প্রথম দূরের যাত্রা ও দারা ভাই
উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হলো। সবার মুখ ভার। আমার রেজাল্ট শুনে সবাই হতাশ। আমি মুখ কালো করে ঘুরিফিরি। ভাবখানা, এ কি হলো? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। নিশ্চয় খাতা দেখায় পরীক্ষকের কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অপার আনন্দ। এক ধাক্কায়, বিনা বাধায় আরও একটি সিঁড়ি টপকে গেছি, এটাই আমার আনন্দ!
গণিতে আমি বরাবরই খারাপ। শুধু খারাপ বললেও ভুল বলা হবে। তারপরও মাধ্যমিকে আমি সাধারণ বিজ্ঞান গ্রুপের ছাত্র ছিলাম। উচ্চতর গণিতও বিষয় হিসেবে নিয়েছিলাম। কেন কী ভেবে, তার সুলুকসন্ধান এতদিনে না করেও বলতে পারি, বন্ধুরা সবাই উচ্চতর গণিত নিয়েই বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হচ্ছে। তো, আমি বাকি থাকব কেন? তারপর কী কী করে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে এসেও আবার ঢুকে পড়লাম বিজ্ঞান বিভাগে। শুরু থেকেই সবাই বলেছিল সিদ্ধান্ত বদলের। ধুর, কিসের কী? পড়লে বিজ্ঞান নিয়েই পড়া ভালো। কলেজে ক্লাসের সঙ্গে খুব বেশি যোগ না থাকলেও, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান পড়তে আমার ভালোই লাগতো। রসায়নে বেশ আগ্রহও জন্মেছিল। কিন্তু এবারও ছিল গণিত। না নিলেও চলতো, বিকল্প ছিল। তবু গণিত নেওয়া চাই-ই। নিয়ে নিলাম। দুই বছর তাইরে-নাইরে করে কাটালেও, পরীক্ষার হলে গিয়ে বুঝেছি, কত ধানে কত চাল। তাই আমার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল নিয়ে সবার মাঝে কষ্ট থাকলেও, আমার আনন্দের সীমা ছিল না। প্রতিটি পরীক্ষাই ছিল বিভীষিকা। কী করে তিন ঘণ্টা কাটাব, তারই আয়োজন। এবার গণিত ছিল চতুর্থ বিষয় হিসেবে। আশির ওপরে পেলে নম্বর যোগ হবে। না পেলে না। আর ফেল করলেও ঝামেলা নেই, তাই সাহস হয়েছিল হয়তো।
সেই বিভীষিকার পাঠ চুকিয়ে এলো আরেকটি সিঁড়ি ডিঙ্গানোর পালা। এজন্য আবার বসতে হবে ভর্তি পরীক্ষায়। এই ভর্তি পরীক্ষার সূত্রেই প্রথম যাওয়া হলো সিলেট। খবরের কাগজে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে আব্বা বললেন, দেখো চেষ্টা করে। কোথায় ভর্তি হতে পারবে তার তো ঠিক নেই। নতুন জায়গা, অত দূর, তখনো বগুড়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথও খুব সহজ ছিল না। আমাদের পরিচিত কে যেন, হঠাৎ সিলেট গিয়েছিল, তিনি ওখান থেকে ভর্তির আবেদনপত্র তুলে, কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু জমা দিয়ে দেবে কে? পরীক্ষারও অনেক দেরি। নির্ধারিত সময়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার জন্য আমাকেই যেতে হলো। একদিন সকালে আব্বা আমাকে ঢাকার বাসে উঠিয়ে দিলেন।
খুব ভোরে ঢাকার উদ্দেশে বগুড়া থেকে বাসগুলো যাত্রা শুরু করে সাতমাথা থেকে। শহরের কেন্দ্রস্থলে খুব ভোর থেকে মানুষের ছোটাছুটি। আব্বা আর আমি বাড়ি থেকে রিকশায় চলে এলাম সাতমাথা। আমাকে বাসে বসিয়ে দিয়ে, নানান উপদেশ দিয়ে নেমে গেলেন আব্বা। একটু পরেই, শুনি বাসের জানালায় টোকা পড়ছে। তাকিয়ে দেখি আব্বা। জানালা খুলে মুখ বের করলাম। আব্বা বললেন, শুধু ভর্তি ফরম জমা দিয়েই চলে এসো না। শহরটাও ঘুরেফিরে দেখো। হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারেও যেও। চা বাগান দেখো। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। বাস চলতে শুরু করলো, পেছনে আব্বা দাঁড়িয়ে থাকলেন। একসময় ছুটতে ছুটতে বাস এসে পৌঁছল ঢাকা। প্রায় সন্ধ্যা তখন। যমুনা নদীর ওপর সেতু ছিল না। ফেরি পার হয়ে আসতে হতো রাজধানীতে। অনেক সময় লাগলো। রাতে থাকলাম ঢাকায়। ও রাতেই কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনের টিকেট করে আনলাম। সকাল ছয়টায় সম্ভবত ছিল ট্রেনটা। পরদিন আবার যাত্রা শুরু হলো।
আন্তঃনগর ট্রেন। প্রায় প্রতিটি সিটেই যাত্রী। হকারেরাও আছে। আর একটু পর পর আসছে খাবার গাড়ির লোকেরা। যাত্রাপথে, একটু একটু করে আশপাশের মানুষের সঙ্গে টুকটাক কথা হচ্ছে। আলাপের চেয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতেই ভালো লাগছিল। ট্রেন ছুটছে আর চোখের সামনে ফুটে উঠেছে ভিন্ন এক মাটির গন্ধ। যতো দূরে চলে যাচ্ছি, ততই কেন যেন মন খারাপ করতে শুরু করলো। কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, পরের স্টেশনে নেমে যাব না কি?
আমাদের সারির উল্টো পাশে কয়েকজন যাত্রী। যাদের কথা শুনে আমার সিলেটের বলেই মনে হলো। তাই সিলেট পৌঁছার দুই একটা স্টেশন আগে, আমার সারির অন্যপাশে একজন যুবকের কাছে জানতে চাইলাম, স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কত দূরে? কী করে যেতে হয়? তিনি আমাকে জানালেন, স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ দূরে। আমরা যখন পৌঁছুব তখন, প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রিকশাতেও যাওয়া যাবে। তারপর আরো কী কী নিয়ে যেন কথা হলো। একটু পরে, ট্রেন থামলো একটি স্টেশনে, ওনার পাশের যাত্রী নেমে গেলেন। উনি আমাকে তারপাশে গিয়ে বসতে বললেন। তারপর, জানতে চাইলেন, সিলেট গিয়ে কোথায় থাকব? বললাম, কোনো হোটেলে। প্রথম যাচ্ছি কি না, জানতে চাইলেন। আমার হ্যাঁ শুনে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরিচিত একজন পড়ালেখা করে। আমি ইচ্ছে করলে তার কাছেও থাকতে পারি। আসলে, অল্প কয়েকটি কথার মধ্যেই তিনি কেমন করে আপন হয়ে উঠছিলেন। ভ্রমণের সময় অপরিচিত মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলার বারবার উপদেশ সত্ত্বেও, কেন জানি না, তার সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তার অনেক কথাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো কোনো কথা, কয়েকবার শুনে বুঝে নিচ্ছিলাম। তার প্রস্তাব শুনে, বললাম, উনি তো আমাকে চিনবেন না, চেনেনও না। আর অপরিচিত কারও কাছে গিয়ে থাকতে চাই না। আমার কথা শুনেই, একটু উত্তেজিত তিনি। বললেন, আরে, আপনি আমার বন্ধু। আর ও আমার বন্ধু। আমার এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে থাকতে দেবে না, সাহায্য করবে না। এটা কোনো কথা? আর ও যদি আপনাকে সাহায্য না করে, ওর সঙ্গে তো আমার সম্পর্কই থাকবে না। ট্রেনে আমার সহযাত্রী, মূল সিলেট শহরে থাকতেন না। তার বাড়ি শহরের বাইরে। তাই উনি বারবার আফসোস করছিলেন, বাড়িতে তার জরুরি প্রয়োজন আছে বলে ঢাকা থেকে ফিরছেন। না হলে, আমার সঙ্গে সিলেট থেকে, আমার কাজটা করে দিতেন।
তার এমন আন্তরিক ব্যবহারে কোনো রকম বিপদের কথা মনেই আসেনি। শেষে রাজি হলাম। উনি বললেন, দাঁড়ান, একটি চিঠি লিখে দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ পরান হলে থাকতেন, তার সেই বন্ধু। নামটা কোনোভাবেই মনে করতে পারিনি পরে। আমার সেই অচেনা মানুষকে উদ্দেশ করে, তিনি চিঠি লিখবেন। আমার কাছে কাগজ চাইলেন। আবেদন ফরম আর সার্টিফিকেটের ফটোকপি ছাড়া আমার সঙ্গে কোনো কাগজই নেই। সঙ্গে আছে ট্রেনের টিকেট। ওটা তো স্টেশন থেকে বেরুনোর সময় দিয়ে দিতে হবে। কী করা যায়, আমার দু’জনে কাগজের সন্ধানে নামলাম। আশপাশের কোনো যাত্রীর কাছেই পাওয়া গেল না। ট্রেনের ভেতরে তিনি একটি খালি সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পেলেন। সেই প্যাকেটটাই ছিঁড়ে, তার সাদা অংশে, লিখলেন,‘পত্রবাহক আমার বন্ধু। ভর্তি ফরম জমা দিতে এসেছে। তুমি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করো।’ নাম-ঠিকানা দিয়ে দিলেন।
প্রায় সন্ধ্যার আগে আগে ট্রেন পৌঁছুল সিলেট স্টেশন। স্টেশনের বাইরে এসে আমাকে একটি রিকশা ঠিক করে দিলেন। চলতে শুরু করলো রিকশা, উনি দৌড়ে এলেন, রিকশাচালককে বললেন, ‘ড্রাইভার, উনি আগে আসেননি। ভালো করে দেখেশুনে নিয়ে যেও।’ আবার বিদায় নিলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, উনি দাঁড়িয়েই আছেন। রিকশা চলতে শুরু করলো। একসময় শহরে ঢোকার মুখে খুব উঁচু ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেলাম। এখানেই দেখলাম, ব্রিজে উঠতে রিকশাকে সহায়তা করার জন্য লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে তারা ঠেলে রিকশা উঠিয়ে দেয় ব্রিজে। ব্রিজের ওপর থেকে দেখা সিলেট। দুপাশ থেকে অন্ধকার জেকে আসছে। সবাই দেখি আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঘটনা কী? দেখি এক কোণে এক চিলতে চাঁদ। রমজানের চাঁদ, রমজানুল মোবারকের চাঁদ। মনেই ছিল না আমার। চাঁদ দেখে মনে হলো। প্রথম রোজা, প্রথম বাড়ির বাইরে একা। আমার মন খারাপের মধ্য দিয়েই রিকশা ছুটছে। একসময় আশপাশ থেকে বাড়ি-ঘর সরে গিয়ে বেরিয়ে এলো খোলা মাঠ। গা ছমছম করতে থাকে। রিকশাচালকের কাছে বারবার জানতে চাই, আর কতদূর? তিনি বলেন, দূর আছে। যত দূরত্ব বাড়ে, তত মনে হতে থাকে, এখানে আমি পরীক্ষা দিতে আসব না। এই শেষ আসা। অবশেষে সেই দূরও একসময় কাছে আসে। নেমে পড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে। ঠিকানা জেনে পৌঁছে যাই নির্ধারিত রুমে। যার কাছে আসা, তিনি রুমে ছিলেন না। তার রুমমেট আমাকে রুমে বসিয়ে তাকে খুঁজতে বেরুলেন। কিছু সময় পরেই উনি এলেন। চিঠিটা এগিয়ে দিলাম, লজ্জার মধ্যেই। তিনি পড়ার পরেই, আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জামা-কাপড় পাল্টে, ফ্রেস হওয়ার পর, ডাইনিংয়ে নিয়ে গেলেন। দু’জনে একসঙ্গে খেলাম। রোজা রাখব কি না জানতে চাইলেন, তাহলে সেহরির জন্য কুপন নিতে হবে।
আমি পরদিন সন্ধ্যার ট্রেনেই ফিরে যাব জানালাম। উনি বললেন, পরীক্ষা যে কদিন বাকি, ইচ্ছে করলে, তার কাছেও থাকতে পারি। পড়ালেখা করলাম, পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। আমার তখন বাড়ি ফেরার তাড়া। কোনো দিকে মন নেই। সকালে কোনোরকমে ভর্তির আবেদনপত্র জমা দিয়েই ছুট। দুপুরের আগেই স্টেশনে চলে এলাম। তার ক্লাস ছিল, তাই সকালেই বিদায় নিয়ে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ঢাকামুখী ট্রেন ছাড়লো।
ঢাকায় ফিরে, ওইদিনই বগুড়ার পথ ধরলাম। অনেক রাত যখন বাড়ি পৌঁছুলাম। আমাকে দেখে বাড়ির সবাই অবাক। আব্বা, বললেন, চলে এলে? ঘুরেফিরে দেখে আসতে। আবার কবে যেতে পারবে। আব্বা হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন, আমি ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাব না, আমার আর যাওয়া হবে না। আমি চুপ করে রুমে ঢুকে গেলাম।
অপরিচিত আমার জন্য পরম মমতায় যিনি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, তিনি দারা ভাই। আমাকে তার ঠিকানাও দিয়েছিলেন। সেই ঠিকানায় পরে দুই একটা চিঠিও লিখেছি। কোনো উত্তর পাইনি। হয়তো, তিনি চিঠিগুলো হাতেই পাননি। এতদিনে আমিও হারিয়ে ফেলেছি, নাম ছাড়া তার সব। অচেনা এমন মানুষের ভালোবাসায়, আমি মুগ্ধ। বুঝতে পারি, বেঁচে থাকা সত্যিই সুন্দর।
চলবে…