॥ ৮ ॥
আমি আশিকের দিকে তাকালাম অবাক চোখে। আশিক কী বলছে এসব! আমার একটি যুক্তিপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে সে এ কী বলল! এ রকম প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের কারণ কী!
আমি শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, আশিক।
আশিক এ কণ্ঠের অর্থ জানে। সে কিছুটা শান্ত হলো। মাথাটা নিচু করল সামান্য। তার ভেতরে এক ধরনের অপরাধ বোধের ভঙ্গি দেখা গেলো। যেন সে কথাটা ওভাবে বলতে চায়নি। আমিও বুঝে নিলাম সবকিছু। বুঝে নিলাম তার দৃঢ়তা প্রতিক্রিয়ামূলক হয়ে গেছে। কিন্তু সে সত্যটাই বলেছে। আমিও কিন্তু অভিযোগের সুরে বলিনি। আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম তাকে মানুষের চেহারায় দেখতে না পাওয়ার কারণ কী? সরল সাধারণ প্রশ্ন ছিল। সরল সাধারণ উত্তরও প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আশিকের কাছে সেটা পাওয়া গেল না।
কিন্তু এ প্রশ্নের একান্ত উত্তর যে দিতেই হবে তাও জরুরি ছিল না। কারণ কিছু প্রশ্নের ব্যাপার থাকে তার উত্তর প্রশ্নকারীর জানাই থাকে। তবু প্রশ্নটা করতে হয়। তবে এ প্রশ্নের একান্ত উত্তরটি নিহিত ছিল গভীরতর চিন্তার ভেতরে। যেমন আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম, তাদের চেহারা তো মানুষের মতো ছিল না! আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম তাদের চিন্তা তো মানুষের মতো ছিল না! আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম তাদের আচরণ তো মানুষের মতো ছিল না! আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম তাদের কর্মকাণ্ড তো মানুষের মতো ছিল না! আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম তাদের আদর্শ তো মানুষের মতো ছিল না! আমরা যাদের মানুষ ভেবেছিলাম তাদের প্রতিক্রিয়া তো মানুষের মতো ছিল না! তাহলে তারা মানুষ নামীয় পদবাচ্যের অধিকারী হয় কিভাবে!
এসব ভাবতে ভাবতে আমি যখন আশিককে কিছু বলতে যাব, তখনই আরও কয়েকটি প্রবল ঢেউ এসে আমাদের আঘাত করল। আমরা সেই ঢেউয়ে তলিয়ে না গিয়ে ঢেউয়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। ঢেউ যখন আসে তখন বোধহয় আমরা তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছিলাম। দীর্ঘক্ষণ রক্ত-ঢেউ এর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে থাকতে বোধহয় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু ঠিক কিভাবে এ দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম, তা এক রহস্য। তা অজানাই থেকে যাবে বোধহয়। ঢেউটি ক্রমাগত সমতলের রক্তে যখন মিলিয়ে গেল আমরাও এসে গেলাম আগের জায়গায়।
আমরা আমাদের সঙ্গে কথা শুরু করার আগেই সাবেক মেজর জেনারেলের দিকে তাকালাম। দেখলাম তার আতিকায় জিহ্বার ওপরে অবস্থানরতরা তরতর করে নেমে আসছে। আমরা তাদের চিনতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমরা এ যাবৎ যত প্রাণী দেখেছি তা গৃহপালিত হোক কিংবা বন্য হোক কিংবা ডিসকভারিতে দেখা কোনো প্রাণী হোক কিংবা শিল্পীদের আঁকা কাল্পনিক প্রাণী হোক, কিংবা কার্টুনে দেখা প্রাণী হোক কারো সঙ্গেই কোনো মিল পেলাম না। আমরা কখনো জাগ্রত অবস্থায় এ ধরনের প্রাণী দেখিনি। আমরা স্বপ্নের ভেতরেও কখনো এ ধরনের প্রাণী দেখিনি। অজ্ঞাত কিম্ভূত সে প্রাণীগুলো খুবই বিশ্রীভাবে মুখ ভেঙচাতে ভেঙচাতে নামতে থাকলো। সবার নামা শেষ হলে তারা আশিক কথিত সাবেক মেজর জেনারেলের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাবেক মেজর জেনারেল তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করল যেন তারা বহুদিনের চেনা। যেন এরকম ঘটারই কথা ছিল।
সাবেক মেজর জেনারেল প্রাণী এবং ওইসব প্রাণীকে একসময় হাসতে দেখা গেল। তাদের হাসির দমক ক্রমেই বাড়তে লাগলো। সেই হাসির দমকে নীলান্ত নীলের সাগরে রক্তের ঢেউয়ের বেগ বেড়ে গেল। সেই হাসির দমকে বেড়ে গেল বাতাসের গতিবেগ। সেই হাসির দমকের সঙ্গে সঙ্গে বেড় গেল হিশহিশ শব্দ। সেই হাসির দমকে কোথায় যেন একটা আতঙ্ক রচনা শুরু হলো। সেই হাসির দমকে কিভাবে কিভাবে যেন সারা রক্ত-সাগরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। সেই হাসির দমকের সঙ্গে একটি সুর ভেসে আসছিল। আমি সে সুর কোন গানের তা বের করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু মনে হচ্ছিল এ গান আমাদের নয়। এ গান এক সময় আমাদের ওপর পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এ গান একসময় আমরা আমাদের বুক থেকে সরিয়ে ফেলেছি।
আশিক বলল, আমি এই সুর চিনি।
আমি বললাম, কোন সুর এটা তুই জানিস?
আশিক বলল, এটা পাক সার জমিন সাদ বাদ-এর গানের সুর।
আমরা এতক্ষণ বিস্মিত ছিলাম। আমরা এতক্ষণ ঘটনার পরম্পরা ধরবার চেষ্টায় রত ছিলাম। আমরা এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বিনিময়ে রত ছিলাম। আমরা এতক্ষণ ঘটনার কার্যকারণে ব্যস্ত ছিলাম। আমরা এতক্ষণ ঘটনার ব্যাখ্যায় রত ছিলাম। আমরা এতক্ষণ রত ছিলাম ঘটনা পর্যবেক্ষণে। এই প্রথম আমরা অতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কারণ তাদের অট্টহাসির সঙ্গে বের হয়ে আসছিল অসংখ্য শাপ। শাপগুলো পাক সার জমিন সাদ বাদের সুরে সুরে তাল মিলিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল। তারা হাসির দমকের সঙ্গে ছন্দ মিলেয়ে রক্তের সাগরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তারা গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলয়ে রক্তের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তারা গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ-কেলি করছিল। তারা গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ধূলিকণায়। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল কুয়াশার বিন্দুর মতো। তাড়া ছড়িয়ে পড়ছিল সারা প্রান্তরের প্রতিটি অন্ধকারের কণায়। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল এই নীলান্ত নীল প্রান্তরের সূক্ষ্মতম আলোর কণায়। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল প্রতিটি রক্ত কণিকায়। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল জোসনার মতো। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল শিশিরের মতো।
এই আতঙ্কের ভেতরেও আমরা তাদের লক্ষ করতে ভুললাম না। কারণ আমাদের যে কিছু করার নেই। কারণ আমাদের যে কিছুই করার নেই। আমরা ওই জটলার ভেতর দেখলাম সাবেক মেজর জেনারেল নামীয় প্রাণীকে, সেও অন্যসব প্রাণীর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। তার পর দেখা গেল সেই চাঁদতারা খচিত কিম্ভুত প্রাণীগুলো ওই মেজর জেনারেল নামীয় প্রাণীটাকে খুবলে খুবলে খেতে শুরু করেছে। যতই খোবল দিচ্ছিল তারা ততই সেখান থেকে বের হচ্ছিল ছোট ছোট সাপ। এক সময় দেখা গেল সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বার ওপরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সাবেক মেজর জেনারেল। তারপর দেখা গেল তাদের ভেতরের একজন ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে। স্ফীত হতে হতে এতই স্ফীত হয়ে গেল যে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলল। ঠিক নিকষ কালো অন্ধকার নয়, গাঢ় ছাই রঙের অন্ধকারে ভলে গেলো পুরো চারপাশ। দূরে, কিন্তু ঠিক কত দূরে ঠাহর করা গেল না, এক বিন্দু আলো এসে ছড়িয়ে পড়লো এই নিকষ কালো অন্ধকারে। তাতে অন্ধকার দূরীভূত হলো না টিক কিন্তু একটু আশার বিন্দু রচিত হলো যেন। যেন মনে হলো, না, সব কিছু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
আমরা লক্ষ করলাম রক্তস্রোত আর নেই। সব রক্তবিন্দু রূপান্তরিত হয়ে গেছে সাপে। লক্ষ কোটি সাপের গিজগিজ আর হিসহিসানিতে ভরে গেলো চারপাশ। আমরা এরকম এক পরিস্থিতির ভেতরে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে গেলাম। আমরা এরকম পরিস্থিতির ভেতরে পড়ে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দিহান হয়ে গেলাম। মনে হতে থাকলো আমরা কি মানুষ! সন্দেহ হতে থাকলো আমরা কি সাপ? সন্দেহ হতে থাকলো আমরা তাহলে কী? যাই হোক না কেন আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমাদের জীবন নিয়ে। এখন এই জীবনের পরিণতি কীরূপ হবে তা নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়লাম।
কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি গুচ্ছগুচ্ছ সাপ একত্রিত হয়ে এক একটি বড় সাপে রূপান্তরিত হচ্ছে। এরকম অসংখ্য বড় সাপ একত্রিত হয়ে একটি আতিকায় সাপে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমরা দেখলাম, আমাদের চোখের সামনেই এরকম কয়েকটি আতিকায় সাপ ফনা তুলে ফেলল। তাদের ফনা এতই বিস্তৃত হয়ে গেল যে গাঢ় ছাই রঙের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে গেল। ঝড়ের শব্দের মতো হিশহিশ শব্দ করে সাপগুলো এগিয়ে আসতে থাকলো আমাদের দিকে। আমরা ভয়ে আতঙ্কে সত্যি সত্যি নীল হয়ে গেলাম। সাপগুলো খুবই দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের দিকে। যেন আমরাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা আতঙ্কে করুণ চোখে পরস্পরের দিকে তাকালাম। হয়তো ভাবলাম এই আমাদের শেষ তাকানো।
আশিক বলল, ভয় পাস না।
আমি একটা হাসি দিলাম। বিদ্রূপের হাসি।
আশিক বলল, ব্যঙ্গ করিস না।
আমি কিছু বললাম না।
এ রকম মুহূর্তেও আশাবাদী হওয়া যায় আশিককে না দেখওে বুঝা মুশকিল। সাপগুলো যখন আরো বিপজ্জনক কাছে এসে প্রবল ফনা তুলে আমাদেরকে ছোবল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, ঠিক সে-সময়ে কোত্থেকে এক সাত-আট বছরের শিশু এসে আমাদের আগলে দাঁড়ালো। সাপগুলো তখন একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি করল। তারপর কোনো সুযোগ না দিয়ে আমাদের তাদের ফনার ছায়ায় ছেয়ে ফেলল। আমাদের দংশন করল কি না, আমরা বুঝতে পারলাম না। কারণ আমাদের কোনো বোধশক্তি ছিল না একটুও।
অনেক পরে যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন দেখি আমরা শুয়ে আছি পাশাপাশি। অনেক পরে যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন বুঝতে পারলাম, আমরা জ্ঞান হারিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরে পেয়ে আমরা আমাদের দেখতে থাকলাম। দেখলাম আমাদের তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু শিশুটির সারা শরীরে অসংখ্য দংশনের দাগ।
আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু বসতেই পারলাম না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। দুই একটা জায়গায় ছোবলের দাগ। আশিক বলল, ছেলেটি আমাদের দংশিত জায়গা থেকে বিষ তুলে নিয়েছে। আমাদের রক্ষা করতে এসে নিজেও দংশিত হয়েছে। আমরা হয়তোবা সুস্থ হয়ে উঠব। কিন্তু ওর জীবন তো আশঙ্কাজনক।
আশিক শিশুটির উদ্দেশে বলল, তুমি এ কাজ করতে গেলে কেন?
শিশুটি কোনো উত্তর দিলো না। আমি আরেকবার বিস্মিত হলাম। একটা শিশু আমাদের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে! তাহলে পৃথিবীতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে এখনো!
আশিক আবারো বলল,ও ওর জীবনকে আশঙ্কাজনক করে তুলল। দুঃখের কথা কি জানিস, ওকে আমরা একটুও সাহায্য করতে পারব না। ও ওর এই ছোট্ট জীবনটা আমাদের জন্য দিয়ে দিলো।
আমি বললাম, কী বলিস ! আমরা ওকে বাঁচিয়ে তুলব।
আশিক বলল, মানুষ কি মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে? আমরা তো ওর পাশেও যেতে পারব না।
আমি বললাম, কেন পারব না। আমরা ওকে হেল্প করব।
আশিক বলল, পারবি না। কারণ আমরা ওর কাছে যাবার সামর্থ্য হারিয়েছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি ওর কাছে যাওয়ার। যেতে পারছি না।
তখন আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। বিষে জর্জর এই আমি বসতে পারলাম না। তখন মনে হলো আমরা কত অসহায়। চোখে সামনে একজন শেষ হয়ে যাবে, আমরা কিছুই করতে পারব না। মানুষের জীবনে এরকম অসহায় মুহূর্তও আসে!
চোখ ফেটে কান্না আসে। আশিককে বলি, তুই এই ছেলেকে চিনিস।
আশিক বলল, ঠিক চিনি না। কিন্তু চিনিও। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।
আমি বললাম, কোথায়?
আশিক বলল, সে আরেক কাহিনি।
চলবে…