॥পর্ব-১৮॥
হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার মানুষের সন্ধান পেলাম। দল বেঁধে কতিপয় রমণী হেঁটে চলছে। শাড়ি জড়িয়েছে তারা গায়ে। তাদের শরীরে সেলাইযুক্ত কোনো বস্ত্র নেই। ফলত কোমরের বাঁক কিংবা বুকের অলিগলি কিংবা শরীরের মোহন অংশগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা নির্বকার চিত্তে হেঁটে যাচ্ছে। প্রত্যেকের কোমরে বেতের তৈরি ডালা।
তারা নির্বকার পাশ কেটে যাচ্ছে। এমত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং তাদের পোশাকের এহেন অবস্থা আমার ভেতরে এক ধরনের সঙ্কোচ সৃষ্টি করেছে। ফলে তাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছে জাগাতে পারছি না নিজের ভেতরে। এক দল রমণী অতিক্রম করে চলে যায়, দেখা যায় আরেক দল রমণী একইভাবে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের পোশাক আগের রমণী দলের মতোই। তাদের কোমরে যথারীতি বেতের তৈরি ডালা। ডালার ভেতরে যেন কী!
একসময় মনে হলো তাদের ডালার ভেতরে কী আমার জানা দরকার। রমণীদলকে অতিক্রম করার সময় তাই সন্তর্পণে ডালার দিকে চোখ রাখবার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। পারি না কারণ আমার চোখ ওই রমণীর কোমরের বাঁকে গিয়ে থেমে যায়। সেই চোখ যখন ডালার দিকে নিবদ্ধ করতে চাই ততক্ষণ তারা আমাকে অতিক্রম করে চলে যায়।
আমি এই প্রচেষ্টা পরবর্তী রমণীদলের ওপরও প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু বার বার একই ফল ঘটতে থাকে। এভাবে কতবার কতগুলো রমণী দলের কোমরের ডালার দিকে আমার কৌতূহল প্রয়োগ করেছি বলতে পারি না। এভাবে কতগুলো রমণীদল আমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেছে বলতে পারি না।
এরপর দেখি একজন একাকী রমণী আসছে। তার বেশও আগের রমণী দলের মতোই। আমি এবার স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। আগের কোনো রমণী আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি। এই প্রথম একজন রমণী আমার দিকে তাকালো। এবং এমন এক অভিব্যক্তি প্রকাশ করল যেন আমি ভূত। যেন আমি মানুষ নই। যেন আমি অন্যকিছু।
সে থামল। তার বাম হাত ডালায়। ডান হাত কোমরে। সে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলল। আমি শুনেও শুনতে পারলাম না। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। সে আবারো কিছু একটা বলল। এবার আমি তার কথা শুনতে পারলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। বুঝলাম সে যে ভাষায় কথা বলছে সে-ভাষা আমি জানি না। সে হাত উঁচিয়ে আমাকে কিছু একটা বলল আবারো। আমি তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম, কী বলছেন আপনি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এবার সে আরও অবাক হলো। হাত উঁচিয়ে আবারও কী যেন বললো। আমি আগের কথাই বললাম আবার। তার অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলাম না।
তখন বুঝতে পারলাম আমি তার কথা বুঝতে পারছি না যেমন, তিনিও আমার কতা বুঝতে পারছেন না। নতুন এক মুশকিলে পড়ে গেলাম। এই অজ্ঞাত ভাষা দিয়ে কিভাবে তাদের সাথে আমি যোগাযোগ করব। কিভাবে এখান থেকে বের হয়ে যাবার উপায় বের করব। কিভাবে আমার কৌতূহল মেটাবো। কিভাবে পাব আমার জিজ্ঞাসার জবাব।
সে আমার দিকে এগিয়ে এলো এবার। একটু হেলে পায়ের কাছে মাটিতে ডালা রাখল। শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে সে আবারো আমাকে কী যেন বলল। আমি তো এতক্ষণে বুঝে ফেলেছি এই অজ্ঞাত ভাষা দিয়ে তার সাথে কোনো ভাব বিনময় অসম্ভব। আমি নিরুপায়।
আমি এবার তার ডালার দিকে তাকালাম। দেখি এক ফুটফুটে শিশুর ছিন্ন মাথা।
আমি আর দাঁড়ালাম না। বুকের ভেতরে মোচর দিয়ে উঠেছে। এরকম এক ফুটফুটে শিশুর ছিন্ন মাথা নিয়ে ভাবলেশহীন রমণী হেঁটে যেতে পারে! ভাবতেই কেমন লাগছে। তাহলে কি আগের রমণীকুলের প্রত্যেকের ডালায় ছিল এরকম এক একটি শিশুর ছিন্ন মাথা! উফ!
আমি হাঁটতে শুরু করেছি। পেছন থেকে রমণীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আমি একবার থেমে পেছনে ফিরে তাকালাম। সে বেঁতের ডালাটি কোমরে তুলে নিয়েছ। এবার সে একটি শব্দই উচ্চারণ করছে। উজুবট। উজুবট।
আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আর ভাবতে থাকলাম। এই শব্দটিকে আমি চিনি। এটা আমি যেন কোথায় শুনেছি। কিছুদূর হাঁটার পরই মনে পড়ল এটা একটা গ্রামের নাম। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে এই গ্রামের কথা উল্ল্রেখ আছে। এই রমণী এই নাম উচ্চারণ করার কারণ কী হতে পারে। সে যে গ্রাম থেকে এসেছে সে গ্রামের নাম উজুবট! নাকি সে যে গ্রামে যাচ্ছে যে গ্রামের নাম উজুবট? না কি এই কোমরে ডালার ঘটনা যেখানে ঘটছে সে গ্রামের নাম উজুবট? আমি শুধু এরকম ভাবতেই পারি। কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট করতে পারি না।
একবার ভাবলাম এই রমণী দলের পেছনে পেছনে যাই। তারা যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব। তাতে দুটি কাজ হবে। এক, তারা যেহেতু মানুষ সেহেতু তারা কোনো না কোনো মানুষালয়ে যাচ্ছে। এতে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত হবে। দুই, তাদের এহেন পরিস্থিতির কারণটা জানা যাবে। বিশেষ করে তাদের প্রত্যেকের কাছে শিশুর ছিন্ন মাথার কারণটি।
কিন্তু পরক্ষণেই অন্য চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল। আমি তো তাদের ভাষা বুঝতে পারছি না। ফলে তাদের সাথে আমার ভাষিক যোগাযোগ হবে না। দুই, নতুন কোনো বিড়ম্বনায় পড়ে যাই কি-না। উপরন্ত আমি ওই পথ দিয়েই এদিকে এসেছি। বাঘের ধাওয়া খেয়ে এসেছি। সুতরাং সে-দিকে আবারও যাওয়া ঠিক হবে কি না।
এসব ভাবতে ভাবতে আমি ঠিক করলাম ওদের সাথে আমি যাব না। তারা যেরকম ধীরস্থিরভাবে হেঁটে যাচ্ছে তাতে তাদের যাত্রারম্ভের স্থান অনিরাপদ বা বিপদসংকুল ছিল বলে মনে হয় না। তাদের একটুও পলায়নপর মনে হয়নি। তাদের ভেতরে কেনো সন্ত্রস্ত ভাব ছিল না। তারা তো রীতিমতো নির্বিকার। নিশ্চিন্ত মনে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে যাচ্ছে যেন।
আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ওই বিশাল বৃক্ষের নিকটে পৌছে গেলাম। ও মা! এপাড়ে তো বিশাল নদী। এত বিশাল নদী! কী স্বচ্ছ তার জল! কী ছন্দময় তার ঢেউ! ওপাড়ের কোনো কিনারা নেই। শত শত নৌকা চলছে। বিচিত্র সে-সব। গাছটির গোড়া থেকে ঢাল বেয়ে কিছুদূর হাঁটলেই পানি ছোঁয়া যায়। শিকড়গুলো বের হওয়া। শিকড়গুলোকেও ডাল বলে ভ্রম হয়। যেন এ বৃক্ষের মাঝখানে গোড়ালী। উপরে নিচে ডাল পালা। শিকড়গুলো এমন মসৃন হয়ে এদিক সেদিক গেছে যে খুব আরাম করে শুয়ে এই নদীর জল-বাতাস-ইশারা উপভোগ করা যায়।
আমি গাছের গোড়ালিতে হেলান দিয়ে বসলাম। মুহূর্তেই আমি যেন সবকিছু ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম আশিকের কথা। ভুলে গেলাম রক্তের ঢেউয়ের কথা। ভুলে গেলাম জোসনা বিধৌত চরাচরের কথা। ভুলে গেলাম সাবেক কর্নেলের কথা। ভুলে গেলাম সাবেক মেজর জেনারেলের কথা। ভুলে গেলাম সাপের গ্রাস থেকে মুক্ত করে দেয়া ওই শিশুটির কথা। যে-শিশুটির জন্য আশিকের অনেক হাহাকার ছিল। ভুলে গেলাম চোখ পা-ুর হয়ে নিথর হয়ে যাওয়া কিশোরের কথা। ভুলে গেলাম দুর্বা ঘাসের সুবাসের কথা। ভুলে গেলাম ধান ক্ষেতের সোনালী ঢেউয়ের কথা। ভুলে গেলাম বাঘের কথা। ভুলে গেলাম শত কুঠুরির ভবনটার কথা। ভুলে গেলাম শিশুর ছিন্ন মাথা নিয়ে যাওয়া রমণীদলের কথা।
আমি বোধহয় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে, জানি না। নদীর কুলুকুলু ধ্বনি এবং হিমেল বাতাস আমাকে বোধহয় তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তুলেছিল। আমি চোখ খুললাম একসময়। দেখি, এক বাঁদর খুব বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠল! হায় হায় নতুন কোনা ঝামেলায় পড়ে গেলাম না-কি। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আমি উঠে বসলাম। বাঁদর একটা খিস্তি করল। তারপর লেজ উঁচিয়ে ভোঁ দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি একটু স্বস্থি পেলাম। কিন্তু মনের ভেতরে আরেকটি আশঙ্কাও দেখা দিলো। বাঁদর তো একা থাকার কথা নয়। তারা তো সংঘবদ্ধ। তার মানে আশে পাশে কি আরো বাঁদর আছে! তাদের ভেতরে তো ভীষণ একতা।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম নদীর পাড় ধরে একটু হাঁটি। তারপর এখান থেকে বের হবার একটা পথ বের করা যাবে। যেহেতু নদী। যেহেতু নদীর পাড়। যেহেতু নৌকা দেখা যাচ্ছে। কেউ না কেউ এখানে নোঙর ভিড়বেই। তখন একটা কুল কিনারা করা যাবে। আমি খুব আশাবাদী হয়ে উঠলাম।
কিছু দূর হেঁটেছি মাত্র। দেখি কয়েকশ বাঁদর, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন সাইজের, দৌড়ে দৌড়ে আমার দিকে আসছে। কী হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। এরা যদি একযোগে আক্রমণ করে বসে আমার উপর তাহলে তো এখানেই শেষ। মনুষ্যরূপী জানোয়ারদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি। বাঘের কবল থেকে নিজেকে বাঁচতে পেরেছি। শেষ মেশ বাঁদরের হাতে প্রাণটা দিতে হবে! এখান থেকে পালানোর কোনো পথই নেই। কারণ তারা তিন দিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। একদিকে তো নদী। নদীতে লাফ দিয়ে লাভ হবে না।
বিচিত্র শব্দ করতে করতে দৌড়ে এসে বাঁদরগুলো আমাকে ঘিরে ফেলল। আমি আতঙ্কিত দৃষ্টি দিয়ে তাদেরকে দেখছি। কত রকম বাঁদর থাকতে পারে আল্লার দুনিয়ায়। তারা আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। তাদের ভেতরে কয়েকজন বিচিত্র শব্দ করল। অমনি একটি বাঁদর দ্রুত বেগে এসে আমার মাথার ওপরে উঠে বসল। আমি তো ভয়ে বসে পড়লাম। আমি জানি প্রাণীদের ভেতরে রণণীতি মানা হয়। আমি হাত জোড় করলাম। দুই হাত ওপরে তুললাম। তখন আবার কয়েকটি বাঁদর বিচিত্র শব্দ করল। অমনি আরো কয়েকটি বাঁদর এসে কেউ আমার হাত ধরল কেউ আমার পা ধরল এবং আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করল।
একটি বড় বাঁদর চিৎকারের ভঙ্গিতে বিচিত্র শব্দ করল। অমনি বাঁদরগুলো আমাকে ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দিয়ে অন্য বাঁদরগুলোর কাতারে চলে গেল। বড় সাইজের বাঁদরটি আরো বিচিত্র শব্দ করতে লাগলো। আমি বললাম, আমার কী অপরাধ আমি জানি না। তবু আমাকে ক্ষমা করুন। আমি হাত জোড় করলাম।
দেখলাম বাঁদরগুলোর চোখমুখ খুশিতে উজ্জল হয়ে উঠল। বড় সাইজের বাঁদরটি যাকে এতক্ষণে আমার কাছে নেতা গোত্রীয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে স্পষ্ট বাংলায় বলল, এ তো দেখি বাংলা বোঝে।
আমি বড় একটা ধাক্কা খেলাম। বাঁদরগুলো বাংলায় কথা বলছে! আমি বাংলা বলাতেই তাহলে তাদের চোখে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল! এদের ভেতরেও দেখি বাংলা প্রীতি আছে! বিচিত্র।
নেতা গোত্রীয় বাঁদর এগিয়ে এলো আমার দিকে। বলল, তুমি আমাদের সাথে চলো। কোনো বাড়তি কথা বলবে না। যা বলব তাই শুনবে।
এরপর নেতা গোত্রীয় বাঁদর অন্য বাঁদরদের উদ্দেশে বিচিত্র কিছু শব্দ করল। বাঁদরগুলো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করল।
চলবে…
মিথ্যামানব: পর্ব-১৭॥ এমরান কবির