(পর্ব-৩৫)
সাধুর কোমালগান্ধার শ্যামল মুখের ওপর চোখ রেখে হোসনে আরা আবেদীনের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। কোথায় একটা টান, একটা জাদুর গাঁথা মনের দেয়ালে এঁচোড় ওঁচোড় রাখে। তিনি দেখতে পান প্রথম সন্তান কামরুল আবেদীন বিপুলকে। প্রায় পঁচিশ বছর আগের ছেলেটি এখন বিদেশে, অস্ট্রেলিয়ায়। গিয়েছিল পড়ালেখা করতে। পড়ালেখা শেষ করে অস্টেলিয়ার মেয়ে মার্গারিটা ক্যাটটকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। ক্যানবেরায় বিরাট বাড়ির মালিক পুত্র। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে ছবি পাঠিয়েছে। সঙ্গে দেড় বছরের নাতনি, দেখা হয় না দুই বছর। সাধুর মধ্যে শৈশবের বিপুলকে দেখে হোসনে আরা আবেদীন তাকায় স্বামী জয়নাল আবেদীনের দিকে। জয়নাল আবেদীন তাকিয়েছিলেন অন্ধকারে দ্রবিভূত জলের ছায়ায়।
-আমি ওকে নেবো! পাশে দাঁড়িয়ে বিপন্ন কণ্ঠে দাবি জানায় জয়নাল আবেদীনের কাছে। জলের স্রোত থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আগন্তুক গলায় জবাব দেন জয়নাল আবেদীন, নিবা? নাও।
-যাবি আমার সঙ্গে, সাধুর হাত ধরে কোমল গলায় বলেন হোসনে আরা আবেদীন।
-যাবো, ঘাড় কাৎ করে কোমল চোখে তাকায় হোসনে আরার দিকে, আমাকে পেট ভরে খাইতে দেবেন?
জড়িয়ে ধরেন হোসনে আরা আবেদীন, দেবো। তুই কত খেতে পারিস?
হাসে সাধু, অনেক খাইতে পারি। দুই হাতে দেখায়, দেবেন তো খেতে?
-বলছি তো, তোকে অনেক খেতে দেবো। তোকে পড়তে দেবো। তোকে কিন্তু সারা দিন আমার সঙ্গে থাকতে হবে। তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবি না।
-যাবো না।
-চল। শক্ত করে হাত ধরে দাঁড়ান হোসেন আরা আবেদীন। সাধুও দাঁড়ায়।
অধ্যাপক মোবারক হোসেন খুব মজা পাচ্ছেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে একের পর ধোঁয়া ছাড়ছেন। দেখছেন ভাঙাগড়ার খেলা। নদী কি কেবল ভাঙে? এই যে নদীর প্রবহমান স্রোতের ধারায় গভীর রাতে বরিশাল টু ঢাকাগামী এমভি সামাদ লঞ্চে একটি শিল্পবাড়ি হচ্ছে, জগতে কতজনে জানবে? আহা! কত ক্ষুদ্র জায়গা থেকে নির্মিত হতে পারে জীবনের নায়গ্রা জলপ্রপাত! অনেক বছর আবেদীন পরিবারের সঙ্গে পরিচয়, যোগাযোগ। স্বভাব নয় অধ্যাপক মোবারক হোসেনের কারও হেঁসেলে ঢুকে, আম পেড়ে আনা। কিন্তু চোখের আয়তনে যা কিছু ঘটতে দেখেন, সেই প্রতিবিম্ব থেকে নিজের মতো করে বুঝে নেন। বুঝতে পারতেন হোসেন আরা আবেদীনের সন্তান সংক্রান্ত বেদনাবোধ।
একটা মেয়েও আছে, ঢাকা শহরে দুজনের। খুবই সুন্দরী মেয়ে রূপন্তি আবেদীন। ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। এমএসএস করে একটা প্রাইভেট ব্যাংকের বড় পদে আছে। কিন্তু বিয়ে করেছে অফিসেরই একজন কলিগকে। কলিগকে বিয়ে করেছে সমস্যা সেখানে না, কলিগটা রূপন্তির পিওন ছিল। ছেলেটা, রূপন্তির স্বামী আলী আসগরকে দেখেছেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। দেখতে শুনতেও খারাপ না। বাড়ি রংপুরের দিকে।
ওর বাবা এক সময়ে মন্ত্রীও ছিল। কিন্তু সাইফুল হক বিরাট ডিগ্রির জন্য অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায় তিন বছরের জন্য। তিন বছর পর ফিরে আসে–সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান কন্যা নিয়ে। প্রতিশোধ নিতে রুপন্তি আমাকে বিয়ে করেছে।
আলী আসগর বলেছে, আমাদের এলাকায় এক সময়ে দারিদ্র্য ছিল ভয়াহ রকমের। আপনারা যাকে মঙ্গা বলেন। বিশেষ করে আষাঢ শ্রাবণ আশ্বিন কার্তিক মাসে, মানুষের ঘরে খাবারের মতো কোনো দ্রব্য থাকতো না। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হতো আমাদের অঞ্চলের মানুষদের। দারিদ্র্য বা ক্ষুধা বা মঙ্গা দূর করার জন্য যে পরিকল্পনার দরকার ছিল, সেটাই ছিল না; রাজনৈতিক না আর্থ-সামাজিক দিক থেকে। পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমাদের অঞ্চলে এনজিও কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এনজিওরা দরিদ্র মানুষের দুয়ারে অন্য জীবনের দুয়ার নিয়ে উপস্থিত হলে, মানুষ কিছুটা হলেও মুক্তি পায়। আরও একটা ঘটনা ঘটে নীরবে, রংপুর অঞ্চলের মানুষ রংপুরের বাইরে যেতে শুরু করে। ঢাকায় এসে রিকশা চালানোর সঙ্গে পরিচিত হলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে কিছুটা হলেও আর্থিক সচ্ছলতা আসে। এখন মোটামুটি মানুষজন ভালোই আছে।
-কিন্তু আপনি লেখাপড়া করলেন না কেন?
-কী করে করবো? মা অন্ধ। বাবা অসুস্থ। তিন চারটে ভাইবোন। আমি সবার বড়। ঢাকায় এসেছিলাম বারো বছর বয়সে। ওয়ারীর একটা বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করতে করতে ইস্কুলে ভর্তি হই। বাড়িঅলা হামিদ কাকা জানার পর আমাকে দারোয়ানগিরি থেকে ছুটিয়ে অফিসের পিওনের কাছে লাগায়। রাতে বাসায় একজন শিক্ষক এসে পড়াতো। এভাবে সেই বাসায় থেকে মেট্রিক পাস করার পর হামিদ কাকা মারা যান, আমার কপালও পোড়ে। হামিদ কাকার ছেলে-মেয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে পড়ি দারুণ সংকটে। তো সেই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এই ব্যাংকের একজন বড় কর্মকর্তা ডিএমডি জহুরুল ইসলাম। তাকে বললাম আমার জীবনের ঘটনা। তিনি আমাকে ব্যাংকে এই পদে চাকরি দেন। আছি ভালোই।
-কিন্তু রুপন্তি!
রূপন্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সাইফুল হককে ভালোবাসতো। তো সাইফুল হক ছিল আরও বড় লোকের ছেলে। ওর বাবা এক সময়ে মন্ত্রীও ছিল। কিন্তু সাইফুল হক বিরাট ডিগ্রির জন্য অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায় তিন বছরের জন্য। তিন বছর পর ফিরে আসে–সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান কন্যা নিয়ে। প্রতিশোধ নিতে রুপন্তি আমাকে বিয়ে করেছে।
-প্রতিশোধ?
-হ্যাঁ।
-কিন্তু।
-আমি অনেক বুঝিয়েছি রূপন্তিকে। ওর সঙ্গে প্রায় তিন বছর কাজ করেছি। কোনোদিন মিথ্যা বলিনি, অফিসে দেরি করিনি। সব সময়ে বসের পিওন হিসেবে অনুগত থেকেছি। সম্ভবত এসব দেখে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে রুপন্তি। আমার কাছে বছর আটেক আগে, হঠাৎ একদিন দুপুরে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। আমি অবাক। কিন্তু সবকিছু খুলে বলে।
-তো আপনি কী বললেন?
-সব শুনে তো আমার মাথা ভনভন ঘুরতে থাকে। আমার পানির পিপাসা পায়। কিন্তু রূপন্তি আমার ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। বলেছে, আপনি কয়েকদিন ছুটি নিন এবং ভাবুন। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথাটা খালি হয়ে গেছে। আমি মানুষ, আবার পুরুষ। লোভ তো আছেই, সেই সঙ্গে অমন শিক্ষিত জ্ঞানী সুন্দরী ভালো পরিবারের মেয়েকে কে না বউ হিসেবে চায়? আমার তো পরামর্শ করার মতো কেউ ছিল না। আমি একাই এক শ।
-শেষে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?
-ওই যে বললাম, লোভ। আমি রাজি হলাম। কিন্তু একটা শর্ত দিলাম।
-কী শর্ত?
-আমি দরিদ্র, আমি মঙ্গা এলাকার মঙ্গাকবলিত মানুষ। আমার কেউ নেই। কিন্তু আমার নিজের কাছে আমার মর্যাদা আছে। সেই মর্যাদা না পেলে আমি চলে যাবো।
-আপনার শর্তে রাজি হলো রূপন্তি?
ঘাড় কাত করে আলী আসগর, রাজি হলেন। আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করলাম। বিয়ের আগে আমি জানতাম, এই বিয়ে বিচিত্র ধরনের জটিলতা তৈরি করবে। সেটা করলোও। আপনি জানেন, ওর ভাই আর মামারা কোনোভাবে মেনে নিতে পারলো না, আমাদের বিয়ে! ফলে, আমার শ্বশুর-শাশুড়িও অনেকটা দূরে রইলেন। কিন্তু বিশ্বাস করুণ, আমরা অসম্ভব সুখে আছি।
-আপনি কি চাকরিটা করছেন?
-না, চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি ব্যবসা করছি।
রূপন্তি অনেকবার চেষ্টা করেছে মা-বাবার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। কিন্তু ভাই আর মামাদের কারণে সম্ভব হয়নি। ফলে মেয়েও গেছে উল্টো পথে। কোনো যোগাযোগই রাখছে না রূপন্তি, এখন আর।
অবাক অধ্যাপক মোবারক হোসেন, কী ব্যবসা করছেন?
-হাউজিং! রূপন্তি হাউজিং লিমিটেডের আমি এমডি। ব্যবসা ভালোই চলছে। আমাকে নানাভাবে ব্যবসায় সাহায্য করছে রূপন্তি। অনেক কিছু বোঝে, জানে, বলা যায় আগলে রাখে। আমাদের দুটি সন্তান, গাড়ি বাড়ি, সবই রুপন্তির পরিকল্পনা।
যে শর্ত দিয়েছিলেন? মোলায়েমভাবে প্রশ্ন করেন মোবারক।
আজ পর্যন্ত বিবাহিত জীবনে তেরো বছরে আমাদের মধ্যে কোনোদিন ঝগড়া হয়নি। নিঃশব্দে, চোখের দৃষ্টিতে আমরা একে অন্যকে বুঝে যাই। শুধু একটাই বেদনা, আমাকে বিয়ে করে রূপন্তি হারিয়েছে বাবা-মায়ের আদর ও অধিকার।
রূপন্তি অনেকবার চেষ্টা করেছে মা-বাবার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। কিন্তু ভাই আর মামাদের কারণে সম্ভব হয়নি। ফলে মেয়েও গেছে উল্টো পথে। কোনো যোগাযোগই রাখছে না রূপন্তি, এখন আর।
হোসনে আরা আবেদীনের বুকের মধ্যে সেই বাৎসল্যের নিখাদ নতুন রূপ দেখেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, রাতের শেষ প্রান্তে চলমান জলের বাড়িতে দাঁড়িয়ে।
-চলো রুমে যাই। স্ত্রীকে তাড়া দেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। পেয়ে তো গেছ তোমার নতুন অবলম্বন। এখন ঘষে মেজে মানুষ করার পালা।
সাধুর হাত ধরে হোসনে আরা দাঁড়ান চাঅলা মিলনের সামনে, ভাই আপনি কোনো দাবি-দাওয়া রাখবেন না।
-কী যে বলেন আফা, ছেলেটার একটা গতি হইলো। আমার দোকানে চা খাইতে অনেকে তো আসে। আমি অনেকরেই কইচি, কেউ নেয় নাই। এক কাম করেন, আপনাগো একটা কার্ড দিয়া যান।
-দিচ্ছি, পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে জয়নাল আবেদীন বাড়িয়ে ধরে। হাতে নিয়ে সামনের একটা বৈয়ামের মধ্যে রেখে দেয় মিলন। তাকায় সাধুর দিকে, তোরে অনেক গালিগালাচ করছি, মন্দ কইচি, মারচি। কিছু মনে রাখিস না ভাই।
সাধু মলিন মুখে হাসে, আপনে আমারে দেখতে যাইয়েন।
-যামু তো, তুই কোথায় কেমন থাহো, দেখতে যামু না? যাবার লাইগাই তো ঠিকানা রাখলাম।
-চল, তাড়া লাগান হোসেনে আরা আবেদীন।
অনেকের কাছে একসেট বই চাইচি, কেউ দেয় নাই। মা-বাপ না থাকলে কেউ দাম দেয় না।
এমভি সামাদ লঞ্চের দোতলা থেকে ঘণ্টাদুয়েক আগে নেমে এসেছিল নিচের ডেকে, তিন জন। ফিরে যাচ্ছে চার জন। সাধুর হাতে ওর জামা কাপড়ের একটা পুটলি। দোতলায় এসে হোসেনে আরা রুমে ঢুকে যায় সাধুকে নিয়ে। অধ্যাপক মোবারক হোসেন ঢুকে যান নিজের রুমে।
-তোর নাম কিন্ত সাধু থাকবে না, রুমে বসে পাশে বসিয়ে বলেন হোসনে আরা আবেদীন। সাধু ও হোসেনে আরার উল্টোপাশে বসেন জয়নাল আবেদীন। মনে মনে খুশি, হোসনে আরা একটা কাজ পেয়েছে। অবসরে ছেলেটাকে নিয়ে মগ্ন থাকবে।
-কী নাম রাখবেন আমার? খুব সাবলীলভাবে বলে সাধু।
-তোর নাম হবে…ভাবেন হোসেনে আরা, বলেন, তোর নাম রৌদ্র।
ফিক করে হাসে সাধু, রৌদ্র!
-তোর পছন্দ হয়নি?
-রৌদ্র মানে কি, রৌদ তো! আমার পছন্দ হইচে।
-তুই কী কী খেতে ভালোবাসিস?
-যা পাই, খাই। না পাইলে না খাই। খাওয়া দাওয়া লইয়া আমার কোনো চিন্তা নাই। আমার একটাই চিন্তা, একটু লেখাপড়া কেমনে করুম। আমি আপনাগো লগে আইচি লেহাপড়ার লাইগা।
-হ্যাঁ। তোকে তো ঢাকা গিয়েই স্কুলে ভর্তি করে দেবো।
-আমি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হমু।
-থ্রিতে কেনো?
-ঢুয়ে তো পড়েছি দুই বচ্ছর।
-দুই বচ্ছর কেন?
-ক্লাস থ্রির বই কিনতে পারি নাই যে। তহন সারে কইলো তুই এই বছরও ঢুয়ে থাক। অনেকের কাছে একসেট বই চাইচি, কেউ দেয় নাই। মা-বাপ না থাকলে কেউ দাম দেয় না।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন বিস্ময়ের সঙ্গে রৌদ্রর ভাষ্য শুনছেন। ছেলেটা অবলীলায় ঠাস ঠাস বলছে, কোনো সংকোচ, কোনো দ্বিধা নেই। না থাকার কারণ, জন্মের পর জীবনের তীব্র কষাঘাত। প্রতিটি মুহূর্তে রৌদ্র পেয়েছে মানুষের নির্মমতা। দেখেছে ওরই মতো দুপায়ের মানুষের কুৎসিত মায়াহীন দাঁতাল দাঁত। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। তাকিয়েই চমকে উঠলেন। পাড় দেখা যাচ্ছে! মানে পদ্মা পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করেছে ইছমতী নদীতে। না কি বুড়িগঙ্গায় চলে এসেছে এমভি সামাদ?
রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উঠে দরজার দিকে গেলে, প্রশ্ন করেন হোসেনে আরা, কই যাইতেছ?
-দেখি, লঞ্চটা বুড়িগঙ্গায় পড়লো কি না! তিনি বাইরে চলে এলেন। খোলা জায়গায় এসে দেখেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন আগেই দাঁড়িয়ে আছেন।
-কী ব্যাপার মোবারক সাহেব? ঘুমুলেন না?
-না, জয়নাল ভাই। জয়নাল আবেদীনকে মাঝেমধ্যে ভাইও ডাকেন। রুমে গিয়ে দেখলাম ভোর পাঁচটা। ভাবলাম, নদীর ভোর দেখা হয় না। তাই বের হয়ে এলাম। দেখেন তাকিয়ে, চারদিকে, কেমন অদ্ভুত একটা আলো ছায়ার খেলা। হালকা অন্ধকার প্রকৃতির ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, অন্যদিকে পুব আকাশ সুঁইয়ের ডগার চিহ্নে খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোটা অন্ধকার গ্রাস করে দিনের সূর্য উঠে যাবে। আর আমরা নদীর সঙ্গে ভেসে যেতে থাকবো।
-আপনি কেমন পাল্টে গেলেন মোবারক।
-পাল্টে যাওয়াই মানুষের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে আপনি যদি নদীর সঙ্গে থাকেন। নদীর জল স্রোত-রঙ আপনার চেতনার মধ্যে একটা প্রভাব রাখে। আমারে তো একেবারে পাল্টে দিয়েছে, জবাব দেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্ত্রী, আমার ভাবি হোসনে আরাকেও কিন্তু পাল্টে দিয়েছে।
-ঠিক বলেছেন আপনি, সমর্থন করেন জয়নাল আবেদীন।
আকাশ নদী কালো রঙ লাল হলুদ আভাময় সৌকর্য ধারণ করে দূরের মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবর।
দুজনে দাঁড়িয়ে আজানের ধ্বনি শুনতে শুনতে নদীর প্রবাহের জলস্রোত, পাড়ের নিঢ়শব্দে দাঁড়িয়ে থাকা বিচিত্র ধরনের, নদীর পাড়ে নানা আকার ও রঙের গাছপালার মেঘমাল্লার দেখতে থাকেন দুজনে। অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের দোলায় শিহরিত, যদিও দুজনার চোখের কোনে ঘুম উম ছড়াচ্ছে। কিন্তু নদী জলের এই স্রোতমাখা সকালের বিচিত্রময়তায় আকুল হয়ে আছেন।
এক হাতে রুটি অন্যহাতে কলা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন তাকিয়ে দেখেন চির আদিম মানবিক জল-স্রোতের দৃশ্য!
আজানটা কিন্তু অন্যরকম লাগলো, মন্তব্য করেন অধ্যাপক জযনাল আবেদীন। ঢাকা শহরে তো কত আজান শুনি কিন্তু এই মুহূর্তের আজানের ধ্বনিটা মনে হয়…খুব গভীরে প্রবেশ করেছে।
-ঠিকই ধরেছেন আপনি।
-শোনো, পিছনে এসে দাঁড়ায় হোসেনে আরা আবেদীন।
-কিছু বলবে?
জয়নাল আবেদীনের কাছে আসেন হোসনে আরা, ছেলেটার তো খিদে লেগেছে।
-কেন, কিছু খায়নি?
-না, সেই সন্ধ্যায় একটা পাউরুটি খেয়েছিল চায়ে ভিজিয়ে।
বিপন্ন বোধ করেন জয়নাল আবেদীন, কি বলছ?
-রৌদ্র তো বললো।
-আচ্ছা, আমি দেখছি, জয়নাল আবেদীন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান। অধ্যাপক মোবারক হোসেন আর হোসনে আরা আবেদীন দাঁড়িয়ে থাকেন এমভি সামাদ লঞ্চের দোতলায়, খোলা জায়গায়।
-জানেন, আমার একটা কিছু হয়েছে ভাই।
-কী হয়েছে?
আমার নদীর জলে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। যদিও আমি সাঁতার জানি না, কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে। আপনার ভাইকে বললে ভাববে আমি পাগল হয়ে গেছি। অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন হোসনে আরা, অবশ্য আমি পাগলই হয়েছি।
-আমি আপনাকে কী ডাকমু? রুম থেকে বের হয়ে আসে রৌদ্র।
-মা ডাকবি।
-মা!
-হ্যাঁ, কেন তোর লজ্জা লাগবে আমাকে মা ডাকতে?
-মাকে মা ডাকতে লজ্জা লাগবে কেন?
রৌদ্রকে দুহাতে বুকের সঙ্গে ঝাপটে ধরেন হোসনে আরা বেগম। এক হাতে রুটি অন্যহাতে কলা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন তাকিয়ে দেখেন চির আদিম মানবিক জল-স্রোতের দৃশ্য!
চলবে…