠাৎ আবার হৈ চৈ।
চুপিচুপি পেছন থেকে এসে আনিসকে জোরে ধাক্কা মারি। আনিস পড়ে যায় পুকুরের পানিতে। কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌঁড়ে বাড়ি এসে পড়তে বসি। মনের ভেতরে ভয় এই বুঝি পরীয়া দাদি আনিসকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। আশঙ্কা সত্যি হয়নি। আনিস আমাদের বাড়িতে আসেনি।
এবার আনন্দের। আনিস ফিরে এসেছে। খেলা শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আমরা সবে পড়তে বসেছি, সেই সময় খবর এলো আনিস ফিরেছে। পড়া রেখেই দৌড় আনিসদের বাড়ি। লোকে লোকারণ্য। সবার মুখে নানা রকম প্রশ্ন, আনিসের মুখে উত্তর নেই। আমরা বড়দের টপকে আনিসের কাছাকাছি যাবার সুযোগ পাই না। মন খারাপ করে ঘরে ফিরে আসি। রাতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবার আগে নানারকম কল্পনা। এতদিন পরীর রাজ্যে আনিস কী করলো, কী খেলো, কিছুই জানা হলো না।
বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় ছিল অনেক বড় একটি পেয়ারা গাছ। দুপুর বেলা স্কুল না থাকলে, আমরা সেই গাছে উঠে বসে থাকতাম। গাছে দড়ির সঙ্গে পিঁড়ি লাগিয়ে দোলনা লাগানো ছিল, তাতে দোল খেতাম। সেখানে মাঝে মাঝে আনিস আসতো। টুকটাক গল্প হতো। আনিসকে নিয়ে ছড়া কাটতাম। ‘আনকিস ঢানকিস মানকিস, টানকিস এটকিস বেটকিস’। এরকম লম্বা লাইন ছিল। পুরোটা মনে নেই। পুরোই মিনিংলেস, ননসেন্স বললেও ভুল হবে। এখন মনে পড়লে হাসি। কিন্তু এটা শুনলেই আনিস রেগে যেতো। মারতে আসতো। দলে ভারী থাকলে, পারতো না। উল্টো মার খেয়ে বিদায় নিতো। কিন্তু একা থাকলেই সমস্যা। আমি প্রায়ই মার খেতাম। তবু ওকে দেখে ছড়া কাটতে কাটতে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়তাম। সেই আনিসকে ছড়া কেটে ক্ষ্যাপানো হয় না। কতদিন ওকে ধরে সবাই মিলে মাইর দেওয়া যায় না। এটাও আমাদের জন্য বেদনার। সেই বেদনা ভুলতেই আমরা পরের সকাল থেকেই আনিসদের বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করি। আনিসের দেখা নেই। ওকে ডাকতে গেলে ওর বড় ভাই, নিষেধ করে দেন, আনিস বাড়ির বাইরে আসবে না। তবুও আমরা আনিসদের বাড়ির আশপাশ ছাড়ি না। ওদের বাড়ির সামনেই বাজার বসতো। দুপুরের অনেকেই আগেই বাজার শেষ হতো। দোকান-পাট উঠে গেলেই কিছু ঝুপড়ি ঘর বাদে, পুরোটাই একটা মাঠ। ওখানেই আমাদের আড্ডা।
আমরা বাজারেই বেশিরভাগ সময় কাটাই। বিকেল কাটে ওদের বড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে। কিন্তু আনিসের দেখা নেই। বেশ কয়েকদিন পর, আনিস বাইরে আসে। রোগা-পটকা আনিসের পরিবর্তন আমরা দেখি। ও মোটা হয়েছে। চেহারায় আলাদা চমক। আমরা ওকে ঘিরে ধরি। আনিস কিছুই বলে না। আমরা যতো জানতে চাই, আনিস ততো এড়িয়ে যায়। একসময় বিরক্ত হয়ে আমাদের সঙ্গই ছেড়ে দেয়। স্কুল পাল্টে আনিস মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। আনিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমতে থাকে। সেই যোগাযোগ কমে যাওয়ার মাঝেই আনিসের সঙ্গে আমার দেখা হয় পথে। ও আমাকে শুখতে দেয় অদেখা ভুবনের ফুলের ঘ্রাণ।
পরীদের সঙ্গে চলে যাওয়ার বেশ আগে, আমার ছোটফুপু বেড়াতে এসেছিলেন। একদিন, সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে আনিস বলে, ‘তোর ফুপুকে আমি বিয়ে করবো’। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দা পার হইনি। সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বিয়ে কী, বুঝিই না। কিন্তু আনিসের কথা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওকে মারার জন্য হাত নিশপিশ করতে থাকে। স্কুলে যাওয়ার পথে মারলে বিপদ, স্কুলে গিয়েই স্যারকে বলে দেবে। স্কুলে পাল্টা মার খেতে হবে। তাই হাতকে সংযত করে, ওর সঙ্গে আর কোনো কথা না বলেই স্কুলে চলে যাই। সারাদিনই মেজাজ খারাপ থাকলেও, আনিসকে মারার সুযোগ আর হয় না। কয়েকদিন পরে, স্কুল বন্ধের সকাল। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে আনিসও এসে দাঁড়ায়। কোনো কথা না বলে চলে যাই বাজারের দিকে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখি, আনিস দাঁড়িয়েই আছে। চুপিচুপি পেছন থেকে এসে আনিসকে জোরে ধাক্কা মারি। আনিস পড়ে যায় পুকুরের পানিতে। কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌঁড়ে বাড়ি এসে পড়তে বসি। মনের ভেতরে ভয় এই বুঝি পরীয়া দাদি আনিসকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। আশঙ্কা সত্যি হয়নি। আনিস আমাদের বাড়িতে আসেনি।
এরপর কোথা দিয়ে সময় কোথায় চলে গেছে। যার যার ভুবনে আমরা ব্যস্ত হয়ে গেছি। বাবার চাকরি সূত্রে ছেলেবেলার স্থান পরিবর্তন হয়েছে। নতুন বন্ধু হয়েছে আমার। নতুন জগৎ হয়েছে আমার। মাঝে শুনেছিলাম আনিসকে মাদ্রাসা ছাড়াতে হয়েছে। অভাব ওর পড়ালেখার গতি থমকে দিয়েছে। কাজ জোটাতে হয়েছে মহাসড়কে ছুটে চলা একটি ট্রাকে চালকের সহকারী হিসেবে। কার কাছে জেনেছিলাম আনিসের খবর মনে নেই। শোনার পরে কিছু মনে হয়েছিল কি-না তাও মনে করতে পারি না। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। জীবনের চাকা ঘুরতে থাকে আমাদের। আনিসেরও। বহু বহু বছর পর, হঠাৎ একদিন পুরনো স্থানের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তার কাছে এর-ওর খোঁজের মাঝে আবারও শুনি আনিসের কথা। যে জীবনের চাকা ঘোরাতে আনিস ছুটে চলা ট্রাকের সঙ্গে বোঝাপড়া গড়েছিল। সেই ট্রাকই তার জীবনের চাকা থমকে দিয়েছে। ট্রাকের চাকা কেড়ে নিয়েছে আনিসকে। হঠাৎ দুর্ঘটনায় আনিস চিরতরেই হারিয়ে গেছে। আনিসের এই চলে যাওয়া-দুর্ঘটনার কান্না এখনো ঝাঁকুনি দেয়। আনিসকে মনে পড়তে থাকে। নাকে ভেসে আসতে থাকে সেই অদেখা ভুবনের ফুলের ঘ্রাণ।
চলবে…
সোনার খাতায় ছড়ানো জীবন-১৯ ॥ মামুন রশীদ