সোহাগপুরের তাঁতপল্লী ও স্কুল পালানো
স্কুলের গণ্ডি কেন জানি আমার কখনোই ভালো লাগেনি। প্রথম স্কুল দিনাজপুরে। বালুবাড়ি মিশন স্কুল নামেই পরিচিত। এক নামেই সবাই চিনতো। ওখানেই প্রথম ভর্তি। বই-খাতা-ব্যাগ নিয়ে যাওয়া। খুব আবছাভাবে মনে পড়ে স্কুলের টিচাররা সবাই সাদা জামা পড়তেন। তাদের আমরা সিস্টার বলতাম। স্কুল ঘরে পুরনো মোটা দেয়াল। ছোট ছোট ব্রেঞ্চ। জানালা খোলা। কোনো গারদ নেই। লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। বেঞ্চের ওপর উঠে জানালা, তারপর জানালা গলিয়ে সোজা বাইরে। তবে স্কুল কম্পাউন্ডের দেয়াল বেশ উঁচু ছিল। সেই দেয়ালের গায়ে লতার মতো লেপটে ছিল সবুজ গাছ। রোজ সকালে আমাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো স্কুলে। তার আগে পরিপাটি করে পড়ে নিতাম স্কুলের জামা-জুতো। কিন্তু স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢোকার আগেই কেন জানি আমার গলা শুকিয়ে যেতো। পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে যেতাম। আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন কোনোদিন আমার নানাভাই, কোনোদিন মামাদের কেউ। কিন্তু কেউই আমাকে স্কুলের ক্লাসরুমে বসিয়ে বাড়ি চলে আসার সুযোগ পেতেন না। আমি আকুল কান্নায় নিজেকে ভাসিয়ে আবার যথারীতি ওই সাইকেলেই বাড়ি ফিরে আসতাম। একদিন আবার সেজ মামা গিয়েছেন আমাকে স্কুলে রাখতে। (এই ঘটনা ওনার মুখে শোনা, আমার মনে ছিল না।)
আমাকে ক্লাস রুমে বসিয়ে রেখে, ভালোভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে উনি যেই সাইকেলের কাছে ফিরে এসেছেন, সাইকেলের তালা খোলার সময়ে সিস্টারদের বলছেন, আমাকে দেখে রাখতে, তখনই হঠাৎ তার ঘাড়ে নাকি আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। স্কুলের জানালা টপকে সেই ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ারও আশঙ্কা নাকি ছিল। উনি আচমকা এই ঘটনায় খুব ভয় পেয়েছিলেন। পরে আমাকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরে আসেন। এই স্কুল নিয়ে আমার আর কোনো স্মৃতি নেই। এরপর ভর্তি হই উল্লাপাড়ার ঝিকড়া বন্দর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সোহাগপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নাম মনে নেই। কিন্তু এই স্কুলটির অনেক স্মৃতি এখনো আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। এই স্কুলে এসেই আমি প্রথম একজন শিক্ষকের মুখ মনে করতে পারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক সম্পর্কে আমার ভালোর চেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি। এই স্কুলে এসেই আমি প্রথম একজন বন্ধু পাই। যাকে আজও মনে পড়ে। কিন্তু স্মৃতির অতল থেকে তার নাম আমি মনে করতে পারি না। এই বেদনা আমাকে আহত করে।
সোহাগপুর আমার জন্য স্বর্গ হয়ে নেমে আসে। আমরা যেখানে থাকতাম, তার চারপাশে তাঁতঘর। তাঁতীদের সারাদিন খট খট করে তাঁতের মাকু টেনে চলা। তাঁতের খটখট শব্দ, বসে থেকে একজন তাঁতী একহাতে কাপড়ের সুতো ঠিক করে দিচ্ছেন, অন্যহাতে মাকু টেনে চলছেন, এই দৃশ্য আমার কাছে কখনোই একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। এই শব্দ আমি কান পেতে আজও শুনতে পাই। একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকে কাপড়, রং পেতে থাকে, তার অবয়ব স্পষ্ট হতে থাকে—এই দৃশ্যের চেয়ে মধুর দৃশ্য আমি চোখ বন্ধ করে আর দেখি না।
সোহাগপুরে এসে আমি হয়ে উঠলাম খাঁচাছাড়া পাখি। আব্বা অফিসের কাজে সারাদিন বাইরে। আমার ছোটবোন তখন বেশ অসুস্থ। মা ওকে নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিনে ঘরের কাজ সেরে, বোনের জন্য সময় বের করে , যতটুকু আমার জন্য বরাদ্দ ছিল, তা দিয়ে আসলে খাঁচামুক্ত পাখিকে ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না। সন্ধ্যায় আব্বা অফিস থেকে ফিরে এসে আমাদের দুই ভাইবোনকে পাশে নিয়ে গল্প শোনাতেন। মা তখন রান্না ঘরে যেতেন। রাতের খাবার শেষে শুয়েও যতক্ষণ ঘুম না আসতো চোখে, ততক্ষণ আব্বাকে গল্প শোনাতে হতো। কখনো কখনো আমরা ক্যাসেট প্লেয়ারে রিউইন্ডের মতো, একই গল্প বারবার শুনতে চাইতাম। কখনো কখনো গল্পের একই অংশ বারবার। আব্বা কখনো বিরক্ত হয়েছেন, বা বলতে চাননি, এমন আমার মনে পড়ে না। মা’ও আমাদের গল্প শোনাতেন, তবে দুপুরে—কখনো কখনো অবসর পেলে। রাতে আব্বার কাছেই গল্প শুনতাম বেশি। স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। পড়ালেখা নিয়ে ওতো মাথাব্যথা নেই বাড়ির কারো। সকালে আব্বা বেরিয়ে যাবার পর, মা আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দেন। আমিও বই-খাতা নিয়ে বেরিয়ে পাড়ি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের পথ কখনোই ধরিনি। মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতদূর দেখা যায়। আমিও ততটুকুই স্কুলের পথে। তারপরও পথ ঘুরে চলে যেতাম যেদিকে বন্ধ তাঁতঘর রয়েছে, সেদিকে। দিনের বেলায় অনেক তাঁতই বন্ধ থাকতো। টিনের তৈরি ঘরে বসানো ছিল সব তাঁতঘর। মাটি থেকে প্রায় এক হাত উঁচুতে টিনের বেড়া। এই জায়গাটুকু ফাঁকা। এই ফাঁক দিয়ে অনায়াসে আমি ঢুকে যেতে পারতাম যে কোন তাঁতঘরে। বন্ধ তাঁতঘর ঘিরে থাকতো অদ্ভুত এক নির্জনতা। আমি ওই তাঁতঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। কখনো কখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। যখন ঘুম ভাঙতো, তখন সূর্য হেলে পড়তো পশ্চিম আকাশে আর আমার পেটের ভেতরে এক আকাশ খিদে। তাঁতঘরের ভেতরেও তখন অন্ধকার। এমনিতে দিনের বেলায় বন্ধ ঘরেও বেশ অন্ধকারই থাকতো, আর ওই সময় আরও অন্ধকার ভর করতো। আমি ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে চলে আসতাম বাড়ি। মায়ের কাছে বসে খেয়ে কখনো বোনের সঙ্গে খেলতাম, কখনো আবার বাড়ির বাইরে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি।
স্কুল ছুটির দিনে, সকালটা বাড়িতেই থাকতাম। মা বাইরে যেতে দিতে চাইতেন না। বোনের সঙ্গে তখন খেলাটাই ছিল প্রধান। যে বাড়িটাতে আমরা থাকতাম, তখন বারান্দায় কয়েকটা কাক আসতেন। তার একটার সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। মা আমাদের বাটিতে করে মুড়ি অথবা বিস্কুট খেতে দিলে ওই কাকও এসে ভাগ বসাতো। কোনো কোনো দিন ও পুরোটাই খেয়ে নিতো। আব্বা একবার ওই কাকটাকে ধরে ওর পালক কেটে দিয়েছিলেন। তারপর ও আসেনি অনেকদিন।
আমি স্কুলে যেতাম না কোনোদিনই। এটা বুঝতেও পারেনি বাড়ির কেউ। হঠাৎ একদিন আব্বা কী কাজে স্কুলের ওদিকে গিয়েছেন, কাজ শেষে আমাকে দেখার জন্য স্কুলে যান। প্রধান শিক্ষকের রুমে বসে ক্লাস থেকে আমাকে ডাকতে পাঠান। কিন্তু আমি তো নেই। প্রথম দিন আব্বা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর, আর কখনোই যাইনি। স্কুলের কেউ আমাকে চেনেও না, জানেও না। আব্বা আমাকে খুঁজে না পেয়ে বাড়িতে চলে আসেন। আমি তখন বাড়িতে নেই। যথারীতি ঘুমিয়ে কোনো একটি তাঁতঘরে। বিকেলে আমি বাড়ি ফিরি। মা আমাকে ডেকে জানতে চান, কোথায় গিয়েছিলাম? বলি, স্কুলে। আব্বা জানতে চান, কোথায় গিয়েছিলাম? বলি, স্কুলে। আমাকে কেউই আর কিছু বলে না। পরদিন অফিস সময় পেরিয়ে গেলেও আব্বকে বাড়িতেই দেখি। স্কুলের সময় হলে, আমি তৈরি হই। আমার হাত ধরে আব্বাও বেরিয়ে পড়েন। বলেন, চলো, তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসি আজ।
আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে হেডস্যারের রুমে, স্যারকে বলেন, এই যে আপনার ছাত্র। স্যার, আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলেন, স্কুলে আসো না কেন বাবা? স্কুলে এসো। কেউ তোমাকে মারবে না। আমি মাথা ঝাঁকাই। তারপর স্যার কাকে দিয়ে যেন আমাকে ক্লাসরুমে পাঠিয়ে দেন। ক্লাস রুমে অনেক ছাত্র। গিজগিজ করছে। কাউকেই চিনি না, জানি না। আমি একদন শেষ বেঞ্চে বসে পড়ি। একটু পরেই একজন এগিয়ে এসে, আমাকে বলে, হাতের লেখার খাতা জমা দাও। আমি তো তখনো হাতের লেখা কি, তাই জানি না। হা করে তাকিয়ে থাকি। সেই ছেলে চলে গেলে, সবাই বলতে থাকে, আজ আমার কপালে দুঃখ আছে। স্যার এসে এমন মাইর দেবে, জীবনে ভুলতে পারব না। ভয়ে পাশের জনের কাজে জানাতে চাই, হাতের লেখা কী? ও বলে দেয়, খাতায় একপাতায় লিখে দিতে। ‘আমার একটি বই আছে।’ এই একটি লাইনই পুরো পাতায় লিখে জমা দিয়ে আসি স্যারের টেবিলে।
একটু পরেই ক্লাসে স্যার আসেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। হাতে খাতা, বই আর একটি বড় বেত। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। ক্লাস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি। হাতের তালু ঘামতে থাকে, পায়ের তালু ঘামতে থাকে। স্যার একে একে সবার খাতা দেখে, তাতে লাল কালিতে টিক চিহ্ন দিয়ে আবার কাউকে যথোপযুক্ত আপ্যায়ন করে বিদায় দিতে থাকেন। একসময় খাতার সংখ্যা কমে আসে। আমি দূর থেকেই আমার খাতা চিনতে পারি। স্যার খাতাটি দেখা হলে, একপাশে সরিয়ে রাখেন। সবার খাতা ফেরত দিয়ে দেন। তারপর আমার খাতাটি হাতে নিয়ে বলেন, মো. মামুনুর রশীদ এদিকে এসো। আমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাই। বুকের ভেতরের সেই কম্পন আজি আজও টের পাই। স্যারের কাছে গেলে, স্যার আমাকে আদর করে কাছে টেনে নেন। তার চেয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে বলেন, বাবা, স্কুলে আসো না কেন? স্কুলে আসবে। পড়ালেখা করলে কেউ তোমাকে মারবে না। মাথায়-গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। শেষে পাঞ্জাবির পকেট থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে আমার খাতার ভেতরে রেখে বলেন, এটা দিয়ে লজেন্স কিনে খেও। আর কাল থেকে স্কুলে এসো। মনে থাকবে? আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেই। সব ছাত্রের চোখের সামনে দিয়ে বীরের মতো, কিন্তু লজ্জায় মাথা নত করে নিজের বসার জায়গায় ফিরে আসি।
স্যারের ক্লাস শেষ হয়, অন্য স্যার আসার আগেই সামনের দিক থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসে। তার নাম বলে। বন্ধু—এই সম্বোধন, ওর কাছে প্রথম শুনি বলেই মনে হয়। ওর মুখের জানতে পারি, আমাদের ক্লাসটিচার যিনি, আমাকে টাকা দিয়েছেন, তিনিই ওর বাবা।
এরপর স্যার আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। আমার খোঁজ নিয়েছেন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে—স্যারের ছেলের সঙ্গে আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাতে আমরা বনভোজনের আনন্দে মেতেছিলাম। বাড়ির বাইরে—আত্মীয়-স্বজনের বাইরে, সেই আমার প্রথম রাত কাটানো। সকালে যখন ফিরে আসি, স্যারের ছেলে, আমার বন্ধু আমাকে একটি ছবির বাঁধাই খাতা দিয়েছিল উপহার হিসেবে। আবছাভাবে মনে ওই ছবির অ্যালবামে—সব হাতে আঁকা ছবি ছিল। হয়তো ওগুলো আমার বন্ধুই এঁকেছিল। দুর্ভাগ্য—এত স্মৃতি আমার মনের গভীরে। কিন্তু স্যার ও স্যারের ছেলে, আমার প্রথম বন্ধুর নাম মনে নেই। মনে করতে পারি না। শুধু আবছাভাবে স্যারের মুখ আজও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা আমার শ্রদ্ধার আসনে বসা প্রথম শিক্ষক। চলবে…
সোনার খাতায় ছড়ানো জীবন: পর্ব-১৩॥ মামুন রশীদ