সাঁতারু লঞ্চের দোতলায় রেলিংঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিলি মাহজাবীন। মিলির পাশে দাঁড়িয়ে শিমুল আহসান। অবাক দৃষ্টিতে দেখছে নদীবেষ্টিত জীবনের রূপ মিলি। চোখ আর ফেরায় না নদীর তীর, নদীর স্রোত আর তীরের মানুষের বিচিত্র কর্মপ্রবাহ থেকে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে শিমুল যতটা দেখে নদী, বেশি দেখে মিলিকে। বুকের ভেতরে বিচিত্র বাজনা বাজে…মিলিকে নিয়ে কতোদূর যেতে পারবো?
-শিমুল?
-বলো।
-জীবন কি অবাক ঘটনার জন্ম দেয় না?
-নিশ্চয়ই, মানুষের পৃথিবীতে মানুষই জন্ম দেয় সব অবাক ঘটনা। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও?
-আমি কি ছয় মাস আগেও ভেবেছিলাম, আজ লঞ্চে তোমার সঙ্গে তোমার বাড়ি যাবো? আরও দেখো, আমি ঢাকা শহরের অনেক জায়গাই চিনি। চিনি দেশের বাইরের অনেক দেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া। ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ন শহরও দেখেছি। থেকেছি। কিন্তু কখনো নদীপথে কোথাও যাওয়া হয়নি।
হাসে শিমুল, খুবই স্বাভাবিক। বিদেশে গেছ বিমানে। আর আমার সঙ্গে বরিশালে যাচ্ছ লঞ্চে।
-জানো, থেমে যায় মিলি মাহজাবীন ওর দিকে তাকিয়ে।
হাত ধরে শিমুল, থামলে কেন? বলো।
যেদিন থেকে বলছিলে লঞ্চে বরিশালে যাবে…সেদিন থেকেই আমার ভীষণ ভয় করছিল। কিন্তু তোমাকে বলিনি।
সাতারু লঞ্চের দোতলায়, কেবিনের দিকে লোকজন নেই। চট করে একবার দেখে নিয়ে ডানহাতে জড়িয়ে ধরে মিলির কোমড়, কেন ভয় করছিল?
শিমুলের কাঁধে মাথা রাখে মিলি, টিভিতে, পত্রিকায় দেখেছি প্রতি বছর লঞ্চ ডুবি হয়ে কত মানুষ মারা যায়। মানুষের কষ্ট-বেদনা-কান্না-চিৎকার-মাতম তো দেখেছি টিভির পর্দায়। পড়েছি পত্রিকার পাতায়। তোমার মনে আছে, একবার ঢাকা থেকে রাঙ্গাবালির পথে যাওয়ার সময়ে একটি লঞ্চ ডুবে শয়ের বেশি যাত্রী মারা যায়। তখন নৌমন্ত্রী ছিলেন লে. কর্নেল আকবর হোসেন। সেই মন্ত্রী প্রতি মৃতু যাত্রীর বিনিময়ে পরিবারে ছাগল দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। মন্ত্রীর সেই প্রস্তাব পত্রিকায় পড়ে আমার কান্না পেয়েছিল।
মিলির দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে শিমুল, তোমার কান্না পেয়েছিল?
মাথা ঝাঁকায় মিলি, হ্যাঁ।
-কেন? মৃতু মানুষগুলোর জন্য শোক অনুভব করছিলে তুমি?
শোক তো অনুভব করবোই, কারণ বাংলাদেশের মানুষ। এই মানুষগুলো খুবই সাধারণ, খেয়ে খাওয়া মানুষ। আমার কান্না পাচ্ছিল একজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে ছাগল? মানুষ এত সস্তা? এত অপমান জীবিত মানুষ করতে পারে মরে যাওয়া মানুষকে? বিশ্বাস করো, আমি কয়েকদিন মানসিকভাবে পীড়িত ছিলাম। ঠিক সেই সময়ে আমার বড় মামা বললেন, চলো সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে আমি। আব্বা আম্মার সঙ্গে আমিও গেলাম, শুধু মানুষের প্রতি মানুষের প্রতি অপমানের এই ট্রমা থেকে বের হওয়ার জন্য, একটানা বলে যায় মিলি মাহজাবীন।
শিমুল আহসানের খুব ইচ্ছে করে এই মুহূর্তে শ্যামল-কোমল মেয়েটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভীষণ রকম আদর করতে। কিন্তু রেগে যাবে মিলি। নিজেকে সামলে নেয় এবং অসম্ভব ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে, মিলির মানবিক বোধের ও ক্রোধের প্রকাশে। সত্যি মেয়েটি অসাধারণ!
সেই ঘটনাটা অনেকের মতো আমাকেও আহত করেছিল। গোটা বাংলাদেশের মানুষও প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল। কিন্তু ভয় করছে না কেন তোমার?
-তুমি সঙ্গে আছ না?
-তাই?
-হ্যাঁ, আরও আছে, দেখছি নতুন নতুন দৃশ্য। আমি পত্রিকায় পড়েছি, টিভির সংবাদে দেখেছি সদরঘাটে হাজার হাজার মানুষ আসে দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে। সদরঘাটা নোংরা আবর্জনায় টইটুম্বুর সময়ে। আর ভিখেরি, ঠিকানাহীন মানুষেরা জটলা করে থাকে। আজ তোমার জন্য নিজের চোখে দেখলাম। সবই ঠিক আছে কিন্তু এই মানুষগুলো থেকে সদরঘাটকে মুক্ত রাখা যায় না? একটু উদ্যোগ নিলেই তো হয়। অথচ বিদেশের বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্টেশন কী সুন্দর ঝকঝকে তকতকে থাকে! যদিও আমি কোনো দেশের নদীবন্দরে যাইনি, কিন্তু আমার ধারণা, ওরা নদীবন্দরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে।
-বাদাম লাগবে, বাদাম। কাছে এসে দাঁড়ায় বাদামঅলা।
-বাদাম খাবে?
-খাবো, ছোট্ট উচ্চারণ মিলি মাহজাবীনের।
-পাঁচ টাকার বাদাম দাও।
ফেরিঅলা একটা প্যাকেটে পাঁচ টাকার বাদাম আর কাগজের ছোট টুকরার ওপর বিট লবণ দিয়ে চলে যায়। শিমুল প্যাকেট হাতে নিয়ে বাদাম খুঁটতে শুরু করে। মিলি বাদাম খুঁটতে পছন্দ করে না। বাদাম খুঁটলে ওর আঙুলের প্রিয় নখগুলো ভেঙে যায়, হাতের সুন্দর দৃশ্যায়ন থাকে না। ক্যাম্পাসে যখনই বসেছে, বাদাম খুঁটে দিয়েছে শিমুল। কখনো কখনো বলেছে মিলি, আমি হাতেও নিতে পাবো না।
-হাতে না নিলে খাবে কী করে?
-খাওয়া খুব সোজা।
-কিন্তু খাবে কী করে?
-আমি হা করছি, তুমি মুখে দিয়ে দাও।
-বলো কী? এত মানুষের সামনে?
-তোমাকে তো মুখে দিতে বলেছি আমি। অনেকে কী করে জানো? অনেক প্রেমিক পুরুষ বাদাম চিবিয়ে নরম করে প্রেমিকার মুখে দেয়। যেন প্রেমিকার চিবোতে কষ্ট না হয়। আর তুমি? আমার মুখে কয়টা বাদাম খুটে দেবে, তাতেও কত সংশয়? যাও, তোমার বাদাম আমি খাবো না।
হাসে শিমুল আহসান। খুঁটতে থাকে বাদাম। বাদাম খুঁটে মিলির মুখের কাছে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হা করে, বাদাম ওর মুখে দেয়। মিনি বিড়ালের মতো চিবোয় ও। মেয়েটির অদ্ভুত সরল অভিব্যক্তি দারুণ লাগে। এই হাসে, এই কাঁদে। অভিমানে থাকে টইটুম্বর…একটু এদিক-ওদিক হলেই। আবার মিলি মাহজাবীনের বোধের বিস্তারও গভীর। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে যখন ভাবে শিমুল আহসান, তখন নিজেই নিজের তল খুঁজে পায় না। অতলে হারিয়ে যায়। সত্যি আমার জীবনে মিলি মাহজাবীন এসেছে?
ফুল দেওয়ার পরের দিন ক্যাম্পাসে এসে শিমুল দাঁড়িয়ে থাকে মিলির ক্লাসের সামনে। সারাটা রাত ঘুমুতে পারেনি। চোখ বুঝলেই রেটিনার ভেতরে এসে দাঁড়ায় মিলি। মিলির হাসি, সিঁড়ির চুম্বন…পুরো শরীর সুখের স্রোতে কেঁপে ওঠে শিমুলের। সকালে একটু ঘুমিয়ে ঠিক সাড়ে সাতটায় উঠে গোসল সেরে প্যান্ট শার্ট পরে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। অনেক দিন পর ইউনিভার্সিটির প্রথম বাসটা ধরে। ক্যাম্পাসে এসে এক দৌড়ে মিলির ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়ায়। গত সন্ধ্যায় বাসায় যাবার মিলি তিনটি প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল শিমুলের কাছে।
প্রথম প্রতিশ্রুতি, প্রেম করো আর যাই করো পড়াশোনাটা ঠিকভাবে করতে হবে। ভালো রেজাল্ট না করলে চিরকালের জন্য কাট্টি। দুই প্রতিশ্রুতি, বাসায় কখনো ফোন দেওয়া যাবে না। প্রয়োজন মনে করলে, আমিই দেবো। তৃতীয় প্রতিশ্রুতি, আমার সঙ্গে হ্যাংলামি করা যাবে না। আমি ছেলেদের হ্যাংলামি একদম পছন্দ করি না। তুমি আমার সামনে থাকবে সব সময়ে স্মার্ট। লোভী বিড়ালের মতো ছোক ছোক করবে না। -আমার এই প্রতিশ্রুতিগুলো মনে থাকবে?
বাসায় যাওয়ার জন্য রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার অপেক্ষা করছে দুজনে। দুটো রিকশাঅলাকে ধানমন্ডি যাওয়ার কথা বললে, যেতে রাজি হয়নি। অবসরে দাঁড়িয়ে দুজনে আলাপ সারছে।
-আর তুমি আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকো কেন? অন্যদিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে মিলি।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না মিলি, উত্তর দেয় শিমুল।
-কী বিশ্বাস হচ্ছে না।
-সত্যি তুমি আমাকে।
-অর্ধেক বলো কেন? যা বলবে পুরোটা বলো।
-আমি কী ভেবেছিলাম জানো?
-না বললে জানবো কী করে?
এইটা রিকশা সামনে দাঁড়ায়। মিলি জিজ্ঞেস করে ধানমন্ডি যাবে? রিকশাঅলা রাজি হলে উঠে বসে রিকশায়। ওর পাশে উঠতে যায় শিমুল। ধরে থামিয়ে দেয় মিলি, তুমি কই উঠছ?
-কেন? তোমার সঙ্গে রিকশায় যাবো। তুমি ধানমন্ডি যাবে আমি শংকরে থাকি।
-জি না। আমার সঙ্গে রিকশায় যাওয়া যাবে না। রিকশায় উঠে প্রেমিকরা যা করে ওসব আমার ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। এই রিকশা চলো।
আধাঘণ্টা ধরে আমি কাঁদি। আমার জীবনে এমন লাঞ্চিত কখনো হই নাই। জানো, সেই বেদনাটা এখনো আমার বাম বুকে আমি অনুভব করি।
রিকশা চলতে শুরু করে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি, মানে মিলি মাহজাবীন কি আমাকে এক রিকশায় চড়েত চায় না? অহংবোধ এত? কিন্তু এতক্ষণ তো অন্যরকম মনে হয়েছিল। ভুল হলো না তো? নাকি এখনই ফিরে যাবো আমার কাছে আমি। মনটা খা খা দুপুরের মতো পুড়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে প্রেমের এতো কষ্ট হয়? জানতাম না।
-আসো! সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আসে মিলি।
-কোথায় আসবো?
-ফুটানি করো না। হাত বাড়ায় মিলি, দাঁড়িয়ে আছো একই জায়গায় একবুক ব্যথা নিয়ে, বুঝি না আমি। আমিও তো তোমাকে একলা ফেলে যেতে পারলাম না। এসো।
-ইচ্ছে হয়েছিল বলে শিমুল, না আমি উঠবো না। বুকের মধ্যে ছলাৎ-ছলাৎ অভিমান ঠেলে ওঠে। কিন্তু পারলো না, উঠে বসে ওর পাশে। সঙ্গে সঙ্গে অবাক সুখে গোটা শরীরের রক্ত নেচে ওঠে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে, আলো-আঁধারীর এই মহেন্দ্রক্ষণে জড়িয়ে ধরে মিলিকে। কিন্ত মিলি বলেছে, আমি হ্যাংলামো পছন্দ করি না। আচ্ছা, প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরলে হ্যাংলামো হয়? কী জানি!
রিকশা চলতে শুরু করেছে।
তাকায় মিলি, আমার হাতটা ধরতে ইচ্ছে করছে?
মাথা নাড়ায় শিমুল, করছে খুউব।
-ঠিকাছে ধর, খুব আস্তে। চাপ দেবে না।
সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ধরে শিমুল। মনে হয়, হাতের মধ্যে সহস্র কবুতর উড়ে যাচ্ছে আকাশের ওপার দিয়ে অন্য আকাশে।
-শিমুল?
তাকায়ও।
তোমার বাবা মা পরিবার সম্পর্কে বলো।
-আমার বাবা একজন কৃষক। আমরা পাঁচ-ভাই-বোন। আমি তৃতীয় বা ছোট ছেলে। দুই বোনের মধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। দুলাভাই মাছের ব্যবসা করেন। ছোট বোন পারুল স্কুলে নাইনে পড়ে। মা গ্রামীণ ঘরের বউ আর কী!
-বুঝলাম।
-কী বুঝলা?
-আমি এখন কৃষকের পুত্রবধূ হবো। কিন্তু…
-কিন্তু কী?
আমি আমার পরিবার কিভাবে সামলাবো? আমরা শহরের মানুষ। গ্রাম আমাদের একটা আছে, কিন্তু যাওয়া হয় খুব কম। দশ বছর আগে একবার গিয়েছিলাম মেহেরপুরে, তুমি নিশ্চয়ই জানো মুজিবনগর।
-হ্যাঁ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল।
-রাইট, সেই আমবাগানের কাছেই আমাদের বাড়ি। বাবা বছরে দুই একবার অবশ্য যান। কিন্তু আমার মা একেবারেই ঢাকা শহরের জন্ম, বেড়ে ওঠা। কোনোভাবেই তোমাকে মানবে না।
-তাহলে?
-হবে একটা কিছু। শোনো তোমার ফাইনাল পরীক্ষা কবে?
-এই তো আগামী অক্টোবরে।
-অক্টোবরে! কর গোনে মিলি মাহজাবীন, এখন জুন মাস। আর মাত্র তিন মাস পর।
-হ্যাঁ।
-বিসিএস দিবা না?
-নিশ্চয়ই। খুব পড়ছি।
-গুড। আর শোনো, তোমাকে একটা খারাপ খবর দেই। সবই একদিনে দিয়ে দেবো? এক দিনের অর্ধেক দিনেরও কম সময়ে অনেক পেয়ে গেছো।
-সত্যিই অনেক পেয়েছি। বলো খারাপ খবরটা।
আমার বড় খালার ছেলে বিশিষ্ট চাটার্ট অ্যাকাউটেন্ট মি. বশিরউদ্দিন আমার পাণিপ্রার্থী। আমার মাও রাজি। শুধু বাবা বলেন, আত্মীয়দের সঙ্গে নতুন করে আত্মীয় করতে ভালো লাগে না। কিন্তু আমি জানি, আমার মা মিসেস আসমা রব্বানীর সঙ্গে আমার বাবা গোলাম রব্বানী শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ফলে, যেকোনো সময়ে আমার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে পারে। শুরু হলেই আমি চলে আসবো তোমার কাছে। তোমার মেসের ঠিকানাটা মোবাইলে ম্যাসেস করে পাঠিয়ে রেখো।
-ঠিক আছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন ছিল আমার।
-বলো।
-মি অ্যাকাউনটন্টে মি বশিরউদ্দিনকে তুমি পছন্দ করো?
-না, ঘৃণা করি। হিস হিস করে ওঠে মিলি মাহজাবীনের গলা। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই, ওকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলবো।
শান্ত মিহি সুন্দর সমুজ্ঝল মিলি মাহজাবীনের ভয়ংকর চেহারা দেখে হতবাক শিমূল আহসান। এই ফুলের বোটার মেয়েটা এতটা শাণিত? নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা।
শিমুল মানুষের টাকা পয়সা ক্ষমতা থাকলে এত দুর্বিনীত হয় কেন?
-জানি না মিলি।
-আপা আইসা পড়ছি। রিকশাঅলার কথায় ওরা তাকায়। রিকশা সাতাশ নম্বর রোডের মাথায়। রিকশা থেকে নামে দুজনে। ভাড়া দিতে যায় শিমুল। হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেয় মিলি, থামুন কৃষক পুত্র। ভাড়া আমিই দেবো। আপনি যখন আমাকে বিবাহ করবেন, তখন সব দায় আপনার…রিকশা ভাড়া থেকে শাড়ি ব্লাউজ…। তাকায় রিকশাঅলার দিকে, ঠিক বলেছি না দাদা?
ফোকলা দাঁতে নিয়নআলোর নিচে দাঁড়িয়ে হাসে রিকশাঅলা, হ ঠিকই কইছেন। রিকশা ভাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজে মোবাইল। হাতে নিয়ে তাকায় শিমুলের দিকে, আমার জননীর ফোন। কোনো শব্দ উচ্চারণ করো না। হ্যালো মা? এই তো বাসার কাছেই আমি…দশ মিনিটের মধ্যে আসছি…। না কাউকে পাঠাতে হবে না। আমি কি কচি মেয়ে এখনো? হারিয়ে যাবো? দয়া করে আমাকে মানুষ ভাবো।
ফোন রেখে মিলি তাকায়, বুঝতে পারছ কী যন্ত্রণার মধ্যে আছি। আমাকে ওরা মানুষই ভাবে না। চলো, হাঁটি। দুজনে সামনের দিকে হাঁটে।
-আমি খুব আদরে মমতায় বড় হয়েছি। বাবার তিন ছেলে মেয়ে। আমি একমাত্র মেয়ে। বাবা আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হন মায়ের চাবি দিয়ে। সব স্বামীরা বোধহয় এমনিই। তোমার মা কি তোমার বাবার ওপর ছড়ি ঘোরান?
-আরে না, বাবা যা বলেন, তাই হয় আমাদের সংসারে। কিন্তু দুজনার মধ্যে অদ্ভুত বোঝাপাড়া আছে। মা বাবাকে খুব ভালোবাসেন ও সন্মানও করেন। এখন পর্যন্ত বাবা না খেলে মা খায় না। বাবা অনেক বলেন, কিন্তু মা শোনে না।
-গ্রামীন জীবনের বোধটা এইরকমই, বলে মিলি।
-হ্যাঁ।
-ওই যে সাততলা বাড়িটা দেখছো, ওটার পাঁচতলা জুড়ে একুশশত বর্গফুটের বিশাল বাসা আমাদের। আমি যাই, কাল দেখা হবে দুপুরের পরে। আমার ক্লাস সকালে।
রাস্তার ধারে অনেকগুলো গাছপালার আড়াল। আলোও তেমন নেই। লোক চলাচল কম, হাত ধরে শিমুলের, একটা আলতো চমু দাও, এক সেকেন্ডে।
বিস্ময়ের অভিভূত শিমুল, হালকা একটা চুমু দেয় মিলির ঠোটে। যাই।
-দু’পা হেঁটে আমার ফিরে আসে শিমুলের কাছে, শোনো শিমুল। বছর তিনেক আগে দুপুরবেলা আমাদের বাসায় এসেছিল চাটার্ট অ্যাকাউন্টেন্ট মি বশিরউদ্দিন। সবে মাত্র ইংলন্ড থেকে পাস করে এসেছে। ওর জন্যই মা বাসায় পার্টির আয়োজন করেছিলেন ঘরোয়া ভাবে। আমি বুঝতে পারি মায়ের পরিকল্পনা…আমাকে বিয়ে দেবে ওর সঙ্গে। এক ফাঁকে বশিরউদ্দিন আমার রুমে আসে। আমাদের মধ্যে এমনি সম্পর্ক ভালো। গল্প করার এক ফাঁকে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বাম বুকে এমন একটা চাপ দেয়, আমি একেবারে বেদনায় অবশ হয়ে যাই। আমি চিৎকার করে উঠি। লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিল না। আমি বাথরুমে যাই…। আধাঘণ্টা ধরে আমি কাঁদি। আমার জীবনে এমন লাঞ্চিত কখনো হই নাই। জানো, সেই বেদনাটা এখনো আমার বাম বুকে আমি অনুভব করি।
মিলি মাহজাবীন চলে যায়, এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। কিন্তু স্থির দাঁড়িয়ে থাকে শিমুল আহসান, উজানগাঁওয়ের বারেক মৃধার ছোট ছেলে বিস্ময় আর বিস্ময় নিয়ে, আধো অন্ধকারে, ধানমন্ডির সাতাশ নম্বর রোড়ে, বিশিষ্ট আমরা গোলাম রব্বানীর বাসার সামনে।
চলছে…