কী নাম দেব, বলুন তো
আমি এই লেখার কী শিরোনাম দেব? কিভাবে বলবেন? লেখা তো শুরুই করিনি। সুতরাং এমন প্রশ্ন নিশ্চয় অবান্তর। তাই আগে লেখা শেষ হোক। তারপর যে বিষয়বাসনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা বিবেচনা করে একটি শিরোনাম দেওয়া যাবে। তাই নয় কি? এবার তাহলে মূল কথায় আসা যাক।
ফেসবুকের কল্যাণে মানুষের অভিমত পাওয়া খুব সহজ। আবার বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম পাওয়া যায় না। আমরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ফ্রেন্ডদের অভিমত কামনা করি। কিন্তু সেটা কতটা যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত, তা ভেবে দেখি না। ‘আমার বউ দেখতে কেমন?’, ‘আমার সন্তান এইমাত্র পৃথিবীতে এলো, ওর একটা নাম দিতে চাই!’ এছাড়া কবরের ওপর সেলফি, রোগির সঙ্গে সেলফি, কোরবানির পশুর সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করে ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি অনেকেই। এমন হাজার হাজার বিষয় শেয়ার করছি বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো কখনো ব্যাপারটা এমনও হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সঙ্গম করার অনুভূতিও পারলে শেয়ার করতেন যেন কেউ কেউ। বিষয়গুলো আমার কাছে বরাবরই হাস্যকর মনে হয়েছে।
ব্যাপারটা এমন হলেও আজ আমার আলোচনার বিষয়টি একটু ভিন্ন। যদিও ফেসবুককেন্দ্রিক, এতক্ষণ তো বললাম আমজনতার কথা। একটু গভীরে গিয়ে দেখলাম, বোকামিটা কবি-লেখকরাও করছেন। তারা তাদের প্রচারের মাধ্যম হিসেবে হয়তো বেছে নিয়েছেন পথটি। তাদের এই আহ্বানের কতটুকু প্রতিফলন ঘটে তা কিন্তু আর পাঠকের জানার উপায় থাকে না। কোনো এক কবি স্ট্যাটাস দিলেন, ‘একটি কবিতার বই করতে চাই। কী নাম দেব বলুন তো?’ স্ট্যাটাসের নিচে হাজার-হাজার কমেন্ট জমা হলো। কবি কি সেখান থেকে কোনো নাম বেছে নিলেন? কিন্তু কিভাবে? তার পুরো কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে ওই নামের কোনো সামঞ্জস্য আছে কি না—ওই নামটি তার গ্রন্থের প্রতিনিধিত্ব করে কি না? এটা ভাবার বিষয় বটে। আবার অনেকে চারটি-পাঁচটি নাম উল্লেখ করে দেন। বন্ধুরা সেখান থেকে একটি নাম পছন্দ করেন। সেটা হয়তো কিছুটা যুক্তিসঙ্গত। ধরে নিলাম, আপনার চারটি নাম মাথায় এলো। আপনি নির্ধারণ করতে পারছেন না যে, কোনটি বেছে নেবেন। তাই আপনি সবার কাছ থেকে পরামর্শ চাইলেন। কিন্তু যে নামটি নির্বাচিত হলো, সেটি হয়তো অপেক্ষাকৃত অন্য নামগুলোর চেয়ে দুর্বল। কারণ গণভোটের কোনো কিছুই শিল্পসম্মত হতে পারে না। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কেননা কেউ কোনো দিনই পুরো পাণ্ডুলিপি না পড়ে বলবে না যে, এই নামটি নির্বাচন করুন।
আমাদের দেশে কোনো পরিবারে সন্তান জন্ম নিলে পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি নবজাতকের নামকরণ করেন। তার কারণ, কোনো আত্মীয়ের নামের সঙ্গে যেন মিলে না যায়। কিংবা পারিবারিক কোনো ঐতিহ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে না যায়। নামকরণও শৈল্পিক ও শ্রুতিমধুর হতে হয়।
তেমনি সাহিত্যকর্মেরও নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামকরণের মতো জটিল কাজটি আমজনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যর্থতাই প্রমাণ করতে চান আপনি। আপনি স্রষ্টা। সৃষ্টির নাম কী হতে পারে, তা আপনার চেয়ে আর কারও ভালো জানার কথা নয়। আপনি ধার্মিক ও মুসলমান হলে, আপনার সন্তানের নাম রাখার দায়িত্ব যদি কোনো হিন্দুর হাতে দেন, তাহলে সে নাম রাখবে ‘গোপাল’। আপনি কি তা মেনে নেবেন? তবে কেন এই বোকামি কনেন। না কি নিজের প্রচার বাড়াতে এ পথ বেছে নেন? সেটা হলে ভিন্ন কথা। এমনটি যারা করছেন, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, আপনারা সাহিত্যের শত্রু। আপনারা সাহিত্যের বারোটা বাজাচ্ছেন।
যুগে যুগে নামগুলোই যেন ইতিহাস হয়ে আছে। ‘মহাভারত’, ‘রামায়ণ’, ‘বিষাদসিন্ধু’, ‘লাইলি মজনু’, ‘দেবদাস’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘লালসালু’ প্রভৃতি নামের কারণেই মানুষের স্মরণযোগ্য হয়ে আছে। গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানানসই নাম না হলে আবেদন কমে যায়। ফলে নামকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন হতে হয়।
স্কুলের পরীক্ষায় আমাদের সময় একটা কমন প্রশ্ন থাকতো—‘নামকরণের সার্থকতা বিচার করো’ । তো ফরমেট একটা আমাদের মুখস্থ ছিলই । সে যে নামকরণই হোক, আমাদের লেখায় সেটা সার্থক নামকরণ হয়ে যেত। তবু এ ধরনের গতানুগতিক ধরাবাঁধা প্রশ্নের একটা ভালো উদ্দেশ্য ছিল । উদ্দেশ্য একটাই—নামকরণ হতে হবে যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক ।
কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র একসময় বলেছিলেন, ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে সুন্দর। এ কথা সুগন্ধী কুসুমের ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত হলেও সাহিত্যের আঙিনায় এর যথার্থতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। বস্তুত, সাহিত্যকর্মের নামকরণ এক পরম গুরুত্ববাহী বিষয়। শিরোনামের দর্পণেই আভাসিত হয়ে ওঠে সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু ও মূর্ছনা।’ রবীন্দ্রনাথ নামকরণকে পরম গুরুত্ব দিতেন। যতক্ষণ না সেরা শিরোনাম খুঁজে পেতেন, ততক্ষণ চলত তাঁর নিরলস গভীরতম অন্বেষণ।
এখন আপনি যদি বলেন, ‘নামে কী আসে যায়, কাজেই পরিচয়’, তবে বলব, সবক্ষেত্রে কথাটা ঠিক নয়। নামকরণের আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। তবেই নামটি যথার্থ হয়।
১. গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নামের সামঞ্জস্য।
২. উচ্চারণে সহজবোধ্য হয় এমন নাম।
৩. নাম শুনেই পড়ার আগ্রহ জন্মায়, এমন নাম।
৪. নামের মধ্যে বিষয়ের সারমর্ম থাকতে হবে।
৫. গ্রন্থের নাম হতে পারে প্রধান চরিত্রকেন্দ্রিক।
একটু লক্ষ্য করুন- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি সহজ কথা। বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিতাস নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এর কাহিনি। কিংবা ‘লালসালু’ উপন্যাসে একটি সালু কাপড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মজিদের কর্তৃত্ব, প্রতিপত্তি ও জৌলুস। কখনো কখনো একটি শব্দেও যথার্থ নাম খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন: মানসী, গীতাঞ্জলী, ক্ষণিকা, সঞ্চিতা, অগ্নিবীণা প্রভৃতি। কখনো কখনো গল্প, উপন্যাস বা কাব্যের প্রধান চরিত্রের নামে নামকরণ করা হয়। তাতেও ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। আপনার গ্রন্থের নামটি যদি সহজবোধ্য না হয়, তাহলে পাঠক বেশিদিন মনে রাখতে পারবেন না। কারণ মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। স্মরণযোগ্য নাম বাছাই করুন।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখান থেকেই আলোচনা শেষ করব। আপনাদের অহেতুক জ্ঞান দেওয়া মূল উদ্দেশ্য নয়। আপনারা যারা বন্ধুদের কাছে নাম বাছাইয়ের আহ্বান জানান; তারা পুরো পাণ্ডুলিপিটা আগে পোস্ট করবেন। পাঠক তা পড়ে নাম বাছাই করবে। অহেতুক প্রচার বাড়িয়ে কী লাভ? প্রচারের পেছনে সময় নষ্ট না করে সৃষ্টির পেছনে ছুটুন। সৃষ্টিই আপনার প্রচারের জন্য যথেষ্ট। তাই নিজের বইয়ের নামকরণ নিজেই করুন। চলবে…
সাহিত্যের সম্প্রতিক শত্রুগণ: ৪॥ পথিক বাঙালি