আপনে মোর গায়ে আত দেলেন ক্যা? মেয়েলি কণ্ঠের বাষ্পরুদ্ধ চিৎকার। আব্বায় কী কইছিল আপনারে? আর আপনে আমারে অপমান হরলেন? মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকারে নাবিক লঞ্চের দোতলায় তাস খেলায় মগ্ন জনাপঞ্চাশেক যাত্রী শব্দের উৎসে তাকায়। রাত সাড়ে এগারোটা। কাঠের কাঠামোর দোতলা নাবিক লঞ্চ রাত সাড়ে ন’টায় চাঁদপুর ছেড়ে এসেছে। লঞ্চটি সদরঘাট থেকে ছেড়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। সদরঘাট থেকে ছেড়ে বাদামতলী পার হয়ে একটানা ঘণ্টা দুয়েক চালিয়ে রাত সাড়ে আটটায় এসে ভিড়েছে চাঁদপুর। চাঁদপুর থামা মানে ঘণ্টাখানেক ইঞ্জিন বন্ধ করে চুপ থাকা। কারণ, চাঁদপুর থেকে প্রচুর মালপত্র ওঠে লঞ্চে। এই এলাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যায় এই একটি মাত্র লঞ্চ।
হাশেম মিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় চামেলির দিকে। চামেলির শরীরের রঙ ফরসা। শরীর একটু মোটা। পরেছে সালোয়ার-কামিজ। মাথাভরা চুল। চোখ দুটো বড় কিন্তু ভাসা ভাসা। দেখতে ভালোই। লঞ্চের ডান দিকে সিঁড়ির পাশে শাড়ি টাঙিয়ে আড়াল করেছে নিজেকে চামেলি। কাপড়ের দুটো বোচকা দিয়ে মাথার বালিশ বানিয়েছে। শাড়ির বাইরে, পাশেই হাশেম মিয়ার লম্বা বিছনা। লঞ্চের অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু হাশেম মিয়ার চোখে ঘুম নেই। পাতলা একটা শাড়ির ওই পাশে একটা তেলতেলে মেয়ে শুয়ে আছে, শুনতে পাচ্ছে নিঃশ্বাস আসা-যাওয়ার শব্দ। চেষ্টা করছে সেই বিকেল থেকে চামেলিকে বাগে আনার, কিন্তু চামেলি যে ফোঁস করে উঠবে, বুঝতে পারেনি হাশেম মিয়া।
-চুপ হরো চামেলি, মাইনষে হোনবে, ফ্যাসফেসে গলা হাশেম মিয়ার।
-হোনলে হুনুক। আগে কন আপনে মোর গায়ে আত দেলেন ক্যা? চামেলির গলা আরও বাড়ছে। ভাসা ভাসা চোখের ভেতরটা জ্বলছে, আপনে মোরে চেনেন নাই। বিয়াল থেকেই আমি বুঝছি, আপনে লোক ভালো না। আপনের চোহে বিষ। আপনে না বিয়া হরছেন? আপনে আমার চাচা লাগেন।
শাড়ির আড়ালের মধ্যে ঢোকে হাশেম মিয়া বলে, হোন যা অবার অইয়া গেছে। তুমি একটু চুপ থাহো। মাইনষে হোনলে আর ইজ্জত থাকবে নানে।
-আপনে ইজ্জতের বোঝেনডা কী? আপনে মোর বুকে আত দিলেন ক্যা? গলা আরও বাড়ছে চামেলির। আব্বায় আপনাকে কয় নাই, ইজ্জতের লগে রাকতে? এই আপনে আমারে ইজ্জত রাকলেন? সুযোগ পাইয়া আন্ধারে আমার বুহে আত দিলেন?
হাশেম মিয়া বুঝতে পারছে পরিস্থিতি যেকেনো সময়ে আরও খারাপের দিকে যেতে পারে, লঞ্চের লোকগুলো জেগে উঠলে। ভাবনা শেষ হতে পারে না, তাস খেলার একটা দল ঝোলানো শাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। দলের মধ্যে থেকে মিনহাজ হোসেন প্রশ্ন করে, কী হয়েছে? আমাকে খুলে বলেন আপনি। চোখ রাখে চামেলির দিকে, আমার বাড়ি পিরোজপুরের পাড়েরহাট। জগন্নাথ কলেজে পড়ি। বলেন আমাকে।
-বাবা, কিছু অয় নাই। আপনেরা যান। আমার মাইয়া অয়, বড় ভাইয়ের মাইয়া, আমারও মাইয়া। হেয় রাগ করছে। মোরা মিডাইয়া হালামুআনে, আপনেরা যান। খুব মিনতির সঙ্গে বলে হাশেম মিয়া।
মিনহাজের পাশে দাঁড়ানো হাফিজউদ্দিন প্রশ্ন করে, আপনের বড় ভাইয়ের মাইয়া অইলে মাইয়ার বোহে হাত দেলেন ক্যা?
-অস্তাগফিরুল্লাহ, খুব দরদের সঙ্গে উচ্চারণ করে হাশেম মিয়া। এরপর বলে, এইডা আপনে কী কইলেন? অস্তাগফিরুল্লাহ!
-মাইয়াডা যে কইলো?
চিনি ছাড়া মজার গন্ধ পেয়ে আরও অনেকে জড়ো হয়েছে নাবিক লঞ্চের দোতলায়, সিঁড়ির পাশে। মজিরউদ্দিন যাবে মোড়েলগঞ্জ। লঞ্চে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রস্রাবের টানে উঠে লঞ্চের পেছনের মাথা থেকে আসে ঘুমন্ত মানুসের মাথা-হাত-পা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে। সিঁড়ির পাশে এসে ঘুম ঘুম চোখে মিনিট খানেক দাঁড়ায়। কয়েকটি সংলাপ শুনে বুঝতে পারে, ঘটনা। বিরক্তির সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে, হারামজাদারে ধইরা নুনু কাইটা দেওন দরকার।
হালকা হাসির রোল পড়ে শাড়ির চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষের মুখে। চামেলি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। ঘটনা কী ঘটবে, কোন দিকে যাবে, কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ কয়েকবার লঞ্চে আসা-যাওয়া করেছে ও। কিন্তু সঙ্গে বাবা, বড় বোন, দুলাভাই বা ভাই ছিল। হাসিতে-আনন্দে আসা-যাওয়া করেছে চামেলি আখতার। পিরোজপুরের ভানডারিয়া উপজেলার উজানগাঁওয়ে বাড়ি চামেলিদের। পড়ে ভানডারিয়া কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। ফাইনাল পরীক্ষা এসে পড়েছে, আর মাত্র দুই মাস বাকি। বাড়িতে যাওয়া দরকার। ঢাকা এসেছিল একমাস আগে। চামেলির বাবা ইরফান বয়াতি চাকরি করে আর্মিতে। সুবেদার। বছর দুয়েক পরে অবসরে যাবে। বড় মেয়ে ঝিলমিলের জামাই মজনুন করিম চাকরি করে মিরপুর একটা গার্মেন্টেসে। সুপারভাইজার। বড় মেয়ে ঝিলমিলরা বেড়াতে গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি। ফিরে আসার সময়ে বোনের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে চামেলি আখতার। পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসায় বাড়ি ফিরে আসার জন্য ছটফট করতে শুরু করলে ঝিলমিল বলে, অত চিন্ত হরিস না। তোর দুলাভাই দুই দিনের ছুটি লইয়া তোরে দিয়া আইবে।
-হেই কতা হনতেছি আইজ দশ বারো দিন ধইরা। দুলাভাইর ছুটির কী অইলো? আওনের সমায় মুই বইও আনি নাই। তহততো কইছিলা, সাত আষ্টোদিন পর মোরে পাঠাইয়া দেবা আফা, চামেলির গলায় উৎকণ্ঠা।
-আরে ছেমড়ি, অত চিন্তা হরস ক্যা? তোর দুলাভাই ছুটি না পাইলে আব্বায় তো আছে। ভরসা জোগায় ঝিলমিল বেগম ছোট বোনকে।
কিন্তু চামেলি আখতারের দুলাভাই মজনুন করিম ছুটি পায় না। শিপমেন্ট কাছে, মালিকের কোটি কোটি টাকার কারবার। ছুটি দেওয়ার সময় নেই। একই অবস্থা চামেলির বাবারও। ছুটি পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সামনে ছাব্বিশে মার্চ। আর্মিদের বিশেষ অনুষ্ঠান আছে প্যারেড গ্রাউন্ডে। এখন থেকে প্রশিক্ষণ শুরু। চামেলি পড়ে বিপদে। একরাতে ব্যারাক থেকে মেয়ের বাসায় আসে ইরফান বয়াতি। জামাই মজনুন করিমের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হয়, মেয়ে চামেলিকে নিয়ে সদঘাটে আসবে।
প্রতিদিন একটা না একটা লঞ্চ থাকেই সদরঘাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। তিনটি লঞ্চ চলে, একের পর এক। আইবিটি বা ইসলাম ব্রাদার্স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্বানি থেকে বড় বড় তিনটি লঞ্চ চলাচল করে দীর্ঘ লম্বা পথে। লঞ্চ তিনটির নাম পূবালী, নাবিক, সাঁতারু। তিনটি লঞ্চই দোতলা। ছোট টিকিটে প্রধান অফিসের ঠিকানা লেখা, বেচারাম, দেউড়ি, ঢাকা। বলা যায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ, আইবিটি কোম্পানির এই তিনটি লঞ্চ। কত ঘাটে ঘাটে ভেড়ে, মানুষ ওঠে-নামে। বিচিত্র এক যাত্রা। বিরাট লঞ্চের পেট বোঝাই হয়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসে ডাব, সুপারি, আমড়া, কলা।
একজনের পরনে লুঙ্গি। প্রত্যেকের চুল ছোট। দ্য রিভার এক্সপ্রেস গভীর রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে জলের ওপর সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন বিকেলে আর্মি মেস থেকে সন্ধ্যার ছুটি নিয়ে ইরফান বয়াতি আসে, মিরপুরে বড় মেয়ে ঝিলমিলের বাসায়। নিজের ছোট্ট ব্যাগ, আর বড় বোনের দেওয়া টুকিটাকি নিয়ে আরও একটি ব্যাগ সাজিয়ে অপেক্ষা করছে চামেলি আখতার। বাবাকে দেখেই চটপট ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলমিল ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে, পরীক্ষাডা ভালো কইরা দিস।
-আইচ্চা আফা! তুমি পারুল আর শিমুলকে বকাঝকা কইরো না। ছোট পোলাপান, অরা তো একটু দুষ্টামি হরবে। তুমি একটু সহ্য হইরো। মাইরো না। দুচোখে পানি আসে চামেলির। পারুল পড়ে ক্লাস ফোরে, শিমুল ওয়ানে। দুজনে জড়িয়ে ধরে খালাকে।
আধো কণ্ঠে শিমুল বলে চামেলির গলা জড়িয়ে, খালা তুমি যাইও না।
-আহারে সোনা আমার! আমার যে পরীক্ষা।
-তোমার পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না, বলে পারুল।
ইরফান বয়াতি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া লাগায়, অ্যাই ঝিলমিল! অগো সামলা। আতে সমায় নাই। এহনই বাজছে সাড়ে তিনটা। আগে না গেলে জাগা পাওয়া যায় না।
-আহো, আমার কাছে আহো, ঝিলমিল কোলে তুলে নেয় ছোট ছেলে শিমুলকে। আর হাত ধরে পারুলের, এই ছ্যামড়ি তুই বড় অইচোস না? সবই তো বোজো, ফাইভে পড়ো। তোর খালায় পরীক্ষা দিয়া আবার আইবে। ছাড় চামেলিরে।
ছাড়া পেয়ে দাঁড়ায় চামেলি। বাবার সঙ্গে বের হয়ে আসে বাসা থেকে। বের হয়ে রিকশায় উঠে চলে আসে মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বরে। গোল চত্বর থেকে ওঠে একটা অটোয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সদরঘাটে পৌঁছালে, ইরফান বয়াতি দেখতে পায় বিরাট ঘাটে অনেক লঞ্চের সঙ্গে গায়ে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পূবালী লঞ্চ। প্রচুর যাত্রী ওঠা-নামা করছে। মেয়ের হাত ধরে ইরফান বয়াতি লঞ্চের দোতলায় উঠে হতাশ, দোতলার মেঝেতে কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। অনেক আগেই যাত্রীরা উঠে বিছনা পেতে দখলে নিয়েছে। লঞ্চ ছাড়তে আরও দেড়ঘণ্টা বাকি!
পরিস্থিতি বুঝে চামেলি মুখ খোলে, আব্বা?
-কী? লঞ্চে ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকান ইরফান বয়াতি, দেখচো, এক বিন্দু জায়গা নাই। এর লাইগা কইছিলাম, আরও আগে আইতে।
-এক কাম করা যায় আব্বা!
-কী কাম? কেবিন ভাড়া?
-তুই জানো কেবিনের ভাড়া কত? এক দেড় হাজার টাহা..
-না আব্বা, আমি কইছিলাম কী! কয় বছর আগে ঈদের সমায় আপা দুলাভাইর লগে বাড়ি গেলিলাম। তহনও মানুষের অনেক ভিড় ছিল। আমরা ছাদে গেছিলাম।
বিরক্ত হন ইরফান। লোকজন লঞ্চের দোতলায় নিজের বিছানায় যাচ্ছে, অনেক জায়গা খুঁজছে। সব চেয়ে বড় সমস্যা, পরিচিত কাউকে পাচ্ছে না। যার কাছে মেয়েটির জিম্মা করা যায়।
-তোর মাতা খারাপ অইচে? তহন তো লগে করিম আছিল, তোর বড় বুইনে আছিল। এহন তুই একলা। কেমনে ছাদে একলা একলা যাবি? বুদ্ধি সব গুইল্লা খাইচো? খাড়া এইহানে, হাতের ব্যাগটা চামেলির হাতে দিয়ে ইরফান বয়াতি লঞ্চের পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেক কষ্টে লঞ্চের মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ম চোখে দেখতে লাগলো, চারপাশের যাত্রীদের মুখ। না, একজনও এলাকার পাওয়া গেলো না।
ষোড়শী মেয়ে চামেলিকে নিয়ে বিপদে পড়লো ইরফান বয়াতি। মেয়েটিকে নিয়ে কী করবে? একটা কেবিন ভাড়া করে পাঠাবে? কিন্তু একা মেয়েটিকে পাঠানো ঠিক হবে? না, মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা দেখতে পায়। পত্রিকার পাতাজুড়ে সংবাদটি ছাপা হয়েছিল কয়েক দিন। অবশ্য ঢাকা-বাগেরহাট রুটের লঞ্চ ছিল না সেটা। সেই লঞ্চের রুট ছিল ঢাকা-লালমোহনের।
রিভার এক্সপ্রেস লঞ্চের যাত্রী ছিল ময়না আর রিফাত। স্বামী-স্ত্রী। লালমোহনের ছেলে রিফাতের বাড়ি বন্দরেই। পারিবারিক ব্যবসা লালমোহনে। দুটো খাবার হোটেল, তিনটা দোকান চালায় বাবা-ভাইয়েরা মিলে। বেশ কয়েকটা দোকানের ভাড়াও পায়। প্রেম করে বিয়ে করেছে ময়নাকে। বিয়ের মাস তিনেক পর ময়নার বড় বোন আসমার বাসায় ঢাকা বেড়াতে আসে ওরা। আসমার জামাই পুলিশের এসআই। ঢাকায় কয়েকদিন বেড়িয়ে দ্য রিভার এক্সপ্রেসে কেবিন রির্জাভ করে বাড়ি যাচ্ছিল ময়না আর রিফাত। ওই সময় কেবিনের লোকজনও কম ছিল। একদিকে কেবল ওরাই ছিল, আর পুরোটা খালি। মেয়েটা, ময়না দেখতে দারুণ সুন্দরী। খোলা চুলে ওকে লাগে লাল রাজকন্যা।
রাত বারোটার দিকে ওরা দুজনে যখন নির্জনে শরীরের শিল্প আবিষ্কারে মত্ত, দরজায় টোকার শব্দে দুজনে চমকে ওঠে। তাকায় পরস্পরের দিকে। আবার টোকা, একটু জোরেই অসহিষ্ণু টোকা বোঝা যাচ্ছে। দ্রুত দুজনের শিথিল হয়ে গেলে অসংবৃত কাপড়ে বাথরুমে ঢোকে ময়না। লুঙ্গি পেচিয়ে বিরক্তির সঙ্গে দরজা খোলে রিফাত। সামনে দাঁড়িয়ে তিন জন পুরুষ। একজনের পরনে লুঙ্গি। প্রত্যেকের চুল ছোট। দ্য রিভার এক্সপ্রেস গভীর রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে জলের ওপর সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।
-কী চান আপনেরা? দ্বিধার সঙ্গে প্রশ্ন করে রিফাত।
একজন ওকে ঠেলে রুমের ভেতরে ঢোকে, দেখে রিফাত একলা। তাকায় খাটের নিচে, কেউ নেই। অবাক তাকায়, তোর লগের মাগিডা কই?
হতবম্ব রিফাত, কী কন আপনে? আমার লগে আমার বউ।
রুমের বাইরে দাঁড়ানো একজন খিক খিক হাসে, আমরা দেখলেই কইতে পারি কে স্ত্রী আর কে মাগি? কই তোর লগের মাগি?
ভেতরের লোকটা বুঝতে পারে, মেয়েটা বাথরুমে। টোকা দেয় দরজায়। দরজা খোলে না। বেশ কয়েকবার টোকা দেওয়ার পরও যখন খোলে না, ভেতরের লোকটা ঠাস করে চড় মারে রিফাতের গালে, হারামজাদা বাইরে আইতে ক।
-না, ঘাড় ফুলে যায় রাগে রিফাতের।
-কয় কী হারামজাদা? পরপর কয়েকটা ঘুষি মারে রিফাতকে বাইরের একটা লোক ভেতরে ঢুকে, দুজনে মিলে। রিফাত কঁকিয়ে ওঠে। দরজা খুলে যায়। খপ করে ধরে ময়নার হাত ধরে একজন, আয় মাগী বাইরে আয়। এক টানে বাথরুম থেকে বাইরে আনে ময়নাকে। ময়না টানের টাল সামলাতে পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকটার মেদবহুল বুকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে ঝাপটে ধরে মুখ নামিয়ে আনে ময়নার মুখের ওপর। ময়না প্রাণপণে মুখটা দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পাশে দাঁড়ানো লোকটা পেছন থেকে ময়নার মাথাটা ধরে এগিয়ে ধরে। ময়নার কিছু করার থাকে না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখটা এগিয়ে যায় লোকটার মুখের কাছে। লোকটার কামুক ঠোঁটঝোড়া নেমে আসে ময়নার ঠোঁটের ওপর। রিফাত অনেকটা বিমূঢ় হঠাৎ কয়েক মিনিটের বিপরীত দৃশ্যযন্ত্রণায়। স্ত্রীর মুখের ওপর লোকটার ঠোট স্পর্শ করতেই আচমকা ঘুষি মারে লোকটার চোয়াল বরাবর।
-ও মাগো! লোকটা ময়নাকে ছেড়ে বসে পড়ে।
আর লোকটা কোমর চালাতে শুরু করে। রুমের বাইরে ঠাণ্ডা মেঝেতে পড়ে থাকা রিফাত চোখ মেলে তাকায়।
ময়না মুক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে রিফাতকে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অবলম্বনের একমাত্র রশি হিসেবে। রুমের ভেতরের লোকটা একের পর ঘুষি মারতে শুরু করে রিফাতকে। বাইরের লোকটাও ভেতরে ঢোকে, দুজুনে মিলে ঘুষি-লাথি মারতে-মারতে টেনে দুজনকে আলাদা করার চেষ্টা করে। ছোট্ট রুমটার মধ্যে গভীর রাতে কয়েকজন মানুষের মধ্যে চলে বাঁচা-মরার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্যে আগে ঘুষি খাওয়া লোকটাও উঠে দাঁড়ায়। তীব্র আক্রোশে রিফাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই জনের প্রবল জোরের সঙ্গে পারে না রিফাত। বুকের ওপর থেকে ক্রমে ক্রমে শিথিল হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে ময়না, মাত্র তিন মাস আগে বিয়ে করা বউ। ঘুষি খাওয়া লোকটা বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে রিফাতের গলার ওপর পা রাখে, রিফাতের শ্বাস আটকে যায়।
ময়না আবার ফিরে যায় তিন জনার একজনার বুকে। ময়না অনুনয় করে, হোনেন ভাইয়েরা, আমরা স্বামী–ইস্ত্রি। তিন মাস আগে মোগো বিয়া অইচে। মোরা ঢাকায় বেড়াইকে আইছিলাম।
-চোপ মাগি! কতা কম। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরা লোকটা অন্য দুজনকে বলে, তোরা হারামজাদারে টাইনা রুমের বাইরে লইয়া যা। বাকি দুজনে হুকুম তালিম করে, রিফাত জ্ঞান হারিয়েছে। ওকে ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, আর তৃতীয় লোকটা লুঙ্গিটা খুলে বিছানার ওপর জোর করে শুইয়ে উঠে বসে ময়নার ওপর।
আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ ছিল। নদীর মাঝ বরাবর চলছে বিরাট লঞ্চ তীরভাঙা ঢেউয়ের তীব্র গতিতে। সেই গতির কাছে ময়না নামক এক গৃহবধূর সব সম্ভ্রম রক্তাক্ত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীর গহ্বরে। মেয়েটির শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে সর্বনাশের অকূল থেকে কূলে ফেরার, দুহাতে লোকটার মুখ ঠেলে ধরছে প্রাণপণে।
লোকটা যখন ময়নার মুখের ওপর মুখটা আনতে পারছে না, দুহাতের ক্রমাগত বাধায়, দরজায় অপেক্ষায় থাকা একজনকে ডাকে, এই হানিফ ভেতরে আয়। মাগি হাত দুইটা ধর। হানিফ ভেতরে ঢুকে জান্তব হাসিতে ময়নার হাত দুটো ধরে মাথার পেছনে নিয়ে বেঁধে ধরে। আর লোকটা কোমর চালাতে শুরু করে। রুমের বাইরে ঠাণ্ডা মেঝেতে পড়ে থাকা রিফাত চোখ মেলে তাকায়।
চলবে…