॥ ১০॥
হঠাৎ এই প্রশ্নটি মাথায় খেলে যায় বার বার। আমি কি এখানে আনন্দ নিতে এসেছি?
তখন আমার ভেতর থেকে আরেক আমি আমার শরীর থেকে বের হয়ে এসে বলে, না তুমি এখানে শুধু আনন্দ নিতেই আসোনি।
আমার আরেক আমি তখন আমাকে প্রশ্ন করে, তাহলে তুমি ঠিক কী নিতে এখানে এসেছ?
আমার আরেক আমি তখন আমাকে আরও প্রশ্ন করে, মানুষের কী প্রয়োজন, মানুষ কি তা ঠিক ঠিক বলতে পারে? মানুষ কোথায় কখন যায়, সবকিছু কি সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে?
আমার অন্য আরেক আমি আমাকে প্রশ্ন করে, মানুষের প্রয়োজন যদি জানতেই পারে তাহলে তাদের জীবনে ব্যর্থতা থাকবে কেন?
আমি এই শেষোক্ত প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম। আমি ভেবেছি এই কথার একটা উত্তর দেওয়া যেতে পারে। অন্তত শুরু করলে অন্যান্য প্রশ্নের গভীরেও প্রবেশ করা সম্ভব। কিন্তু শুরু করার আগেই আমার অসংখ্য আমি এসে আমাকে ঘেরাও করে ফেলে। আমি আমার অসংখ্য আমির দিকে তাকিয়ে তাদের দেখি। দেখি এক আমি আমার দিকে চেয়ে আছে টিকই কিন্তু তার মস্তিষ্কের ভেতরে প্রাচীন বিদর্ভ নগরীর ধ্বংসাবশেষের চিত্র। আমার দিকে চেয়ে আছে ঠিকই কিন্তু আমার আরেক আমির মস্তিষ্কে একটি তর্জনি বার বার কী যেন নির্দেশ করছে। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা। আমি দেখছি আমার আরেক আমির মস্তিষ্কে একটি দীর্ঘ তালিকা। সে তালিকায় দেখি সবচেয়ে আলোকিত মানুষের ছবি। সে-ছবিগুলো লক্ষ করে কতিপয় মানুষের মতো দেখতে আজব প্রাণী কী যেন করছে, অমনি ছবিগুলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একজন তখন দরাজ গলায় দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে বলছে, এগুলো কিছুই নয়। এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি। আমি দেখছি আমার আরেক আমির মস্তিষ্কে একটি চলমান দৃশ্য। যে দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে দৌড়াচ্ছে। তার পিছে পিছে অস্ত্র হাতে আরও কয়েক তরুণ। ছেলেটি দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো। অস্ত্রধারীরা একসময় তাকে ধরে ফেলল। ছেলেটি বলল, আমি হিন্দু। আমি আওয়ামী লীগ করি। অস্ত্রধারীদের কানের কিছুই পৌঁছালো না। তাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলল তারা। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ছেলেটির চোখে একটি দৃশ্য ভেসে উঠলো। একাত্তরে বিধবা হয়ে যাওয়া মা ছেলেটির জন্য পান্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে। ছেলেটি বললো অস্ফুট স্বরে আমি বাবার কাছে যাচ্ছি মা। তুমি ভালো থেকো। আমি দেখছি আমার আরেক আমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু তার মস্তিষ্কে একটি বিভীষিকাময় ছবি। দেখা যাচ্ছে একটি সফেদ পাঞ্জাবির ভেতরে একটি নিথর দেহ। সাদা পাঞ্জাবির ডানপাশে রক্তের প্লাবন। সিঁড়িতে পড়ে থাকা সে দেহটিকে ঘিরে সাত কোটি এবং ত্রিশ লাখ মানুষের আহাজারি। সে-আহাজারি আমার ভেতরে এতই তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করল যে আমি রীতিমতো চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
সেই চিৎকারে কী হলো জানি না। পৃথিবীতে কত চিৎকারই তো হচ্ছে যখন তখন। তাতে কার কী হচ্ছে। পৃথিবীর চিৎকারগুলো কি মানুষের কানে পৌঁছাচ্ছে। যদি পৌঁছায় তাহলে যার যা করার তা করছে না কেন? কেন এ সদিচ্ছা মুছে যাচ্ছে দিনকে দিন! আমার চিৎকার বোধ হয় কারও কারও কানে পৌঁছেছিল। আমি তা জানতাম না। আমি বোধহয় অন্য জগতে ছিলাম। এই চিৎকার আমাকে সে জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনলো। আমি যখন সম্বিত ফিরে পেলাম দেখি সাত-আটজন মানুষ আমাকে ঘিরে রয়েছে। একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, ভাইজানের কী শরীল খারাপ?
আমি দেখি আমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা অসংখ্য আমির একটিও নেই। কতিপয় অচেনা লোক আমাকে ঘিরে রয়েছে। তাদের চোখে সহানুভূতির ছায়া। এই বিনোদন কেন্দ্রে বিনোদন নিতে আসা কতিপয় মানুষ। বোধকরি আমার চিৎকার তাদের কাছে পৌঁছেছে। তারা হয়তোবা এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। আমার চিৎকার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমার চিৎকার তাদের কানে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয় আমার চিৎকার তাদের বিবেকের কাছেও পৌঁছেছে। আজকাল চিৎকারগুলো কানে পৌঁছুলেও বিবেকের কাছে পৌঁছে না। তাদের কান ও বিবেক তাদের নিয়ে এসেছে আমার কাছে। তারা ভেবেছে আমি অসুস্থ। তারা ভেবেছে আমার কিছু একটা হয়েছে। কারণ মানুষ এমনি এমনি চিৎকার দেয় না।
যা গরম পড়ছে। ভাই জান পানি খাবেন?
সমস্যা কী। কেউ কিছু করছে না কি। পকেটমার?
আমি তাদের উদ্দেশে বলি, আমি দুঃখিত। আমার কিছু হয়নি। আমি সুস্থ আছি।
একজন বলে, তাহলে চিল্লানি দিলেন ক্যা?
আমি বললাম, হঠাৎ করে পেটে ব্যথা হয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। অসহ্য। আমি আবারও দুঃখিত। আপনাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটিয়েছি আমি।
তারা আর কথা বাড়ালো না। কারণ তারা তো সময় নষ্ট করতে আসেনি। তারা আনন্দ নিতে এসেছে। তাই অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চায়নি। আমার কথার ওপরও তারা আস্থা রেখেছে। আমাকে সাহায্য করতে হবে না ভেবে হয়তো তারা মনে মনে স্বস্থির নিঃশ্বাসও ফেলেছে।
তারা চলে গেলো। তারা তো যাবেই। তাদেও তো চলে যাবারই কথা।
মাঝখানে আমি আমার অন্য আমিগুলোকে আমি হারিয়ে ফেললাম। ওই বিভৎস দৃশ্য দেখে চিৎকার না দিলে হয়তোবা তারা এখনো এখানে থাকতো। ওই বিভৎস দৃশ্য দেখে চিৎকার না দিলে হয়তোবা আরো কিছু আমির উপস্থিতি বাড়তো। ওই বিভৎস্য দৃশ্য দেখে চিৎকার না দিলে হয়তোবা নতুন আমিগুলোর মস্তিষ্ক আরও কিছু ঘটনা ঘটতো। ওই বিভৎস দৃশ্য দিখে চিৎকার না দিলে হয়তোবা আমি আরও কিছু দেখার সুযোগ পেতাম। আমি হয়তোবা তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম। তাদের সঙ্গে কথা বললে আমার এক ধরনের যোগযোগ তৈরি হতো। তাতে তাদের ক্রিয়া সম্পর্কে আমার ধারণা হতো। তাতে তাদের বিক্রিয়া সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হতো। তাতে তাদের মনোভাব সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হতো। তাতে তাদের চিন্তা সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হতো। তাতে তাদের চেতনা সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হতো। তাতে তাদের এইসব দৃশ্য ধারণ সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হতো। হয়তো বা আমি ধারণা পেয়ে যেতাম তাদের এইসব দৃশ্যধারণের করণকৌশলেরও। হয়তোবা আমি ধারণা পেয়ে যেতাম তাদের এইসব দৃশ্য প্রদর্শনের কৌশলেল। হয়তোবা আমি ধারণা পেয়ে যেতাম তাদের চিন্তার আন্তঃসম্পর্ক স্থাপনের কৌশলের। কিন্তু হলো না। আমার অসহিষ্ণু চিৎকার সবকিছু স্থিমিত করে দিলো। আমার অসহিষ্ণু চিৎকার সবকিছু ভণ্ডুল করে দিলো।
এভাবে এভাবে একসময় পায়ে পায়ে চলে আসি ওই জায়গা থেকে।
হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি আরেকটি আনন্দকেন্দ্রে।
ছোট্ট একটা টিকেট কাউন্টারের সামনে বিশাল লাইন। টিকেট কাটছে আর আনন্দ প্রত্যাশীরা আনন্দকেন্দ্রের মূল জায়গাটার ভেতরে প্রবেশ করছে। কী মনে করে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অথচ আমি এই ঘূর্ণি আনন্দ পছন্দ করি না। একবার ঘুরতে না ঘুরতেই বমি শুরু হয়ে যায় আমার। আর এতই অসুস্থ হয়ে যাই যে দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরের কথা বসে থাকতেও পারি না। কিন্তু আমি লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা মানে হলো আমি টিকিট চাই। লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা মানে আমি এই আনন্দটি নিতে চাই। এখন আমার অপেক্ষা কখন লাইনের শেষে দাঁড়ানো এই আমি একটা টিকেট পাব। তারপর নেব আনন্দ ঘূর্ণি। কিন্তু এই আনন্দ ঘূর্ণি তো আমার অসহ্য। কিন্তু আমি কেন এই লাইনে দাঁড়াই! আমি আমার কিছুই বুঝতে পারি না। আমি কি তাহলে আমার ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। বুঝতে পারছি না।
টিকিট দেওয়া বন্ধ হলো। নির্ধারিত সিটের সমসংখ্যক টিকিট বিক্রি হলেই সাময়িকভাবে টিকিট বিক্রি স্থগিত করা হয়। এই পর্ব শেষ হলে আবার টিকিট দেওয়া শুরু হবে। আমি হয়তো বা অর্থহীন অপেক্ষা করি। এছাড়া তো কোনো উপায়ও নেই।। হঠাৎ মনে হলো অন্তত এই ফাঁকে দেখা যাবে আনন্দ গ্রহণ কালে একেক জনের একেকরকম প্রতিক্রিয়া। ঘূর্ণি তখনো শুরু হয়নি। আমার সম্মুখ বরাবর এক দম্পতি এসে দাঁড়ালো। ফলে ঘূর্ণি-অঞ্চল আমার আড়ালে চলে গেলো। আমার সামনে এখত তারা। আমার সামনে তিন সদস্যেও পরিবারটি দাঁড়ানো। আমি তাদেরই দেখতে থাকলাম। চকচকে শার্ট গায়ে ছেলেটির। মাথায় তেল দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ানো। সুন্দর করে শেভ করার চেষ্টা করেছে সে। সদ্য ভাঁজখোলা অতি যত্ন করে তুলে রাখা অল্পদামি প্যান্ট। পকেটে চিরুনির ডাঁট দেখা যাচ্ছে। তরুণি বধূর কোলে আঙুল ধরে থাকা কিছুটা মলিন এক শিশু। সামনে তাকানোর চেষ্টা করছে। তরুণি মা ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কী কী যেন বলতে বলতে হাসতে হাসতে শিশুটির গালে চুমু দিলো। শিশুটি অনেক সুন্দর করে হেসে হেসে হাত পা ছুড়তে লাগলো। একটু একটু করে লাফাতে লাগলো। তরুণি মার ওড়না তখন এলোমেলো হয়ে যায় যায় অবস্থা। শিশুটিকে থামাতে কোনো চেষ্টা না করেই সে তার বাবার কোলে দিতে চাইলো। বাবাও হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো। তরুণি মা তার মলিন ওড়না ঠিকঠাক করে খুব দ্রুত তার এলোমেলো হতে যাওয়া চুলগুলোকে খোপায় বেঁধে ফেললো। ততক্ষণে শো শুরু হয়ে গেছে। চিৎকার হইচই হাসি হাততালি। শিশুটি আরো উত্তেজিত আনন্দে। মাকে ধরে যেন ফেলে দিতে চাইছে। মায়ের জামা ধরে টানছে আনন্দে। মা তাকে এবার কপট ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে করতে তার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। তখন লক্ষ করলাম তরুণীর পোশাক অত্যন্ত শাদামাটা। রং ওঠা দেখেই তাদের গরিবি হাল বোঝা যায়। তবে তার স্বামীটির পোশাক অল্পদামি হলেও নতুন। নতুনের ভাঁজ এখনো যায়নি। হয়তো বা তরুণী বধূ তার সব সুখ -আহ্লাদ স্বামীর মাঝেই পেতে চেয়েছে। আহা ভালোবাসা!
আমি লাইন থেকে সরে তাদের কাছে গেলাম। আমি জানি এখানে অত কার্টেসি না দেখালেও চলবে। তাই সরাসরি বলে ফেললাম, এখান থেকে দেখলে তো মজা পাবেন না। টিকিট কেটে উঠুন। আপনাদের বেবি খুব খুশি হবে।
ছেলেটি একটু হকচকিত হয়ে গেছে মনে হলো। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। তারপার বললো, আমাদের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে।
তার সরলীপনা আমাকে মুগ্ধ করলো। আজকাল সবকিছু এতই জটিল হয়ে গেছে যে সারল্য প্রায় নেই বললেই চলে।
আমি একটুও দেরি না করে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি টিকিট কেটে দেই? তরুণটির চোখে মুখে তখনো হকচকিত ভাব। শ্যামলা রঙের লম্বাটে মুখের ভেতর থেকে ঝকঝকে দাঁতের হাসি আর একরাশ উচ্ছলতা নিয়ে বললো, না না লাগবে না।
এরপর তো আর কিছু বলা যায় না। আমি লাইনে এসে দাঁড়ালাম। অনেক উচ্চস্বরে গান বাজছে। আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন ধন্য করো, এ জীবন ধন্য করো…
চলবে…
মিথ্যামানব: ৯ম পর্ব ॥ এমরান কবির