লেখক সম্মানী ও উদাসীনতা
‘লেখালেখি বাদ দে। নইলে না খাইয়া মরতে হইবো।’ এমন কথা হরহামেশাই শুনতে হয়। কারণ লেখালেখিটা বাংলাদেশে পেশা হিসেবে স্বীকৃত নয়। ‘লিখে কেউ বড় লোক হয় না।’ এমন অপবাদে মেয়ে বিয়ে দিতেও চান না বাবা-মা। এ রকম অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে লেখকদের নিয়ে। তবে এখন লেখকরাও সচেতন হয়েছেন। এমনকি চল্লিশ একর জমির ওপর বিশাল পল্লিও গড়েছেন লেখকরা।
লেখকরা তাঁদের সম্মানী আদায় করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তবু প্রাচীন ধ্যান-ধারণা, সমস্যা রয়ে গেছে। সব লেখকই সম্মানী পান না। এর কিছু কারণও অবশ্যই রয়েছে। অনেকেই বিনাপয়সায় লিখে দেন। শুধু লেখা প্রকাশিত তারা হলেই খুশি। তাদের সম্মান ও সম্মানী দরকার নেই। কারণ তাদের টাকা-পয়সার অভাব নেই। এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত যারা:
১. সরকারি চাকরিজীবী
২. পারিবারিকভাবে বিত্তশালী
৩. শিল্পপতি
৪. প্রবাসী
৫. শখের লেখক
৬. বিত্তশালীর স্ত্রী
এ ধরনের লেখকরা শুধু নিজের নাম প্রকাশের জন্যই লেখেন। তাদের মাথায় সম্মানী নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে না। ফলে যারা সিরিয়াস লেখক বা লেখালেখির জন্য মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন, থাকেন উপেক্ষিত। একসময় সম্মানী না পেয়ে হতাশায় ডুবে যান।
লেখকদের কথা বাদ দিলেও পত্রিকার প্রকাশক বা সম্পাদকেরও এ ক্ষেত্রে হঠকারিতা বা উদাসীনতা রয়েছে। অনেক পত্রিকাই লেখককে সম্মানী দিতে নারাজ। তাদের ধারণা, বাংলাদেশে এখন লেখকের অভাব নেই। টাকা ছাড়াই বহু লেখা ই-মেইলে বা ডাকবাক্সে জমে থাকে। একটু ঘষামাজা করে তুলে দিলেই হলো। এমন অবস্থায় শুধু লেখালেখিকে যারা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ভাবতে চান, তারা নিরাশ হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে কয়েক শ্রেণির সম্পাদকের সন্ধান পাই আমরা:
১. এমন সম্পাদক যিনি লেখকের সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে লেখা আদায় করেন
২. যারা লেখকের কাছ থেকে উপঢৌকনের বিনিময়ে লেখা প্রকাশ করেন
৩. এমন সম্পাদক; যিনি সুন্দরী লেখকের প্রতি আকর্ষিত থাকেন
৪. যারা লেখকদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকেন
৫. পত্রিকার প্রচার সংখ্যার জারিজুরি দিয়ে
৬. যে সম্পাদকদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা বা সম্মাননা দেওয়া হয়
লেখক ও সম্পাদক উভয়ের মধ্যেই সাহিত্যের দুশমনগণ বিরাজ করছেন। এমন মীর জাফরদের জন্য সাহিত্যের এই দুর্যোগ। তবে এত হতাশার মাঝেও আশার কথা অবশ্যই আছে। যদিও আজ আমি আশার বাণী নিয়ে হাজির হইনি।
একটি কথা মনে রাখুন, সবাই হুমায়ুন আহমদ নন। সবাই লেখার পাশাপাশি নির্মাতা বা চিত্রশিল্পী নন। ফলে শুধু লিখেই যাদের সংসার চলবে-তাদের প্রতি তো সম্পাদককে সদয় আচরণ করতে হবে। এছাড়া একটি লেখার জন্য লেখককে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। মেধা, বুদ্ধি, সময় ব্যয় করতে হয়। সারাদিন মাটি কাটলেও তো তিনশ টাকা পাওয়া যায়। আর লেখালেখিটা তো মাটি কাটার চেয়েও কঠিন কাজ। ফলে কলমশ্রমিক কি তার পারিশ্রমিক পেতে পারেন না? বা পাওয়া উচিত নয়?
কেউ কেউ সম্মানী চাইলে সাহিত্য সম্পাদক বলবেন, ‘কী এমন লেখকরে বাবা! লেখার জন্য টাকা চায়।’ তাদের উদ্দেশে আমি বলব, ‘সম্পাদক মাস গেলে ঠিকই নিজের পাওনাটা বুঝে নেন। তাহলে লেখকের পারিশ্রমিক পেতে বাধা কোথায়? একটু সম্পাদনার জন্যই এত টাকা নিচ্ছেন অথচ যাদের লেখায় পাতাটা আলোর মুখ দেখছে তাদের কথা ভাববেন না?’
একবার ভেবে দেখুন, লেখকের লেখায় পত্রিকার পাতা ভরে। কিন্তু লেখকের পকেট ভরে না। এ নিয়ে আছে আক্ষেপ। অনেকে আবার বিষয়টাতে ভ্রূক্ষেপও করেন না। কেউ কেউ লেখা প্রকাশটাকেই গুরুত্ব দেন, টাকা নিয়ে ভাবেন না। কারণ তার অভাব নেই। তিনি হয়তো সরকারি আমলা, শিল্পপতি, প্রবাসী অথবা চাকরিজীবী। এদেশে লেখালেখিটাকে কেউ পেশা হিসেবে নিতে পারেন না। কারণ এতে সম্মান আছে, সম্মানী নেই। ফলে বিনা পয়সার লেখা প্রকাশ করতে গিয়ে দুর্বল লেখাও স্থান পায় সাহিত্য পাতায়। আর তাতে নষ্ট হয় সাহিত্যের মান।
এছাড়া সম্পর্কচর্চা যেমন ভয়ঙ্কর, লেখকের সম্মানী না দেওয়াটা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। সর্বক্ষেত্রে সম্মানীর প্রচলন থাকলে লেখার মানও ভালো হবে। হোক নবীন কিংবা প্রবীণ। পরিমাণ কমবেশি হোক। যেটা সাহিত্য পাতায় ছাপা হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই সম্মানী পাওয়ার যোগ্য।
সবেচেয়ে বেশি অবেহেলিত হন নবীন বা অল্প পরিচিত লেখকগণ। ‘তুমি নবীন। কে চিনবে তোমাকে? এমনিতেই এ লেখা ছাপা যায় না। তার ওপর আবার সম্মানীর কথা।’ এমন ধমক শুনেও তাকে দমে যেতে হয়। শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন সাহিত্যচর্চার ওপর। অনেককে দেখা গেছে, কর্মজীবনে গিয়ে আর সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকে পা-ও মারান না। ওই যে প্রথম দিকেই ভয় ছিল। চুন খেয়ে মুখ পুড়লে দধি দেখেও যে ভয় পেতে হয়।
এমনও শোনা যায়, কোনো কোনো পত্রিকার মালিক বলেন, ‘লেখকদের টাকা দিতে হবে কেন? তাদের টাকা দেওয়ার ফিডব্যাক কী? টাকা ছাড়া লেখা পাওয়া যায় কিনা দেখেন।’ তবে লেখকরাও এখন অনেকটা সচেতন হয়েছেন-বিশেষ করে যারা মূল ধারার লেখক। তারাও ছাফ ছাফ বলে দেন, টাকা দিলেই লেখা পাবেন। আর আগাছাদের কথা বাদই দিলাম। যারা বিনা পয়সায় লিখবেন-তাদের প্রকৃত লেখক হতে অনেক সময় বাকি। সম্পর্কের কথা না হয় বাদই দিলাম।
তবে আমার প্রস্তাব-আপনারা সম্মানের ভিত্তিতেই লেখা প্রকাশ করুন। আপনাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্মানী দিন। তাহলে অহেতুক লেখার চাপ থেকে মুক্ত হতে পারবেন। সম্পাদকরা বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে লেখকদের তালিকা প্রণয়ন করুন। প্রতি সপ্তাহে তাদের কাছে লেখা আহ্বান করুন। মাস শেষে লেখা অনুযায়ী সম্মানী দিন। সাহিত্যকে অবহেলিত না করে মূল্যায়ন করতে উৎসাহী হোন। আপনার পত্রিকার অনেক আয়ের উৎস রয়েছে। সেখান থেকে লেখকদের সম্মানিত করার ব্যবস্থা করুন।
আর লেখকদের যদি টাকা-ই দিতে না পারেন, তাহলে ওই বিভাগ বন্ধ করে দিন। ভিক্ষুকের মতো কত কাল আর হাত পাতবেন? লেখকদের সমাজের উচ্ছ্বিষ্ট ভাববেন না। লেখককে তার কর্ম ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী মর্যাদা দিতে শিখুন। তাহলেই সাহিত্য সমাজ উপকৃত হবে। সাহিত্যের এমন শত্রুদের বিনাশে ঐক্যবদ্ধ হোন। চলবে…
সাহিত্যের সাম্প্রতিক শত্রুগণ: পর্ব-৩ ॥ পথিক বাঙালি
সাহিত্যের সাম্প্রতিক শত্রুগণ: পর্ব-২॥ পথিক বাঙালি
সাহিত্যের সাম্প্রতিক শত্রুগণ ॥ পথিক বাঙালি