বাদশা কাকু ও প্রিয় শেফালী
চিঠির আবেদন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন দাপ্তরিক চিঠি ছাড়া ব্যক্তিগত চিঠির ব্যবহার আমাদের জীবনে নেই। অথচ একসময় কি ভীষণভাবে আমাকে ছেয়ে রেখেছিল এই চিঠি। কত কত চিঠি যে লিখেছি, কত কত চিঠি যে পেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন অসংখ্য মানুষের কাছে আমি চিঠি লিখেছি। চিঠির খাম ডাক বাক্সে ফেলে—তার ফিরতি খামের জন্য প্রতীক্ষা করেছি। ডাকহরকরার জন্য অপেক্ষা করেছি। সেই অনন্ত অপেক্ষার প্রহর শেষে দুপুরের ভাত ঘুমের সময়ে বাসায় আসতো ডাকহরকরা। যে ডাকের জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছি, সেই ডাকটি শোনার পর আর এক মুহূর্তও দেরি না। খামটি হাতে নিয়ে, যত্ন করে কাঁচি দিয়ে একমাথা কাটতাম, যেন খামটি নষ্ট না হয়ে যায়। পড়া শেষে আবার ওভাবেই খামে ভরে রেখে দিতাম। খামের উভয় পাশে ডাক বিভাগের ছাপমারা মোহরের দিকে থাকত বিশেষ দৃষ্টি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিলিয়ে দেখতাম ডাকবাক্সে ফেলার তারিখের জন্য বিলি হওয়ার দিনের সিলমোহর।
এই সেদিনও জেলা শহরে—উপজেলা, খোদ রাজধানীতেও বিভিন্ন মোড়ে এক সময় লাল ডাকবাক্স চোখে পড়তো। এখন আর চোখে পড়ে না। ডাকবিভাগের অফিসের সামনে ছাড়া রাজধানীতেও আর নেই ডাকবাক্স। রাজধানীতে তো পাশাপাশি তিনটি ডাকবাক্স থাকত। একটি ঢাকার ভেতরের জন্য, একটি দেশের ভেতরে আর একটি দেশের বাইরের চিঠির জন্য।
এই চিঠির সঙ্গে আমার কত ঘটনা, কত স্মৃতি যে জড়িয়ে রয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে মাতামহী দেখালেন মতামহের কাছে লেখা আমার প্রথম চিঠিটি। সবে লিখতে শিখেছি। কাঁপা-কাঁপা অনভ্যস্ত হাতের লেখায় মতামহীকে লিখেছিলাম, আমার ভালো না লাগার কথা, নিঃসঙ্গতার কথা। লিখেছিলাম, তিনি অথবা আমার মাতুলদের কেউ এসে যেন আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যায়। জানি না, নিজে থেকেই এই আকুলতা প্রকাশ পেয়েছিল, নাকি আমার মায়ের আগ্রহে, তার শিখিয়ে দেওয়া কথামালা—সাজিয়ে দিয়েছিলাম। মতামহের কাছে লেখা এই চিঠির বয়স—প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। আমার লেখা প্রথম চিঠিটি আজও সংরক্ষিত আছে, এ আমার আনন্দের। মাতামহ যত্ন করে আমার লেখা চিঠিটি রেখে দিয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত ডায়েরির ভেতরে সযত্নে তুলে রাখা চিঠিটি তিনি চলে যাওয়ার পর রেখে দেন আমার মাতামহী। মতামহ কেন সেদিন আমার চিঠিটি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, আমি জানি না। আর মাতামহী হয়তো—আমার চিঠির সঙ্গে আঁকড়ে ধরে আছেন মতামহেরও স্মৃতি। মাতামহ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন দশ বছরেরও বেশি সময় আগে। তবু তার স্মৃতি টাটকা আমার কাছে, সেসব বলব অন্যক্ষণে। তবে আজ চিঠি নিয়েই বলি।
চিঠির প্রসঙ্গ আসলেই মনে আসে প্রেমের কথা। কারণ চিঠির সঙ্গে প্রেমের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। আমাদের সময়ে যেমন, তেমনি আমাদের আগেও প্রায় প্রত্যেকেরই ঝুলিতে রয়েছে প্রেমপত্র লেখার অভিজ্ঞতা। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রেমপত্র লেখা অথবা পাওয়ার অভিজ্ঞতাবিহীন মানুষ পাওয়া দুর্লভ মনে হয়। এখন তো জীবন থেকে চিঠিই হারিয়ে গেছে, সেখানে প্রেমপত্র লেখার মানুষ খুঁজে পাওয়া তো আরও ভার। প্রেমপত্র লেখা, প্রেমপত্র পাওয়া, সবার চোখ এড়িয়ে প্রেমপত্র লুকিয়ে রাখার যে লুকোচুরি খেলা—এও রোমাঞ্চকর উপন্যাসের মতোই। আমার জীবনে প্রথম প্রেমপত্র দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় লিখেছিলাম। আমরা থাকতাম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। বাবার চাকরির সুবাদে সেখান থেকে শেকড় তুলে চলে এলাম বগুড়া দুপচাচিয়া নামের উপজেলাটিতে। সেখানেই ভর্তি হলাম দ্বিতীয় শ্রেণীতে। প্রথমে যে বাড়িটাতে থাকতাম। তার পাশে ছিল একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরি। সঙ্গে লাগানো বিরাট এক তালগাছ। গ্রীষ্মের দুপুরে ধুপধাপ করে পাকা তাল পড়তো বিস্কুট ফ্যাক্টরির টিনের চালে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি লেগে যেত ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য। আশপাশের সব বাড়ি থেকে আমরা ছোটরা দৌড়ে বেরুতাম, সবার আগে তালটি কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই আমাদের কারও ভাগ্যে তালটি জুটতো না। ফ্যাক্টরিরই কেউ না কেউ পেয়ে যেত সেটি। আর আমরা হতাশ মনে ঘরে ঢুকে পড়তাম। তাল কুড়ানোর আগ্রহের সঙ্গে মাঝে মাঝে ওই ফ্যাক্টরি থেকে পাউরুটি অথবা বিস্কুট কিনে খাওয়ার জন্যও—ওখানে যারা কাজ করতেন, তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। সবাইকে কাকু বলতাম। তাদেরই একজন—বাদশা কাকু, একদিন স্কুল থেকে ফিরছি, আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, ভাতিজা, আমার একটা কাজ করে দিবা। কী কাজ জানতে চাওয়ার আগেই বলে দিলাম, হুম করে দিব। সঙ্গে খুব করে বললেন, কাউকে বলব না তো? তাতেও সায় দিলাম, তখন উনি আমাকে দুইটা বিস্কুট দিলেন, আমি নিতে না চাইলেও বলেলন, আরে খাও, সমস্যা নাই। বাড়িতে জানলে বকা দিবে বলার পরেও জোর করে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, কাল তো তোমার স্কুল ছুটি, সকালের পড়া শেষ করে, ফ্যাক্টরিতে এসো।
পরদিন সকালের পরা শেষ করে যখন খেলার জন্য বাইরে বেরিয়েছি, দেখি উনি ফ্যাক্টরির গেটেই দাঁড়িয়ে। আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন, ভেতরে। ফ্যাক্টরির একপাশের রুমে বেশ কয়েকটি চৌকি বিছানো। ওখানে সবাই থাকে, তারই একটিতে আমাকে বসতে বলে, উনি চলে গেলেন। আমি ঘুরে ফিরে রুমটি দেখছি, কিছু পরেই তিনি একহাতে একটি, তখনকার সময়ের দুই টাকা দামের খাতা ও ইকনো বল পেন নিয়ে এলেন। আশাপাশ দেখে—আমাকে বললেন, আমাকে একটা চিঠি লিখে দাও। কিন্তু কাউকে বলো না যেন। আমি আবারও ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিয়ে হাত বাড়িয়ে খাতা ও কলম নিলাম। কলমের মাথা খুলে বললাম, বলেন কী লিখব? উনি বলতে শুরু করলেন, লিখো, প্রিয় শ্যাফালি। আমি বললাম, প্রিয় শেফালী। আমি যতবারই বলি শেফালি, উনি বলেন শ্যাফালি। তখন তো আর শ্যাফালী বানান জানি না, তাই আমার মতো করেই শেফালী বানান লিখলাম। তারপর তিনি মনের কথাগুলো বলে যেতে থাকলেন, আমি আস্তে ধীরে রয়ে সয়ে লিখতে থাকলাম, এক বাক্য কয়েকবার শুনে শুনে। আজ এতদিন পরে— এই চিঠির শুধু প্রিয় শেফালী শব্দটিই মনে আছে। প্রিয়জনকে লেখার সময় যে প্রিয় সম্বোধন করতে হয়, সেটিও আমার প্রথম শেখা বাদশা কাকুর কাছে। বাদশা কাকুর হয়ে লেখা অদেখা অজানা এক শেফালীর কাছে সেই আমার প্রথম প্রেমপত্র। সেই আমার আবেগ ঢেলে দেওয়া প্রথম প্রেম। বাদশা কাকুই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শেফালী ফুলের সঙ্গে। তাই হয়তো ‘প্রিয়’ শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে শেফালী ফুলও প্রিয় হয়ে উঠেতে থাকে।
বাদশা কাকু কোথায় আছেন? তিনি কি তার প্রিয় শেফালীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন? আজ আমি জীবনের মধ্য গগণে দাঁড়িয়ে, বাদশা কাকু হয়তো এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মানুষ—তার শেফালীরও হয়তো চুলে পাক ধরেছে, স্বামী-সন্তান-নাতী-নাতনির সঙ্গে সুখের সংসার উপভোগ করছেন। হয়তো তার আর কোনো অবসর নেই, হয়তো বাদশা কাকুর কথা মনেও নেই। অথবা বাদশা কাকুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। দুটি মানুষ—যাদের একজনকে আমি দেখিনি, অন্যজন—যার আবেগকে আমি কাগজের পাতায় ধরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম—তাদের কথা মনে পড়লো। যেখানেই থাকুন—বাদশা কাকু ও তার প্রিয় শেফালী ভালো থাকুন।
চলবে…