[পর্ব-১৮]
গত ত্রিশ বছরের যাত্রী আবদুল মতিন, এই বিশাল নদী পথের।
অনেক ঝড়, ঝঞ্ঝা দেখেছে, সহ্য করেছে, অভিজ্ঞতার কারণে তেমন ভয় পায় না নদী পথের এই যাত্রায়। কিন্তু এই মুহূর্তে মেঘনা নদীর এই ভয়াল ঝড়ের তো কোনো তুলনা করতে পারছে না আবদুল মতিন। নিজের মধ্যেও ভয় প্রবেশ করেছে। হ্যাঁ, সাঁতার জানে ও, কিন্তু বিশাল মেঘনার বক্ষে উথাল পাতাল ঢেউয়ের উতুঙ্গে সেই সাঁতারে কিভাবে টিকে থাকবে, যদি ডুবে যায় বিশাল লঞ্চ এমভি সামাদ? প্রবল ঢেউ কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাবে, কোনো দিশা আছে? হারিয়ে যাবে মার্বেলের মতো অথৈ পানির প্রবাহে।
আবদুল মতিনের ভাবনার মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পায়, মা!
লঞ্চ দুলছে। দুলছে লঞ্চের প্রতিটি কণা, প্রতিটি বস্তু। আর দুলছে লঞ্চের মানুষগুলো। কানে ভেসে আসছে ডেক থেকে হুইসেলের বাঁশি। মতিন শব্দের উৎসে তাকায়, মহুয়া হালদার মোচড় খেয়ে কন্যা সুকন্যার ওপর পড়ে। মেয়ে ডাকে, মা!
রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পানির তোড়ে ভিজতে ভিজতে মতিন ভেবেছিল, মা মেয়ে বেঁচে নেই। কিন্তু পানির প্রবল স্রোতের মধ্যে, ঝড়ের কর্ণভেদী শব্দের মধ্যেও শুনতে পায় সুকন্যার ডাক, মা!
কিন্তু অধ্যাপক গোপাল হালদার কই? আবদুল মতিন প্রচণ্ড দুলুনির মধ্যেই ঘাড় বাকা করে খাটের নীচে তাকায়, পানির মধ্যে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পায়। লঞ্চের দুলুনিতে, রুমের ভেতরে পানির অবাক যাতায়াতের তোড়ে প্রায় জ্ঞান হারানো মানুষগুলো কোনোভাবে বেঁচে আছে, বুঝতে পারে আবদুল মতিন।
লঞ্চটা কোথায় এখন? আবদুল মতিন বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই বাতাস অনেকটা কমে যায়। বিশাল মেঘনার ঢেউ থমথম করছে লঞ্চটাকে ঘিরে। আবদুল মতিন শুনতে পায়, নিচতলা থেকে যাত্রীদের চিৎকার, কান্নাকাটি। কান্নাকাটির বিরটা অংশজুড়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল প্রার্থনা, বাঁচিয়ে রাখার। লঞ্চ যেন ডু্বে না যায় মাঝ অকূল দরিয়ায়, আন্টি! মতিন নুয়ে প্রায় অসংবৃতা মহুয়া হালদারের হাতটা ধরে, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? জোরে চিৎকার করছে ও।
মহুয়া হালদার প্রায় বেহুঁশ। পাঁজাকোলো করে কোনোভাবে তুলে ধরতেই, মাথা নুইয়ে প্রচুর পানি বমি করে দেয় মুখ থেকে। নেতিয়ে পড়ে আবদুল মতিনের শরীরের ওপর। খাটের নিচ থেকে লঞ্চের দোলায় বের হয়ে এসেছেন গোপাল হালদার। মহুয়া হালদারকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বাম হাতে ধরে গোপাল হালদারকে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাক দেয়, স্যার? স্যার?
কোনো সাড়া নেই। হতবিহব্বল মতিন। চোখ ফেটে কান্না আসছে। কি অসহায় মানুষ প্রকৃতির রুদ্ররোষের কাছে। ঘণ্টা খানেক আগেও কি নির্মল আনন্দ উচ্ছাসের জীবন পার হয়ে এসে, এখন জীবন মৃত্যুর পারে অপেক্ষা করছে সবাই। হঠাৎ ভাবনায় আসে, আমার সঙ্গে বুয়েটের যেসব ছাত্ররা ছিল, ওরা কোথায়. ঠিক আছে তো? জসিম উদ্দিনের তো উচিত ছিল, খোঁজ নেওয়ার। কিন্তু এদেরকে রেখে কেমন করে যাই? অন্য দিকে রুমের দুই অধ্যাপক কেমন আছেন?
স্যার? স্যার? ডান হাতে প্রবলভাবে ঝাঁকি দেয় অধ্যাপক গোবিন্দ হালদারকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায় গোবিন্দ হালদার। মনে হচ্ছে শত বছরের ঘুমের পর জেগে উঠেছে এবং এতোদিনের অর্জিত অভিজ্ঞতার চোখে দেখতে পাচ্ছেন চারদিকের সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিছুই চিনতে পারছে না। শরীরের অর্ধেক ডুবে আছে মেঘনার উদাত্ত জলে। পরিপাটি চুল, জামা কাপড় জলে ময়লায় একাকার। জীবনের এমন বিশুদ্ধ বিরূপ পরিস্থিতির মুখে কখনো পড়েননি। আধা ঘণ্টার ঝড়ে সব ভুলে নতুন এবং ভিন্নধর এ জলের ফাঁদের জালে আটকা পড়েছেন তিনি এবং সংসার।
স্যার? আমাকে চিনতে পারছেন? ঝড়ের একটানা শো শো শব্দ আর মেঘনার পানির ছলাৎ ছলাৎ বজ্রনিঘোষের মধ্যে চিৎকার করে ডাকছে মতিন।
অধ্যাপক গোপাল হালদার চোখ বড় বড় করে তাকায় আবদুল মতিনের দিকে। বিহ্বল, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, ভয়ে চোখের মণি বাইরে বের হয়ে আসতে চাইছে। দুহাতে বর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে প্রশ্ন করে, আমি কোথায়?
স্যার, আপনি এম ভি সামাদ লঞ্চে।
লঞ্চে কেন? লঞ্চ কোথায়? লঞ্চটা পানির নিচে? আমি বেঁচে আছি কেমন করে? উঠে বসেছেন অধ্যাপক গোপাল হালদার কেবিনের আধ হাটু পানির মধ্যে।
না, স্যার, লঞ্চ পানির ওপরেই আছে।
পানির ওপরই আছে? বিভ্রান্ত অনেকটা তিনি। হাটু পরিমাণ পানির মধ্যে বসে, দুহাতে পানি হাতাতে হাতাতে প্রশ্ন করেন, তাহলে রুমে এত পানি এলো কী করে?
স্যার, আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছি, এই দেখুন, সরে গিয়ে বুকের ওপর থেকে মহুয়া হালদারকে টেনে স্থাপন করে দেয় অধ্যাপকের হাঁটুর ওপর, আপনার স্ত্রী। বাম পাশে বড়ে থাকা মেয়েকে বলে, আর ওই যে আপনার মেয়ে সুকন্যা।
ওরা দেখতে পায় না, কেবিন থেকে বের হয়ে মিসেস মহুয়া হালদার দাঁড়িয়েছেন আলুথালুভাবে ডেকের সামনে, কাঠের গরাদ জড়িয়ে ধরে দেখছে একটা তারার বুকে আর একটা তারা নদীর তরঙ্গে কেমনে মিলেমিশে এককার হয়ে যায়!
নিজের স্ত্রী কন্যাকে দেখে অনেকটা ফিরে আসে নিজের চেতনায় অধ্যাপক গোপাল হালদার। এম ভি সামাদ দুলছে, দুলছেন অধ্যাপকও, দুলছেন মুহুয়া হালদারও। পাশে পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেয়ে সুকন্যা। কিন্তু অধ্যাপক স্ত্রী মহুয়াকে টেনে হাঁটুর উপর থেকে নিজের বুকের ওপর নেন। আবদুল মতিন দেখেতে পায়, মহুয়া স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঝড়ে দুলতে দুলতে হা করে শ্বাস নিচ্ছেন। মতিন নিজেও নিজের মতো করে শ্বাস নিয়ে বসে সুকন্যার পাশে। নাড়া দেওয়া মেয়েটাকে। মেয়েটার কোনো শ্বাস নেই। মনে হচ্ছে নিথর। ঝড় এবং দুলনির মধ্যেও আবদুল মতিনের মাথা খালি হয়ে যায়, সুকন্যা মারা গেলো?
অধ্যাপক গোপাল হালদারের একমাত্র সন্তান সুকন্যা! ঝড়ের পরে এই মৃত মেয়েকে নিয়ে বরিশালে নেমে অধ্যাপক আর তার স্ত্রী মহুয়া হালদার কী করবেন? গোটা পরিস্থিতি মেঘনা নদীর মাঝখানে বা পারের দিকের জলের তোড়ে রাত্রির অন্ধকারে ভিজে ভিজে কাক হয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে আবদুল মতিন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও জীবনের পবরর্তী রেখা বিষয়ে ভাবছে। হঠাৎ ভয়াল একটা ঢেউয়ের ছোবল হামলে পরে এমভি সামাদের ওপর মেঘনার অন্ধকারের ঢেউ, মনে হচ্ছে লঞ্চটা দুমড়ে মুচরে পানির নিচে, পাতাল দেশে আশ্রয় নিতে চলছে, পানির তোড়ে তোড়ে মোড়ের ঘূর্ণিপাকে। চিৎকার করে অধ্যপাক জড়িয়ে ধরে স্ত্রী মহুয়াকে। ঝড়ের প্রবল বল্গাহীন টানে ঘুরতে ঘুরতে থাকা লঞ্চটা হারিয়ে যায় জলের মধ্যে। প্রবল টানে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না আবদুল মতিন, জলের ঢেউয়ের ধাক্কায় রুমের ভেতর থেকে বের হয়ে খোলা দিকে ছুটতে থাকে। লঞ্চের খোলা জায়গায় একবার গেলে, চিরকালের জন্য আদিগন্ত বিস্তৃত জলের গর্ভে হারিয়ে যাবে, আর ফিরে আসতে পারবে না। যেতে যেতে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালার একটা লোহার শিক আকড়ে ধরে শরীরের সব শক্তি দিয়ে। জলের ওপর ঝুলে থাকতে থাকতে মতিন টের পায় জলের লেলিহান জিহবা কতো শক্তি রাখে। প্রবল স্রোত আর পানির তোড়ে ভেসে যেতে যেতে নিজেকে কোনোভাবে রক্ষা করে। আজদাহা সাপের শো শো শব্দের আওয়াজের সঙ্গে স্রোতের ধাক্কায় খাবি খেতে খেতে লঞ্চটা হঠাৎ ভেসে ওঠে জলের ওপরে।
ভেসে উঠেই লঞ্চটা স্থির হয়ে যায়। কানে ভেসে আসছে লঞ্চের যাত্রীদের করুণ বিপন্ন অসহায় আর্তনাদ, কান্নার বিউগল। নিজেকে সামলে নিয়ে লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়ায় মতিন। চারদিকে তাকায়, ঘন নিঃসীম অন্ধকারের ওপর মেঘনার জল কল কল শব্দ বহিয়া যায় অন্ধ প্রেতাত্মার গতিতে। কিন্তু ঢেউ অনেকটা কম। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা আর নিজস্ব আলোয় মুতিন বুঝতে পারে, এমভি সামাদ লঞ্চটা মেঘনা পাড়ি দিয়ে হিজলার কাছে, আড়িয়াল খাঁ নদীর মুখে পড়েছে। আকাশের সেই ঘনায়মান কালো মেঘের ছায়াও নেই। তারায় তারায় খচিত প্রায় নির্মেঘ আকাশ ঝকঝক করে হাসছে। প্রকৃতির অপরূপর বিস্ময়ের সঙ্গে এই যে পরিচয়, আবদুল মতিন জানে, কাউকে কোনোদিন বলে, লিখে প্রকাশ করা যাবে না। প্রকাশে স্বভাষার সীমাবন্ধতা যেমন আছে, তেমন আছে বর্ণনার অক্ষমতা। মেঘনার এই ভয়াবহ ঝড় রাত্রি অভিজ্ঞতার বর্ননা দিতে পারেন একমাত্র শরৎ বাবু। তিনি শ্রীকান্ত উপন্যাসে বার্মা থেকে ফেরার পথে ঝড়ের যে বর্ণনা দিয়েছেন।
পাশ কেটে বরিশাল থেকে ঢাকার দিকে এটলান সান। দোতলা এই লঞ্চটায় আবদুল মতিন অনেকবার ঢাকা বরিশাল আসা যাওয়া করেছে। দোতলা লঞ্চটার যাত্রীরা জানতেও পারবে না, এই মাত্র বা কিছুক্ষণ আগে মেঘনার উপর দিয়ে, এমভি সামাদ লঞ্চের ওপর দিয়ে কী বয়ে গেছে! সময় এবং পরিস্থিরি মুখোমুখি হলে বোঝা যায়, জীবনের বহুমাত্রিক দার্শনিক পর্ব!
এমভি সামাদকে অতিক্রম করে এটলাস সান চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিন চলে আসে অধ্যাপক গোপাল হালদারের কেবিনে। এমভি সামাদ হালকা দুলছে, জলের ওপর হালকা ঢেউয়ের কারণে। কিন্তু ঝড়ের প্রকোপ অনেকটা কমে গেলেও লঞ্চ এবং যাত্রীদের মধ্যে বিপর্যস্ততার স্নারক কবে মুছে যাবে, কে জানে! ভাবতে ভাবতে কাক ভেজা আবদুল মতিন কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, সুকন্যা-মহুয়া হালদার এবং অধ্যাপক গোপাল হালদার, তিনজনে জড়াজড়ি করে বসে আসে হাঁটু পানির মধ্যে।
বাবা, একটু পানি খাওয়াতে পারো? অনেক দূরের ওপার থেকে ভেঙ্গে যাওয়া গলায় আকুল আবেদনের সুরে বলছেন অধ্যাপক গোপাল হালদার।দুঃখে বেদনায় আবদুল মতিন হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে, চারপাশে এতো পানি, পানির মধ্যে বসে অধ্যাপক পান করতে পারছেন না পানি।
দিচ্ছি স্যার! আবদুল মতিন দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচতলায় যায়। সিঁড়িতে, পথে, গোটা লঞ্চের মধ্যে মানুষের বিষ্টা, প্রস্রাবে আর বমিতে একাকার। ভয়ে অনেকেই প্রকৃতির কর্ম সেরে ফেলেছে। আবার কিছুটা ঝড়ের আগ্রাসী জলের তোড়ে ময়লা ধুয়ে মুছে ভেসে যায়। নানা ধরনের যাত্রীরা মিলে মিশে ডালের চালের মিশ্রণে মানুষ্য খিচুড়িতে রূপ নিয়ে পুথিঁগন্ধময় একটা অবর্ণনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে আছে। অনেক কষ্টে মানুষের শরীর হাত পা পারিয়ে পিছনে রহিমের চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। চায়ের দোকানের অধিকাংশ প্লেট, পিরিচ, কাপ, চুলো, পাতিল ভজঘট পাকিয়ে জড়িয়ে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। যাকে বলা যায় লণ্ডভণ্ড। ছোট দোকানের নিচে, মেশিন ঘরের সামনে দুই মাথার দিকে মুড়ে বিচিত্র কায়দায় বসে আছে। আবদুল মতিনকে দেখে মুখে সর্বহারার হাসি ফুটিয়ে বলে, কইছিলাম না। বাতাসটা ভালো না।
রহিমের কথার উত্তরে বলে রহিম, একটা গ্লাস দিন।
বসা থেকে দাঁড়ায় রহিম। হাত বাড়িয়ে নিজের দোকানে স্টিলের খোপে আটকানো তিনটি গ্লাস থেকে একটা গ্লাস বের করে হাতে দেয়। গ্লাসটা হাতে নিয়ে পিছনে ফিরে ছুটতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়,রহিম ভাই খাওয়ার পানি কই পাই?
রহিম ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুল মতিনের প্রশ্নে আবারও হাসে, পানি? লঞ্চের মধ্যে খাওয়ার যে পানি ছেলো সব বাতাসের তোড়ে পইরা গেছে নয়তো পানি বমি ঢুইকা নষ্ট অইয়া গেচে। কার লাইগা পানি?
আমার স্যারের জন্য…
আমারে দেন, গ্লাসটা হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেয় রহিম। গ্লাসটা হাতে নিয়ে সামাদ লঞ্চের শেষের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে, একটু ঝুঁকে মেঘনার অথৈ পানির মধ্যে গ্লাসটা ডুবিয়ে দিয়ে ভরা পানিসহ এনে হাতে দেয়, নেন।
মতিন পানির গ্লাসটা নিয়ে দৌড়ে ওপরের দিকে ছোটে। দোতলায় এসে অধ্যাপকের রুমের সামনে দাঁড়ায় মতিন, হাতে পানির গ্লাস। অধ্যাপক গোপাল হালদার, স্ত্রী মহুয়া হালদার আর কন্যা সুকন্যা জড়াজড়ি করে বসেই আছে। প্রত্যেকের চোখ খোলা কিন্তু কিছু দেখেছে, এমনটা মনে হয় না। এমভি সামাদ লঞ্চের প্রায় পাঁচশত যাত্রীর অবস্থা বোঝা যায়, এই রুমের যাত্রীদের দেখেই। মাত্র, আধঘণ্টা আ এক ঘন্টার জলের সঙ্গে বাতাসের ঘূর্ণিপাকে এমভি সামাদ লঞ্চের ইতিহাস ভূগোল আর স্মৃতির মানচিত্রটাই পাল্টে দিয়েছে।
স্যার আপনার পানি! কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন অধ্যাপক গোপাল হালদার। বুঝতে পারছেন না কি করবেন, পানি কেন? হঠাৎ মনে পড়ে, পানি খেতে চেয়েছিলেন। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। কথা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আবদুল মতিনের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে তিনি পানিটুকু এক নিশ্বাসে খেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অধ্যাপক গ্লাসটা ফিরিয়ে দেয়। শরীরের মধ্যে পানি প্রবেশ করায় অধ্যাপক একটু চাঙা হয়ে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন, ক’টা বাজে মতিন?
ঘড়ির দিকে তাকায় আবদুল মতিন। হাতের কবজিতে ঘড়ি বাঁধা আছে, খেয়ালই ছিল না। ঘড়ির দিকে বলে, স্যার সাড়ে চারটা।
সকাল না বিকেল?
স্যার সকাল। মানে ভোর।
বাবা জল খাবো, বাপের সঙ্গে লেপটে থেকে বলে সুকন্যা।
আনছি.. পানির জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে শুনতে পায় মহয়া হালদারের কণ্ঠ, খুব ক্ষিন স্বরে, আমিও খাবো।
ঘুরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়ায় মতিন, আমি দুজনের জন্যই পানি আনতেছি।
দৌড়ে চলে যায় নিচে রহিমের কাছে, রহিম ভাই জগ আছে?
আছে, রহিমকে আর কিছু বলতে হয় না। স্টোর থেকে অ্যালুমিনিয়ামের মাঝারি আকারের একটা জগ বের করে আগের মতো লঞ্চের কিনারে গিয়ে ঝুঁকে এক জগ পানি এনে হাতে দেয়। পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে দূত দোতলায় গোপাল হালদারের কেবিনে এসে দেখতে পায়, সুকন্যা কেবিনের জানালা ধরে দাঁড়িয়েছে। আর মিসেস মহুয়া একটা খাটের ওপর বসে আছে, নিচে পাদুটো ঝুলিয়ে। শরীরে যে ময়লা পানি, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আর অধ্যাপক গোপাল হালদার দেয়ালে পিঠ রেখে চোখ বুঝে চুপচাপ বসে আছে, ধ্যানের ভঙ্গিতে।
স্যার পানি! দরজায় দাঁড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে আবদুল মতিন।
এগিয়ে আসে সুকন্যা, আমাকে দিন। হাতে নিয়ে পানির গ্লাসটা এক চুমুকে পানিটা খেয়ে আবার বাড়ায়, আরও এক গ্লাস।
ঢেলে দেয় মতিন, দ্বিতীয় গ্লাসের পুরোটা খেয়ে ফিরিয়ে দেয় আবদুল মতিনের হাতে। মতিন আবার গ্লাসে পানি ঢেলে বাড়িয়ে দেয় মিসেস মহুয়ার দিকে। তিনি গ্লাসটা নিয়ে ধীরে ধীরে পানি পান করে বলেন, জগে পানি আছে?
ঘাড় নাড়ায় মতিন, আছে দিদি।
বাড়িয়ে ধরে গ্লাসটা, দিন।
আবদুল মতিন পানি ঢালে গ্লাসে। গ্লাসে পানি ভরা হলে জগ নামিয়ে নেয় মতিন। মহুয়া পানি পান করে অর্ধেক গ্লাস, বাড়িয়ে ধরে অধ্যপকের দিকে, খাবে অধ্যাপক কোনো শব্দ না করে স্ত্রীর হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে বাকিটুকু পান করে মতিনের কাছে গ্লাসটা ফেরত দিতে দিতে প্রশ্ন করে, মতিন ঝড় থেমেছে?
জি স্যার, থেমেছে। আকাশটা একেবারে পরিষ্কার। কোনো মেঘ নেই। তারায় তারায় খচিত আকাশ।
তাহলে বেঁচে আছি? প্রশ্ন করেন মহুয়া হালদার।
দুঃখ ও বেদনার মধ্যে হাসে মতিন, হ্যাঁ বেঁচে আছি। আর কোনো সংশয় নেই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন অধ্যাপক, এখন আমরা কোথায়?
অধ্যাপকের সঙ্গে মতিনও বাইরে তাকায়। তাকিয়েই বুঝতে পারে, সকাল হয়ে আসছে। দূরের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আর লঞ্চ ঢুকে পড়েছে আড়িয়াল খাঁ নদীর মধ্যে। মেঘনা থেকে আড়িয়াল খাঁ নদী অনেক ছোট। অনেক দীর্ঘ নদী, কিন্তু চওড়ায় কম। এইপার থেকে ওইপার দেখা যায়।
স্যার, আমরা এখন আড়িয়াল খাঁ নদীর মধ্যে। উত্তর দেয় আবদুল মতিন। আপনারা বাইরে আসুন, জীবন প্রতি মুহূর্তে কতভাবে পাল্টে যায়, কিছুক্ষণ আগে যে ভয়াবহ ঝড় ছিল, এখন এই নদীতে কিছুই নেই, কেমন শান্ত আর আকাশে তারার মেলা।
আমার ইচ্ছে করছে না, অধ্যপক শুইয়ে পড়েন বিছনার ওপর। পাশে বসে আপন মনে পা জোড়া দোলাচ্ছেন মহুয়া হালদার। পাশ থেকে সুকন্যা বলে, আমি দেখবো।
আসুন আমার সঙ্গে।
সুকন্যা কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। আর এতক্ষণ কেবিনের ভেতরে পানি না ঢোকায় পানি ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে। কেবিনের ভেতরটা স্যাঁত স্যাঁতে। মতিনের হাত ধরে কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়ায় সুকন্যা। মতিন কেবিনের টেবিলের ওপর পানির জগ আর গ্লাস রেখে আসে। দোতলার এই খোলা জায়গায় প্রসূতি ভোরের কালে এখনো কেউ এসে দাঁড়ায়নি। এমভি সামাদ লঞ্চ হালকা গর্জন করে আড়িয়াল খাঁ নদীর মধ্যে দিয়ে চলছে পানি কেটে কেটে।
সুকন্যা আড়িয়াল খাঁর দুই তীরে তাকায়, ভোরের প্রথম আলোয় কুসুমের মতো জেগে উঠছে দিন। এখনো সূর্য উকি দেয়নি। গাঢ় আবছা অন্ধকারে সুকন্যা আকায় আকাশের দিকে, পাশে দাঁড়ানো মতিনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট বেদনার সুরে উচ্চারণ করে, সুন্দর!
মতিনের কি একটা হয়, দুহাতে জড়িয়ে ধরে সুকন্যাকে, সুকন্যাও মাথা রাখে মতিনের চওড়া বুকে। ভোরের হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বহিয়া যায় দুজনের ওপর দিয়ে, পাশ দিয়ে। ওরা দেখতে পায় না, কেবিন থেকে বের হয়ে মিসেস মহুয়া হালদার দাঁড়িয়েছেন আলুথালুভাবে ডেকের সামনে, কাঠের গরাদ জড়িয়ে ধরে দেখছে একটা তারার বুকে আর একটা তারা নদীর তরঙ্গে কেমনে মিলেমিশে এককার হয়ে যায়!
চলবে…