(পর্ব-১)
-তোমার জন্য শুধু তোমার জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। গোলাম রব্বানীকে সামনে পেয়ে হামলে পড়ে আসমা রব্বানী। ইনগ্রেট হাসপাতালের আট তলার ক্যাবিনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আসমা রব্বানী খাট থেকে নামতে নামতে দরজার মুখে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। গোলাম রব্বানী দ্রুত দরজা বন্ধ করে স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসার চেষ্টা করেন, কী হয়েছে? একটু চুপ করো।
-কী হয়েছে মানে? এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো আর তুমি বলছো চুপ করো। তোমার কোনো মান-সন্মান নেই? চারদিকে আত্মীয় স্বজনেরা কি বদনাম করছে, আমি এই মুখ বাইরে, আমার সামাজিক সোসাইটিতে কী করে দেখাবো? কেন মিলি এমন করলো? শুধু আমাকে, আমাকে জব্দ করার জন্য এমন কাজ করেছে, তাই না? একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে আসমা রববানী।
স্ত্রীর হাতে ধরেন গোলাম রব্বানী, একটু শান্ত হও। বসো, টেনে বিছনার ওপর নিজে বসেন, স্ত্রীকেও বসান।
-তুমি এতদিন আসোনি কেন? মনে করেছিলে আমি মরে যাবো? আমি মরে গেলে আসতে? আমি তোমাদের কাছে অসহ্য, তাই না?
-কী বলছ, এসব আসমা?
-আমি ঠিকই বলছি। ওই দিকে মেয়ে বাড়ি ছেড়ে গেছে আর আমি হাসপাতালে। তুমি কি কোনো খোঁজ নিয়েছ আমার?
-হাসার চেষ্টা করেন গোলাম রব্বানী, তোমার সঙ্গে প্রত্যেক দিন আমার তিন চারবার ফোনে কথা হয়েছে। তোমার ডাক্তারের সঙ্গে আমি তোমার বিষয়ে আলাপ করেছি প্রতিদিন। হাসপাতালের টাকা পরিশোধ কে করেছে? আবার বলছ, আমি তোমার কোনো খবর রাখি না?
একটু হাসেন আসমা রব্বানী, জানো হাসপাতাল এখন আর ভালো লাগে না। মরা মানুষের গন্ধ পাই চারদিকে।
চমকে ওঠেন গোলাম রববানী, ঠিক আছে বাসায় চলো। এখন তো কোনো সমস্যা নেই তোমার?
-নাহ, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার মেয়ের খবর কী?
-মিলি একটা চিঠি পাঠিয়েছে।
-চিঠি পাঠিয়েছে? ধাতব কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করে আসমা রব্বানী।
মাথা নাড়ান গোলাম রব্বানী, হ্যাঁ।
-মিলি এখন কোথায়?
পকেট থেকে চিঠিটা বের করে বাড়িয়ে ধরে আসমা রব্বানীর দিকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন তিনি চিঠিটার দিকে। ধীরে ধীরে চিঠিটা হাতে নিয়ে খোলেন। পড়তে শুরু করেন মনে মনে। গোলাম রব্বানী মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছেন চিঠি পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়ার। তিনি ভেবে রেখেছেন, টিঠি পড়ার পর আসমা রব্বানী চিৎকারে ফেটে পড়বেন। নয়তো চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বলবেন, আমি আর বাঁচতে চাই না, অন্য ধরনের অঘটন ঘটানোর পরিকল্পনা করতে পারেন। বিশ্বাস করতে পারবেন না, বা মেনে নিতে চাইবেন না, হাতের গ্রাস থেকে মেয়েটা বের হয়ে গেছে!
কিন্তু গোলাম রব্বানীকে অবাক করে বললেন, দেখেছ মেয়েটা কোথাও আমার বিষয়ে কিছু লেখেনি। ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন গোলাম রব্বানী, ঠিকই তো বলেছে আসমা। মিলি চিঠির কোথাও মা সম্পর্কে একটি শব্দও লেখেনি। মেয়ে, মানে মিলি কি মাকে ঘৃণা করে? অসহ্য যন্ত্রনায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করেন গোলাম রব্বানী, মানুষের জীবনের মোহ ও মায়া কত জটিল? মিলি কেনো লিখলো না, মা সর্ম্পকে একটি বাক্য? মনে হচ্ছে, মেয়ে লেখেনি মাকে নিয়ে একটি বাক্য, দায় পিতা গোলাম রব্বানীর। হ্যাঁ, মেয়েটা ক্রমশ বড় হচ্ছিল আর মায়ের ছায়া থেকে সরে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলেন গোলাম রব্বানী। স্ত্রী আসমাকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আসমা বুঝতে চায়নি। বরং এক ধরনের আসুরিক মোহে সব কিছু অস্বীকার করে মেয়ের ওপর জোরের শিকল পড়িয়ে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু মেয়ে মানবে কেন? অনেক দিন তো মেনেছে। মায়ের হুকুম মেনে চলেছে। কিন্তু যখন জীবনের মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, মেয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে। কিন্তু মেনে নিতে পারছি না আমিও। কী করতে পারি?
গ্রামের প্রায় অশিক্ষিত এক নারী, জীবনের সারল্যে ছেলের বৌকে কতখানি হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন, মিলির নিজের জীবনে ঘটনাটা না ঘটলে কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারতো না।
-শোনো, মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে লাল হয়ে উঠছে আসমা রব্বানীর। স্ত্রীর ফর্সা মুখের স্বাভাবিক রঙ পরিবর্তন হয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ! দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন গোলাম রব্বানী, আমি একটি জটিল স্রোতে আবর্তে ডুবে যাচ্ছি। আসমা আমাকে নতুন কোনো জালে ডুবিয়ে ছাড়বার পরিকল্পনা করছে।
স্ত্রীর দিকে তাকান গোলাম রব্বানী, আমি ছাড়বো না।
মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?
-যে মেয়েকে আমার প্রয়োজন নেই, আমিও সেই মেয়েকে দেখে নেবো।
-কী করতে চাও তুমি? অসহিষ্ণু গলা গোলাম রব্বানীর। বাসায় চলো; মীরা আর কায়েশ তোমাকে কুব মিস করছে। গেলে যাক না একটা মেয়ে, আমাদের তো আরও ছেলে মেয়ে আছে। ওরা ছোট, ওদের প্রতি আমাদের দায় আছে। বাসায় খুব কষ্ট হচ্ছে ওদের তোমাকে ছাড়া।
-আমি বাসায় যাবো না, গলার স্বরে ভয়ানক রুদ্ধতা।
-কী বলতে চাও তুমি?
-আমি বাসায় যাবো না।
-কেন? তোমার বাসায় তুমি যাবে না কেন? বললাম না, একটা মেয়ে চলে গেছে যাক। আমাদের মীরা আর কায়েশ আছে। ওদের প্রতি দায় আছে না? আর দিনের পর দিনে হাসপাতালে পড়ে থাকলে মানুষে কী বলবে? চলো, বাসায় চলো। তোমার বড় বোন তো ইতোমধ্যে নানা ধরনের গল্প ছড়াচ্ছে।
-ছড়াক। ওদের গল্প ছড়ানোর সুযোগ তৈরি করেছে কে? তোমার আদরের মেয়ে মিলি। কতবড় অকৃজ্ঞ মেয়ে! পেটে ধরলাম, বড় করলাম, সমাজের সব চেয়ে বড় পরিবারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলাম, সেটাই আমার অপরাধ হয়ে গেলো? এখন হারামজাদি গ্রামের চাষাভূষার ছেলের বৌ হয়েছে। কত্ত বড় সাহস! আবার চিঠি লেখে?
-আসমা, সংসারের প্রয়োজনে অনেক বিষয়ে ছাড় দিতে হয়।
-আমি মিলিকে কোনো ছাড় দেবো না, হিসহিস কণ্ঠ আসমা রব্বানীর। আমি ওকে তিলের মতো পিষবো। বুঝিয়ে দেবো।
-আসমা!
-থামো তুমি, আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। যদি তুমি…। দরজায় টোকা পড়ে। থেমে যান আসমা রব্বানী। দরজা খুলে দেন গোলাম রববানী। দরজায় দাঁড়ানো ডাক্তার আর নার্স। হাসপাতালে ঢোকার সময়েই রিসিপশনে বলে এসেছেন, হিসাবপত্র আর ডাক্তারকে আসার জন্য।
ডাক্তার হরেকৃষ্ণ রায় হাসিমুখে বলেন, স্যার কোনো সমস্যা নেই ম্যাডামের। বাসায় যেতে পারেন। এমনিতে ম্যাডামের কোনো সমস্যা নেই।
-কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন?
-জি, একদম রেডি। এই হচ্ছে ম্যাডামের ডিসচার্য চিঠি। আপনি সই করে নিয়ে নিন।
গোলাম রব্বানী সই করেন। নার্স আর একবার প্রেসার দেখে চলে যায়। দুজনে নিচে নেমে গাড়িতে ওঠেন। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ে। কিন্তু ভীষণ নির্বিকার আসমা রব্বানী।
উজানগাঁওয়ের প্রতিটি বাড়ি, রাস্তাঘাট ঘুরে দেখা প্রায় শেষ মিলি মাহজাবীনের। গ্রামের মানুষের আদর আপ্যায়নে মুগ্ধ। শহরের সীমানা ভেঙে গ্রামের এই জীবনের যাত্রা উপভোগ করছে মিলি। শিমুলের দূর সম্পর্কের ফুপু সাবিহাদের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের আলোয় বাড়িতে এসে পৌঁছেছে মিলি। দাওয়াত ছিল পুরো বাড়ির মানুষের। ফুপুর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে শামসুদ্দিন আর শিমুল গেছে উজানগাঁওযের বাজারে। বাড়ি ফিরে এসেছে রুপালী আখতার, তমাল, পারুল বেগম। রাতে পিঠা বানানোর আয়োজন চলছে।
শিমুল আহমেদ আর মিলি মাহজাবীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে। প্রায় একমাস গ্রামের বাড়িতে হানিমুন করে বেড়াচ্ছে শিমুল আর মিলি। বেড়াতে বেড়াতে এক দুপুরেই প্রসঙ্গ তোলে মিলি, শিমুল?
-বলো।
-গ্রামের বাড়িতে মজা করে খাচ্ছি, ঘুমুচ্ছি, ঘুরছি, এভাবে আর কতদিন?
-মানে?
-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করতে হবে না?
-আমিও ভাবছি। তোমাকে কী করে বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। তুমিই যখন বললে, ভালোই হলো। ঢাকা চলো। আমরা একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে পড়ালেখাটা শেষ করি। আর মাত্র একটা বছর। একটু, না অনেক কষ্ট হবে তোমার। কিন্তু তুমি চমৎকার মানিয়ে নিতে পারো।
হাসে মিলি, আমার কষ্ট হবে কেন?
-হবে, আমি জানি তো।
-হোক কষ্ট, এখন সিদ্ধান্ত নাও কবে যাবে?
-বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবো।
-ঠিক আছে। আর একটা বিষয়ে বলতে চাই।
-বলো।
-মা আমাকে যে গয়না দিয়েছেন, সেই গয়না দিয়ে আমি কী করবো? মাকে ফিরিয়ে দিলে তিনি কষ্ট পাবেন। অথচ তুমি দেখেছ, আমি গয়না আমি একদম পরি না। গয়না পরে রুপালী। ওকে দিয়ে গেলে মা কি কষ্ট পাবেন?
-আপতত নিয়ে নাও মায়ের দেয়া গয়না। ঢাকায় গিয়ে বাসা ঠিকঠাক করে রুপালী, তমাল, বাবা, মাকে নিয়ে যাবো তো। তখন তুমি বুঝিয়ে দিয়ে দিলেই হবে।
-তুমি দারুণ বুদ্ধি বাতলে দিলে। আমি ভীষণ ভাবনায় ছিলাম।
বাবা-মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করা হয়েছে, আগামী বৃহসপতিবার সকালের লঞ্চে ঢাকা চলে যাবে। বাড়িতে নানা আয়োজন চলছে। মাস খানেকের মধ্যেই মিলি মাহজাবীনের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে গেলেই কিছু না কিছু খেতে হয়। বাড়িতে প্রতি মুহূর্তে খাবার নিয়ে পারুল বেগম অপেক্ষায় থাকেন।
-মা, আমি এত খাবার কেমন করে খাবো? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে মিলি মাহজাবীন। এত এত খাবার আপনি তৈরি করে অপেক্ষা করেন আমাকে খাওয়ানোর জন্য। আমি না খেলে আপনি কষ্ট পাবেন, সেজন্য খাই। আর এমন সুস্বাধু খাবার খেতেও লোভ লাগে। কিন্ত মা, আমি তো মোটা হয়ে যাচ্ছি।
পারুল বেগম হাসেন, মাইয়া মানুষের একটু মোটা হওয়া হওয়া ভালো মা। মিলি মাহজাবীন বোঝে, ঢাকার নগর জীবনের আচার বিশ্বাস আর আধুনিকতার ফরেমেটের বাইরে গ্রামীণ মানুষের লৌকিক জীবনের পরিধি।
মিলি আর তর্ক বাড়ায় না, খায়। কত ধরনের পিঠা যে বানিয়েছেন, আচার তৈরি করেছেন, মাছ যে কত পদের রান্না করেছেন, সব পরিশ্রম করেন হাসি মুখে। চাল যে ভাজি করে মুড়ির মতো চাবিয়ে খাওয়া যায়, উজানগাঁও না এলে মিলি কোনোদিন জানতে পারতো না। পারুল বেগম চালভাজাকে অনেক রমক খাবারে পরিণত করেন। ভাজা চালের সঙ্গে নারকেল কুড়িয়ে খেতে দিয়েছেন মিলিকে। মিলি অবাক, এভাবে খাওয়া যায়?
-তুমি মুখে নিয়ে খাইয়া দেহো।
মিলি তাকায় শিমুলের দিকে। শিমুল একমুঠো চালভাজা মুখে দিয়ে নারকেলের একটা অংশও নিয়ে চিুবতে থাকে। মিলিও সেটা করে। চিবুতে চিবুতে মুখের ভেতরের নারকেল আর চালভাজা মিশে অদ্ভুত স্বাদ তৈরি হয়। ভীষণ ভালো লাগে মিলির, জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে, মা খুব মজা!
হাসেন পারুল বেগম।
আবার চালভাজা পাটা পুতায় পিশে গুঁড়ি করে নারকেল, খেজুরের গুড় মিশিয়ে নাড়ু বানালেন। সঙ্গে দিলেন ভাজা মসল্লা। অবাক স্বাদে মুখ ভরে যায় মিলির। চালভাজা দিয়ে ভিচকি নামের একটা খাবার বানিয়েছেন রাত জেগে। সকালে যখন খেতে দিয়েছেন। খেয়ে মজায় মুখ ভরে গেছে। কোনো পুত্রবধূর জন্য কোনো শাশুড়ি এত পরিশ্রম করে খাবার তৈরি করে রাখে, মিলি জীবনে শোনেনি। গ্রামের প্রায় অশিক্ষিত এক নারী, জীবনের সারল্যে ছেলের বৌকে কতখানি হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন, মিলির নিজের জীবনে ঘটনাটা না ঘটলে কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারতো না।
-মজা দেখতে খুব মজা লাগে না? প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে এনামুল বের করে দেয় জলিলকে,বাইরন, এহনই বাইরন। মজা দেখতে এসে গলা ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে সবাই ঘর ছেড়ে উঠোনে নামে।
ঢাকা যাওয়ার আর মাত্র দুদিন বাকি। কত ধরনের খাবার যে বানাচ্ছেন পারুল বেগম। রাতে হবে চালের আটার রুটি আর চিংড়ি মাছের সঙ্গে নারকেলের ঝোল। পাশের বাড়ির মহিলারা এসে চুলোর পাড়ে জড়ো হয়েছেন। পারুল বেগম, রুপালী আখতার বসেছে ওদের ঘিরে। সঙ্গে মিলিও। নানা ধরনের গল্প হচ্ছে, শহরের কী ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করে মিলি, প্রশ্ন করে রাবিয়া বেগম। দূর সর্ম্পকের চাচি শিমুলের।
-আমি পিজা খেতে খুব ভালোবাসি।
বুঝতে পারে না রাবেয়া বেগম, পিজা না পিঠা, বুঝলাম না বউ।
-সেটাই এক ধরনের পিঠা।
-ভাবি! তমাল আর জগদীশ সামনে দাঁড়িয়ে প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে। বুক ওঠানামা করছে। তমালের চিৎকারটা বজ্রপাতের মতোই অকস্মাৎ মহিলাদের গল্পের আয়োজন হঠাৎ থেমে যায়।
-কী অইচে রে তমাল? রুপালী রেগে যায়। এমন কইরা কেউ ডাহে? আমার তো কইলজা কাঁপতেছে।
-ভাবি, সামলে নিয়েছে তমাল, আব্বারে আর ভাইজানরে পুলিশে ধরছে।
-তুই কী কও? তোর মাতা ঠিক আছে? রুপালী হাতে একটা লাঠি নিয়ে দৌড়ায়, মোর বাপ ভাইরে পুলিশে ধরবে ক্যা?
-আফা, ভাবির বাপে পুলিশ পাঠাইচে, জগদীশ রায় ঢুকে যায় ঘটনার মধ্যে। উজানগাঁও বাজারের মধ্যেই পুলিশে চাচাজান আর ভাইজানরে ধরছে। লোক জমা অইচে মেলা। হ্যারা এহন বাড়ির দিকে আইতেছে।
ঘটনার পরিস্থিতিতে রাতের পিঠা বানানোর নারীরা কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু মিলি মাহজাবীন মুহূর্তের মধ্যে বুঝে যায় সরল মানুষ শ্বশুর শামসুদ্দিন যে দায় ও ভালোবাসার মানচিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন, সেই মানচিত্রের বিপরীতে ক্ষমতাশালী পিতা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, চিঠিতে দেওয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। উপলক্ষ আসামিদের গ্রেফতার করে এখন বাড়ির দিকে আসছে প্রকৃত আসামি কবজা করতে।
-তমাল? পুলিশ কোথায় ধরেছে বাবা আর শিমুলকে?
-উজানগাঁও বাজারে ধরছে ভাবি। আব্বা আর ভাইজানের আতে ছিয়াল দিয়া বানচে।
মিলি তাকায় রুপালীর দিকে, তমাল কী বলছে?
-তমাল কইতেছে আব্বা আর ভাইজানের হাত বানছে শিকল দিয়া। রুপালীর মুখের উচ্চারণ শেষ হতে পারে না, মিলি মাহজাবীন পাখিতে পরিণত হয়। হাত ধরে তমালের, চলো আমাকে নিয়ে চলো তোমার ভাইয়ের কাছে।
-আপনি গিয়া কী হরবেন? প্রশ্ন করে তমাল। হেরা তো বাড়ির দিকে আইতেছে।
-তুমি চলো আমার সঙ্গে। মিলি প্রায় দৌড় শুরু করে বাজারের দিকে। উজানগাঁও গ্রামের সব পথঘাট একমাসে হাতের রেখার মতো চিনে গেছে। রাতে উজানগাঁও বাজারে গিয়ে গরম জিলাপি খেয়েছে অনেক কয়েকবার। সঙ্গে ছিল শিমুলের বন্ধুরা। মোজাহার আলী, দেবাশীষ রায়, এনামুল হক সহ সবাই। সুতরাং পথ চিনতে কোনো সমস্যা নেই। তমাল আর জগদ্বীষ দৌড়ে পারে না মিলির হাঁটার গতির সঙ্গে।
চালের গুঁড়ো আর জুনা নারকেল সামনে নিয়ে নির্বিকার মুখে বসে আছেন পারুল বেগম। রুপালী আখতার কী করবে বুঝতে পারছে না। বাড়িতে পুলিশ আসতেছে? আব্বা আর ভাইজানরে ধরছে? ওর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুলিশ জানলো কিভাবে? জানালো কে?
-আমি আগেই কইছিলাম, শহরের মাইয়া, দেখতে আগুনের নাহান। জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার করতে আইছে মোগো গেরামে, নিজের মনে বলে পাশের বাড়ির হামিদের মা। আর মোর কতাই হাচা অইচে।
-তুমি থামবা হামিদের মা? মুরব্বী জয়নাব বিবি পান খাওয়া মুখে বলেন, তুমি হোনলা বাড়িতে একটা বিপদ আইচে। আর তুমি চোপা শুরু হরলা?
-মুই কী মিছা কইচি?
-অনেক সমায় হাচা কতাও জানলেও চুপ থাকতে অয়, এই জ্ঞেয়ান নাই তোমার? তোমার চোপা এহন থামাও।
-আপনেরা বাড়ি যান, আইজ আর পিডা বানামু না, উঠে দাঁড়ান পারুল বেগম। পুকুর ঘাটে নেমে অজু করেন ধীরস্থিরভাবে। পাশে দাঁড়িয়ে হাউমাউ কাঁদছে রুপালী আখতার। মহিলারা যেতে যেতে বাড়ির পূর্বের ঘরের আলতাফ আর শহিদুলের ঘরের সবাইকে জানিয়ে যায় হামিদের মা। সবাই ছুটে আসে শিমুলদের ঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেদের বাড়ি, আশপাশের বাড়ির নারী পুরুষ ও শিশুদের পদভারে শাসমুদ্দিনের বাড়িটা ভরে যায় এবং উৎসুক্যের লোকজন গভীর আগ্রহ নিয়ে পথের দিকে তাকাচ্ছে, কখন হাতে হাতকড়া পরিয়ে শামসুদ্দিন আর শিমুলকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকে। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে ঢুকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। বাজার থেকে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকে এনামুল হক আর দেবাশীষ রায়।
-এই আপনারা ঘরের মধ্যে হানচেন ক্যা? কড়া গলায় প্রশ্ন করে দেবাশীষ রায়।
বোকার মতো হাসে জলিল, মোরা একটা খবর হুইরা দেখতে আইচিলাম বৌছেরি কি হরতেছে?
-মজা দেখতে খুব মজা লাগে না? প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে এনামুল বের করে দেয় জলিলকে,বাইরন, এহনই বাইরন। মজা দেখতে এসে গলা ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে সবাই ঘর ছেড়ে উঠোনে নামে।
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-৩০॥ মনি হায়দার