(পর্ব-১৯)
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে এমভি সামাদ লঞ্চ কীর্তনখোলা নদীর তীরে, বরিশাল লঞ্চঘাটে নোঙ্গর করে। মেঘনা নদীতে কয়েকঘণ্টা আগে অন্ধকারের স্রোতে যে প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গেছে, বরিশাল শহরের কেউ জানে না। লঞ্চ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে জানে লঞ্চঘাটের মানুষ। লঞ্চঘাটের টার্মিনালে সকাল সাড়ে ছটা থেকে অপেক্ষা করছে বর অমলেন্দু ঘোষ, সঙ্গে পিতা শীর্ষেন্দু ঘোষ, বন্ধুরা। প্রত্যেকের হাতে গেন্দাফুলের বড় বড় মালা। সঙ্গে একজন পাকা ক্যামেরাম্যান। কিন্তু রাতে ঝড়ের কবলে পড়েছে লঞ্চ, জানার পর অমলেন্দু আর শীর্ষেন্দুর মুখে কালো ছায়া পড়ে। কারো কোনো ক্ষতি হয়নি তো? প্রশ্নটা জেগে ওঠে অমলেন্দুর। কারণ, জানে বিয়ের নিমন্ত্রনে আসা মান্যবর অতিথিদের অনেকেরই নৌপথে চলাচলের অভিজ্ঞতা কম।
বিশেষ করে, যখন জয়নাল আবেদীন স্যারের বাসায় কার্ড দিতে গিয়েছিল, স্যার ও ম্যাডাম দুজনেই আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অমলেন্দু ভীষণ খুশি, আপনারা দুজনে গেলে তো খুবই ভালো হবে। কারণ গোবিন্দ স্যারও যাবেন ওনার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে।
তাই নাকি? হাসেন জয়নাল আবেদীন। তাকান স্ত্রীর দিকে, তাহলেতো খুবই ভালো হবে। তুমি কী বলো?
ভালো তো হবেই, কিন্তু অমলেন্দু আমি যাচ্ছি অন্য কারণে।
কী কারণ ম্যাডাম? আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় অমলেন্দু ঘোষ।
হাসতে হাসতে বলেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, তোমার ম্যাডাম কবিতা লেখেন। কয়েকটা বইও আছে কবিতার।
ধীমান অমলেন্দু ঘোষ বুঝে যায়, ম্যাডামের বরিশাল যাওয়ার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু কী! হাসতে হাসতে জবাব দেয়, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর পরই আপনাকে আর স্যারকে জীবনানন্দ দাশের বাড়ি নিয়ে যাবো।
তুমি কী করে বুঝলা, আমি কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি দেখতে চাই?
চা পানের শেষে কাপটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে হাসে অমলেন্দু ঘোষ, স্যার না বললেন আপনি কবিতা লেখেন? এই বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় যারা কবিতা লেখে, তারা সুযোগ পেলেই বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়িটা দেখে আসে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু কেবল বরিশাল গেছে জীবনানন্দ দাসের বাড়িটা দেখার জন্য। অবশ্য পিতৃভূমিতে একটা বড় ঘর ছাড়া আর কিছু নেই এখন।
কিছু থাক আর না থাক, কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর সুখই অন্যরকম। ওই বাড়িতেইতো তিনি জন্মেছিলেন?
জি ম্যাম, তিনি ওই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন, জবাব দিয়ে দাঁড়ায় অমলেন্দু ঘোষ।
শোনো অমলেন্দু, আমার কিন্তু পানিতে ভীষণ ভয়। বরিশালের দিকে যাওয়াই হলো না পানির ভয়ের কারণে। কয়েক বছর আগে আমার ছোট বোন বরিশাল থেকে এসেছে। ওর বর চাকরি করতো। আমাকে যাবার জন্য কতোবার চিঠি লিখেছে। আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েও যাইনি পানির ভয়ে। এবার যাচ্ছি, এক সঙ্গে বুয়েটের অনেকেই যাচ্ছে তো, একটা সাহস পেয়েছি।
আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই ম্যাম। যদিও বরিশাল পানির পথ কিন্তু এম ভি সামাদ লঞ্চটা অনেক বড়। তেলের ট্যাংকার কিনে কেটে সাইজ করে যাত্রীবাহী লঞ্চ বানানো হয়েছে। আর স্টিল বডি, কোনো ভয় নেই। আসুন বরিশালে, ভালো লাগবে। আজ আসি, দেখা হবে বরিশালে।
বড় আশ্বাস দিয়ে চলে এসেছিল অমলেন্দু ঘোষ। সেই ম্যাম কি এসেছে? অমলেন্দু ঘোষ ফুলের মালা ওর বাবার কাছে রেখে লঞ্চে ওঠে। মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় মতিন বৈরাগীর সঙ্গে। মতিন নামছে অমলেন্দুর খোঁজেই। আর লঞ্চের ভেতরে ঢুকে পরিস্থিতি দেখেই বুঝে গেছে, লঞ্চের যাত্রীদের ওপর দিয়ে কী বাটনা না গেছে গত রাতে। অনেক যাত্রী এখনো অসুস্থ। ব্যথায় কাতরাচ্ছে, উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ইতোমধ্যে ডাক্তার এসেছে দুজুন। যাত্রীদের সেবা করছে।
ওনারা কোথায়? মতিন বৈরাগীর কাছে জানতে চায় অমলেন্দু ঘোষ।
কেবিনে। আয় আমার সঙ্গে।
চল, অপরাধী মুখে অমলেন্দু ঘোষ যাচ্ছে মতিন বৈরাগীর পিছু পিছু।
শরীর ভেঙে আসে শফিক হায়দারের। ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ, কিন্তু একজন মানুষও পরিচিত নয়। একটা মহাশূন্যের মধ্যে এসে পড়ে শফিক হাসান। কিন্তু হাঁটা অব্যাহত রাখে, হাঁটা থামায় না। মনে হয়, দেখতে চায়, পথের শেষ কোথায়. পথের শেষ কি দেখা যায়? পথ কি হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে শফিক হায়দার। বেশ কিছুদূর আসার পর দেখতে পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শুনেছে মানুষের মুখে, সদরঘাটে নামলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ধীরে ধীরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে সামনে এগুতেই ডান দেখতে পায়, বাহাদুর শাহ পার্ক।
বাহাদুর শাহ? দিল্লির শেষ মুগল সম্রাট। ইংরেজ বেনিয়ারা যাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে দিল্লি দখল করে সম্রাট বাহাদুর শাহকে নির্বাসনে রেঙ্গুনে পাঠায়। হায়, নিজের সাম্রাজ্যেও থাকার সুযোগ হয়নি বয়োবৃদ্ধ সম্রাটের। তিনি কবিতা লিখতেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় শফিকের, সকালে বাদশা সন্ধ্যায় ফকির। গানটা শুনেছে ট্রানজিস্টারে। শফিক বাহাদুর শাহ পার্ক পার হয়ে জনসন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইংলিশ রোডে এসে পড়ে। চৌমাথা। কোন দিকে যাবে? একটা লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, জিজ্ঞেস করে শফিক, ভাই আমি সেগুনবাগিচা যাবো।
সামনের ছোট রাস্তা দেখিয়ে বলে, এই রাস্তা ধরে সোজা হেটে যাবেন। এই রাস্তার নাম নবাবপুর রোড। সোজা হেঁটে যেতে যেতে সামনে পড়বে বাইতুল মোকাররম সমজিদ। ওই মসজিদের ডান পাশে সচিবালয়। সচিবালয়ের ডানে প্রেস ক্লাব। প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকেই সেগুনবাগিচার রোড। লোকটা সিগারেটটা ফেলে দেয় মাটিতে, পায়ের বুট জুতা দিয়ে পিষে চলে যায় উল্টো দিকে।
শফিক হায়দার নবারপুরের রাস্তায় ঢোকে, বামে রেখে ইংলিশ রোড়ের বারবণিতাদের খামার। খুব খিদে অনুভব করছে শফিক। কিন্তু কী খাবে? ঢাকা শহরের কোন হোটেলে কী পাওয়া যায়, জানে না। শুনেছে, ঢাকার হোটেলে ঢুকে না জিজ্ঞেস করে খেলে, পরে অনেক টাকা বিল করে। এমনকি জামা খুলেও রাখে। না বাবা, আগে সেগুনবাগিচায় মাওলানা মতিনের লেবার পার্টির অফিসে পৌঁছায়। সেখানের পরিস্থিতি কেমন, কে জানে? থাকতে না পারলে কোথায় থাকবে? ফুটপাতে?
রাতের শহরটাই অপরিচিত লাগে শফিক হায়দারের। এতো আলো? কিন্তু আলোর আড়ালে আরো ঘন অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে যায় শফিক। টিকে থাকতে পারবে তো ঢাকায়? টিকতে না পারলে লেখক কি করে হবে? আর বাড়িতে রেখে আসা মা ভাইবোনগুলোর বাঁচবে কি করে?
না ফুরোয়? পথ তো হাজার হাজার কিলোমিটার নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে খুনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা শহর দেখতে দেখতে চাটতে চাটতে সচিবালয় পার হয়ে তোপখানা রোড পার হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ায় শফিক। জিজ্ঞেস করে সেগুনবাগিচা রোড কোনটা? একজন দেখিয়ে দিলে, প্রবেশ করে রোডে। রোডে ঢুকেই হাঁটতে হাঁটতে হাতের ডানে প্রথম রোডে প্রবেশ করে। মিনিট দুয়েব হাঁটার পরই শফিক হায়দার পেয়ে যায় বাংলাদেশ লেবার পার্টির অফিস। মিজানের দেওয়া ঠিকানা নিয়ে ১০/বি সেগুনবাগিচার সামনে দাঁড়িয়ে শফিক। দোতলা একটা পুরনো কিসিমের দালান। সামনেই একটা বড় আম গাছ। প্রবেশ করেই বড় একটা রুম। ঢুকলেই রুমের পশ্চিমের দিকে প্লাসটিকের সোফায় একজন খালি গায়ে বসা পেটমোটা লোকের দেখা পায়।
কাকে চান? গলাটা বরিশালের।
মাওলানা আবদুল মতিনকে চাই।
কোত্থেকে এসেছেন?
ভাণ্ডারিয়া থেকে।
ভাণ্ডারিয়া শোনার সঙ্গে সঙ্গে পেট মোটা খালিগায়ের গলা একটু নুয়ে আসে, মাওলানা তো এখনো আসে নাই। আসতে পারে। আপনি বসেন।
শফিক ঢাকা শহরের প্রথম বসে ১০/বি সেগুনবাগিচায় মাওলানা আবদুল মতিনের লেবার পার্টির অফিসে। বসে অপেক্ষা করছে মাওলানার। বন্ধু মিজানের মামা মাওলানা মতিন। সেই সূত্রে আসা। সূত্রটা বড় নাজুক। থাকতে দিলেও দিতে পারে মাওলানা, নাও দিতে পারে। না দিলে কী হবে। ভাবনার মধ্যে কালো রঙের ছোটখাটো একজন লোক প্রবেশ করে। হালকা চাপ দাড়ি। মাথায় লম্বা করে কালো টুপি। রুমের মধ্যে আরও দুচারজন যারা ছিল, দাঁড়ায়।
শফিকও দাঁড়ায়। মাওলানা মতিন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে?
আমি শফিক হায়দার। ভাণ্ডারিয়া থেকে এসেছি। মিজান বলেছিল।
আমি জানি, ভদ্রলোক পাশে বসে শফিকের। বসেই আরও টুকটাক সংলাপের মধ্যে শফিকের রানের ওপর হাত রেখে কয়েক বার টিপ দেয়। শফিক কিছু মনে করে না। এই টিপের মধ্যে কি প্রকাশ পাচ্ছে কিছুই জানে না। শুধু জানে, টিকে থাকতে হবে।
তো হুজুর, আমি কী করবো?
লেখাপড়া কতদূর?
এইবার এসএসসি দিয়া আসলাম। আমার যেকেনো একটা কাজ দরকার।
থাকো দেখি, মাওলানা উঠলো। নিজের চেয়ারে বসে দুই-একটা চিঠি দেখে, আগত লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। যাওয়ার সময়ে পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে দিয়ে বলে, খেয়ে নিও।
ঢাকা শহরের প্রথম আয়? দান? না উপহার? অত ভাবনার সময় কই শফিক হায়দারের? বুঝে গেছে জীবনের নাগিরক ধারাপাত শুরু হলো দশটাকা দিয়ে। পরের দিন, মাওলানা মতিন সূত্রাপুরের একটা ঠিাকানা দিয়ে বলে, যাও এই ঠিকানায়। কাজ আছে।
সূত্রাপুরে ঠিকানায় গিয়ে দেখতে পায়, বিরাট একটা ঘর। ঘরটা টিনের। এক ধরনের গুদামঘর। সেই স্যাঁতস্যাঁতে গুদাম ঘরের মাঝ বরাবর ঢাকা শহরের টোকানো কাগজের স্তূপ। সেই পচা ছেঁড়া কাগজের স্তূপ থেকে কাগজ বেছে বেছে বড় একটা জায়গায় রাখতে হবে।
গোটা ব্যাপারটা দেখে দমে যায় শফিক হায়দার। দরিদ্র, হ্যাঁ দরিদ্র। খেতে পায় না, হ্যাঁ খেতে পায় না, কিন্তু এই কাজ করতে হবে? ঢাকা শহরের পুরনো ছেঁড়া বাতিল কাগজের মধ্যে থেকে ভালো কাগজ বাছতে হবে? অনেকেই কাজটা করছে। যেহেতু উপায় নেই, হাজির হয়েছে। কাজটা শুরু করে শফিক কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে, আমি তো লেখক হতে আসছি ঢাকা শহরে। ছেঁড়া কাগজ বাছতে তো আসি নাই। যারা আগে থেকেই ছিল, কোনোভাবে তাদের সঙ্গে কাজটা করে, দুপুরের পরে চলে আসে সেগুনবাগিচায়।
সন্ধ্যার পরে অফিসটা সরগরম হয়ে যায়। মাওলানা মতিনের বাসায় থাকে ছোট দুই ভাই। মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার আর আবদুল ওয়াহীদ। মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার মোটামুটি বড় ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। ছোটখাটো গড়নের নরম স্বভাবের মানুষ। বাংলাদেশ সিরাত মিশন নামে প্যাড সর্বস্ব একটা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। আর ছোট ভাই আবদুল ওয়াহীদ পুরোদস্তুর আধুনিক মানুষ। অর্থনীতিতে মাস্টার্স। বড় ভাই আবদুল মতিনের এক কাগজের মালিক বা শিল্পপতির সঙ্গে খাতির। বড় ভাইয়ের সৌজন্যে সেই শিল্পপতির কাগজের কারাখানায় ওই ছেঁড়া কাগজ সাপ্লাই দেওয়ার ব্যবসা করে ওয়াহীদ।
সন্ধ্যায় আরও আসেন বাংলাদেশ বেতারের একজন টাইপিস্ট লিয়াকত হোসেন এবং বিশিষ্ট ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদ্দিন। দুজনের সান্ধ্যাকালীন চাকরি বাংলাদেশ লেবার পার্টির অফিসে। মাওলানা মতিন প্রায় সন্ধ্যায় এসে চেয়ারে বসেন।
বসেই ডাক দেন, খালেক সাহেব আছেন?
খালেক বিন এগিয়ে আসেন, আছি হুজুর।
বসেন আমার সামনে।
খালেক বিন জয়েনউদ্দীন বসেন মাওলানা মতিনের টেবিলের সামনে। হাতে কাগজ-কলম। মাওলানা মতিন চোখ বুঝে বলতে শুরু করেন, আজ বিকালে টঙ্গির শ্রমিক এলাকা থেকে প্রায় এক হাজার শ্রমিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল মতিনের সঙ্গে লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সেইসব শ্রমিক ভাইয়ের উদ্দেশে মাওলানা আবদুল মতীন বলেন….।
শফিক হায়দার অনেকের সঙ্গে সোফায় বসেছে। দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাওলানা মতিন যে বললো, আজ বিকেলে টঙ্গী থেকে প্রায় এক হাজার শ্রমিক এসেছিল, কই? আমি তো সারাদিন এই অফিসে ছিলাম। কোনো শ্রমিককে তো দেখিনি।
খালেক বিন জয়েনউদ্দীন বেশ কয়েকবার বিবৃতি কেটেকুটে ঠিক করে আবার মাওলানাকে শোনায়। মাওলানা আরও একটা শব্দ পরিবর্তন করে টাইপিস্ট লিয়াকতকে দিয়ে দেন। লিয়াকত আলী দ্রুত টাইপ করতে থাকে। টাইপ করার ফাঁকে মাওলানা টেলিফোন তুলে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক গোলাম সারোযারকে ফোন করে। দুজনের বাড়ি একই এলাকায়, বানারীপড়া আর ভাণ্ডারিয়া।
হ্যালো সারোয়ার ভাই, কেমন আছেন?
ভালো, ওপাশ থেকে উত্তর দেন সারওয়ার, আপনি কেমন?
আছি আর কি! শোনেন আজকে আমার অফিসে টঙ্গী থেকে হাজারখানেক শ্রমিক এসেছিল। একটা বিবৃতি রেডি করে খালেক সাহেবকে দিলাম। একুট দেইখেন।
আচ্ছা পাঠান, গোলাম সারোয়ার ফোন রেখে দিলেন। রাত আটটা, পত্রিকার কম্পোজ মেকাপ অনেক কাজ। ফোন সেরেই মাওলানা পকেট থেকে টাকা বের করে খালেক বিন জয়েনউদ্দিনকে দিলেন পঞ্চাশ টাকা, খালেক সাহেব যাবার সময়ে এই বিবৃতিটা সারোয়ার ভাইকে দিয়ে যাবেন।
আচ্ছা, খালেক বিন জয়েন উদ্দিন টাকাটা পকেটে নিতে নিতে হিসাব মেলান, রিকশায় সেগুনবাগিচা থেকে রামকৃষ্ণ মিশন রোড়ের ইত্তেফাক ভবন পর্যন্ত দশটাকা ভাড়া। ইত্তেফাক থেকে আজিমপুর বাসা পর্যন্ত বিশ টাকা। পকেটে থেকে যাবে আরও বিশ টাকা।
লিয়াকত সাব, টাইফ হয়েছে? হাক দেন মাওলানা আবদুল মতিন।
হয়েছে হুজুর। ফাইনাল একবার চেক করে দিচ্ছি।
তাড়াতাড়ি করেন, রাত নটা বাজলে সারোয়ার ভাই ধরাতে পারবেন না, গম্ভীর গলা মাওলানার।
দেখা শেষ হুজুর, লিয়াকত আলী বাংলাদেশ লেবার পার্টির প্যাডে টাইপ করা আট নয় দশটা কাগজ এগিয়ে দেয় মাওলানার সামনে। একবার চোখ বুলিয়ে প্রেরণকারী হিসেবে কারও নাম দিয়ে স্বাক্ষর দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পত্রিকা অফিসে।
খালেক সাব? দৈনিক ইত্তেফাকের জন্য একটা বিবৃতির কাগজ নিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে ডাক দেয় মাওলানা।
বলেন হুজুর।
আপনি যাবার সময়ে নতুন একটা ছেলে আসছে ভাণ্ডারিয়া থেকে। এই তোমার নাম কী? মাওলানা তাড়া দেন।
আমার নাম শফিক হায়দার হুজুর।
অরে সঙ্গে নিয়া যান। ইত্তেফাকে যাবার সময়ে শফিককে বাংলার বাণী, সংবাদ, দৈনিক বাংলা পত্রিকার অফিস চিনিয়ে দিয়ে যাবেন।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হয় খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, ঠিক আছে হুজুর। তাকায় শফিকের দিকে. আসো, তাড়াতাড়ি আসো।
শফিকের তো একটা কাজ দরকার। দ্রুত দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় গেটের দিকে।
এই শফিক শোনো, ডাকেন মাওলানা।
টেবিলের সামনে এগিয়ে গেলে পকেট থেকে বের করে ত্রিশ টাকা দেন, তুমি ভালো করে পত্রিকার অফিস চিনে আসবা। আর সব প্রেসরিলিজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের হাতে দিয়ে আসবা। ঠিক আছে?
জি, ঠিক আছে।
র হয়ে আসে শফিক লেবার পার্টির অফিস থেকে। অফিসের বাইরে বের হয়ে শফিক দেখে, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন একটা রিকশা ঠিক করে বসে বসে সিগারেট টানছে। শফিক কাছে গেলে, সরে জায়গা দেয়। শফিক ঢাকা শহরে প্রথম রিকশায় চড়ে বসে। রিকশাঅলা চালাতে শুরু করে। উপভোগ করছে শফিক হায়দার ঢাকা জীবনের দ্বিতীয় দিনের রাতের ঢাকা রিকশায় চড়ে। রিকশা মেইন রোডে পড়লে, গত দুই দিনের প্রেসক্লাব, তোপখানা রোড়টাই লাইটের আলোয় অচেনা লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোপখানা রোড পার হয়ে রিকশা ছুটে চলে মতিঝিলের দিকে।
রাতের শহরটাই অপরিচিত লাগে শফিক হায়দারের। এতো আলো? কিন্তু আলোর আড়ালে আরো ঘন অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে যায় শফিক। টিকে থাকতে পারবে তো ঢাকায়? টিকতে না পারলে লেখক কি করে হবে? আর বাড়িতে রেখে আসা মা ভাইবোনগুলোর বাঁচবে কি করে?
রিকশা ছুটে চলে।
চলবে…