পর্ব-৩৪
হাসেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, তোমার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। অধ্যাপনার বয়স আছে আর দেড় বছর। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে এই ধরনের একটা হোটেল দিলে মন্দ হবে না। নদীতে ভাসতে ভাসতে নদীর বিচিত্র রূপ দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেবো বাকি জীবন?
তাই? খুব রহস্যময়তার সঙ্গে হাসে হোসনে আরা আবেদীন। সাধারনত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হালকা আলাপ আলোচনা কমই হয়। দুজনে ব্যস্ত থাকেন সংসার ও চাকরির বিবিধ বিচিত্র বিষয় নিয়ে। কিন্তু বরিশাল যাওয়ার পর থেকে দুজনার মধ্যে সংলাপ সংরাগে জমাট বরফ গলে এক ধরনের মিষ্টি মিশ্রিত জল দুজনার মধ্যে গলে গলে যায়। একটা বাসায় প্রায় একলা একলা থাকার মধ্যে দিয়ে দুজনার মধ্যে এক ধরনের পাথর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ইলিশ মাছের সঙ্গে ভাত মেখে শেষ লোকমা মুখে দিয়ে তাকান হোটেলের মালিক তরমুজ মিয়ার দিকে, তরমুজ মিয়া ম্যাডাম জানতে চাইছিল তোমার হোটেলে লাভ কেমন হয়?
তরমুজ মিয়ার কালো মুখে সাদা দাঁত ঝকমক করে ওঠে, কিচুতো অয়। না অইলে এত কষ্ট কইরা রাইত জাইগা কেন চালাই?
ছেলে-মেয়েরা কী করে? মুখের ভাত চিবাতে চিবাতে আবার প্রশ্ন করেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
আমার দুই মাইয়া দুই পোলা, অধ্যাপক জয়নালের দিকে পানি ভরা গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে উত্তর দেয় তরমুজ মিয়া। বড় মাইয়ার বিয়া দিছি।
লেখাপড়া? দুজনার মধ্যে ঢুকে পড়েন কবি হোসনে আরা আবেদীন।
বড় মাইয়ার পর পোলা, হের নাম হরমুজ। হরমুজ পড়ে বিএ ক্লাসে। পরের মাইয়া তাসলিমা। হেয় পড়ে নাইনে। এক্কেবারে ছোট পোলা জয়নাল মিয়া পড়ে ফাইভে, প্রাইমারিতে।
ও! তরমুজের মুখে ছেলের নাম জয়নাল শোনার সঙ্গে তিন জনে পরস্পর তাকায় এবং হাসতে থাকে।
খুব ভালো লাগলো তরমুজ সাহেব, বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, আপনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। খরচ পাতি কি এই হোটেল ব্যবসা দিয়েই চালান?
তাইলে আর কই পামু খরচ? তরমুজ মিয়া খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, আমার দূর সম্পর্কের মামু ছিল সামাদ লঞ্চের কেরইন। হেই মামু আমারে ডাইকা সামাদ লঞ্চে হোটেল চালানোর কামডা দেয়। হোটেল যে চালামু, হেই চালানও ছিল না। কেরানি মামু আমারে পাঁচ হাজার টাকা দেয়। হেই টাকা দিয়া হাঁড়িপাতিল থালাবাটি কিইনা ব্যবসা শুরু করি। তয় দুঃখ কী জানেন? আমার হেই মামু বাঁইচা নাই। তিন বচ্চর আগে মইরা গেছে…বলতে বলতে সামাদ লঞ্চের হোটেল মালিক তরমুজ মিয়ার গলা ভারী হয়ে আসে। এতক্ষণের হাসি-খুশি পরিবেশটা হঠাৎ ভারী হয়ে যায়।
তরমুজ মিয়া! খাওয়া শেষ করে দাঁড়ান অধ্যাপক মোবারক হোসেন, আপনি অনেক ভালো মানুষ। পরিশ্রম করে খেটে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করছেন…পানি দেন হাত ধোবো।
হোসেন আরা আবেদীন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বোধের গভীর থেকে শরীর দুমড়ে-মুচড়ে কান্না উথলে উঠছিল।
তরমুজ মিয়া পানি ভরা গ্লাস এগিয়ে দেয় মোবারকের দিকে। মোবারক হোসেন হাত ধুতে ধুতে আবার বলেন, আপনি বুঝরেত পারছেন ভাবি তো লঞ্চে ভাতের হোটলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে! ভাবি কি পারবেন হোটেল চালাতে আপনার মতো?
হাসে তরমুচ মিয়া, আমরা পুরুষেরা পারলে ম্যাডামও পারবেন।
ভাবি, এখন আপনার হোটেলে আমারে একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন, হাত ধুয়ে পকেটে রাখা রুমালে মুখ মুছতে মুছতে প্রস্তাব রাখেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
ঠিক আছে, আপনি কি রান্নাঘরে ভাবির কি হেল্প করেন?
মাথা দুলিয়ে হাসেন মোবারক হোসেন, ভাবি জীবনে রান্নাঘরে ঢুকিনি। আমি রান্নার কিছুই পারি না, রান্না করা খাবার খাওয়া ছাড়া!
তাহলে আপনাকে কি কাজ দেবো? হোসনে আরা আবেদীনও খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলেন, কাজ না পারলে বেতন তো পাবেন না।
রান্না করতে না পারলেও মুছতে পারি ভাবি। আপনার এই চেয়ার টেবিল থালা বাটি ধুয়ে একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবো।
ঠিক আছে ভাই, আপনার চাকরি পাক্বা আমার হোটেলে, বলতে বলতে তাকায় পাশে বসা জয়নুল আবেদীনের দিকে, তুমি? কী কী চাকরি করবা আমার ভাতের হোটেলে?
আমিও ভাবতেছিলাম, আমার মনে হয়, আমি তোমার ক্যাশ সামলানো ছাড়া কিছুই করতে পারবো না, খুব নিরীহভাবে বলেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। তোমাকে একটা বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারি।
কী বিষয়ে?
টাকা পয়সার যথাযথ হিসাব পাবে, একটা টাকার এদিক ওদিক হবে না!
অধ্যাপক মোবারক হোসেন সামাদ লঞ্চের চলমান যান্ত্রিক শব্দ, পদ্মার জলস্রোত, ঘুমন্ত যাত্রি, জেগে থাকা যাত্রিদের ফাটিয়ে হো হো হসিতে ভেঙে পড়লেন, এদেশের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক শেষ পর্যন্ত সামাদ লঞ্চের ভাতের হোটেলের ক্যারিয়ার!
আরে মিয়া আমি ক্যাসিয়ার, আপনি কে? কলিগ ও বন্ধুকে হাসতে হাসতে এক পাট নেওয়ার চেষ্টা করেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
আপনি ক্যাসিয়ার আর আমি ডেসিয়ার! অম্লান বদনে বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
ক্যাসিয়ার তো বুঝলাম, ডেসিয়ার কী? প্রশ্ন করেন হোসনে আরা।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়ে যেসব বাঙালিরা হোটলে হোটেল খাবারের পর এটোঁ ডিস ধুয়ে পরিষ্কার করে থাকে, তাহাদের ডেসিয়ার বলে ভাবি।
ডেসিয়ার? অবাক হোসেন আরা আবেদীন। এমন শব্দ তো জানা নেই।
জানবেন কী করে? এই শব্দ তো ডিকশনারিতে নেই। কাজের বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিরা এই শব্দ আবিষ্কার করেছে, সরি আবিষ্কার না ভাবি, উদ্ভাবন করেছে। ডিস ধৌত বা ধোয়া থেকে ডেসিয়ার শব্দ। বিদেশ থেকে দেশে এসে তো বলতে পারে না, আমি হোটেলের ডিস ধুই। যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি বিদেশে কী চাকরি করো? উত্তরে বলে, আমি ডেসিয়ার পদে চাকরি করি, পাঁচ তারা হোটেলে। এখন সাধারণ মানুষতো ভালো শিক্ষিতজনেরাই বোঝে না জানে না, ডেসিয়ার কী? আবার তো স্বীকার করতেও কুণ্ঠা, ডেসিয়ার শব্দটা মানে জানে না। সুতরাং সবাই মেনে নেয়, ডেসিয়ার মানে বিদেশে হোটেল অনেক বড় একটা পদ আর কী! এক নাগারে বলে থামেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
অবাক তাকিয়ে থাকেন হোসনে আরা, আপনি সত্যি বলছেন?
ঘাড়ে নাড়েন মোবারক, জি আপা। এই ঘটনা গত শতকের আশি নব্বইয়ের দিকে ঘটেছিল বাংলাদেশে। শুরুতে হাসি পেলেও পরে আমি অনেক ভেবেছি ডিসেয়ার শব্দটি নিয়ে। প্রথম দেখুন, মানুষের আত্মমর্যাদার প্রবঞ্চনা। মানুষ কোনোভাবেই অন্যর কাছে নিজে ছোট হতে চায় না। ছোট বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবন ও জীবিকার বিরুদ্ধে কাজ করলেও মানুষ নিজেকে পরিচয় দেওয়ার সময়ে সচেতন থাকে, যেন আত্মমর্যাদার কোনো ঘাটতি না থাকে! দ্বিতীয়ত বিদেশে কে দেখতে যায়, কে কী কাজ করছে? সুতরাং মিথ্যা বললে কোনো সমস্যা নেই। ভাবি, মানুষ এক আজব প্রাণী! তো আমি আপনার হোটেলের ডিসেয়ার হবো।
তরমুজ মিয়ার হোটেলে দিনে রাতে বিচিত্র ধরনের ক্রেতা আসে খেতে, কিন্তু আজকের গভীর রাতের এই ধরনের ক্রেতাদের সঙ্গে আগে দেখা হয়নি। গল্প ও আড্ডার মধ্যে তিনজন বয়স্ক মানুষের পরিচয় অনেকটা অনুভব করেছে তরমুজ মিয়া। লেখাপড়া করতে না পারলেও সামাদ লঞ্চে ভাতের হোটেল দিতে বিচিত্র যাত্রীদের আনাগোনায় এক ধরনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।
তরমুজ মিয়া সাহেব, কত হলো আপনার? খাওয়া শেষে স্বামী জয়নাল আবেদীনকে ঠেলে সরিয়ে তরমুজ মিয়ার সামনে দাঁড়ায় হোসনে আরা।
কী হলো, বিল তুমি দেবে নাকি? খানিকটা বিস্মিত অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
দুজনার থেকে সামান্য পিছনে দাঁড়িয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধুর নিবিড় লেনদেন দেখছেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। ইতোমধ্যে দুই-তিন জন যাত্রীও খেতে এসেছে। তরমুজ মিয়ার ও হোটেলের কর্মীদের সঙ্গে সবাই দেখছে মধ্য রাত পার হওয়ার পরে সামাদ লঞ্চে বয়স্ক তিনজন যাত্রীর কলহাস্য।
হ্যাঁ আজকের বিলটা আমিই দেবো। কারণ, আমিও তোমাদের এখানে খেতে এনেছি। দেশে বিদেশে এখানে সেখানে খাইয়ে তুমিও বিল দিয়েছ, কিন্তু আজকের এই বিলটা আমি দিয়ে স্মৃতির খাতায় নতুন কবিতা লিখতে চাই, মৃদু হাসির তরঙ্গে বলেন হোসনে আরা আবেদীন।
ঠিক আছে, দাও। সমৃদ্ধ হোক তোমার স্মৃতির কবিতা, সহাস্যে বলেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
ভাই বললেন না, কত হয়েছে আপনার বিল? ব্যাগের মধ্যে থেকে টাকা পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে তরমুজ মিয়ার সামনে ধরেন হোসনে আরা আবেদীন।
আফা, আমি এই এম ভি সামাদ লঞ্জে আট নয় বচ্ছর হোটেল দিচি। কত মানুষ আমার হোটেলে খাইচে, গুইনা শ্যাষ করতে পারমু না। কিন্তু আপনাগো নাহান কোনো মানুষ পাইলাম, পেরতম। আমি গরীব মানুষ ঠিকই, তয় আমার অন্তরটা অনেক বড়। আমি আপনাগো কাছ দিয়া বিল নেতে পারমু না, শেষের দিকে কেমন গলা ধরে আসে তরমুজ মিয়ার।
কবি হোসনে আরা আবেদীন, অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ও অধ্যাপক মোবারক হোসেন, অবাক তিন জনই। তরমুজ মিয়া পেটের ওপর ফেলে দেওয়া গামছা দিয়ে শরীর মুচছে। হোটেলে কর্মীরাও অবাক হয়ে মালিকের কাণ্ডকারাখানা দেখছে। যে মানুষটা খাবারের হিসাব পাই পাই বুঝে রাখে, কোনোদিন কাউরে এক টাকা ছাড় দেয় নাই, সেই।
সে কী কাণ্ড! টাকা নিবেন না কেন? হোসনে আরা আবেদীন খাবার টেবিল ঘুরে আরও সামনে যান, এগিয়ে দেন পাঁচশ টাকার নোটটা, নিন, আপনি ব্যবসা করতে এসেছেন না? এই ব্যবসার টাকা দিয়ে সংসার চালান, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখান; নিন, টাকা রাখুন…মৃদু ধমক দেন।
তরমুজ মিয়া হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে হোসনে আরা আবেদীনের কোমল মুখের দিকে, আফা; কইলাম তো। আমি গরিব মানুষ। জীবনে ক্উারে কিছু দিতে পারি নাই। আপনারে আমার দাদির মতো লাগতেছে, আফা আমারে মাফ কইরা দেন, মানুষটা; এমভি সামাদ লঞ্চের ভাতের হোটেলের মালিক তরমুজ মিয়ার দুচোখে পানি। কাঁদছে।
সবাই হতবাক হয়ে দেখছে তরমুজ মিয়া কাঁদছে মাথা নুইয়ে।
হোসেন আরা আবেদীন হাতের টাকাটা নিয়ে বিমূঢ় তাকিয়ে থাকেন তরমুজ মিয়ার কান্নাকাতর মুখের দিকে। পেছনে এগিয়ে এসে হোসেন আরার কাঁধে হাত রাখেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, ওকে টাকাটা দিও না। মানুষের চোখের জলের কোনো মূল্য হয় না।
ঠিক বলেছেন আপনি, আর একটু পেছনে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক জয়নালকে সমর্থন করেন সহকর্মী অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
ঠিক আছে, হোসনে আরা টাকাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে পেছনে ফিরে, মানুষের দঙ্গল পার হয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে শুরু করেন। যেতে যেতে তিনিও কাঁদছেন। বুঝতে পারছেন না, কেন চোখে জল নামছে? অবিরল এক আনন্দ উচ্ছাসে হৃদয়ের তন্ত্রী ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। হোসেন আরা আবেদীনের পেছনে পেছনে যাচ্ছেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ও মোবারক হোসেন। সিঁড়ির গোড়ায় এসে তিনজনে দাঁড়ায়। লঞ্চের পূর্ব দিকটা অনেকটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নদীর জলের তরঙ্গ। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় জলের তরঙ্গের মাথায় ভেঙে পড়া ঢেউ জ্বলছে। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে নদীর জলের তরঙ্গে আলোর সঙ্গত দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে যায়। হোসেন আরা আবেদীন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বোধের গভীর থেকে শরীর দুমড়ে-মুচড়ে কান্না উথলে উঠছিল।
একটা দাবি হরি আপনাগো কাচে, পোলডা খুব বালা। অরেক স্মরণশক্তি; একটা কতা কইলে ভোলে না। মুইতো চায়ের দোকানদার। পোলাডারে আপনেরা লইয়া যান।
কী অবাক ঘটনা! বরিশাল টু ঢাকাজল পথের এমভি সামাদ লঞ্চের ভাতের হোটেলের মালিক তরমুজ মিয়ার জন্য কেন এমন কান্না উথলে উঠছে? তিনি সবাইকে গোপন করে বিপরীত দিকে তাকিয়ে আঁচলে চোখ মুচছেন বার বার। পরিবেশটা সহজ করার জন্য অধ্যাপক মোবারক বলেন, এক কাপ চা হলে।
আমারও চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, সমর্থন করেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
চলুন, লঞ্চের পেছনে চায়ের দোকান আছে। তিন দিন আগে আমাদের চা খাইয়েছিল আবদুল মতিন; ঘুমন্ত, আধা জাগ্রত যাত্রীদের মধ্যে দিয়ে ছোট যাত্রাপথ, সেই পথে হাঁটতে শুরু করে।
পেছনে পেছনে আসেন অধ্যাপক জয়নাল ও হোসনে আরা আবেদীন। দুই পাশের অবিন্যস্ত সারিবদ্ধ ঘুমন্ত নাকডাকা যাত্রীদের এলেমেলো হাত পা মাথামুণ্ডুর মধ্যে দিয়ে সরু পথে হাঁটতে হাঁটতে সামাদ লঞ্চের পেছনে, মেশিন ঘরের পরেই যেতেই দেখা হয়ে যায় টি-বয় ছেলেটার সঙ্গে। টি-বয় ছেলেটা আবদুল মতিনের পরিচিত। তিন জনকে দেখে ছেলেটা হাসে।
তোর নাম কিরে? জিজ্ঞেস করেন মোবারক হোসেন।
হাসতে হাসতে জবাব দেয়, মোর নাম সাধু।
সাধু? শোকাক্রান্ত মুখে হাসি ফোটে হোসনে আরা আবেদীনের। কোন বনের সাধু তুমি?
আমি বোনের সাধু না আফা! আমি লঞ্চের সাধু; হাতের চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরে চায়ের খুপরী দোকানের মালিক মিলনের দিকে।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন তাকান মিলনের দিকে, আমাদের তিন কাপ চা দিন।
দিচ্ছি। মিলনের গলা চড়ে যায়, এই সাধু! কাপ দিলি, পিরিচ দিলি না?
দিতাচি! সামনে রাখা পানি ভরা বালতির মধ্যে হাত দিয়ে পিরিচ বের করে আনে সাধু। তিন পা হেঁটে তিনটা পিরিচ বাড়িয়ে ধরে, নেন।
মিলন দ্রুত হাতে চা বানিয়ে পিরিচের ওপর রেখে তাকায় অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের দিকে, নেন স্যার।
তিন জনে তিন কাপ চা নিয়ে চুমুক দিচ্ছে, রাতের নদীর স্রোত, লঞ্চের হুম হুম হুম অবিশ্রান্ত শব্দ অদ্ভুত প্রান্তে দাঁড়িয়ে শহরের জীবনযাত্রায় বেড় ওঠা, ভিন্ন ধরনের এক বিমূর্ত ক্যনভাসে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে জলস্রোত আর সামাদ লঞ্চের নিনাদ।
তুই কবে থেকে লঞ্চে রে? জিজ্ঞেস করেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
তিন বছর হইছে না ওস্তাদ? বালতির পিরিচ কাপ তুলতে তুলতে সাধু তাকায় মিলনের দিকে।
ওর বয়স কত? অবাক গলা হোসনে আরা আবেদীনের।
নয়-দশ বছর হবে আফা, মিলন কাছে দাঁড়িয়ে আর একজন যাত্রীর দিকে চায়ের কপা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ও ভালো বংশের পোলা। ওর বাবা ছিল কলেজের মাস্টার। বিয়া করছিল এক হিন্দুর মাইয়া। পেরেমের বিয়াতো। ওর দাদায় বিয়া মানে নাই। কলেজ দিয়া বাড়ি যাওয়ার সমায়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট কইরা লগে লগে মইরা যায়। ওর মায়ের পেটে ছিল একটা মাইয়া। হেই মাইয়া জন্ম দিতে যাইয়া মায়ে মাইযায় এক লগে মরচে। পোলাডা রাস্তায় রাস্তায় গুরতো।
লেখাপড়া?
সাধুর অনেক মাতা। বরিশাল শহরে থাহার সমায়ে একটা এন জিওর স্কুলে পড়ছে কয়েক মাস। ওই সাধু, নদী ইংরাজি কী?
রিভার।
পানি ইংরেজি কী? প্রশ্ন করেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
ওয়াটার।
চা ইংরেজি কী? জানতে চান হোসনে আরা আবেদীন।
টি।
খেলায় পেয়ে বসে তিনজনকে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অধ্যাপক মোবারক হোসেন প্রশ্ন রাখেন, বলতো মানুষ ইংরেজি?
ম্যান! সাধুও মজা পেয়েছে। মুখে হাসি আর হাতে চলে কাজ। দ্রুত হাত চালান দিয়ে বালতির জলের ভেতর দিয়ে কাপ পিরিচ প্লেট নিয়ে আসছে। হাতের কাছে রাখা ভেজা রুমালে মুছে মুছে তুলে দেয় মহাজন মিলনের হাতে।
বলো তো বাংলাদেশ ইংরেজি কি?
প্রশ্ন শেষ করতে পারেন না হোসনে আরা আবেদীন, মুহূর্তের মধ্যে জবাব দেয় সাধু, বাংলাদেশ।
শেখ মুজিবুর রহমান? প্রশ্ন করেন জয়নাল আবেদীন।
এক মুহূর্তও সময় নেয় না সাধু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক; অধ্যাপক মোবারক হোসেন ও অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন এবং ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক হোসনে আরা আবেদীন চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন সাধুর দিকে। সাধু নিজের অভ্যাস অনুসারে বালতিতে হাত দিয়ে পানির মধ্যে থেকে তুলে আনছে কাপ পিরিচ প্লেট।
ম্যাডাম? মিলন মধুর স্বরে ডাকে মিলন।
বলুন, সাড়া দেন হোসনে আরা আবেদীন।
আপনারা কারা মুই জানি না। তয় তিন দিন আগে ও আপনগো চা বিসকুট খাওয়াইচে। সেইদিন ঝড় আছিল, মোরা কেউ বাইচা থাকুম আশা আছিল না। সাধু আপনাগো চা খাওয়াইচে। আর আবদুল মতিন স্যার আমাগো অনেক দিনের পরিচয়। এই সামাদ লঞ্চে ঢাকা টু বরিশাল আসা যাওয়া করতে করতে মোগো রগে পরিচয় অইচে। একটা দাবি হরি আপনাগো কাচে, পোলডা খুব বালা। অরেক স্মরণশক্তি; একটা কতা কইলে ভোলে না। মুইতো চায়ের দোকানদার। পোলাডারে আপনেরা লইয়া যান।
আরও পড়ুন: মোকাম সদরঘাট-৩৩॥ মনি হায়দার