(পর্ব-০৫)
রিমির মা পড়াচ্ছে রিমি আর আবিরকে। আবির পড়ছে আর ঘুমে ঢুলছে। পাখার ডাটা দিয়ে হালকা আঘাত করে ভাবি, সারাদিন খেলা আর খেলা! সন্ধ্যায় একটু পড়াতে বসেছি, অমনি বাবুর চোখে ঘুম। পড়।
আ…আমটি আমি খাবো পেড়ে.. আবির পড়তে শুরু করে চোখ মেলে। কিন্তু চোখের পাতা মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু রিমির মা, শফিক হায়দারের ভাবি রিক্তা আখতার খুব কড়া মেজাজে পড়াচ্ছে ছেলে-মেয়েদের। আবির থেকে একটু দূরে, খাটের কিনারে বসে পড়ছে রিমি।
রিমি পড়ে ক্লাস থ্রিতে। নামতা পড়ছে চার অক্ষে চার, চার দুগুণে আট…। টেনে টেনে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে রিমি। গোলগাল মুখের রিমির চোখ দুটো একটু লম্বাটে, নাকটা সরু। একটু অন্যরকম লাগলেও দেখতে সুন্দর। রিমির দিকে ঝুঁকে পড়াতে এলে রিক্তার বুকের শাড়ি অনেকখানি সরে যায়, বের হয়ে পড়ে স্ফীত দুটি স্তন, বিস্ফারিত চোখে তাকায় শফিক, পড়াতে দৃষ্টি থাকায় খেয়াল করে না কয়েক মুহূর্ত রিক্তা আখতার। রিমিকে পড়াতে পড়াতে এক পলক তাকায় শফিকের দিকে, মৃদু হেসে আঁচলটা তুলে নেয় রিক্তা। অন্ধকার নেমে আসে শফিক হায়দারের চোখে। নিমিষে চোখের দৃষ্টি বিপরীত অন্ধকারে রাখে।
-তুমি খেয়েছ? জিজ্ঞেস করে রিক্তা আখতার।
মাথা নাড়ায় শফিক, খাইচি ভাবি। সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিয়ে উত্তর দেয়, খেয়েছি ভাবি।
হাসে রিক্তা আখতার, তুমি খুব ভালো ছেলে। এখন যাও সামনের রুমে। খাটের বিছনা বালিশ দেওয়া আছে, মশারিটা টাঙ্গিয়ে শুয়ে পড়ো।
বসে থাকে শফিক, যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। শালার শিয়ালগুলোর কী হলো? মরছে শালারা? মনে মনে তীব্র আক্রোশে ফুঁসতে থাকে শফিক জঙ্গলের না-ডাকা শিয়ালদের ওপর। বসে বসে দেখে সামনের এলোচুলের রিক্তা ভাবিকে। মনে হচ্ছে, এখনই এই ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে। কিন্তু মাকে কী বলবে?
-কী? চোখ তুলে তাকায় রিক্তা আখতার, ঘুমুবে না?
-যাই! অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় শফিক হায়দার। শরীরটা ভারী মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে দরজা পার হয়ে সামনের রুমে আসে। বসে খাটের ওপর। চারদিকে নিকষ অন্ধকার। তীব্র একটা ক্ষোভে বেদনায় চোখ ফেটে কান্না আসে। নিঃশব্দে কাঁদে শফিক হায়দার। কেন কাঁদে বুঝতে পারে না। জীবনে প্রথম অলৌকিক দরজাটা পার হতে চেয়েছিল। কত কল্পনা, কত স্বপ্ন, কতো কথা যে ভেবেছিল, কানের কাছে মশার প্রবল গানে ও শরীরের নানা জায়গায় কামড়ে অতীষ্ঠ হয়ে মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রিক্তা ভাবির অলৌকিক স্তনজোড়া। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় শফিক হায়দার হাহাকার আর বেদনার বাঁশির সুরে।
অপেক্ষারত দুই জন ড্রাইভার দ্রুত মেশিনের সামনে গিয়ে ছোট দুটি যন্ত্র নাড়া দেয়, লঞ্চটার গতি হঠাৎ থেমে যেতে থাকে।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, ঠিক করে বলতে পারবে না কিন্তু আচমকা ঘুম ভেঙে যায় শফিকের। কানের কাছে শোনে মেয়েলি কণ্ঠের ফিসফিস ডাক, শফিক? ও শফিক? ঘুমিয়ে গেছ?
শফিকের ঘুম ভেঙে গেলে অনুভব করে রিক্তা ভাবি পাশে শুয়ে আছে, ওকে জড়িয়ে ধরে। ধরমড় করে উঠে বসার চেষ্টা করে শফিক, দুটি মৃণাল বাহুতে জড়িয়ে ধরে ভাবি, কই যাও?
-না মানে…তোতলায় শফিক।
-খুব রাগ করছ, না? ভাবির দুটো ঠোট নেমে আসে শফিকের ঠোটের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে শফিক দুহাতে জড়িয়ে ধরে কোমল পদ্মফুলের একটা শরীর।
পরের দিন সকালটা ছিল শফিকের জীবনের শ্রেষ্ঠ সকাল। দিনটা ছিল বেসামাল। যতদূর মনে পড়ে সেদিন ছিল স্কুল বন্ধ। দুপুরের পর যায় রিক্তা আখতারের ঘরে। রিক্তা তখন বিছনায় শুয়ে বিশ্রাম করছে। ছেলে-মেয়েরা বাইরে খেলছে। শ্বশুর গেছে দূরে খালে গোসল করতে। খাটে, পাশে বসতেই চোখ মটকে জিজ্ঞেস করে রিক্তা আখতার, রাতের শিয়াল দিনে কেন? লোভ লেগেছে?
শফিক কোনো উত্তর দিতে পারে না। বোকার হাসি মুখে। রিক্তা ভাবি হুকুম করে, যাও দরজা লাগিয়ে এসো।
সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য ছেলের গতিতে দরজা লাগায় শফিক। দিন ও রাত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শফিক হায়দারের জীবনে। গোপন সিন্ধুকের খরব পেয়ে ছটফট করতে থাকে মাতাল ভ্রমরের ছন্দে। কিন্তু তিন কী চার মাস পরে খুলনা থেকে চলে আসে রিক্তা ভাবির হাজব্যান্ড গোলাম কিবরিয়া। খবর খুবই ভালো, মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। এবার চলো খুলনায়।
বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে কৈশোর পার হওয়া যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো শফিক হাসান, এখন আর ফিরেও তাকায় না রিক্তা ভাবি। তীব্র বেদনায় বুকের ভেতরটা বালির ঝড়ে ভেঙে যায়, বাড়ির সামনের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কী যে একটা টান মায়া, অনুভব করে রিক্তা ভাবির জন্য! কিন্তু রিক্তা ভাবি ফিরেও তাকায় না। কী আজব ঘটনা! ঘরে এসে রিক্তা ভাবি মায়ের সঙ্গে আলাপ করে, চাচি আমরা আগামী শুক্রবার খুলনা চলে যাচ্ছি।
মা করিমুননেছা হাসেন গাল ভরে, কইছিলাম না গোলাম কিবরিয়া ঠিকই একটা ব্যবস্থা হরবে। তুমি তো খুব চিন্তায় ছিলা।
-চিন্তায় থাকবো না, খুলনার খালিসপুরে আমার সাজানো সংসার রেখে এই অজপাড়াগাঁয়ে থাকা সম্ভব? আক্ষেপ ঝরে রিক্তা ভাবির গলায়।
পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে শোনে শফিক হায়দার কিন্তু ওর দিকে ফিরেও তাকায় না।
-খুলনায় বেড়াইতে আসেন, যেতে যেতে বলে রিক্তা ভাবি।
করিমুননেছা হাসেন, মুই খুলনা যাইয়া কী হরমু? ভাবতেছি, আর এক বচ্চর পর শফিক মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। মা এই ফাঁকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, সবই তো তোমারে কইচি। সতীনের ঘর, ওর পাবে বাইচ্চা নাই। দুইটা ছেলে মেয়ে লইয়া বড় আকালে থাহি। মেট্রিক পাস করলে তোমাগো কাছে পাডামু শফিকরে। তোমরা একটা ব্যবস্থা কইরো।
তাকায় শফিকের দিকে রিক্তা আখতার, আপনি পাঠাইয়া দিয়েন। আমি রিমির বাবাকে বলে ওর মিলে একটা ব্যবস্থা করে দেবো।
-আইচ্চা! মা গাল ভরে হাসেন।
পরের সকালে চলে যায় গোলাম কিবরিয়া, রিক্তা আখতার, রিমি আর আবির। বাড়িটা এতদিন ভরা লাগতো, এখন মনে হচ্ছে অথৈ পাথার, কেবলই শূন্য। বুকের গহীন থেকে কান্না ঠেলে আসতে থাকে…তিন-তিনটা মাস কী এক সুখের সায়রে ভাসিয়ে রেখে একেবারে শূন্য করে দিয়েছে ভালোবাসার খাঁচাটা…খুলনা থেকে আসা এক রিক্তা ভাবি।
ফেলে আসার স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গত করতে করতে লঞ্চের চারপাশ ঘিরে নেমে আসে অসীম অন্ধকার। লঞ্চের মধ্যে জ্বলে আলোর বাতি। হালকা শীত লাগে। নিচে, দোতলায় নেমে আসে শফিক। খিদে অনুভব করছে। আবার লঞ্চের পেছনে যায়। বালতি দিয়ে পানি তুলে কয়েক চুমুক পান করে এসে দাঁড়ায় ইঞ্জিন রুমের পাশে। একটানা ছমছম শব্দে ইঞ্জিন রুমের চারপাশটা কাঁপছে। ইঞ্জিন রুমের চার পাশটা শক্ত তারের জালে আচ্ছাদিত। ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকায়, নিচের দিকে লঞ্চের পাটাতনের সঙ্গে দুটি বিরাট মেশিন, একটানা চলছে। একটানা এই বিকট শব্দের মধ্যে দুই জন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, মাস্টার কেবিন থেকে আসা নির্দেশের অপেক্ষায়। হঠাৎ কিরিত কিরিত শব্দে ইঞ্চিন রুমের মধ্যে দুটি ঘণ্টা বাজে। অপেক্ষারত দুই জন ড্রাইভার দ্রুত মেশিনের সামনে গিয়ে ছোট দুটি যন্ত্র নাড়া দেয়, লঞ্চটার গতি হঠাৎ থেমে যেতে থাকে।
শফিক বুঝতে পারে, পূবালী লঞ্চ কোনো স্টেশনে থামছে। কোন স্টেশনে থামছে? দ্রুত ইঞ্জিন রুম থেকে সামনের দিকে আসে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় শফিক। পূবালী লঞ্চের সার্চ লাইটের উজ্জ্বল আলোয় দেখতে পায়, বানাড়ীপাড়া লঞ্চ ঘাট লেখা বিরাট সাইনবোর্ড।
মুখে কলা আর রুটি, দৃষ্টি নদীর ওপর। লঞ্চ থেকে চুইয়ে চুইয়ে যে আলোর হালকা ধারা আসছে, সেই আলোয় জলের স্রাত দৃষ্টিতে পিছলে যাচ্ছে।
গ্রামে, উজানগাঁওয়ে থাকার সময়ে অনেক বার শুনেছে বানাড়ীপাড়ার নাম। এখানে ধান চালের বড় বাজার। সুন্দরবন থেকে বাওয়ালীদের কেটে আনা সুন্দরী গাছ, কেওড়া গাছ আর গড়ান কাছের বড় বাজার বানাড়ীপাড়া। লঞ্চটার কেবল সূচালো মাথাটা লেগেছে, চিলের অপেক্ষায় থাকা ফেরিঅলারা লাফ দিয়ে লঞ্চে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা লঞ্চটা বিচিত্র কোলাহালের চাদরে ঢেকে যায়।
-অ্যাই ডিম লাগবে, গরম ডিম…গামলা ভরা সিদ্ধ ডিমের ফেরিঅলা একতলা দোতলায় দ্রুত ছুটতে শুরু করে। অ্যাই পাকা কলা লাগবে, পাকা গলা…ফেরিঅলার সুরেলা হাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা পূবালী লঞ্চে। নেবেন পাউরুটি…পাউরুটি…। ফেরিঅলাদের বিচিত্র হাক-ডাকের মধ্যে শফিক হায়দার নিচতলা থেকে দোতলায় উঠে আসে, রেলিংঘেঁষে দাঁড়ায়। চোখ রাখে নিচের দিকে, যাত্রীদের নামা-ওঠার পথে। ইতোমধ্যে লঞ্চের খালাসিরা সিঁড়ি নামিয়ে দিয়েছে টার্নিমালে। যাত্রীরা নামছে…বিচিত্র জিনিস তাদের হাতে, মাথায়। এক যাত্রী মাথায় বড় একটা বোঝা নিয়ে নামতে নামতে সিঁড়ির সঙ্গে হালকা বাড়ি খেয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে টার্মিনালের ওপর। পেছনে বোরকা পরিহিত স্ত্রী, স্ত্রীর কোলে দুই তিন বছরের বাচ্চাসহ চিৎকার করে, অরে ধরেন ধরেন। মুহূর্তের মধ্যে টার্মিনালে থাকা শখানেক লোক পতিত লোকটাকে ঘিরে দাঁড়ায়। আর খালাসিদের একজন বোরকা পরিহিত মহিলার হাত ধরে, মহিলার বোরকার অবগুণ্ঠন অনেকখানি খুলে গেছে। মহিলা ছিলেন শেষ যাত্রী। টার্মিনালে নেমে দাঁড়াতেই খালাসিরা সিঁড়ি টেনে লঞ্চে ওঠায়। পূবালী লঞ্চের মাস্টার লঞ্চের দোতলার মাথা থেকে ইশারা করে, লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে সারেং লঞ্চ পেছনে নেওয়ার জন্য ঘণ্টা বাজায় মেশিন রুমে, ড্রাইভার লঞ্চ পেছনে নেওয়ার জন্য যন্ত্র চালায়। বিশাল পূবালী লঞ্চ মুহূর্তের মধ্যে বানারীপাড়ার টার্মিনাল থেকে পেছনে যেতে থাকে।
শফিক হায়দার সেই রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখে, লঞ্চটা কয়েক মিনিটের মধ্যে নদীর মাঝ বরাবর চলে আসে। আবার শুনতে পায় সারেংয়ের ভিন্ন ধরনের ঘণ্টাধ্বনি। লঞ্চ একেবারে থেমে যায়, আবার ঘণ্টাধ্বনি, পূবালী লঞ্চ সবেগে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। বানারীপাড়ার টার্মিনাল ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে লঞ্চ। টার্মিনালের মানুষজন, সেই মহিলা, পড়ে যাওয়া মানুষটা হারিয়ে যায় চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে।
নদী ও অন্ধকার থেকে লঞ্চের দিকে ফিরে তাকায় শফিক। আলোয় চক-চক করছে গোটা লঞ্চ। দোতলা থেকে নিচে নামে শফিক। নিচে, দোতলায় ওঠা সিঁড়ির সামনের খোলা জায়গায় হকারেরা বসেছে। কেউ রুটি কিনছে। কোনো যাত্রী কিনছে কলা। দরদাম করছে কোনো কোনো যাত্রী। পাউরুটির গন্ধটা নাকে লাগে, সঙ্গে খিদেটা চাগিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। দাঁড়ায় রুটি হকারের সামনে, মাঝারী সাইজের একটা রুটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে শফি, কত?
-দুই টাকা।
শফিক পকেট থেকে টাকাটা বের করে হকারের হাতে দিয়ে রুটি নিয়ে আসে কলাঅলার কাছে। কেনে দুটি সাগরকলা এক টাকায়। নিচতলায় লঞ্চের পাশঘেঁষে লোহার বেঞ্চে ফাঁকা জায়গায় বসে রুটি আর সাগরকলা খেতে শুরু করে। মুখে কলা আর রুটি, দৃষ্টি নদীর ওপর। লঞ্চ থেকে চুইয়ে চুইয়ে যে আলোর হালকা ধারা আসছে, সেই আলোয় জলের স্রাত দৃষ্টিতে পিছলে যাচ্ছে।
চলবে…