কবিতার রয়েছে সর্বগ্রাসী এক আবেদন, যা কবি তো বটেই, পাঠককেও হামেশা আনমনা করে তোলে। এই শক্তি বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে কেবল প্রকৃত ‘কবিতা’র। কবিতার মতো দেখতে সাজানো বাক্যাবলিতে নয়। আবেগঘন বক্তব্যকে যারা কবিতা চালিয়ে দেন, আর ওই জড়ভরত না পড়ার কারণে যারা পাঠককে দোষ দেন, তারা কবি নন, কবিতার শত্রু। তারা অন্য কোনো হীনউদ্দেশ্যে এসে কবিতার রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন। নিজেদের অক্ষমতাকে কবিতাকারে প্রকাশ করতে গিয়ে পড়ে গেছে ‘কবি’খ্যাতির মোহে। কিন্তু কবি হওয়ার মতো তাদের ন্যূনতম পুঁজিও নেই। না আছে পাঠপ্রস্তুতি, না আছে বিশুদ্ধ কবিকল্পনা। এ কারণে ছন্দ-প্রকরণ-আঙ্গিক না জেনে লিখতে এসেছেন। এ যেন সাঁতার না শিখেই সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া! সমুদ্রে নেমে তারা ডুবে মরেন আর দোষ দেন সমুদ্রের। যারা সাঁতার না শিখে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাদের যেমন একমাত্র পরিণতি মৃত্যু, তেমনি ছন্দ-প্রকরণ-আঙ্গিক না জেনে কবিতা লিখতে আসা অপ্রস্তুতদের একমাত্র প্রাপ্য পাঠকের শীতল উপেক্ষা!
সে যাই হোক, অ-কবিতার অতি প্লাবনের যুগেও প্রকৃত কবিতা রচিত হচ্ছে। হচ্ছে নীরবে, দৈনিকের সাহিত্যপাতা, ছোটকাগজ কিংবা সরাসরি বইয়েও। কোনো কোনো কবি কখনোই কোনো গণমাধ্যমে কবিতা প্রকাশ করতে দেন না। তাঁরা সরাসরি গ্রন্থভুক্ত করতেই স্বস্তি বোধ করেন। এ রচনার মুখ্য বিষয় ওপরি বর্ণিত বিষয়গুলো নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো গত দশ কি বারো বছরে যারা কবিতা রচনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন, তাদের সৃষ্টির গহনে ডুব দেওয়া। তুলে আনা তাদের কিছু অমেয় পঙ্ক্তি। এসব পঙ্ক্তি পাঠ শেষে নিজের উপলব্ধির সঙ্গে অন্যদের ভাবনার মিল খুঁজে দেখা।
তবে, তার আগে বলে নেওয়া ভালো, এ সময়ে যারা প্রকৃত কবিতা চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন, তাদের বেশির ভাগই কম পরিচিত। বিপরীতে অ-কবিদের দাপটে মিডিয়ায় থরহরিকম্প দশা। এ সময়ের কবিতা পড়তে এসে দেখি—কারও কারও কাছে শৃঙ্খলা অসহ্য, তারা মনে করে শৃঙ্খলায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে। তারা বিশৃঙ্খলাকেই স্বাধীনতা মনে করে। বিপরীতে কেউ-কেউ শৃঙ্খলাকেই মানেন স্বাধীনতা। এর ভেতরেই তারা মনের ভাব প্রকাশ করেন স্বাধীনভাবে, সুনিয়ন্ত্রিত-সুচিন্তিতভাবেই। শেষোক্তরা মূলত লিখতে আসেন প্রস্তুতি নিয়ে। তাই তাদের রচনায় থাকে বক্তব্যের প্রাঞ্জলতা, যুক্তির শৃঙ্খলা। কল্পনার নিয়ন্ত্রণ।
আর যারা নিয়মকে নিগড় মনে করেন, তারা সহজ-সরল বিষয়কেও নিজেদের কর্মদোষে বিশৃঙ্খল করে তোলেন। তাদের কারণে সমাজে সুরুচের অভাব দেখা দেয়। সমাজে যখন সুরুচির অভাব দেখা দেয়, তখন নেমে আসে ঘোর অমানিশা। মানুষের প্রতি মানুষের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি লোপ পেতে থাকে। রুচিহীনরা কখনোই কাউকে সম্মান দেখাতে পারেন না, বিষয়টি তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। ফলে তারা সময়-সুযোগ পেলেই অন্যকে অপমান করেন, তাদের কথা-আচরণ হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না। বরং এই নিয়ে তারা বেশ আত্মগর্বে বুক ফুলিয়ে চলেন। এই প্রবণতা যদি কবিযশপ্রার্থীদের মধ্যে থাকে, তাহলে বিষয়টি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ। নিজেদের অক্ষমতাকে তারা স্বীকার করেন না; উল্টো নিজেদের অজ্ঞতাকেই মনে করেন শিল্পের রীতি। প্রয়োজনে নিজেদের অন্তঃসার বাক্যসর্বস্ব রচনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য শুরু করেন সংঘ গঠন, পুরস্কার দেওয়া-নেওয়ার খেলা। তারা জানেন না—দলবদ্ধ হয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর সমিতি চলে, সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও চলে, কিন্তু সাহিত্য? নৈব নৈব চ; এটি একলা চলার কাজ, একলা ধ্যানের কাজ। অথচ এ সময়ের ব্যর্থরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কবি, সংঘের কবি, ইজমের কবি হিসেবে পরিচিত করে তোলার অপপ্রয়াস চালান। যদিও এসব অপপ্রয়াস সময়ের উত্তেজনা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে মিশে যায়।
অপচেষ্টাকারীরা তা বুঝতে বা মানতে চান না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শৈশবের একটি ঘটনা। আমার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ডাক্তার, একজনের মাস্টার, একজনের ঈমাম। পরবর্তী জীবনে ডাক্তার হয়েছে রাখাল, মাস্টার হয়েছে মাছের আড়ৎতার। ঈমাম চালায় রিকশা। (মাস্টার, ডাক্তার, ঈমাম, রাখাল, শিক্ষক, মাছের আড়ৎতার, রিকশাচারকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক)। আসলেই শখের বসে বাবা-মা সন্তানের যে নাম রাখেন, প্রায় দেখা যায় সন্তানের নামের সঙ্গে কাজের মিল থাকে না।
এ সময়ে এসে দেখি—অনেকেই শখের বসে কিছু কিছু বাক্য-স্তবক লেখেন। লিখে আবার সেগুলোর পরিচয় দাবি করেন কবিতা। আবার ওই সব তথাকথিত ‘কবিতা’ দিয়ে বইও প্রকাশ করেন। (সেসব বই নাকি আবার দশ দিনে হাজার কপিও বিক্রি হয়! অবশ্যই বিক্রির বিষয়টি তারা নিজেরাই ঢোল পিটিয়ে জানান দেন)। তাদের কেউ কেউ আবার আমাকে ইনবক্সে তাদের লেখাগুলো পাঠান, বলেন পড়ে যেন মন্তব্য করি। কী মন্তব্য করব ভাবতে ভাবতে দিন শেষ হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেকের রচনারাজি পড়লে আমার শৈশবের ওই তিনবন্ধুর কথা মনে পড়ে। যারা নামের সঙ্গে কাজের সাদৃশ্য রাখতে পারেননি। তাদের উদ্দেশে বলতে হয়—দুঃখিত! আপনাদের সামনে ‘কবিতা’ লেখা ছাড়া আরও অনেক মহৎ কাজ আছে। সেসব যদি করেন, তাহলে আপনাদের পরিবার, সমাজ উপকৃত হবে। পণ্ডশ্রম করে সময় নষ্ট করছেন। পরে দোষ দেবেন সমাজের। সবাই আপনাদের ‘কবি’-‘কবি’ বলে মুখে ফেনা তুললেই কবি হয়ে যাবেন না। কবি অন্য সত্তা, অন্য বস্তু। যা কখনো আপনারা বুঝতেই পারবেন না। কারণ জন্মের পরই আপনাদের বাবা-মা শখ করে নাম রেখেছেন ডাক্তার, মাস্টার, ঈমাম। শখের নামের ডাক্তার-মাস্টার-ঈমামদের নাম সতীর্থরা বিকৃত উচ্চারণে ডাকে ‘ডাক্তরিয়া’, ‘মাস্টরিয়া’, ‘ঈমাইম্মা’। আর তারা পরিণত হন—রাখাল, মাছের আড়ৎদার কিংবা রিকশা শ্রমিকে। অতএব কবিযশ প্রার্থীগণ পদের জোরে, টাকার জোরে, মিডিয়ার জোরে, ফেসবুকে সেলিব্রিটি হওয়ার জোরে যারা কবি হতে চান, সত্যিকার অর্থে যদি কবিতার ছন্দ-প্রকরণ-আঙ্গিক না শেখেন, তাহলে একদিন আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে চরম পরিহাস!
এদিকে, পদের জোরে, মিডিয়ার জোরে, ফেসবুকে সেলিব্রিটি হওয়ার জোরে যারা কবি হতে এসেছেন, তারা দাবি করেন, যত বড় কবি, তত বেশি বই বিক্রি! এখন যার বই বেশি বিক্রি হয়, তিনি নিজেকে বড় লেখক মনে করেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখা ভালো, বড় লেখক হওয়ার সঙ্গে বই বিক্রির সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। তবে এ কথাও সত্য, কখনো কখনো বড় লেখকের বই বাজারে বেশি কাটে, কখনো কখনো গণরুচির জোগানদাতার বই। বই বেশি বিক্রি হলেই যে বড় লেখক হয়ে গেলেন, তা কিন্তু নয়। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই যদি বিশ কপি বিক্রি হয়, তো কাসেম বিন আবু বাকারের (ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক) বই বিক্রি হয় দুই লাখ কপি।
সাহিত্যের মান বিচার যারা করেন, উপন্যাস নিয়ে যারা আলোচনা-সমালোচনা করেন, তাদের আলোচনার একটি বড় অংশ ইলিয়াস-হাসান দখল করে রাখলেও, কোনো সমালোচনামূলক প্রবন্ধে কাসেম বিন আবু বাকারের নামও উচ্চারিত হয় না। ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো আশঙ্কা (সম্ভাবনা) নেই। আসলে গণরুচি আর সাহিত্য রুচি দু’টি আলাদা বিষয়। বিষয়টি আমরা যত দ্রুত বুঝব, ততই মঙ্গল।
এদিকে, এ সময়ে এসে অনেকেই কেবল কবিতা লিখতে চান, কবিতাবিষয়ক কোনো গদ্য রচনা করতে গেলে তাদের নানা রকম টালবাহানা শুরু হয়। তারা আসলে কবি তো নয়ই, কবিতাবান্ধবও নয়। কবিতাবিদ্বেষী। তারা তো গদ্য লিখতে জানেনই না, পরন্তু যারা কবিতার পাশাপাশি কবিতাশ্লিষ্ট গদ্য রচনা করেন, তাদের উদ্দেশে বলেন—’ব্যর্থ কবিরাই ভালো সমালোচক হয়’। কথাটা যে ষোলো আনাই স্টান্টবাজি থেকে বলা, তার প্রমাণ ভুরি ভুরি দেওয়া যাবে। আসলে বড় কবি বড় সমালোচকও। শুধু তাই নয, বড় কবিরাই বড় গদ্যকারও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, টিএস এলিয়ট, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, মোহিত লাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, হাসান হাফিজুর রহমান, শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আনেয়ার প্রমুখ কবির দিকে তাকালেই আমার বক্তব্যের প্রমাণ মিলবে। যারা বলেন, ‘ব্যর্থ কবিরাই ভালো সমালোচক’, তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন—উল্লিখিত কবিদের মধ্যে কে কতটা ব্যর্থ কবি?
সম্প্রতি ব্যর্থ লিখিয়েদের বলতে শোনা যাচ্ছে—তারা নাকি ছন্দ মানেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা ছন্দ জানেনই না। তাদের অনেকেই ছন্দ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় মূলত অনুপ্রাস নিয়েই কথা বলেন। তারা ছন্দ বলতেই বোঝেন অন্ত্যমিল বা অনুপ্রাসকেই। এই অন্ত্যমিল তাদের ভালো লাগে না বলে দাবি করেন। এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমিও একমত, অন্ত্যমিল সবসময় ভালোও লাগে না। এছাড়া অন্ত্যমিলের কারণে অনেক সময় বিরক্তও লাগে। কবিতারও মানহানি ঘটে মাঝেমাঝে। কিন্তু কথা হলো—অন্ত্যমিল ভালো লাগে না বলে ছন্দ উচ্ছেদের আন্দোলনে নামতে হবে কেন? ছন্দের সঙ্গে অন্ত্যমিলের সম্পর্ক কী? উত্তর একটাই—জগতে যেমন বৈজ্ঞানিক সত্য নিয়ে তিরস্কার করার লোকের অভাব নেই, তেমনি নির্দিষ্ট বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন না জেনেও, না মানার ভান ধরার মতো ভণ্ড-ইতর লোকেরও অভাব নেই। বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করার মতো দুর্মতিঅলাদের সঙ্গে শিল্পের নিয়ম-কানুন অস্বীকারকারীদের কোনো তফাত নেই। এই নিয়মবিদ্বেষীদের দেখলেই মনে পড়ে: জগতে জ্ঞান সীমাবদ্ধ, মূর্খতা সীমাহীন।
আমাদের মনে রাখা উচিত প্রতিটি কাজের, প্রপঞ্চের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। আমাদের সেটাই মেনে চলা উচিত। দুর্লোভ বস্তুকে সহজলভ্য করা মহা-অন্যায়। তাতে যে সহজে পেয়ে যায়, সে ওই বস্তুর কদর বোঝে না। উল্টো অবহেলা-তাচ্ছিল্যে মহার্ঘ জিনিসকে তুচ্ছ-কীটের স্তরে এনে বিবেচনা করে। অর্থাৎ সেই পুরনো বাণীই সত্য—‘বানরের গলে দিলে মুক্তার হার/ ফল ভেবে দাঁতে কেটে করে চুরমার।’ তাই বিবেকবান মানুষ মাত্রই গুণাগুণ বিবেচনায় বস্তুকে উপযুক্ত স্থানেই রাখেন। বস্তুর যেমন স্থানিকগুরুত্ব রয়েছে, তেমনি মানুষেরও। ব্যক্তিকে তার মেধা, প্রতিভা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতানুযায়ী নিজের সমাজ-আসন নির্বাচন করতে হয়। নিজের চেয়ে নীচুজাতের সমাজ মূল্য বোঝে না, উঁচুসমাজ তাকে গ্রহণ করে না। এ থেকে একটা সহজ সমীকরণ করা যেতে পারে—যে সমাজে গুণীর কদর জানে না, সেখানে গুণীকে সহজলভ্য করা মহাপাপ। এ কারণেই শিল্পের নিয়মকানুনকে সহজ না করে আরও কঠিন করা উচিত। যারা শিল্পের কঠোর সাধনায় উত্তীর্ণ হবেন, কেবল তাদেরই কাল-মহাকাল মনে রাখবে। বাকিদের ছুড়ে ফেলবে ভাগাড়ে। কোনো মিডিয়া, ক্ষমতার জোর কিংবা সেলিব্রিটির ঝলকই তাদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
ধান ভানতে শিবের গীত দীর্ঘ হয়ে গেল। এবার আসি মূল কথায়। উল্লিখিত এসব নেতিবাচক দিক থাকার পরও গত পনের কি বিশ বছরে বেশ কয়েকজন সত্যিকার কবির আবির্ভাব ঘটেছে। তারা লিখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ পঙ্ক্তিমালা। এই নিবন্ধের মুখ্যবিষয় তাদের সেই রচনারাজি। চলবে…