(পর্ব-৭)
রাতের প্রায় ঘুমন্ত দোতলা পূবালী লঞ্চের মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে বড় অসহায় বোধ করে শফিক হায়দার। কোথাও ঘুমানোর এক চিলতে জায়গা দেখতে পায় না। নিচতলা থেকে দোতলায় উঠে সিঁড়ির ডান পাশে সামান্য এক চিলতে জায়গা আছে, যেখানে সিঁড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দেওয়া যায়। কিন্তু বসার জন্য একটা কিছু তো দরকার। হাতের নাইলনের ব্যাগে দুটি জামা আর একটি পুরোনা প্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই, যা লঞ্চের পাটাতনের ওপর বিছিয়ে বসা যায়। পাটাতনের ওপর যাত্রীরা যে যার মতো করে শুয়ে বসে আছে। পাশের জনের সঙ্গে কেউ কেউ গল্প করছে। ঘুমের বা বসার কোনো জায়গা না দেখে, চোখেও ঘুম নেমে আসে তীব্র গতিতে। চোখজোড়া আটকে রাখতে পারছে না।
সেই সময়ে ছাদ থেকে কয়েকজনকে নেমে আসতে দেখে শফিক, সিঁড়ি বেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে শফিক ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে যায়। ছাদে যদি থাকা যায়! ছাদে উঠে চারদিকে তাকিয়ে শফিক বিভ্রমে পড়ে। পুরো ছাদে মানুষ আর মানুষ। কখন কোন স্টেশন থেকে এই যাত্রীরা উঠেছে? খোলা আকাশের নিচে লঞ্চের ছাদের ওপর চাদর বিছিয়ে, চাদর না বিছিয়েও পত্রিকার ওপর অনেক শুয়ে বসে। হায়, একটা পত্রিকা যদি কিনতাম, ভাবে শফিক হায়দার।
কিন্তু একটা টাকার মায়ায় পত্রিকা কেনা হয়নি। যাচ্ছে ঢাকা, পকেটে মাত্র তিরানব্বই টাকা। সেই সকাল থেকে রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত খরচ করেছে সাত-আট টাকা। এখনো ভাড়া দেওয়া হয়নি। ভাড়া যদি দিতেই হয়, পশ্চাশ টাকা দেওয়ার পর কত টাকা থাকবে? সদরঘাটে নেমে কী করবে? মগজে আর কাগজে একটা ঠিকানা, ১০/ বি সেগুনবাগিচা। সচিবালয়ের পশ্চিমে জাতীয় পেস ক্লাবের উল্টো দিকের গলির মধ্যে ঢুকে হাতের বায়ে প্রথম যে গলিটা, সেই গলিতে ঢুকে ডানে তিনটা বাড়ির পর একটা কাঠাল গাছঅলা বাড়ি।
অচেনা অজানা একটা বাড়ির ঠিকানা সম্বল করে উজানগাঁওয়ের শফিক হায়দারের ঢাকা যাত্রা। সেই যাত্রায় শফিক হায়দার মেসার্স ইসলাম ব্রাদার্স ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির পূবালী লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে চোখে ঘুম নিয়ে ঢুলছে। লঞ্চের ছাদে মেশিনের ধোঁয়া উদগীরণের বিশাল দুটো চোঙ্গের সঙ্গে হেলান দিয়ে কয়েকজন বসেছিল। সেই কয়েকজন থেকে দুইজন উঠে নিচে চলে গেলে, শফিক চট করে বসে যায়। চোঙ্গের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে হাতের নাইলনের ব্যাগটা খোলে। খুলেই অবাক, আরে ব্যাগের মধ্যে দুটি লুঙ্গিও আছে, আছে একটা পুরোনো ম্যাড়ম্যাড়ে গামছাও। কখন ঢুকিয়েছিল মনে নেই। দুটি লুঙ্গি আর গামছা দেখে এক ধরনের স্বস্তি পায়। দুইটা লুঙ্গির একটা বিছিয়ে কোথাও একটু জায়গা পেলে ভালো হয়। ধোঁয়া উদগীরণের কারণে চোঙ্গের শরীর গরম। রাতে নদীর শীতল বাতাসে হালকা শীতের কারণে পিঠে উষ্ণতা পায়। হেলান দিয়ে বসে চোখ বুঝে আসে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরে এক ধরনের অবসাদ নেমে আসে। চোখের পাতা আর টেনে রাখতে পারে না শফিক। ঘুম। ঘুম পরম মমতায় নেমে আসতে চায়।
রাশিদা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই রাশিদার শরীরে বান ডাকলে, নিজেই দ্রুত সাড়া দেয়। শফিক অভ্যস্ত হাতে ব্রাহীন ব্লাউজটা খুলে স্তনের বোঁটা মুখে নেয়।
ঘুমিয়ে পড়ে শফিক। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুমানোর পর ঘুম ভাঙে। তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নাইলনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত নিচে নামে। আবার চলে আসে লঞ্চের পেছনের শেষ দিকে, কেউ নেই। পেছনে একটানা মেশিনের আর্তনাদের শব্দ আর পানির তোড় শুনতে পায় শফিক। আবার দ্রুত পানির কল টিপে আঁজলা ভরে পানি খায়। পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা শরীরে এক ধরনের সুখ ও স্বস্তি পায়। পানি খেয়ে গামছায় বের করে মুছে আবার হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। দোতলায় উঠে সিঁড়ির পাশে মানুষের পায়ে চলার পথ দেখতে পায় ও। রাত অনেক, কেউ জেগে নেই। মাঝখানের তাস খেলার একটা গ্রুপ ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে, যাত্রীদের চলাচল নেই। সেই প্যাসেসে বসে একটা লুঙ্গি বের করে শুয়ে পড়ে শফিক। মাথার নিচে রাখে জামা-প্যান্ট-লুঙ্গি-গামছার নাইলনের ব্যাগ। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা শরীরজুড়ে খণ্ড খণ্ড অবসাদ গ্রাস করে। ঘুমিয়ে যায় শফিক।
-শফিক? এই শফিক্যা?
-কী?
-তুই আমারে লইয়া কী করতে চাও? আমার তো বিয়ার প্রস্তাব আইচে।
-জামাই কী করে?
-আর্মিতে চাকরি করে।
-বিয়া বইয়া যা।
-হের লগে বিয়া বইলে তুই আমার লগে ওইসব করলি ক্যা?
-কী করছি?
-তোর মনে নাই?
-থাকবে না? সব মনে আছে রে, কিন্তু আমি তোরে কেমনে বিয়া করমু? কী খাওয়ামু? চোখের সামনেই তো দেখতে পাইতেছ আমার অবস্থা। ঘর নাই, জায়গা নাই।
-এক কাম কর…
-কী?
-তুই আমি পলাইয়া যাই।
শফিক শুয়েছিল। পাশে রাশিদা। রাশিদা পাশের বাড়ির জজ মিয়া চাচার মেয়ে। গায়ের রঙ কালো কিন্তু স্বাস্থ্যটা দুরন্ত। খুলনার রিক্তা আখতার খুলনায় চলে যাওয়ার পর শফিক নিপতিত হয়েছিল ঘূর্ণিপাকে। দিশেহারা একটা সময় পার করছিল। কোনো কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। সময়ে অসময়ে কচানদীর পারে বসে থাকতো। বারবার, প্রতি মুহূর্তে রিক্তা ভাবির শরীরের কোষ আর কামকাতর ধ্বনি শুনতে পেতো, দেখতে পেতো। কিন্তু সবই অলীক। অন্তহীন যন্ত্রণার সেতারে যখন পুড়ছিল সেই সময়ে হঠাৎ পেয়ে যায় রাশিদাকে। রাশিদার বাড়ির পেছনে শফিকদের কয়েক কাঠা জমি। জমিতে আজ জাম আর কলা গাছের বিপুল সমারোহ। কচানদীর পার দিয়ে দুপুরের পর এসে সেই বাগানে ঢোকে শফিক। একছড়া কলা পেকেছে। কলা গাছ কাটার জন্য দা দরকার। ঢোকে রাশিদার দোচালা ঘরে, ঘরের মধ্যে একটা হোগলায় শুয়ে রাশিদা।
-রাশিদা, তোদের দা-টা কই?
-ক্যান?
-কলা পাকছে, কাটবো।
রাশিদা বিছানা ছেড়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে মাথার ওপরের মাচা থেকে দা-টা নামাতে যায়, পারে না। ঘরের মধ্যে ঢুকে শফিক হাত বাড়িয়ে দা-টা নামাতে গেলে, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। আর পরে পাশে দাঁড়ানো রাশিদার ওপর। রাশিদা মাটিতে পড়ে যায়, ঠিক ওর বুকের ওপর শফিক। দুজন দুজনের ওপর পড়ে আছে, শফিক কয়েক মুহূর্তপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে রাশিদার মুখে চুমু খায়, একের পর এক। রাশিদা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই রাশিদার শরীরে বান ডাকলে, নিজেই দ্রুত সাড়া দেয়। শফিক অভ্যস্ত হাতে ব্রাহীন ব্লাউজটা খুলে স্তনের বোঁটা মুখে নেয়। মিনিট কয়েক পর রাশিদা ফিসফিসিয়ে বলে কানের কাছে, এইহানে না, মানুষ আইয়া পড়বে।
-তাইলে কোথায়?
-মাচায় ল…
-চৌচলা ঘরের আড়ায় কয়েকটা তক্তা সাজিয়ে পাটাতনের মতো করা হয়েছে। বেড়ার সঙ্গে ছোট ছোট কয়েকটা বাতা লোহা দিয়ে গেঁথে মাচায় ওঠা নামার সিঁড়ি করা আছে। সেই বাতায় পা রেখে দুজনে মাচায় উঠে যায়। অনেক পরে মাচা থেকে নেমে দা নিয়ে বাগানে যায় শফিক। কলার কাঁদিটা পুরোটাই দিয়ে যায় রাশিদাকে। রাশিদা হাসে।
সেই থেকে রাশিদার সঙ্গে আবার সকাল-বিকাল-দুপুর কিংবা রাতের গোপন অভিসার চলছিল শফিক হায়দারের। সেই সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে শফিক বুঝতে পেরেছে, জীবন এক নৌকা। ঘাটে ঘাটে ভেড়ে। রাশিদার সঙ্গে সম্পর্কের সুতোর কাঁথা তৈরির পর রিক্তা আখতারকে আর মনে পড়ে না। গল্পে-উপন্যাসে পড়া চরিত্রগুলোও নাড়া দেয় মনের ভেতরে। অবাক ভাবনায় তাড়িত শফিক দেখে, নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে শরীর একটা চমৎকার বাজনা। বাজালেই বেজে ওঠে ঝনঝনাৎ। কিন্তু সমস্যা তৈরি করে রাশিদা। প্রায়ই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে, আমারে বিয়া কর।
ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পরে শফিক, বিয়া করুম ক্যান?
বিয়া করবি না? তয় আমার কাছে আহোস ক্যা? রাশিদার বাঁকা উত্তর। আমার পেটে যদি তোর বাচ্চা আসে? তহন উপায় কী? আমার তো মরতে অইবে?
শফিক হায়দারের ভাবনার মধ্যেই লঞ্চের গতি কমে আসে। দোতলা পূবালী লঞ্চ সদরঘাটে ভিড়ছে।
বোঝে ব্যাপারটা শফিক। কিন্তু শফিকের বাদাম তোলা নৌকা তো উজানগাঁওয়ে নেই। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা একটাই ভাবনা, কবে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হবে! মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হলেই ঢাকা যাবে। জীবনের একমাত্র ইচ্ছে, লেখক হবে। লেখক হতে হলে, অবশ্যই ঢাকা যেতে হবে। ঢাকাই লেখক বানায়। আর রাশিদা কয়, আমারে বিয়া কর। সেও প্রতারক। অনেক পড়া-গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের মতো। ঢাকায় আসার সময়ে রাশিদাকে বলেও আসেনি। জানে, বলতে গেলেই রাশিদা বাগড়া দেবে, আগে আমারে বিয়া কর। পরে ঢাকা যা। মাথা খারাপ? আমারে বিয়া কর। বিয়া হিংগুল বাড়ইয়ের হাতের মোয়া!
উজানগাঁও ছেড়ে ঢাকার লঞ্চের যাত্রী, কেউ জানে না। মাকেও বলেনি। মায়ের ইচ্ছে, শফিক খুলনায় যাবে। খুলনায় রিক্তা আখতারের বাসায় গেলে, রিক্তার স্বামী গোলাম কিরবিয়াকে ধরে কোনো একটা জুট মিলে বদলিঅলা হিসেবে ঢুকিয়ে দিলে, সপ্তাহে সপ্তাহে নগদ টাকা। সংসারের অভাব ঘোচে। সবশেষ যেদিন রাশিদার সঙ্গে মাচায় ওঠে, সেদিন তো রাশিদা বেকে বসেছিল।
-আমি তোর লগে নাই…
-ক্যা?
-আগে আমারে বিয়া কর।
-করবো তো।
অন্যদিকে পাশ ফেরে, কবে করবি?
-আগামী মাসে করবো।
-হাঁচা? হাসি মুখে শরীর ফেরায়, হাঁচা করবি?
মাথা নাড়িয়ে ওর বুকে মুখ রাখে, রাশিদা শরীরের সব গ্রন্থি খুলে দেয়। কারণ, এই প্রথম শফিক সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু শফিক জানে, এই শেষ মৈথুন। চলে যাবে হাতের নাগালের বাইরে, যোজন দূরে। ওকে ডাকছে ঢাকা শহরের কোলাহল, গাড়ি, মানুষ, মিছিল, পত্রিকার পাতা, বেতারের যন্ত্র, টিভির পর্দা আর গল্প উপন্যাসের আখ্যান।
যাত্রীদের কোলাহল আর পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙে শফিকের। তাকিয়ে দেখে, ওকে ঘিরে ডিঙিয়ে যাত্রীরা আসা-যাওয়া করছে। চট করে বসে। সকাল প্রায়। ঘুমের মধ্যে এসেছিল রাশিদা। রাশিদা যখন ওকে খুঁজে পাবে না, উজানগাঁওয়ের কোথাও, কী করবে? কাঁদবে? অসম্ভব অভিমানী একটা নির্দোষ মেয়ে রাশিদা। রেখে এসেছে শফিক হায়দার মিথ্যা আশ্বাস আর কুহকের তোড়ে।
উঠে দাঁড়ায় শফিক। লুঙ্গিটা তুলে ভাঁজ করে নাইলনের ব্যাগে ভরে নিচে যায়, টিউবওয়েলের কাছে। মুখ ধোয়া দরকার। অনেক মানুষের ভিড়। প্রায় বিশ মিনিট পর হাত মুখ ধুয়ে লঞ্চের মাঝামাঝি এলে যাত্রীদের সংলাপ কানে আসে, লঞ্চটা কোথায়?
বুড়িগঙ্গাং ঢুকছে। আর আধঘণ্টা পর সদরঘাটে ভিড়বে।
নিজের মনে আওড়ায়, সদরঘাট! কেমন সদরঘাট? অনেক মানুষের আনাগোনা সেখানে। দেশের নানা জায়গা থেকে শত শত লঞ্চ আসে আর যায়। কী হবে আমার? আমি কোথায় আশ্রয় পাবো? সেই ঠিাকানা ১০/বি সেগুনবাগিচা আমাকে নেবে তো? না কি আবার সদরঘাটে ফিরে আসতে হবে?
শফিক হায়দারের ভাবনার মধ্যেই লঞ্চের গতি কমে আসে। দোতলা পূবালী লঞ্চ সদরঘাটে ভিড়ছে।
চলবে…