[পর্ব-২]
রিফাত চোখ মেলে কিন্তু শরীরে শরীর নেই। দুর্বল। গলার ওপর প্রচণ্ড জোর দিয়ে চাপ দিয়েছিল লোকটা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রিফাতের। মুখটা দরজার পাশেই, চোখে দেখতে পাচ্ছে ময়নার শরীরের ওপর একটা দানব অস্ত্র শানাচ্ছে, ময়না গো গো শব্দে শরীর নাড়াচ্ছে, ছটফট করছে নিজেকে রক্ষার, কিন্তু দুই দানবের পৈচাশিক কামনার কাছে হেরে যাচ্ছে।
রিফাত প্রবল মনোযোগ দিয়ে বসার চেষ্টা করছে, কেবল কোমর সোজা করেছে, পেছন থেকে পিঠের ওপর ভয়ঙ্কর এক লাথি এসে এড়।কিছু বোঝার আগেই রিফাত ছিটকে সামনে রাখা বড় চেয়ারের হাতার ওপর পড়ে মাথা ফেটে যায়। প্রথম লোকটা কাজ করে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের লোকটা প্যান্ট খুলে ভেতরে ঢুকে বিছনার ওপর ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে হাত ধরে বসা লোকটা, এখন আমি করবো।
-শালা, তুই দুধ হাতা, আমি সারি আগে। তোর সিনিয়ার না?
তিনজনে কাজ করে শরীর ঠাণ্ডা করে বুদ্ধি করতে বসে বারান্দায়, দুটাকে নিয়ে কী করা যায়! সিনিয়ারটা বলে, কী আর করবি? আগে যা করতাম সেটাই কর। দুইটাকে নদীতে ফালায়ে দে।
তিন জন পুরুষের নিখাদ অত্যাচারে ময়না অজ্ঞান বিছনার ওপর। রাত শেষের দিকে। লঞ্জ আধাঘণ্টা মধ্যে পদ্মা পাড়ি দিয়ে পারে পৌঁছে যাবে। যা করার এই গহীন পদ্মায় করা করতে হবে। তিন আনসার মিলে প্রথমে ময়নাকে, পরে রিফাতকে ছাদের ওপর দিয়ে গহীন জলে ফেলে দেয়।
লালমোহনে ছেলে ও পুত্রবধূ ফিরে না যাওয়ায় রিফাতের বাবা মেয়ের জামাইকে চিঠি লেখে। চিঠি পড়ে তো আসমার জামাই, পুলিশের এসআই বদরুদ্দিন অবাক। স্ত্রী আসমাকে বলে, ঘটনা কী? আমি নিজে রিফাত আর ময়নাকে দ্য রিভার এক্সপ্রেস লঞ্চে কেবিনে তুলে দিয়ে এলাম, কিন্তু আজ এগারো দিন, বাড়ি যায়নি? আপন মনে মাথা নাড়ে বদরুদ্দিন, কোথাও ঝামেলা হয়েছে। পুলিশের মন, কু গেয়ে ওঠে। পরের দিন সদরঘাটে এসে বদরুদ্দিন দ্য রিভার এক্সপ্রেস লঞ্চের অফিসে যায়। পুরো ঘটনা জানায় ম্যানেজার আশীষ স্যানালকে।
-তো আমরা কী করতে পারি?
-আমি অলরেডি কোতোয়ালী থানায় ডায়েরি করে এসেছি। ওসি খাযরুজ্জামান স্যারকে সব জানিয়ে এসেছি। খুব শিঘ্রই আইও পাঠাবেন, আমি আগে চলে এসেছি।
আশীষ স্যান্নাল দেখলো, বিপদ ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। ফোন করে মতিঝিলের হেড অফিসে। প্রশাসনের ডিরেকটর জানায়, যদি কোনো ঘটনা ঘটে থাকে পুলিশ তো তদন্ত করবেই। তদন্তে সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব। যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, বিচারও হওয়া দরকার।
ঠিক আছে স্যার, আমি দেখছি।
কোতোয়ালী থেকে ডায়েরির তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল আরও তিন জন পুলিশ সদস্য নিয়ে হাজির। আশীষ স্যান্নাল সবাইকে নিয়ে অফি সরুম থেকে সদরঘাটের দিকে আসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অনেক লঞ্চ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সদরঘাটের বিশাল টার্নিমালজুড়ে। খালাসিরা চিৎকার করছে, লঞ্চে ওঠার জন্য। তেলবাহী বিশাল জাহাজ লঞ্চে পরিণত করেছে একটা কোম্পানি। লঞ্চটা ঢাকা থেকে বরিশাল যায়, নাম সামাদ। খালাসিরা চিৎকার করছে, আগে গেলে সামাদে…আগে গেলে সামাদে…। ফেরিঅলারা চিৎকার করে, অ্যাই পাউরুটি, পাউরুটি…। এই সেদ্ধ ডিম, লাগবে সেদ্ধ ডিম। সেই সঙ্গে আসছে দলে দলে যাত্রী, নানা দিক থেকে। সদরঘাটের যাত্রীদের কোলাহল, লঞ্চের বিচিত্র শব্দ, খেয়ানৌকার আনাগোনা, ফেরিঅলাদের গলার ঝংকারের মধ্যে হেলাল, বদরুদ্দিন ও পুলিশ সদস্যরা দ্য রিভার এক্সপ্রেস লঞ্চে উঠে দোতলার একেবারে কর্নারের বত্রিশ নম্বর রুমের সামনে দাঁড়ায়।
বদরুদ্দিন জানায় হেলালকে, স্যার এই রুমে আমি নিজে উঠিয়ে দিয়ে গেছি ওদের। রুমের সামনে, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গল্প করেছি। লঞ্চ ছাড়ার বিশ মিনিট আগে আমি নেমে যাই। কিন্তু গতকাল লালমোহন থেকে আমার শ্বশুর চিঠি লিখেছেন, আমার শ্যালক রিফাত আর রিফাতের বউ ময়না বাড়ি যায়নি আজও। তখনই আমার মাথায় আসে, এই লঞ্চ, এই রুম।
-ঠিক আছে, আমি দেখছি। ওপরে আসার সময়ে লঞ্চের সুপারভাইজার নিজামুদ্দিন আর টিকেট মাস্টারকেও আসতে বলেছিলেন। সেই দুজনের সঙ্গে লঞ্চের আরও কয়েকজন স্টাফ এসে দাঁড়িয়েছে। হেলাল তাকায় সুপারভাইজার নিজামুদ্দিনের দিকে, আপনার এই কেবিনের যাত্রী দুজন বাড়ি যায়নি। ওরা লঞ্চে উঠেছিল দশ দিন আগে।
-স্যার, যাত্রী দুজনের কেউ কি মেয়ে ছিল? প্রশ্ন করে লঞ্চের মাঝবয়সী খালাসী এরফান। কালো জামের কালো শরীর। মাথায় আরও কালো চুল। চোখদুটো শরীরের তুলনায় ছোট।
মাথা ঝাঁকায় বদরুদ্দিন, হ্যাঁ, একজন আমার শ্যালক রিফাত আলমগীর। আর একজন ওর বউ ময়না।
সবাই চুপ। নিচের দিকে তাকিয়ে এরফান। ধমক দেয় সুপারভাইজার, তোমারে কেডায় ডাকছে এইহানে! যাও, যাও নিচে।
-না, বাধা দেয় এস আই হেলাল। বলে, তুমি যাবে না। কী নাম তোমার?
-আমার নাম এরফান।
-গুড, তুমি কিছু জানো?
এরফান নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের নখ খোটে। সবাই তাকিয়ে ওর মুখের দিকে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
-তুমি উত্তর দাও আমার প্রশ্নের! এরফান তুমি কিছু জানো? দেখো, দুজন মানুষের কোনো খবর নেই আজ এগারো দিন। বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষায়। জানলে বলো, এরফানের কাঁধে হাত রাখে এস আই হেলাল। বলে, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা আছি তোমার সঙ্গে।
-স্যার, আনসারদের জিজ্ঞাস করেন, খুব নিচুকণ্ঠে উত্তর দেয় এরফান।
-কী কইতেছিস তুই? খেকিয়ে ওঠে সুপারভাইজার নিজামুদ্দিন। লঞ্চের যেকোনো ঘটনা, দুঘটর্নার জন্য দায়ী থাকে সুপারভাইজার। মালিক খেয়ে ফেলবে, চাকরি থাকবে কি থাকবে না।
হেলাল কড়া চোখে তাকায় নিজামুদ্দিনের দিকে, আপনার সমস্যা কী? কেন এরফানকে ধমক দিচ্ছেন? বুঝতে পারছেন না দুজন মানুষ আপনার লঞ্চ থেকে নিখোঁজ?
-স্যার যে কী কন! হালকা পরিহাসের কণ্ঠে বলে নিজামুদ্দিন, আমার লঞ্চ থেকে মানুষ নিঁখোজ অইবে ক্যানো? আমি এই রিভার লঞ্চের দায়িত্বে আছি সাত বচ্চর, আইজ পর্যন্ত…
-আপনার নাম কী?
-থতমত খেয়ে তাকায় সুপারভাইজার, আমার নাম নিজামুদ্দিন।
-শুনুন নিজামুদ্দিন, আপনি সেই দিন, আজ থেকে এগারো দিন আগের রাতে আনসারদের ডিউটির রোস্টারটা আনুন।
-স্যার, আনসাররা কী করবে?
-আপনি বড় বেশি বকেন নিজাম সাহেব। আমি যা বলছি, সেটা করুন, ধমক দেয় হেলাল।
-যাইতেছি, নিজামুদ্দিন যাওয়ার জন্য ফিরছে।
-বাধা দেয় হেলাল, না। আপনি যাবেন না। আপনার একজন স্টাফ পাঠান।
সুপারভাইজার নিজামুদ্দিন থমকে বড় বড় চোখে তাকায় হেলালের দিকে, হেলালও তাকিয়ে থাকে। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা হেলালের। বুঝতে পারছে ঘটনাটা। শরীর শিউরে উঠছে। সময় নেই, তাড়াতাড়ি পাঠান।
-এরফান, যাও আমার রুম দিয়া।
-না, এরফানও যাবে না। আপনি অন্য কাউকে পাঠান।
পাশে দাঁড়ানো সারেং জুলমত আলীকে বলে, আপনে যান। কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে হাতে দেয়, আমার রুমের টেবিলের ওপর আচে আনসারদের ডিউটির রোস্টার। লইয়া আহেন।
দরজার সামনে মোহন মিয়াকে হ্যান্ডক্যাফ পরা অবস্থায় পুলিশ দেখে, আনসাররা হতবাক হয়ে তাকায়। পরিস্থিতি দেখে লুঙ্গি পরা জামা গায়ে সমীর চক্রবর্তী নিরীহভাব দেখিয়ে বের হওয়ার জন্য দরজা পার হচ্ছিল।
চাবি নিয়ে চলে যায় জুলমত আলী। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে আনসারদের অধিনায়ক মোহন মিয়া তিন তলার সারেংয়ের রুমের পেছনের নিজের রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। ইচ্ছে মুখ ধুয়ে নিচে নেমে এককাপ চা আর একটা বিস্কুট খাবে। কিন্তু দোতলায় নামতেই লোকের ভিড়, বিশেষ করে সুপারভাইজারকে দেখে এগিয়ে আসে। জটলার কাছে এসে পুলিশ আর রুম নম্বর বত্রিশের সামনে দেখে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশ নম্বর রুমের সামনে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বদরুদ্দিন সবাইকে ডিঙিয়ে দ্রুত এসে মোহন মিয়ার কাঁধ ধরে, শুনুন।
ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয় মোহন মিয়া, আমারে কইতেছেন?
-হ্যাঁ, এদিকে আসুন। এক ধরনের জোর করেই সবাইকে ডিঙিয়ে বত্রিশ নম্বর রুমের সামনে নিয়ে আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছে মোহন মিয়া। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে, আমারে এইহানে আনলেন ক্যা?
-আপনার নাম কী?
বিরক্তি ফুটিয়ে তোলে দুই চোখে আর কপালের মাঝখানে, আপনে কিডা?
এসআই হেলাল উত্তর দেয়, উনি এএসআই বদরুদ্দিন। সাদা পোশাকে আছেন। আমরা একটা কেসের তদন্তে আছি।
-তো আমারে আনছেন ক্যা? মুখের পেস্ট শুকিয়ে গেছে, গলা আটকে আসছে মোহন মিয়ার। পাশেই পানির কলে মুখ ধোয়ার জন্য ইশারা করে হেলাল। মুখ ধুয়ে ফিরে দাঁড়াতেই সুপারভাইজারের রুম থেকে আনসারদের ডিউটি রোস্টার নিয়ে হাজির সারেং।
এএসআই বদরুদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে, বত্রিশ নম্বর কেবিনের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাতাস মাখতে মাখতে সিগারেট টানছিল। রুমের ভেতর ব্যাগ রেখে রিফাত আর ময়না সামনে এসে দাঁড়ায়। ময়না চুলের বেণী দুলিয়ে দুষ্টমি করে, ভাইজান লঞ্চে তো আইয়াই পরচেন। লন আমাগো লগে লালমোহন।
-আমিতো তোমার সঙ্গে চাইতেই চাই, সিগারেটের ধোয়া উগড়ে বলে বদরুদ্দিন, কিন্তু তোমার আপায় বাসায় উঠেতে দেবে না।
খিলখিল হাসিতে ফেটেন পড়ে ময়না, আপনে আপারে খুব ভয় পান বুঝি?
-তোমার জামাই রিফাত সাব তোমাকে ভয় পায় না?
-একটুও ভয় পায় না। উল্টো আমারে ভয় দেখায়।
ওদের এইসব হাসি ঠাট্টার সময়ে নাবিক লঞ্চের আনসারাদের কমান্ডার মোহন মিয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। অপাঙ্গে তাকায় ময়নার দিকে। সুন্দরী নারী হলে পুরুষ তো তাকাবেই। মোহন মিয়াও তাকিয়েছিল, কয়েকবার আনাগোনা করেছে সিভিল পোশাকে ছিল। থুতনির নিচে এক চিলতে দাড়িই দেখে চিনতে পেরেছে, এই লোক সেইদিন ময়নাকে দেখার জন্য বেশ কয়েকবার বারান্দায় আসা-যাওয়া করেছে।
-আপনি কে?
-আমি মোহন মিয়া, চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তোলে। বলে, আমি লঞ্চের আনসার কমান্ডার। লঞ্চের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। কী হইচে বলেন?
এসআই হেলাল পুরো ঘটনা আবার শুনিয়ে প্রশ্ন করে, রিফাত আর ময়না কোথায় গেলো? আজ এগারো দিন বাসায় যায়নি কেন?
-সেটা আমি ক্যামনে বলবো?
-হেলাল ভাই, আজ থেকে ঠিক এগারো দিন আগে বিকেলে এইখানে দাঁড়িয়ে আমি, ময়না আর রিফাত নানা বিষয়ে আলাপ করছিলাম। সেই সময়ে এই লোক, লঞ্চের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার কমান্ডার মোহন মিয়া আমাদের সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে। চোখ ছিল ময়নার ওপর। আমি মোহন মিয়ার থুতনির নিচের এই দাড়ি দেখে চিনেছি।
সারেংয়ের হাত থেকে ডিউটির রোস্টার নিয়ে দেখে, আজ থেকে এগারো দিন আগের দিন রাতে কে কে দায়িত্বে ছিল লঞ্চের নিরাপত্তায়, রোস্টারে ঠিকভাবে লেখা নেই। শুধু ওই দিন না, প্রায় প্রতিদিনের তারিখে দেখা যায়, তারিখ সময় লেখা ঠিকই আছে কিন্তু কারও নাম নেই, সাদা পাতা।
-রোস্টারে দায়িত্বরতদের নাম নেই কেন?
হেলালের প্রশ্নের উত্তরে আমতা আমতা করে মোহন মিয়া, মাসের শেষের দিকে।
-বুঝতে পারছি। হাসান গ্রেফতার করো মোহন মিয়াকে। সঙ্গে সঙ্গে মোহন মিয়ার দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয় হাসান।
মোহন মিয়া তোতলাতে শুরু করে, স্যার আমি কী করচি? আমারে গ্রেফতার হরলেন ক্যা?
-চুপ, ধমক দেয় হেলাল, আনসাররা কোথায় থাকে?
-তিন তলায়, সারেংয়ের রুমের পেছনে ওদের জন্য রুম।
-চলো, সবাইকে নিয়ে তিন তলার আনসার রুমের সামনে যায় হেলাল, বদরুদ্দিন, নিজামুদ্দিন, মোহন মিয়া। আনসারা কেউ কেউ ডিউটির জন্য প্রস্তত হচ্ছে, কেউ ঝিমাচ্ছে, কেউ ঘুমুচ্ছে। দরজার সামনে মোহন মিয়াকে হ্যান্ডক্যাফ পরা অবস্থায় পুলিশ দেখে, আনসাররা হতবাক হয়ে তাকায়। পরিস্থিতি দেখে লুঙ্গি পরা জামা গায়ে সমীর চক্রবর্তী নিরীহভাব দেখিয়ে বের হওয়ার জন্য দরজা পার হচ্ছিল।
হাত ধরে হেলাল, আপনি কে?
পুরো শরীর কাঁপে, মুখে জড়তা, আমি সমীর চক্রবর্তী।
-আনসার?
মাথা নাড়ায় সমীর, জি।
হেলাল তাকায় পুলিশ সদস্যদের দিকে, নরেন্দ্র?
-স্যার?
-ওর হাতেও হ্যান্ডকাফ লাগাও।
মুহূর্তের মধ্যে সমীর চক্রবর্তীর হাতে হ্যান্ডকাফ লাগায় নরেদ্র রায়। মোহন মিয়া আর সমীর চক্রবর্তীকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে হেলাল। বসে চেয়ারে, আনসারদের সবাই দাঁড়ায়। পরিস্থিতি একবারে ঘোলাটে। রুমের বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে বদরুদ্দিন। গোটা ঘটনা চোখের সামনে ভাসছে। নিশ্চিত, রিফাত আর ময়না বেঁচে নেই। নদীর জল বিলীন করেছে দুজনকে। কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনা কিভাবে জানাবে শ্বশুর- শাশুড়িকে? নিজের বউকে কী করে বলবে? আসমা ছোট ভাইটাকে অসম্ভব ভালোবাসে। লালমোহন চলে আসার সময়ে রিফাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আসমা, যহন একা ছিলি বছরেও আমারে দেখতে আইতি না। এহন বিয়া করচো, দশ বছরেও আমারে দেখতে আসবি না তুই।
হাসছিল ময়না, আপা রিফাত আর মুই বছরে দুইবারও কইরা আপনেরে দেখতে আমু। আর আপনেও তো যাইবেন।
ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে এসআই হেলাল ও এএসআই বদরুদ্দিনের নেতৃত্বে নাবিক লঞ্চের সুপারভাইজার নিজামউদ্দিন, আনসার কমান্ডার মোহন মিয়া, আনসার সদস্য সমীর চক্রবর্তী ও সুরুজ আলী হ্যান্ডক্যাফ পরিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়।
সেই ভাই আর ভাইয়ের মৃত্যুর নির্মম সংবাদ কিভাবে জানাবো? নিজের মনে জিহ্বায় দাঁত ফেলে কামড় দেয় আর হাটে সারেং রুমের সামনে। তাকায় চারপাশে বদরুদ্দিন, কোলাহল ক্রমশ বাড়ছে। দূরে, দক্ষিণে দেখা যায় প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু। রেখার অঙ্কনে বাস ট্রাক চলাচল দেখতে পাচ্ছে। নাবিক লঞ্চের পিছনে, বুড়িগঙ্গার ওপারে দখলদারদের সারি সারি সাদা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে। বিল্ডিংয়ের আশেপাশে জাহাজের বডি তৈরির কারখানায় কাজ চলছে।
ডেকের একেবারে সামনে চলে যায় বদরুদ্দিন।
-স্যার?
তাকায় বদরুদ্দিন, পুলিশ কনস্টেবল আরিফ দাঁড়িয়ে, আপনাকে হেলাল স্যার ডাকছে।
চলো, সিগারেটের শেষ অংশ নদীর জলে ফেলে এগিয়ে যায় আনসার ক্যাম্পে। সবার মুখ থমথমে। হেলাল তাকায় বদরুদ্দিনের দিকে। পুরো কক্ষটার মধ্যে বিষাক্ত নীরবতা থৈ থৈ করছে।
বদরুদ্দিন, বসেন।
একটা বেঞ্চের ওপর বসলে হেলাল তাকায় সরুজ আলীর দিকে, এখন বলেন সুরুজ।
ভ্যা ভ্যা কাঁদতে শুরু করে সুরুজ আলী। থলথলে মোটা শরীর সুরুজের। চওয়া মুখের নিচে সরু মুখ। নাকটা বেঢপ। চ্যাপটা।
-ওই মিয়া ভোদরের মতো কাঁদেন কেন? বলেন, ধমক দেয় হেলাল। হাতে সময় নেই।
-স্যার আমার কোনো দোষ নাই। আমি যাইতে চাই নাই। কিন্তু আমাদের কমান্ডার মোহন স্যার আমাকে ভয় দেখায়, চল। মজা পাবি। সুন্দর মাইয়া। আমি কমান্ডার স্যার আর সমীর চক্রবর্তী মিলে রাত তিনটার দিকে দোতলায় কর্নারে, বত্রিশ নম্বর রুমের সামনে যাই।
কাজ শেষ করার মেয়েটা অধমরা হয়ে যায়। আর ছেলেটার গলায় পা দিয়ে চেপে ধরেছিল সমীর দা। শ্বাস বন্ধ হয়ে ছেলেটাও আধমরা অবস্থা। লালমোহনের আগে ইশিলা যাবার পথে আমরা তিন জনে মিলে ছাদের ওপর থেকে দুজনকে ফেলে দিই।
সঙ্গে সঙ্গে বদরুদ্দিন উঠে একের পর এক ঘুষি মারতে থাকে সুরুজ আলীর মুখের ওপর। হেলাল ঝাপটে ধরে বদরুদ্দিনকে, থামুন থামুন আপনি। আপনি না পুলিশ? আবেগ সামলান।
জোর করে টেনে বেঞ্চের ওপর বসায় বদরুদ্দিনকে। বসেই হাউ-মাউ কাদঁতে শুরু করে, হেলাল ভাই আমার বউকে কিভাবে বলবো ওর আদরের ছোট ভাইয়ের মৃত্য, ছোট ভাইয়ের নতুন বউয়ের মৃত্যু। আমি বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে কিভাবে জানাবো, প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুর ঘটনা।
সদরঘাটের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বদরুদ্দিনের কান্নায়।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নাবিক লঞ্চ ছেড়ে যায় সদরঘাট। ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে এসআই হেলাল ও এএসআই বদরুদ্দিনের নেতৃত্বে নাবিক লঞ্চের সুপারভাইজার নিজামউদ্দিন, আনসার কমান্ডার মোহন মিয়া, আনসার সদস্য সমীর চক্রবর্তী ও সুরুজ আলী হ্যান্ডক্যাফ পরিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়। সদরঘাটের মূল টার্মিনাল থেকে লঞ্চ পেছনে যেতে থাকে, সারেং ঘণ্টি বাজায় ওপর থেকে।
চলছে…