(পর্ব-৩৩)
কিছুক্ষণ পরে হোসনে আরা আবেদীন আর জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগ দেন পাশের রুমের অধ্যাপক মোবারক হোসেন। অন্ধকারের মধ্যে হালকা ঝড়। দুলছে সামাদ। দুলছে যাত্রীরা। অধ্যাপক মোবারক হোসনেকে দেখে হাসেন কবি হোসনে আরা আবেদীন, আপনি ভয় পাচ্ছেন না?
একটু পাচ্ছি, কিন্তু সেই তিন দিন আগের মতো না। আর সেদিনের মতো ওলট পালট অবস্থা তো না। অনেকটা কম ঝড়। বরং ভালোই লাগছে। নদীতে ভ্রমণ করবেন আর ঝড়ের কবলে পড়বেন না, এমন তো হওয়ার কথা না। জীবনের এই অবাক অভিজ্ঞতা থাকাও দরকার, হালকা হাসির সঙ্গে বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
হঠাৎ একটা ধমকা হাওয়ার সঙ্গে ঢেউয়ের পানি ছিটকে তিনজনের শরীরে লাগে হালকাভাবে। তিনজনের কেউ ভয় পান না। বরং শরীরের হালকা ভেজা কাপড় নিয়ে হাসেন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। পাশ দিয়ে সিটি বাজিয়ে আর একটি লঞ্চ চলে যায়, লঞ্চটা বেশ বড়। দ্রত চলে যাওয়া এবং আলোর স্বল্পতার কারণে লঞ্চটার নাম পড়তে পারলেন না কেউ। কিন্ত গভীর রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে সুগভীর পদ্মার জলস্রোতে নিজেদের লঞ্চের পাশ দিয়ে বিপরীতে আর একটা লঞ্চের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের সঙ্গে মেশিনের ভৌতিক শব্দ, লঞ্চের ভেতরের আলো ছায়ার কৌতুক অদ্ভুত অপার্থিব পরিবেশ তিনজনকে মুগ্ধ করে। বাতাসের ঝাপটা কমে এসেছে অনেকটা। সামাদ লঞ্চের কেবিনের ভেতরে থাকা যাত্রীরা দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছে। অনেক কেবিনের ভেতরের খাটে বসে জানালা খুলে গলা বাড়িয়ে বাইরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন জয়নাল আবেদীন, রাত দুটো বাজে। অথচ দেখো আমার চোখে একফোটা ঘুম নেই। বাসায় থাকলে কখন ঘুমিয়ে যেতাম!
ভ্রমণের ওপর থাকলে আমারও ঘুম আসে না, সারা রাত চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি; বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। বিমানে দূরের পথে গেলে যন্ত্রণা আরও বাড়ে। ট্রেনে বাসে গাড়িতে এমনকি এই লঞ্চেরও বাইরের দৃশ্যাবলি পাল্টে যাচ্ছে, দেখতে অনুভব করতে ভালোই লাগে। কিন্তু বিমানের পথে জানালা দিয়ে একমাত্র শূন্য আকাশ দেখা ছাড়া কিুছই দেখা যায় না। আমার বিমান ভ্রমণ খুব বিরক্ত লাগে।
মতিনটা থাকলে খুব ভালো হতো, পদ্মার হালকা কিন্ত মাঝারি ধরনের ঢেউয়ের দিকে চোখ রেখে বলেন কবি হোসনে আরা আবেদীন।
কেন? কী সমস্যা তোমার? পাশে দাঁড়ানো স্বামী জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন করেন।
জল থেকে চোখ ফিরিয়ে উত্তর দেন হোসনে আরা, এক কাপ চা পেলে খুব ভালো হতো।
সমর্থন করেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, ভাবি, আমার খুব ইচ্ছে এক কাপ চায়ের…। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। বাসায় থাকলে আমি অনেক রাতে চা তৈরি করে পান করি। গলাটা খুস খুস করছে।
সঙ্গে সঙ্গে আবার বাতাসের হালকাভাবে দুলুনি দিয়ে যায় সামাদ লঞ্চটাকে। লঞ্চের দুলুনির সঙ্গে তিনজনেও একটু নড়ে যায়। যেতে যেতে রেলিং ধরে সামলে নেন জযনাল আবেদীন। জয়নাল আবেদীনকে ধরেন হোসনে আরা আবেদীন। আর মোবারক হোসেন কেবিনের জানালার শিক ধরে সামলে নেন।
সেদিনের মতো আবারও এলো না কি ঝড়? নিজেকেই বলেন অধ্যাপক মোবারক।
ঝাপটার পর লঞ্চ অনেকটা আগের মতো স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতাকে অনুভব করে জবাব দেন জয়নাল আবেদীন, না মনে হয়। বড় নদীতে এই ধরনের দুই একটা ঢেউ মাঝে মধ্যে হয়।
ভাবী, এক কাজ করলে কেমন হয়?
হোসেন আরা আবেদীন তাকান মোবারক হোসেনের দিকে, কী কাজ ভাই?
চলুন, আমরা নিচে যাই।
নিচে যাবো?
হ্যাঁ, নিচে মেশিন ঘরের ওখানে চায়ের দোকান আছে।
তাই না কি?
হ্যাঁ। সেখানে গিয়ে গরম গরম চায়ের সঙ্গে বিসটুকও খেয়ে আসবো আর নিচতলার ডেকের যাত্রীদের অবস্থাটাও দেখা হবে।
খুব মজা পান হোসনে আরা আবেদীন। হাসেন শিশুর সারল্যে, চলুন তো। তাকায় স্বামীর দিকে, তুমি কী করবে?
তোমরা গেলে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো না কি? আমিও যাবো।
কিন্তু রুম তো খোলা।
ভয় নেই চাবি দিয়ে আটকে যাবো। তুমি অপেক্ষা করো।
কাঁধের গামছা নামিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে সাদা দাঁত বের করে হাসে, বসেন স্যার বসেন। তাকায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লোক মনোতোষের দিকে, টেবিলটা ভালো কইরা মুইছ্যা দে ছেমড়া।
জয়নাল আবেদীন পকেট থেকে চাবি বের করে ক্যাবিনে তালা লাগালেন। পাশে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক মোবারক হোসেনও নিজের ক্যাবিনের তালা লাগিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করলেন। তিন জনের মধ্যে রাতে সামাদ লঞ্চের দোতলার ছাদে এসে দাঁড়ালেন। তাকালেন চারদিকে, এক অবিনশ্বর দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে তিন জন। ছাদে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আরও যাত্রীরা শুয়ে আছে যেখানে সেখানে। অনেকেই শরীরের ওপর পাতলা কাঁথা দিয়ে নির্ভার ঘুমিয়ে। এক যাত্রীতো ভয়নাক নাক ডাকছে। দুই বন্ধু সিগারেট টানছে আর গল্প করছে।
কবি দেখুন তো।
হোসনে আরা আবেদীন তাকান পাশে দাঁড়ানো অধ্যাপক মোবারকের দিকে। তাকিয়ে দেখেন তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশে। আকাশে অদ্ভুত খেলা চলছে। বাতাস অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে কিন্তু হালকা বায়ে বাতাস গোত্তা খায় মাঝে মধ্যে। পদ্মার ঠিক জায়গা দিয়ে বিরাট বপুর লঞ্চ সামাদ চলছে, বোঝা যাচ্ছে না। লঞ্চের আনাড়ি যাত্রীদের বোঝা বা অনুমান করাও কঠিন। যেদিকে তাকায়, পানি পানি আর পানির অবাক অগাধ প্রবাহ।
চারদিকে তাকিয়ে যেমন ভয় লাগে, তেমন বিস্ময়ও জাগে, না? হোসনে আরা আবেদীন গাম্ভির্যের চাদর খুলে কেমন হাসি কোমল মানুষের পরিণত হলেন। আপনি আকাশের দিকে কী দেখাচ্ছিলেন?
আপনি তাকিয়েই দেখুন ভাবি, এমন অবাক আকাশ পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে দেখার স্মৃতিটাই ইতিহাস।
অধ্যাপক জয়নাল ও হোসনে আরা তাকালেন। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়েই রইলেন। আকাশের মাঝ বরাবর খণ্ডিত অর্ধেক চাঁদ। অর্ধ খণ্ডিত চাঁদের কেন্দ্রভাগে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিচিত্র ধরনের কালো মেঘ। একেবারে জমকালো খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে যেতে যেতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ঢেকে দেয় চাঁদটাকে। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা নদীতে, জলে ও হালকা তরঙ্গের ওপর নেমে আসে নিপাট অন্ধকার। ঝটিতে কালো মেঘ সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার হেসে ওঠে নদী, নদীর জল ও তরঙ্গ। দোতালার বিচিত্র ধরনের যাত্রীদেরও দেখা যায়, মেঘ ও চাঁদের খেলা দেখছে আর ঝিমুচ্ছে।
সত্যি, প্রকৃতির কোনো তুলনা হয় না। আপন মনে বলেন হোসনে আরা আবেদীন।
অধ্যাপক মোবারক বলেন, বুঝলেন জয়নাল ভাই, গোবিন্দ দা আর মহুয়া, সুকন্যা বাসের যাত্রী হয়ে প্রকৃতির এই বিস্ময়কর রপ রস সৌন্দর্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছেন।
ঠিক বলেছেন, সমর্থন করেন হোসনে আরা। ভাগ্যিস আমি সাহস করেছিলাম। খিল খিল হাসির সঙ্গে শরীরে একটা ঢেউ তোলেন তিনি। অধ্যাপক দুজনে গভীর নিশিথে পদ্মার বুকে এম ভি সামাদ লঞ্চের নয়নাভিরাম দৃশ্যর সঙ্গে মধ্যে বয়সী এক নারীর পরম লগ্নও উপভোগ করেন।
চায়ের তেষ্টা তো বেড়ে যাচ্ছে। তাড়া দেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
ও হ্যা চলুন। সামনে, সিঁড়ির দিকে পা বাড়ান অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
তিন জনে সিঁড়ি বেয়ে নীচে ডেকে নেমেই বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকেন। বিশাল ডেক জুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। মানুষ যে বিচিত্র উপায়ে ঘুমাতে পারে, সামাদ লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন ও দেখছেন তিনজনে। বিশেষ করে ছেলে বা পুরুষেরা ঘুমিয়ে থাকায় বাতাসের তোড়ে লুঙ্গি উড়ে উড়ে যেতে চায়। কিন্তু কেউ ভ্রূক্ষেপও করছে না। সিঁড়ির একেবারে গোড়ায় বয়স্ক এক নারী ও দুই পুরুষ যবুথবু বসে আছেন। নারীর মুখের ওপর ঘোমটা। কিন্তু তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে করুণ সুরে কাঁদছেন। পুরুষ দুজন। বোঝা যায় একজন পিতা, অন্যজন পুত্র। ভাবলেশহীন মুখে নদীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছেলেটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, কী হয়েছে ওনার?
কিছু না, গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়। বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি খুব বিরক্ত। কিন্তু নাছোড়বান্দা অধ্যাপক মোবারক, কাঁদছেন কেন?
ছেলেটি মুখটি কঠিন করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু পাশের ভদ্রলোক, ছেলেটির বাবা মুখ খোলেন, আমার স্ত্রী।
ও, কিন্তু কাঁদছেন কেন?
আমাগো বড় পোলা শাহজামাল ঢাকায় থাহে। রিশকা চালায়। গত পরশু চিঠি পাঠাইচে, হেয় এক্সিডেন্ট করছে। পঙ্গু হাসপাতালে আচে। হেই খবর পাওয়ার পর থেকে কানতাছে।
বুঝতে পেরেছি, অধ্যাপক মোবারকের গলায় দুঃখ উপচে ওঠে। মা তো কাঁদবেনই। তিনি অনেক দূরের প্রান্ত থেকে হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন। চলুন।
সিঁড়ির কাছ থেকে লঞ্চের মাঝ বরারব আসতেই লঞ্চের সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেন তিনজনে, হোটেলে খাবার খাচ্ছে অনেকে। লঞ্চের একেবারে সামনের বাম পাশে অনেক খানি জায়গাজুড়ে খাবারের হোটেল। বড় একটা বেঞ্চ। বেঞ্চের সামনে একটা লম্বা টেবিলের ওপর গরম ভাতের ভাপ উঠছে। পাশের কেরাসিনের পাম্ব চুলায় ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে। ভুরভুর গন্ধে গোটা লঞ্চের ডেকেটা ভরে গেছে। বেঞ্চের ওপর বসে গরম ভাত আর গরম ইলিশ খাচ্ছে। একজনে খাবার শেষ করে থালাটা চাটছে।
শুনেছি লঞ্চের গরম ভাত আর গম ইলিশ অনেক সুস্বাধু হয়, বলেন মোবারক হোসেন। টেস্ট করবেন?
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের আগেই বলেন হোসনে আরা আবেদীন, আমি খাবো। এই জীবনে আর কোনোদিন এমন সুযোগ আসেব না।
স্ত্রীর আগ্রহে হাসেন অধ্যাপক জয়নাল, ঠিকই বলেছো। এই জীবনে এই সুযোগ আসার সুযোগই হবে না। তাকান অধ্যাপক মোবারকের দিকে- চলুন, টেস্ট করা যাক।
যাত্রীরা বিচিত্র ভঙ্গি ও উপায়ে ঘুমিয়ে সামাদ লঞ্চের গোটা ডেক জুড়ে। সিঁড়ির গোড়া থেকে হোটেলের দিকে যাবার পথেও যাত্রীরা ঘুমিয়ে গেছে, যে যার মতো। কিন্তু হোটেলে যাওয়া ও আসার জন্য মাঝখানে ছোট একটা পথ তৈরি আছে। ইতিমধ্যে খাওয়া শেষ করে দুজন যাত্রী বের হয়ে আসছে সেই ছোট পথ ধরে। চোখে মুখে বিপুল আনন্দ আর তৃপ্তি উপছে পড়ছে। যাত্রী দুজন পাশ কাটিয়ে চলে গেলে ঢোকে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, হোসনে আরা আবেদীন আর অধ্যাপক মোবারক হোসেন। প্রচলিত পোষাকের বাইরে কোট টাই পরিহিত দুইজন সৌম্য দর্শন যাত্রী আর সঙ্গে একজন মধ্যবয়সী কিন্তু শাড়ি অলংকারে গাম্ভীর্যে হোসনে আরাকে বেশ ভারিক্কিচেহারায় অন্যরকম লাগে। তিন জনকে সরাসরি হোটেলে দেখে মালিক তরমুজ মিয়া বিচলিত।
দাঁড়িয়ে সালাম দেয় তরমুজ মিয়া। তরমুজ মিয়ার গায়ের রঙ বেজায় কালো। মাথার চুল শরীরের চুলের সঙ্গে মিলিয়ে কালো কিন্তু মুখের দাঁতগুলো পরিপাটি আর সাদা। তরমুজ মিয়া খুব একটা হাসে না, সব সময়ে গম্ভীর থাকতে পছন্দ করে। কিন্ত হাসলে মুখের আদলে দেখা যায় এক ফালি চাঁদ। দিনরাত হোটেলের ভিতরে হাতলঅলা একটা বড় চেয়ারে বসে থাকার কারণে, শরীর থেকে পেটটা বের হয়ে গেছে প্রায় চার পাঁচ ইঞ্চি। ফলে গোটা শরীরের সঙ্গে চর্বিঅলা পেটটাও চলে। এতোক্ষণ সামাদ লঞ্চের সাধারণ যাত্রীরা খেয়েছে, তরমুজ মিয়া সেইসব যাত্রীদের পাত্তা দেয় না। কাঁে র উপর একটা গামছা রেখে পেটটা বের করে চেয়ারের উপর আয়েশ করে বসেছিল তরমুজ মিয়া। পাশেই পাম্প চুলার উপর ইলিশের রান্না চলছে। ভাজার চড়চড় শব্দে আর চুলোর শো শো শব্দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ইলিশের মোহনীয় গন্ধও। হঠাৎ মাঝরাতে হোটেলে সুবেশেধারী তিন খদ্দের দেখে দাঁড়িয়ে যায় তরমুজ মিয়া। কাঁধের গামছা নামিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে সাদা দাঁত বের করে হাসে, বসেন স্যার বসেন। তাকায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লোক মনোতোষের দিকে, টেবিলটা ভালো কইরা মুইছ্যা দে ছেমড়া।
কানের কাছে মুখ নিয়ে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার? এত খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করছো, সব ফেলে লঞ্চে ভাতের হোটেল দেবে না কি?
খাবার টেবিলের নিচে রাখা টেবিলের ময়লা মোছা ময়লা মাখা কাপড় তুলে মনোতোষ দ্রুত টেবিল মুছতে থাকে। অন্য ছেলেটি দ্রুত তিনটা গ্লাস ধুয়ে টেবিলের ওপর রাখে।
কী খাবেন আপনারা? মোলায়েম গলায় জানতে চায় তরমুজ মিয়া।
বসতে বসতে বলেন হোসেন আরা, কী আর খাবো গরম ভাত আর গরম ভাজা ইলিশ ছাড়া। থালা ভালো করে ধুয়ে গরম ভাত আর গরম ইলিশ দিন তিনজনকে।
মনোতোষ, তাড়াতাড়ি ওনাগো পেলেট দে আর গ্লাস ভইরা পানি দে।
দ্রুত গ্লাস আর পানি দিলে তিনজনে প্লেটে পানি ঢেলে সময় নিয়ে ঢলতে থাকে। তিনজন ওপরতলার মানুষ এসেছে হোটেলে, যা খুবই কম ঘটে- জানে তরমুজ মিয়া। কেবিনের যাত্রীরা সব সময়ে অর্ডার দিয়ে খাবার নিজেদের রুমে নিয়ে যায়। সেখানেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে টাকা পাঠিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে যে উঁচু ধরের যাত্রীরা যে খেতে আসে না হোটেলে , তা নয়, আসে। কিন্ত সেইসব যাত্রীরা তরুণ তরুণী। অল্প বয়স- এক সঙ্গে বসে মজা করে খায় আর গল্প করে। কিন্ত মধ্যে বয়সের যাত্রীরা আসেই না প্রায়।
স্যার লবন লইবেন? কর্নারে বসা অধ্যাপক মোবারককে জিজ্ঞস করে তরমুজ মিয়া।
থালা ঢলতে ঢলতে বলেন তিনি, খাবার সময়ে ভাতে আমি লবন খাই।
সামান্য হাসে তরমুজ মিয়া, আমি বলছিলাম পেলেড পরিষ্কার সময়ে পানির লগে লবণ মিশাইয়া ঢললে পেলেড পরিষ্কার হয় ভালো।
তাই না কি? দাও তো লবণ।
এ গিয়ে দেয় লবণের বাটিটা তরমুজ মিয়া।
প্লেটের পানির মধ্যে লবন ঢেলে মিশিয়ে নাড়াচাড়া করে পানিটা ফেলে দেয় নিচে রাখা বালতিতে। অধ্যাপক মোবারক হোসেনের দেখাদেখি প্লেটে লবন মিশিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে হোসেন আরা আর অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনও।
পরিষ্কার প্লেটে তরমুজ মিয়া গরম ভাপ ওঠা ভাত দেয় দুই বড় চামচে করে। চুলোয় ইলিশ রান্না করা ছেলেটা কায়দা করে বড় তাগাড়ি নিয়ে একেবারে সামনে আসে, কন কোনটা লইবেন?
ইলিশ মাছের এক কড়া গন্ধ আর কড়া হলুদ রং দেখে হোসনে আরার মুখে অবাক আনন্দ ভেসে ওঠে, তিন জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। ইলিশ মাছের গরম ভাপে, তাগাড়ির গরমে মুখটা জ্বলে যায়। হোসনে আরা আবেদীন ইশারায় বড় একটা টুকরো ইলিশ দেখিয়ে দিলে, মাছটা পাতে দেয়। দুই অধ্যাপকও দেখিয়ে দিলে সেই ইলিশের টুকরো দিয়ে তাগাড়ী নিয়ে চলে যায় ছেলেটা।
গরম ভাই, গরম ইলিশ ভাজা, গভীর রাত। বিশাল পদ্মা পাড়ি দেওয়ার ক্ষণ ঢাকা শহরের তিনজন মধ্যে বয়েসর সুখী মানুষ ভাতে ইলিশ মেখে মুখে দিচ্ছেন, মুখ জিহবা নেড়ে। দাঁতের সংযাগে খাচ্ছেন, চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যায়, দারণ উপভোগ করছেন।
প্রথম লোকমা পেটে চালান করে দিয়েই ঝালে একটু কাহিল অবস্থায় প্রায়য়োল্লাস করে ওঠেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, ডেলিশাস!
সত্যি অসাধারণ। খেতে খেতে জবাব দেন মোবারক হোসেন, কত দেশে কত ধরনের খাবারই না খেয়েছি কিন্ত আজকের এই মুহূর্তের খাবারের কোনো তুলনা হয় না ভাবি। ঝালের কারণে একটু পানি মুখে দিয়ে আবার বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, কত নামি দামি তিন তারকা- পাঁচ তারকা হোটেলে খেয়েছি, সত্যি বলছি নদী পথের আজকের এই ইলিশ মাছ আর গম ভাতের কোনো তুলনায়ই হবে না।
সত্যি, আমারও ভীষণ ভালো লাগছে, অথচ দেখেন কতো অডিনারী রান্না! বলেন হোসনে আরা আবেদীন।
আমি আগেও অনেকের কাছে শুনেছি, লঞ্চের খাবার খুব সুস্বাদু। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আপনার ভাবি যখন খাওয়ার প্রস্তাব দেয়, টেস্ট করার জন্য রাজি হই। সত্যি, রাজি না হলে একটা তৃষ্ণা বা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। তাকায় স্ত্রীর দিকে, তোমাকে ধন্যবাদ হোসনে আরা।
কবি হোসেন আরার মুখে তীর্যক সুখের হাসি। তাকায় তরমুজ মিয়ার দিকে, আপনার কী নাম?
তরমুজ মিয়া।
তরমুজ মিয়া? প্রশ্ন করে নামটা সঠিক শুনেছেন কি না, বুঝতে চাইছেন জয়নাল আবেদীন।
জি আমার নাম তরমুজ মিয়া, তরমুজ মিয়ার মুখে মৃদু হাসি।
ঠিক আছে তরমুজ মিয়া, আপনার নাম তরমুজ না হরমুজ সমস্যা নেই। আপনি আমাকে বলুন- কি কি মসলা দিয়েছেন ইলিশ মাছের তরকারিতে?
বেশি কিছু না আপা, হলুদ মরিচ মরিষার তেল, তেজপাতা।
আর কিছু না?
দুদিকে মাথা নাড়ায় বরিশাল টু ঢাকাগামী লঞ্চ এম ভি সামাদের হোটেলে মালিক তরমুজ মিয়া, জে না। আর কিছু দেই না। বেশি মসলা দেলে মাছের সাধ নষ্ট হইয়া যায়।
বুঝতে পারছি, আপনি কতদিন হোটেল চালান?
যেদিন এই সামাদ লঞ্চ চালু অইচে। একটু ভাবে, ধরেন তিন চাইর বচ্চর।
লাভ কেমন হয়?
কানের কাছে মুখ নিয়ে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার? এত খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করছো, সব ফেলে লঞ্চে ভাতের হোটেল দেবে না কি?
ঘাড় নাড়ায় কবি হোসনে আরা, সে রকমই ভাবছি আমি। তুমি কী বলো?
চলবে…