পর্ব: ৪৩
উলন রোডের মসজিদ মেসের শফিক হাসানের রুমের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে মজমা চলে। আমীর হোসেন প্রতিদিনের তুলনায় গম্ভীর। কিন্ত সন্তোষ রায় আর কারী আবদুল জলিল মিলে হাসিতে গল্পে রুমটাকে ভরাট করে রেখেছে।
হোনেন, জগতের সকল সর্বনাশের মূলের কী? প্রশ্ন করে কারী আবদুল জলিল।
টেকা, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় দবিরউদ্দিন। দবিরউদ্দিকে মেসের অনেকেই পছন্দ করে না। কালো দশাসই শরীরের মানুষ দবিরউদ্দিন এমনিতে হাসিখুশি ধরনের মানুষ। কিন্ত রাজনীতিতে সাপোর্ট করে জামাতকে। মেসের মধ্যে রাজনীতি না করলেও কথা আচরণে বোঝা যায়। শফিক হাসান রাজাকার আলবদরদের নামই শুনতে পারে না। মাহমুদ মাঝামাঝি ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমীর হোসেন রাজনীতি আর রাজনীতিকদের ঘৃণা করে থুতুর মতো। বলে, রাজনীতি হইলো সকল সর্বনাশের মূল। আর রাজনীতিবিদরা হইলো নোম্যান্সল্যান্ডের ফকির মিসকিন- যাদের কোনো আদর্শ নাই, মা নাই- মামাসী নাই…। মা খালা বউ ওদের কাছে সমান।টাকা আর ক্ষমতার জন্য ওরা পারে না, এমন কাম নাই।ওয়াক থু…।
না, সরাসরি অস্বীকার করে কারী আবদুল জলিল।
তাইলে কী? জানতে চায় আমীর হোসেন।
মাইয়া মানুষ।
কারী আবদুল জলিলের উচ্চারণে রুমের প্রত্যেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। বিশেষ করে জামাতের সেবক দবিরউদ্দিন। চোখে পলক পড়ে না লোকটার।
আপনে এইডা কী বললেন? দবিরউদ্দিন চায় চলতি ভাষায় কথা বলতে কিন্ত অর্ধেক চলতি আর অর্ধেক মারফতি শব্দ এসে যায়।
মৃদু হাসে আবদুল জলিল, ভাইবা দেখেন- খারাপ কিছু কই নাই। যা কইচি, জেনে বুঝে শুনে বলছি।
রুমের প্রত্যেকে তাকিয়ে আছে কারী আবদুল জলিলের দিকে। নির্বিকার আবদুল জলিল। মিসমিসে কালো রঙের আবদুল জলিল মিটি মিটি হাসে সাদা ফরসা দাঁতে, আমি মিছা কই নাই।
টিপ্পনী কাটে সন্তোষ রায়, আপনে হাচা বলেছেন?
জি আমি সত্যি বলেছি, উলন মসজিদের কারী আবদুল জলিল মৃদু লয়ে বলে, আপনে এখানে বসে আছেন কিন্ত আপনার ভাবনার মইধ্যে আছে নারী বা মেয়ে মানুষ। সব সময়ে মাথার মধ্যে থাকবে এমনটা না, কিন্ত থাকছে, থাকে। এই যে আপনে আমি- দুনিয়ার কুটি কুটি মানুষ পয়দা কিভাবে হইতেছি? মাইয়া মানুষের সঙ্গে পুরুষেরা সেক্স করলে না, ছেলে মেয়ে পয়দা হয়? আপনারা ভাবেন, একদিন সকালে উঠে শুনলেন বাংলাদেশে কোনো মেয়ে মানুষ নাই; সব গায়েব হয়ে গেছে, টিকতে পারবেন একদিন? যিনি মাইয়া মানুষ পয়দা করেছেন দুনিয়ায় তিনি বুঝে শুনেই করেছেন; ধরুন আপনি একজন মাইয়া মানুষ দেখলেন, অতীবও সুন্দরী কিন্ত সেই মহিলার স্তন নাই; আপনি তারে লইয়া কী করবেন? অথবা সুন্দরী কিন্ত মাথার চুল নাই; আপনে সেই মাইয়া মানুষরে নেবেন? আর সর্বনাশের বিষয় অইলো; একটা ছিদ্র। সৃষ্টিকর্তা মেয়ে মানুষরে বিশেষ একটাএকটা অঙ্গ দিছে, দুনিয়ার সকল পুরুষ সেই ছিদ্র অংগের কাছে পরাজিত হয়। আমি আপনে সাধারণ মানুষতো বটেই মণি মনীষীরা তো ভালো জগতের কেউ নারীর ছোবল থেকে রক্ষা পায় নাই। ধর্মীয় মানুষ যারা- আমরা কী মানুষ বা পুরুষ না? যদি পুরুষ হই তাইলে কী অন্যান্য মানুষের মতো আমাদের রিপু থাকবে না? আপনাদের মতো আমরাও কী নারী নিয়ে ভাবতে পারি না? আমরা নারী বিষয়ে দুই একটা কথা বললেই চোখ উল্টে যায়।
এতোক্ষণে গম্ভীর আমীর হোসেন খাট থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে কারী আবদুল আজিজকে, আপনি এমন করে সত্য বলতে পারেন, জানতাম না।
দবির দাঁত বের করে, না আমাদের কারী হুজুরে অনেক সত্যই বলেছেন কিন্তু।
কারী হুজুরের বলার মধ্যে কোনো কিন্ত নাই, যা বলেছেন সবটুকুই সত্য- বিশাল দেহী আমীর হোসেন দাঁড়ায়, রাত অনেক হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকায়, প্রায় সাড়ে এগারোটা, মাহমুদ আসছে না কেনো?
শফিক হাসান দাঁড়ায়, সত্যি তো। চল বাইরে গিয়ে দেখি রাঙ্গা মুলাটা কই গেলো?
মাহমুদের শরীরের রঙ অনেকট্লাাল সাদা, সেই কারণে শফিক ঠাট্টা করে ডাকে- রাঙ্গা মুলা। ওর কথায় হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে মেসের প্রত্যেকটা রুমে খোঁজে সবাই মিলে, কোনো রুমে পাওয়া যায় না ওকে। কারী আবদুল জলিল রুম থেকে তালা নিয়ে এসে মসজিদের তালা খুলে মসজিদের মধ্যে খোজে- কোথাও নেই। মাহমুদকে না পেয়ে উলন মসজিদ মেসের সদস্যরা মেসের সামনে জড়ো হয়, একটা প্রশ্ন- এতো রাতে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে কোথায় গেলো মাহমুদ?
চল, দুজনে হেঁটে চলে যায় রুমের দিকে। অবাক দৃষ্টিতে দুই বন্ধুর অথবা দুজন মানুষের যাত্রা দেখে উলন রোডের মসজিদ মেসের মুয়াজ্জিন কারী আবদুল জলিল।
শফিক হাসান মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে যায় রেহানা বেগমের বাসায়। রেহানা বেগমের বাসায় যাবার আগে যায়, পিছনের ছোট রুমটায়. যেখানে দুই মাস আগে ছিল ওরা। রুমটা বাইরে থেকে তালা দেয়া। বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরে কেউ নেই। রেহানা বেগমের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না শফিক। এই তল্লাটের কেউ জেগে নেই, রেহানা বেগমের বাসাও অন্ধকার। এতো রাতে একা ওকে দেখতে পেয়ে কিছু মনে করতে পারে, ভেবে দ্রুত চলে আসে। মেসের দিকে আসতে আসতে নিজের মাথায় প্রশ্ন চক্ক্র দেয়, কোথায় গেলো মাহমুদ?
একজন বিবাহিত নারী রেহানা বেগম, হতে পারে খানিকটা সুন্দরী; সেই মহিলার প্রতি এতোটা আসক্ত হওয়া কী ঠিক? যে মহিলা নিজের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। তাও আবার একজন ড্রাইভারের বউ? কিন্ত প্রেম এক আজব সরবত। একবার যে পান করেছে সেই শরবতের জলে আকণ্ঠ ডুবেছে। রেহানা বেগমের দিকে থেকে সাড়া পাওয়া গেলে একটা কিছু করা যেতো। কিন্ত এখন, এই গভীর রাকে কোথায় খুঁজবো মাহমুদকে, গলায় চেপে ধরা মাহমুদের শাড়াসি আক্রমনে ব্যথার জায়গায় হাত দিয়ে ব্যথা অনুভব করতে করতে প্রশ্ন করে নিজেই, সত্যি কী মাহমুদ আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল?একজন অন্য নারীর জন্য আমাকে…। অথচ মাহমুদ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঢাকা শহরের। পরিচয় ছয় বছরের মতো.. মাওলানা মতীনের লেবার পার্টির অফিসে। একই এলাকার মানুষ; ঢাকায় পরিচয়। সেই সূত্রে ছয় বছরের জীবনে মাহমুদ আর শফিক হাসানের মধ্যে গড়ে উঠেছে চমৎকার বন্ধুত্ব, আছে কিন্ত আর কী থাকা যাবে? বোঝা যাবে; থাকা যাবে কী যাবে না কিন্ত হারামজাদা গেলো কই এতো রাতে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক, রাত বারোটা।
রেহানা বেগমের বাসা থেকে বের হয়ে রামপুরার উলন রোডে মাথা পর্যন্ত হেঁটে যায় শফিক হাসান। সুনসান রাস্তা; কেউ কোথাও নেই। রাস্তায় কয়েকটা নেড়ি কুকুর হাঁটছে। রাত জাগা কয়েকজন রিকশাঅলা দ্রুত রিকশা চালিয়ে ডেরায় চলে যাচ্ছে। রাস্তার লাইটগুলোর ফ্যাকাসে আলোয় রাস্তাগুলো মৃত মাছের মতো শুয়ে আছে। খুব অসহায় লাগছে শফিকের, কেউ নেই আমার জন্য কোথাও? মাহমুদ কে ভরসা করতাম খুব। সেই মাহমুদও হত্যার নেশায় মেতে উঠলো? কিন্ত ও রুমে নেই।
রাস্তা পার হয়ে সুনশান রাতে শফিক ঢোকে মসজিদ এরিয়ায়। মসজিদের সামনের বারান্দার মাঝামাঝি আসতেই থামের আড়াল থেকে প্রথমে একটা ছায়া বের হয়ে আসে, ছায়া দেখেই ভয়ে কাঁটা জাগে শরীরে। থমকে দাঁড়াতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে মাহমুদ হাসান, লুঙ্গি পরা, খালি শরীরে। রাস্তার পাশের লাইটপোস্টের আলো পরে মাহমুদের মুখের উপর। মুখটা পাংশুটে, বেদনায় ভয়ানক মলিন। চোখে কাতরতা। কিন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শফিক হাসান, মাঝ রাতে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ানোর কারণ? সত্যি কী আমাকে মেরে ফেলতে চায় ও? শংকায় কেঁপে ওঠে শফিক। ভয়ে পিছিয়ে যায় এক পা!
শফিক! আর্তনাদে পূর্ণ গলা মাহমুদের। তুই আমারে মাফ কর…ঝর ঝর কাঁদছে। আমি একটা বোকাচোদা। কোথাকার কোন রেহানা মাগীর জন্য তোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি, আমাকে মাফ কর; দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে মাহমুদ হাসান।
বুঝে উঠতে পারে না শফিক, মাহমুদ কী সত্যি মর্মাহত? নাকি অভিনয়? বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখে এক লহমায় গোপনে লুকিয়ে রাখা ছুরি বসিয়ে দেবে পিঠে। ওর হাত দুটো শফিকের পিঠের ওপর।
আমি জানি, আমি খুব অন্যায় করেছি; আর একটু হলেই তুই মারা পরতি। কিন্ত তখন আমার কী যে হলো! আমার আমিকে সামলাতে পারলাম না, তোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সত্যি বলছি, তখন তোকে মেরে ফেলতেই ইচ্ছে হয়েছিল। আমাকে মাফ কর… এবার ফুপিয়ে এবং শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে মাহমুদ হাসান। রাতের উলন রোড ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগে। মসজিদ মেসের কেউ জেগে নেই; কিন্ত রাতের এই কান্না ও আর্তনাদের মর্মভেদী স্বর কোথাও না কোথাও আঘাত হানছে। শফিকের আত্মার মধ্যেও জমে থাকা অপমান আর বেদনার বরফ গলে তরল কান্নার স্রোতে চোখের গহিন থেকে বের হয়ে আসে, দুহাতে জুড়িয়ে ধরে মাহমুদ হাসানকে।
দুজনে দুজনকে জড়িয়ে কাঁদছে।
অনেক তো কাঁদলেন, এখন ঘুমান গিয়া- পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মসজিদের কারী আবদুল জলিল, অনেক বন্ধুত্ব দেখছি, কিন্ত এমন বন্ধুত্ব দেখি নাই। কয়েক ঘন্টা আগে মাইরা ফেলতে চাইলেন, এখন কানতেছেন; গলা ধইরা।
কারী আবদুল জলিলের উচ্চারণে দুজন ছেড়ে দেয় দুজনকে। মাহমুদ হাসান চোখের পানি পরনের লুঙ্গির খুট দিয়ে মোছে। কারী আবদুল জলিলের কাঁধের উপর রাখা গামছা টেনে চোখ মোছে শফিক।
আমরা এতো খোঁজলাম, কই আছিলেন মাহমুদ ভাই?
হাত উচুঁ করে দেখায়, ছাদে।
মসজিদের ছাদে ছিলেন? অবাক কারী আবদুল জলিল। আমরা তো অনেক বার খুঁজেছি ওখানে।
আপনার তিন তলার পানির ট্যাংকির উপরে যান নাই, আমি পানির ট্যাংকির আড়ালে বসেছিলাম।
খালি গায়ে ছিলেন, মশায় কামড়ায় নাই?
অনেক… শরীর দেখায় মাহমুদ, দেখেন- মশার কামড়ে শরীর ফুলে উঠেছে।
মশার কামড় খাইয়াও আপনি চুপচাপ বসেছিলেন?
লজ্জায় বসেছিলাম, মশার কামড় টেরই পাই নাই। নিচে নামার পর দেখলাম, সারা শরীরে মশার কামড়।
কিসের লজ্জা?
শফিক হাসান অনেকটা স্বাভাবিক। হাত ধরে মাহমুদের, বুঝতে পারছি। এখন চল রুমে।
চল, দুজনে হেঁটে চলে যায় রুমের দিকে। অবাক দৃষ্টিতে দুই বন্ধুর অথবা দুজন মানুষের যাত্রা দেখে উলন রোডের মসজিদ মেসের মুয়াজ্জিন কারী আবদুল জলিল। নিজের মনে বলে, মানুষের দুনিয়ায় মানুষের চাইয়া আশ্চার্য প্রাণী আর নাই। এই মারে, এই কান্দে…।
চলবে…